হিন্দুত্বের ক্রোনোলজি ও স্বাতন্ত্র্যবীর সাভারকার : একাদশ কিস্তি


  • July 14, 2020
  • (0 Comments)
  • 2341 Views

বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’ তত্ত্বের উপর গড়ে উঠেছে আজকের আরএসএস-বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতি। গোহত্যা, জাতিভেদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে সাভারকারের মত থেকে বর্তমান মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শাসকশক্তি আজ অনেকটাই সরে এসেছে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব আসলে একদিকে সাভারকার আর অন্যদিকে হেডগেওয়ার আর গোলওয়াকারের ধর্মভাবনার এক খিচুড়ি তত্ত্ব। এই প্রেক্ষিতে সাভারকারের মতবাদ ও জীবন নিয়ে কয়েকটি কিস্তিতে দীর্ঘ আলোচনা রাখলেন পার্থ প্রতিম মৈত্র

 

প্রথম কিস্তি : গো-পূজন বিরোধিতা ও বর্তমান স্বীকৃতি পর্ব  

দ্বিতীয় কিস্তি : স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নির্বাচনী পরাজয় পর্ব

তৃতীয় কিস্তি : হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব পর্ব 

চতুর্থ কিস্তি : হিন্দু উত্থান ও নির্বাচনী বিজয় পর্ব 

পঞ্চম কিস্তি : কংগ্রেস রাজনীতি ও সাম্প্রতিক সাভারকার পুনর্বাসন পর্ব 

ষষ্ঠ কিস্তি : হিন্দুরাষ্ট্রের তত্ত্বনির্মাণ পর্ব 

সপ্তম কিস্তি : বিবেকানন্দ, হিন্দুত্ব ও দেশভাগ পর্ব 

অষ্টম কিস্তি : হিন্দু রাষ্ট্র ও ঘৃণার রাজনীতি পর্ব 

নবম কিস্তি : ধর্ম ও রাজনীতির ককটেল পর্ব 

দশম কিস্তি : হিংস্র হিন্দুত্ব, স্টেইনস, পুনর্ধর্মান্তরকরণ পর্ব 

 

একাদশ কিস্তি : নাগরিকত্ব, বিদেশী ও চিহ্নিতকরণ পর্ব

 

সাভারকার এবং তাঁর অনুগামীরা আসামের ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন প্রদর্শন করে দেখান যে ১৯৪১ সাল নাগাদ, পূর্ববাংলার মুসলমানরা যখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অস্বাভাবিকভাবে প্রচুর সংখ্যায় স্থানান্তরিত হতে শুরু করেছিল, তখন আসামের বাইরের প্রথম নেতা হিসাবে সাভারকারই প্রথম  সতর্ক করেছিলেন যে এই আগমন ভবিষ্যতে অসমিয়া সংস্কৃতি এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তকে হুমকির সম্মুখীন করবে। এর জবাবে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, “প্রকৃতিতে, যেখানে খোলা জায়গা আছে সেখানে মানুষের বসতি স্থাপন করতে বাধা দেওয়া যেতে পারে কীভাবে?” সাভারকর একটি দ্রুত রিপোস্ট জারি করেছিলেন: পন্ডিত নেহেরুর পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান খুব দুর্বল। প্রকৃতি বিষাক্ত গ্যাসকে ঘৃণা করে। সাভারকরের তত্ত্ব আজ সারা ভারতবর্ষব্যাপী জাতীয় নাগরিকপঞ্জী আর নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিধি ২০১৯-র মাধ্যমে সারা দেশে ধর্মীয় বিভাজন এনে ধর্মনিরপেক্ষতা আর বিদেশী বিতাড়ণের নামে দেশকে উত্তাল করে তুলেছে। সাভারকারের হিসেবে ১৯৪১ সালে আসামের মুসলমান জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১০%। বর্তমানে এটি ৩৫%। তবে একই সাথে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে হিন্দু রাষ্ট্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুবাদের নামে অন্য একটি জাতি গঠনের অনুমতি দেবে না। তাঁর মতে, এজাতীয় নমনীয়তাই একশ বছর ধরে মুসলিম তোষণের মাধ্যমে প্রথমে দেশকে পার্টিশনের দিকে পরিচালিত করেছিল এবং তারপরে ভারতকে সত্যিকার অর্থে এক জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে বাধা দিয়েছিল। সাভারকারের দর্শন অনুসারে কংগ্রেস মুসলিম তোষণে জড়িত না হলে ভারতের বিভাজন রোধ করা যেত।

 

এখানে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিধি ২০১৯ বা সি.এ.এ-র পশ্চাদপটটি একবার খতিয়ে দেখা যাক। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে গৃহদপ্তর ৭.৯.২০১৫ তারিখে দুটি নোটিফিকেশন জারি করে। অফিশিয়াল গেজেটে ১৯২০ সালের পাসপোর্ট অ্যাক্ট (ভারতে প্রবেশ) এবং ১৯৪৬ সালের ফরেনার্স অ্যাক্টে এই নোটিফিকেশান অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহমন্ত্রক ঘোষণা করছে যে, মানবিক বিবেচনার খাতিরে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু নাগরিক (অর্থাৎ মুসলিম বাদ দিয়ে অন্য সব ধর্মাবলম্বী, বিশেষত হিন্দুরা), যারা ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর অথবা তার আগে পাসপোর্ট বা সমজাতীয় বৈধ ভ্রমণপত্র অথবা বৈধ নথি নিয়ে (কিন্তু যার বৈধতা অতিক্রান্ত হয়েছে) ভারতে প্রবেশ করেছে, এবং যারা অনুমোদন ব্যতিরেকেই প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে, তারা ১৯২০ সালের পাসপোর্ট অ্যাক্ট (ভারতে প্রবেশ) এবং ১৯৪৬ সালের ফরেনার্স অ্যাক্টের প্রাসঙ্গিক নির্দেশাবলী ও নিয়মাবলীর আওতামুক্ত থাকবেন। কিন্তু একটি নয়, নাগরিকত্ব নিয়ে ভারতবর্ষে দুটি প্রক্রিয়া একসঙ্গে চালু হতে চলেছে। প্রথমটি ‘নাগরিকপঞ্জী নির্মাণ’ এবং অন্যটি ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল’। পরস্পরবিরোধী এই প্রক্রিয়া দুটির কোনটা কাদের জন্য? প্রথমটি তথাকথিত বাংলাদেশীদের নাম বাদ দিয়ে প্রকৃত ভারতীয়দের নামের তালিকা প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়টি মুসলমান নাম বাদ দিয়ে বৃহত্তর হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্বের তালিকাভুক্ত করা। দুটিই আসলে প্রকট গণবিভাজন প্রক্রিয়া। ‘নাগরিকপঞ্জী নির্মাণ’ মূলতঃ ভারতীয় এবং বাংলাদেশীর বিভাজন। ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল’ বৃহত্তর হিন্দু বনাম মুসলমান ধর্মের বিভাজন। এ দেশের সংবিধানের ‘আর্টিকল-১৪’ জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভিত্তিক যেকোনো ধরণের বৈষম্যকে প্রতিহত করে। এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকেই ধ্বংস করে দিল। কাকতালীয় নয় যে, সাভারকারের ‘পয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ আসামেই “নাগরিকপঞ্জী নির্মাণ” (এন.আর.সি) প্রক্রিয়ায় উনিশ লক্ষ ছয় হাজার সাতান্ন জন মানুষকে বিদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিজেপির দূরবর্তী কল্পনায় এইভাবে ফিল্টারিং করে মুসলমানদের আলাদা করে ফেলে তাদের সাভারকার কল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হবে। তালিকাচ্যূতদের মধ্যে যারা হিন্দু তাদের ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল’ (সিএএ) এর মাধ্যমে নাগরিকত্বে পুনর্বাসিত করা হবে। কেউ কেউ একটা অদ্ভূত প্রশ্ন শুরু করেছেন। সিএএ এলে হিন্দুদের লাভ হবে বটে, কিন্তু মুসলিমদের তো ক্ষতি হবে না। এই প্রকাশ্য, হৃদয়হীন, স্বার্থান্ধ, নৃশংস বিভাজনে ভারতবর্ষ আড়াআড়ি ভাঙবে। যে ক্ষত সৃষ্টি হবে আগামী একশ বছরেও সে ঘা শুকাবে না। ভারত ক্যা-উত্তর যুগে ঢুকে পড়ছে। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে যে ভারতবর্ষে হিন্দুত্ববাদীদের সবচাইতে বড় অবদান কী? আমি বলবো এক হৃদয়হীন, স্বার্থান্ধ, নৃশংস রাজনৈতিক মানসিকতায় ভারতবাসীকে বেঁধে ফেলা। লিঙ্গ পরিবর্তন করে পিতৃভূ হচ্ছে আমাদের ভারতবর্ষ।

 

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাস হওয়ার পরে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়। এই বিভাজনটি পুরোপুরি একটি অবাঞ্ছিত ঘটনা ছিল, যা এই দুই দেশের শরণার্থী সঙ্কটের কারণ হিসাবে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন লোককে বাস্তুচ্যুত করেছিল। একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে জিন্নাই পাকিস্তানের জন্য চাপ দিয়েছিলেন এবং তিনি দেশকে নিজ ধর্মের ধারায় বিভক্ত করেছিলেন। অন্যদিকে কংগ্রেস এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেছে যে বীর সাভারকর দ্বি-দেশ তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন যার ভিত্তিতে দেশটি বিভক্ত হয়েছিল। মনে রাখতে হবে ১৮৮৩ সালে তাঁর বক্তৃতায়, জিন্না বলেছিলেন, “বন্ধুরা, ভারতে দুটি বিশিষ্ট জাতি রয়েছে যা হিন্দু এবং মুসুলমানদের নাম দ্বারা পৃথক। একজন মানুষের যেমন কিছু প্রধান অঙ্গ থাকে তেমনি এই দুটি জাতিই ভারতের প্রধান অঙ্গগুলির মতো।” হিন্দু মহাসভার মতো রাজনৈতিক দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে, সাভারকর হিন্দু রাষ্ট্র (হিন্দু জাতি) হিসাবে ভারতবর্ষের ধারণাকে সমর্থন করেছিলেন। এবং ১৯৪২ সালের কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ভারতের বিভাজনকে মেনে নেওয়ার তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন।

 

সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপির আরএসএস-এর মোহন ভাগবত রাম মাধব থেকে শুরু করে বিজেপি অমিত শাহ পর্যন্ত বারবার বোঝাতে চেষ্টা করেছেন এনআরসি এবং সিএএ সম্পর্কিত বিষয়ে প্রথমে ক্রোনোলজি বুঝতে হবে। ক্রোনোলজির বুৎপত্তি বুঝতে আমরা যে ভুলটি করেছিলাম, তা হল এনআরসি এবং সিএএ-র মধ্যে কোনটি আগে হবে কোনটি পরে, এই বিষয়ে বোধগম্যতা। পাল্টে যাওয়া ক্রোনোলজি বুঝতে হবে, এই কথাটার মানে আমরা ভেবেছিলাম আসাম এর ক্ষেত্রে যেমন প্রথমে এনআরসি এবং পরে নাগরিকত্ব বিল আনা হয়েছিল, সারা ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সেটি পাল্টে প্রথমে নাগরিকত্ব বিল এবং পরে এনআরসি আনা হবে। আমরা বুঝতে পারিনি, বা বুঝতে ভুল করেছিলাম যে, ক্রোনোলজি বুঝতে শুরু করতে হবে সেই ১৯২৩ সাল থেকে। সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’ নামক বইটি রচনা কালের সময় থেকে। ১৯৮০ সালে ভারতীয় জনসংঘের সদস্যরা অটল বিহারী বাজপেয়ীর সভাপতিত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ এই তিন বছরেই বাজপেয়ীর মুখোশ উন্মোচিত হলো। এই সময়বৃত্তেই আসামে বিদেশী সমস্যাকে একটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যু করে দেওয়া হয়। আসামের বিদেশী বিতাড়ণের উত্তাল আন্দোলনের দাবীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদে জারি হল আইএম(ডিটি) ১৯৮৩ নামে ইল্লিগাল মাইগ্রেশন (ডিটারমিনেশন বাই ট্রাইবুনাল) ১৯৮৩, যে আইনে বিদেশী চিহ্নিত করার জন্য ট্রাইবুনাল গঠন করা হলো। শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে হাজার হাজার মানুষকে বিদেশী চিহ্নিত করে তাদের নো-ম্যানস-ল্যাণ্ডে ছেড়ে দেওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। সমসময়ে ১৯৮৩ সালেই আসাম বিধানসভা ভোটে যাচ্ছিল। অটল বিহারী বাজপেয়ী তখন কংগ্রেস বিরোধী বিদেশী বিতাড়ন ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির গল্পের প্রধান চরিত্র। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেলির গণহত্যার ঘটনা ঘটে। নেলি আসামের মরিগাঁও জেলায় অবস্থিত। দাঙ্গায় ২ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। প্রায় সবাই বাঙালি মুসলমান। আসাম সেসময় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং বাজপেয়ী বিজেপি সভাপতি হিসাবে রাজ্যে প্রচার চালাচ্ছিলেন। ১৯৮০ সালে জনতা পার্টি ভেঙে গিয়ে যখন বিজেপির সৃষ্টি হল, তখন বিজেপির প্রধানমন্ত্রিত্বের মুখ হিসেবে সামনে নিয়ে আসা হল ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’, ‘মধ্যপন্থী, উদারমনস্ক এবং পরিশীলিত এমন একজনকে, যিনি সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলতে সক্ষম। আরএসএস-এর মতাদর্শিক কে এন গোবিন্দাচার্য অটল বিহারী বাজপেয়ীকে দলের মুখোশ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন, যে অপরাধে তাঁকে দলের মধ্যে আভ্যন্তরীণ নির্বাসনে চলে যেতে হয়।

 

বাজপেয়ী যখন পুরো মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনিই প্রথম নাগরিকত্ব আইন সংশোধনীর সুবিধা চিহ্নিত করেছিলেন। তিনিই, ২০০৩ সালে এই আইনটি এমনভাবে সংশোধন করেছিলেন, যেখানে তিনি বহু পুরোনো নাগরিকত্বের জুস সোলি-কে (দেশের ভূখণ্ডে জন্মের অধিকারের জন্য নাগরিকত্ব) থেকে জুস সাঙ্গুইনিস (রক্তের সম্পর্কে নাগরিকত্ব) এ পরিবর্তন করেছিলেন। মনে করে দেখুন সাভারকারের হিন্দুত্বের শর্তে প্রথমদিকে ভৌগোলিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও পরে রক্তের সম্পর্ককেই প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। ২০০৩ সালে আইনটির সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ধারা ২ (খ)-এর মধ্যে ‘অবৈধ অভিবাসী ‘বিদেশী নাগরিক, যিনি ভারতে প্রবেশ করেছেন –

(১) কোনও বৈধ পাসপোর্ট বা অন্যান্য ভ্রমণ নথি এবং এ সম্পর্কিত কোনও আইন দ্বারা নির্ধারিত কোনও ডকুমেন্ট বা অনুমতি ছাড়াই,; অথবা
(২) বৈধ পাসপোর্ট বা অন্যান্য ভ্রমণ নথি এবং এ সম্পর্কিত কোনও আইন দ্বারা নির্ধারিত কোনও ডকুমেন্ট বা অনুমতি সহ, কিন্তু নির্ধারিত অনুমতিপ্রাপ্ত সময়ের বাইরেও সেখানে থেকে গেছেন;

 

বিভাগ ৩. প্রত্যেক ব্যক্তি যিনি ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন –

(ক) ১৯৫০ সালের জানুয়ারীর ২৬ তম দিন বা তার পরে, তবে ১৯৮৭ সালের জুলাইয়ের প্রথম দিনে;

(খ) ১৯৮৭ সালের জুলাইয়ের প্রথম দিন বা তার পরে, তবে নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন, ২০০৩ শুরুর আগে এবং যার বাবা-মা কেউ তাঁর জন্মের সময় ভারতের নাগরিক ছিলেন;

(গ) সিএএ, ২০০৩ শুরু হওয়ার সময় বা তার পরে, যেখানে –

(১) তাঁর বাবা-মা উভয়ই ভারতের নাগরিক; অথবা
২) যার পিতা-মাতার একজন ভারতের নাগরিক এবং অন্যজন তাঁর জন্মের সময় অবৈধ অভিবাসী নন, তিনি জন্মগতভাবে ভারতের নাগরিক হতে পারবেন।

 

সাম্প্রতিককালে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন যে ২০১৯ সালে নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন, ২০১৯ তৈরি করা হয়েছে কারণ কংগ্রেস ধর্মভিত্তিক বিভাজনের বিষয়ে একমত হয়েছিল এবং এখন এই সংশোধনীর মাধ্যমে তাঁরা অত্যাচারিত পাকিস্তান বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের হিন্দুদের উপর ঘটে যাওয়া অতীতের ভুলগুলি সংশোধন করার লক্ষ্য নিয়েছে। হিন্দু, জৈন, শিখ, বৌদ্ধ, পার্সি ধর্মের সমালোচকরা ঐ তিনটি দেশের পশ্চাদপট এবং তাদের পিছনের উদ্দেশ্যগুলি সংজ্ঞায়িত করছে এই সংশোধিত আইনের মাধ্যমে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একটি প্রিয় লাইন হ’ল সংবেদনশীল  “এক ঐতিহাসিক ভুলের সংশোধন”।

 

সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকদের উদ্দেশ্যে মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার স্পষ্ট সতর্কতা জারী করেছিলেন, যে হিন্দুস্তানের বিদেশী জাতিদের (পড়ুন মুসলিম ও খৃস্টান) হিন্দু সংস্কৃতি এবং ভাষা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দুধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে শিখতে হবে, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির গৌরব অর্জন ছাড়া আর কোনও ধারণা গ্রহণ করা চলবে না। তাঁরা এই দেশে থাকতে পারেন পুরোপুরি হিন্দু জাতির অধীনস্থ হয়ে, কোন কিছুই দাবি না করে, কোনও সুযোগ-সুবিধার দাবি না রেখে। এমনকি নাগরিকের অধিকারও তাদের প্রাপ্য নয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় যে ক্রোনোলজি আসলে শুরু হচ্ছে ১৯২৩ সালেরও আগের থেকে। একটু একটু করে পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে বর্তমানে হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের বিপক্ষে সব বাধাগুলিকে অতিক্রম করে, মুসলিমদের মার্জিনালাইজড করে ফেলে, তাদের অনাগরিকে পরিণত করে ফেলার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ প্রায়। আসামে নাগরিকত্ববিহীন এনআরসি-ছুট প্রায় উনিশ লক্ষ মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র মুসলিমদের ফিল্টারড আউট করে ফেলা হচ্ছে। তাদের নব্য ক্রীতদাস শ্রেণী হিসাবে কাজে লাগানো হবে। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে প্রক্রিয়াটি চালু হলে সংখ্যাটি দাঁড়াবে প্রায় দু কোটি। যদিও আসামে দেখা গেছে প্রচুর পরিমানে অমুসলিম জনতা, যাদের বিপুল অংশ হিন্দুও এনআরসি থেকে বাদ পড়ে গেছে। তবে সেটা কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসাবেই ধরে নেওয়া হয়েছে।

 

সাভারকার তাঁর পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমির প্রেক্ষাপটে এনআরসি সম্পর্কে কী ভাবতেন? তিনি মুসলমানদের ভারতীয়ত্বের ধারণা থেকে বাদ দিয়েছিলেন এবং খ্রিস্টানদের প্রতি তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিলেন। এনআরসি আসলে ধর্মনির্ভর নয়, নথিনির্ভর নাগরিকত্ব। সাভারকর হিন্দুধর্ম, জৈনধর্ম, শিখধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মকে অভিন্ন হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। সিএএ-কে যদিও বলা হচ্ছে ধর্ম‌নির্ভর নাগরিকত্ব, প্রকৃত প্রস্তাবে কিন্তু তাও নথিনির্ভর। সাভারকার ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ (হিন্দু জাতি) দৃষ্টিভঙ্গিকে “অখণ্ড ভারত” (সংযুক্ত ভারত) হিসাবে রূপরেখা দিয়েছিলেন, যা পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়েই প্রসারিত। তিনি হিন্দুদের আর্য বা দ্রাবিড় না বলেই সংজ্ঞায়িত করেছিলেন – “যারা একটি সাধারণ মাতৃভূমির সন্তান হিসাবে বাস করে, এবং একটি সাধারণ পবিত্রভূমির উপাসনা করে।” সাভারকার হিন্দুত্বের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রবক্তা হিসাবে বিবেচিত। তিনি ভারতীয়ত্বে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ এবং জৈনদের অন্তর্ভূক্ত করে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের বাদ দিয়েছিলেন। সাভারকারের উত্তরসূরীরা প্রতিশোধ এবং হিংস্রতাতাড়িত হয়ে এক এক করে মুসলিমদের সমস্ত অধিকার কেড়ে নেবার ব্রতে ব্রতী। কাশ্মীর লকডাউন, ৩৭০ ধারা  বিলোপ থেকে শুরু করে, শুধুমাত্র মুসলিমদের সিএএ-র আওতার বাইরে রাখা – এসবই হিন্দুত্বের ধ্বজা ওড়ানো, হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে দৃপ্ত পদক্ষেপ।

 

দ্বাদশ কিস্তি : হিন্দু অর্থশাস্ত্র ও সঙ্ঘপরিবারের বিজয় পর্ব 

 

গ্রন্থসূত্র ও তথ্য সূত্র:

  1. The Origins of Religious Violence : An Asian Perspectiveby Nicholas F. Gier
  2. Who is Hindu?by V.D. Savarkar
  3. The Hindu Mahasabha and the Indian National Congress, 1915 to 1926, by Richard  Gordon
  4. The Gandhian Confusion by D. Savarkar
  5. Hindu Rastro Darshan D. Savarkar
  6. Country First? Vinayak Damodar Savarkar (1883–1966) and the Writing of Essentials of Hindutva, by Janaki Bakhle
  7. Third Way by Dattopant Thengadi
  8. Savarkar: Echoes from a Forgotten Past, by Sampath, Vikram.
  9. The Brotherhood in Saffron: The Rashtriya Swayamsevak Sangh and Hindu Revivalism, by Walter Anderson & Shridhar D. Damle
  10. Marathi – Gandhi Hatya Abhiyogatil Savarkaranche Nivedan
  11. Economic Thoughts of Swami Vivekananda by Sebak Kumar Jana
  12. Bunch of Thoughts by Golwalkar
  13. भावी भारत का निर्माण – दत्तोपंत ठेंगड़ी
  14. Global Economic System-A Hindu View
  15. Mohan Bhagwat’s Speech Reflects Concerns About Prime Minister Narendra Modi – By Mani Shankar Aiyar
  16. small is beautiful by E.F. Shumakher
  17. Full Text of speech by RSS Sarasanghachalak Mohan Bhagwat’s RSSVijayadashami Speech-2015
Share this
Leave a Comment