হিন্দুত্বের ক্রোনোলজি ও স্বাতন্ত্র্যবীর সাভারকার : নবম কিস্তি


  • July 9, 2020
  • (0 Comments)
  • 2245 Views

বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’ তত্ত্বের উপর গড়ে উঠেছে আজকের আরএসএস-বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতি। গোহত্যা, জাতিভেদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে সাভারকারের মত থেকে বর্তমান মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শাসকশক্তি আজ অনেকটাই সরে এসেছে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব আসলে একদিকে সাভারকার আর অন্যদিকে হেডগেওয়ার আর গোলওয়াকারের ধর্মভাবনার এক খিচুড়ি তত্ত্ব। এই প্রেক্ষিতে সাভারকারের মতবাদ ও জীবন নিয়ে কয়েকটি কিস্তিতে দীর্ঘ আলোচনা রাখলেন পার্থ প্রতিম মৈত্র

 

প্রথম কিস্তি : গো-পূজন বিরোধিতা ও বর্তমান স্বীকৃতি পর্ব  

দ্বিতীয় কিস্তি : স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নির্বাচনী পরাজয় পর্ব

তৃতীয় কিস্তি : হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব পর্ব 

চতুর্থ কিস্তি : হিন্দু উত্থান ও নির্বাচনী বিজয় পর্ব 

পঞ্চম কিস্তি : কংগ্রেস রাজনীতি ও সাম্প্রতিক সাভারকার পুনর্বাসন পর্ব 

ষষ্ঠ কিস্তি : হিন্দুরাষ্ট্রের তত্ত্বনির্মাণ পর্ব 

সপ্তম কিস্তি : বিবেকানন্দ, হিন্দুত্ব ও দেশভাগ পর্ব 

অষ্টম কিস্তি : হিন্দু রাষ্ট্র ও ঘৃণার রাজনীতি পর্ব 

 

নবম কিস্তি : ধর্ম ও রাজনীতির ককটেল পর্ব

 

সাভারকার বলেছিলেন : “গরু হিন্দু জাতির প্রতীক হওয়া উচিত নয়। গরু কিন্তু হিন্দু জাতির দুগ্ধ প্রতীক। কোনও উপায়েই এটিকে হিন্দুত্বের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নয়। হিন্দুত্বের প্রতীক গরু নয়, নৃসিংহ (নৃসিংহের উল্লেখ, ভগবান বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার হিসাবে বিবেচিত)। গরুকে ঐশী হিসাবে বিবেচনা করে এবং তাঁর উপাসনা করার সময় গোটা হিন্দু জাতি গরুর মতো সহজবশ্যে পরিণত হয়েছিল। গোটা জাতি যেন ঘাস খাওয়া শুরু করে। আমরা যদি এখন কোনও প্রাণীর আদলে আমাদের জাতিকে খুঁজে পেতে চাই, তবে সেই প্রাণীটিকে সিংহ হতে দিন। আমাদের এখন নরসিংহ পূজা করা দরকার। এবং গরুর খুর হিন্দুত্বের চিহ্ন নয়।” নৃসিংহ অবতারের হিংস্র ভয়াল মৃর্তি সাভারকার প্রতিটি হিন্দুর মনে গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন যারা প্রতিপক্ষের পেট চিরে রক্তপান করবে। গৌতম বুদ্ধের অহিংসার শক্তি উপলব্ধির ক্ষমতা সাভারকারের ছিল না। নেহাতই জান্তব ও মাংসল হিংস্র দর্শনের প্রতীক করে তোলেন বিষ্ণুর নৃসিংহ রূপ কে। যদিও তাঁর অনুগামীরা নৃসিংহের বদলে গরুতেই আটকে থাকেন, কেননা তুলে ধরার পক্ষে সিংহের চাইতে গরুই আদর্শ।

 

১৯৯৮ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা প্রস্তাব করেছিলেন যে ওই বছরের এপ্রিলে ঘটানো পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার স্থান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে, পোখরাণে একটি নতুন দেবী মন্দির তৈরি করা যাক। তাদের কর্মসূচি অনুসারে এটি হিন্দু আধিপত্যের তিপ্পান্নতম শক্তিপীঠ হয়ে উঠবে। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন যে পরীক্ষার স্থান থেকে তেজস্ক্রিয় বালি প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা উচিত। ভাগ্যিস কিছু ঠাণ্ডা মাথার মানুষ এই প্রস্তাব ভেটো করে দেয়। ফলে এক বড়োসড়ো বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়। কিছু হিন্দু মৌলবাদীরা, স্বামী দয়ানন্দের সূত্র অনুসরণ করে এও বিশ্বাস করে যে প্রাচীন ভারতীয়রা আসলে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী ছিল, যাকে তারা “ওম-নির্মিত-বোম” বলে অভিহিত করে।

 

আধুনিক হিন্দুধর্মের দার্শনিক ভিত যাঁরা রচনা করেছিলে তাঁদের অন্যতম হলেন ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, যিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম বিদ্বান রাষ্ট্রপতি। ডঃ রাধাকৃষ্ণণ হিন্দুধর্মকে এক উন্মুক্ত গোঁড়ামিবিহীন বিশ্বমানবতার দৃষ্টিতেই দেখতেন, কেবল একটি ধর্মবিশ্বাস হিসাবে নয়। হিন্দুধর্ম এমনই ধর্ম, যুক্তি এবং জ্ঞানের সংযোগেও যার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায় না। বিশ্বের ইতিহাসে হিন্দুধর্মই একমাত্র ধর্ম, যা বলে মানুষের মন স্বাধীন ও মুক্ত। নিজের ক্ষমতার ওপর তার পূর্ণ আস্থা। হিন্দুধর্ম হচ্ছে মুক্তির ধর্ম, বিশেষতঃ ঈশ্বর চিন্তার ক্ষেত্রে সে সম্পূর্ণ মুক্ত। অতিপ্রাকৃতের সন্ধান যেন কোনও সীমানা বা বাধা ছাড়াই মহাকাশে ভ্রমণ। হিন্দুধর্ম বোধগম্যতা এবং সহযোগিতার একটি প্রচেষ্টার প্রতিনিধিত্ব করে। পরম বাস্তবতার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা এবং উপলব্ধির স্বীকৃতি দেয় হিন্দুধর্ম। ধর্মের মর্ম হলো সকল সত্ত্বার মধ্যে পরিব্যপ্ত যা কিছু চিরন্তন এবং চিরস্থায়ী, তা-ই মানুষের অধিগত। হিন্দুইজম যে আধ্যাত্মিকতার প্রতিনিধিত্ব করে তার আত্মা এমন অনন্য জীবনশক্তির অধিকারী যা সমস্ত রাজনৈতিক ও সমাজিক পরিবর্তনের মধ্যেও বেঁচে থাকে। লিপিবদ্ধ ইতিহাসের শুরু থেকে, হিন্দুধর্ম এই চিরকালীন আধ্যাত্মিকতার পবিত্র শিখার সাক্ষী থেকেছে। এমনকি যখন আমাদের রাজবংশগুলির পতন ঘটে আর সাম্রাজ্যগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, তখনও। এই আধ্যাত্মিকতাই ভারতীয় সভ্যতাকে একটি আত্মা প্রদান করেছে, বেঁচে থাকার জন্য একটি নীতি।

 

হিন্দুইজম এই চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার উত্তরাধিকার বহন করে চলছে। জীবনের চলনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এই গতিময়তা। ভারতবর্ষ অন্যদের চেয়ে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে সুউচ্চ স্থান দেয়। হিন্দুরা উপলব্ধি করতে পারে যে সমস্ত রাস্তাই ধার্মিককে এক অনন্যের দিকে নিয়ে যায়। তবে প্রত্যেককে অবশ্যই সেই রাস্তাটিই বেছে নিতে হবে, যে রাস্তা সেই বিন্দু থেকে শুরু হয় যেখানে যাত্রার পূর্বমুহুর্তে সে নিজেকে খুঁজে পায়।

 

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের এই হিন্দুধর্ম কোনও ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মগ্রন্থের সাথে আবদ্ধ নয়, কোনও প্রফেট বা বা প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গেও সম্পর্কিত নয়। তিনি নীতি শৃংখল, উৎকট একেশ্বরবাদ, এবং পুনর্ধর্মান্তরকরণে আস্থা প্রকট করেননি। তাঁর মতে হিন্দুদের কাছে প্রতিটি ধর্মই সত্যধর্ম, যদি সেই ধর্মের অনুগামীরা আন্তরিকভাবে এবং সততার সাথে তাকে অনুসরণ করে। তখন তারা তাদের ধর্মবিশ্বাস পেরিয়ে অভিজ্ঞতার আলোকপথে যায়, অন্ধভাবে অনুসৃত নিয়মাবলী অতিক্রম করে সত্যদর্শনের পথে যায়। তবে প্রতিনিয়ত সত্যের সন্ধানে অবিচল নিরবিচ্ছিন্নভাবে নিত্যনূতন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। হিন্দুধর্ম ধারাবাহিকভাবে ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের চিন্তাভাবনার ক্রমবিবর্তন। যে ধর্মে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সহাবস্থান। অদ্বৈত, দ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈতবাদে বিভক্ত দর্শন ও পথ। বৈষ্ণব, শাক্ত আর শৈব সহ বহুধা বিভক্ত ধর্মানুগামীরা। তারা ধর্মের একত্বে বিশ্বাসী হবে কোন সূত্রে? অতএব হিন্দুত্ব আর হিন্দুধর্মে যোজন ব্যবধান। একটি রাজনৈতিক, অন্যটি আধ্যাত্মিক, উদারনৈতিক।

 

গত কয়েক বছরে ভারত সরকার যে পরিবর্তনগুলি আনতে পেরেছে এদেশের রাজনৈতিক সিস্টেম পরিকাঠামোয়, তার প্রথমটা যদি হয় আমরা না ওরা এই দুই ভাগে গোটা দেশকে প্রায় বিভক্ত করে ফেলা, তাহলে দ্বিতীয় অবদান হচ্ছে প্রাক-সত্য, সত্য এবং উত্তর-সত্য, প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বাসহীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নাগরিকদের পৌঁছে দেওয়া। ফেক নিউজ, ফটোশপড ইমেজ, ডক্টরড ভিডিও এই সবকিছুর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়াকে বাহন করে, এই বিশ্বাসহীনতা, এই মিথ্যার বাতাবরণ ছড়িয়ে গিয়েছে সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে। যেহেতু প্রথমেই হয় এবং নয় এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে গোটা দেশ, ফলে এই নিউজগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা, তার সত্যতা, তার সন্দেহপ্রবণতা, সবকিছু অস্বীকার করে এক অদ্ভুত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মিথ্যার প্রতি নিঃশর্ত বিশ্বাসের এবং পক্ষ নেওয়ার প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। কোনও সংবাদপত্র, কোনও ইলেকট্রনিক মাধ্যম, কোনও সোশ্যাল মিডিয়া, এখন আর নিরপেক্ষ বলে নিরপেক্ষতার ভান করে না। সরাসরি পক্ষ নেয়। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে, তা নিয়ে যতিহীন প্রচার করে, মানুষের মধ্যে চূড়ান্ত এবং অর্থহীন এক দাস-মানসিকতা তৈরী করে, তার শিকড় চাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সমাজের প্রতি রন্ধ্রে। ভেঙে পড়ছে সৌধ, ভেঙে পড়ছে অট্টালিকা। কিন্তু তাতে এই নতুন রাজনীতির কিছু এসে যায় না। তা নির্ভর করে কতগুলি আপ্তবাক্যের উপর যেমন, “টাইম ইজ দ্যা বেস্ট ইরেজার অফ মেমোরি।” যেমন, “ইউজফুল লাইজ আর বেটার দ্যান হার্মফুল ট্রুথ (অর্থাৎ ক্ষতিকর সত্যের চাইতে কার্যকরী মিথ্যা অনেক বেশি লাভজনক)।”

 

আজকে তারা জানে যে যাদেরকে বোঝাতে হবে, যাদেরকে কনভিন্স করতে হবে, তারা বশ্যতা বাধ্যতা আর নির্বুদ্ধিতার আশ্রয়ে আশ্রিত। যেহেতু সত্য সহনের ক্ষমতা তাদের ভিতর থেকে লুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে, তাই তারা ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তারা ক্ষমতার গা ঘেঁষে থাকতে আগে যতটা পছন্দ করতো এখন তার চেয়ে অনেক বেশি অনুগত। আগে ক্ষমতার গা ঘেঁষে থাকা ছিল পছন্দ, এখন বাধ্যতা। এবং যখনই তারা নতজানু হয়, তাদের সারাৎসার জ্ঞান লুপ্ত হয়। যা তারা নয়, তাই দেখাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যারা নিজেদের হিন্দু বলে দাবি করে, তারা জীবনে কখনো হিন্দুধর্মের পরিসীমার আলোচনাতেও ছিল না। আজ অকস্মাৎ হিন্দুত্বের রসে জারিত হয়ে তারা বুঝতেই পারেনা যে হিন্দুত্ব তাদের কাছে ধর্ম নয়, অনুসঙ্গমাত্র। তারা দলদাস এবং যখনই তারা এই আত্মসমর্পণের গতি প্রাপ্ত হয়, তখনই ক্ষমতাকেন্দ্রের পক্ষে সহজ হয়ে যায় তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা। এই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস। ফলে তাদের যা খুশি তাই বোঝানো যায়।  তারা প্রশ্ন করতে শেখে না, তারা সন্দেহ করতে শেখে না, তারা প্রতিবাদ করতে শেখে না। তারা তখন একই সঙ্গে জড়, নিষ্ক্রিয়, বশ্য, বাধ্য এবং অজ্ঞ। যা তাকে শেখানো হয় সে শুধু সেটুকুই শেখে। যা তাকে বোঝানো হয় সে শুধু সেটুকুই বোঝে। এমন জড়ভরত পাবলিককে কন্ট্রোল করা সহজ। যা খুশি করে, যা খুশি বোঝানো যায়।

 

রাজনীতিতে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলি এখানেই শেষ নয়। যেমন অতি সাম্প্রতিক কালে দেশের শাসক দল এবং সরকার একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন, যা দেশের চরিত্রগত কাঠামোটি বদলে দিচ্ছে। এই সমস্যাগুলি সাম্প্রতিক উদ্ভাবন। তার মধ্যে কিছু প্রকাশ্য, কিছু অপ্রকাশ্য নীতির ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এমনভাবে কার্পেট বম্বিং করা হচ্ছে যাতে সেই কার্পেট বম্বিং অফ রেজোলিউশনস দেশের ফ্যাব্রিক চেঞ্জ করে দিচ্ছে। যখন ভারতবর্ষে গুজরাট গণহত্যা হচ্ছে, কারগিল যুদ্ধ হচ্ছে সীমান্তে, যখন হিন্দুত্ববাদী দল দেশের শাসন ব্যবস্থার উপর দখলদারি কায়েম করতে শুরু করেছে, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এক সদাশয় কবি এবং ‘ইনক্লুসিভ’ প্রধানমন্ত্রী, অটলবিহারী বাজপেয়ী। যিনি লৌহপুরুষ উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবাণীকে ইনক্লুড করে শাইনিং ইন্ডিয়া গড়ে তুলেছিলেন। তিনি প্রায় নিঃশব্দে ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এলেন। জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিষয়টি আর শর্তহীন রইলো না। মুখ আর মুখোশের সৌভ্রাতৃত্ব (আরএসএসের প্রচারক গোবিন্দাচার্য প্রকাশ্যেই বলেছিলেন বাজপেয়ী দলের মুখ নয় মুখোশ) ভারতীয় রাজনীতিতে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিল।

 

আগের সরকারের মতই শিক্ষা স্বাস্থ্য অর্থনীতি, সম্প্রীতি ইত্যাদি প্রশ্নে হিন্দুত্ববাদী সরকার পূর্বতন সরকারের চাইতে এতটুকু এগিয়ে নেই। দূর্নীতি প্রশ্নে তো ইতিহাসের নিকৃষ্টতম। নোটবন্দীর ধাক্কা সামলানোর আগেই জিএসটির ধাক্কা, সেটা সামলানোর আগেই ব্যাঙ্কের সাধারণ মানুষের টাকার হরির লুট। সেটা হজম করার আগেই উড়িজনিত কারণে সার্জিকাল স্ট্রাইক। সেটা বিস্মরণের আড়ালে যাবার আগেই রাফায়েল। তার পর পরই তিনতালাক বিলোপ, ৩৭০ বিলোপ, এনআরসি,  সিএএ, কাশ্মীরে কার্ফু, ইভিএম কেলেঙ্কারী,  তার হাত ধরে একের পর এক লাভজনক সরকারী সংস্থার বেসরকারীকরণ, একের পর এক মিল বন্ধ হয়ে যাওয়া, কৃষকদের লংমার্চ, পুলওয়ামা, আবার সার্জিকাল স্ট্রাইক, বালাকোট, রাষ্টসঙ্ঘ, দ্রব্যমূল্য তীব্র উর্ধগতি, অর্থনীতির তীব্র নিম্নগতি, দুলক্ষ লোকের ট্রল আর্মি, পূজাবিনোদন, এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্মের আবাহনে প্রতিটি মানুষের মস্তক প্রক্ষালন, ভারতবাসী এখন আর ভাববার অবকাশ পায় না। সে আর রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, নিয়ে প্রশ্ন করতে পছন্দ করে না। মাথা না ঘামিয়ে তার মস্তিষ্ক শূন্য ব্যাঙ্কের ভল্ট হয়ে যায়, যেখানে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তাদের নিজস্ব দর্শন জমা রাখে ডেটা ব্যাঙ্কের মত।

 

গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে ভারতীয়রা ছিল জাতি হিসাবে পুরুষালি। তাঁর লড়াই ছিল অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে লড়াই এর অস্ত্র ছিল সাহস, সত্য এবং অহিংসা। মোটকথা, গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে “অহিংসা হ’ল পৌরুষেয়”। উল্টোদিকে সাভারকর বিশ্বাস করতেন যে, বুদ্ধের প্রেম, করুণা এবং অহিংসার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হিন্দু জাতির অবক্ষয়ের প্রথম প্রধান পদক্ষেপ। এর ফলে যে জাতিগত দুর্বলতা জন্ম নেয় তা বাইরের আগ্রাসনকারীদের দ্বারা ভারতকে আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। সাভারকার বৌদ্ধধর্মের অহিংস প্রতিরোধকে ধরেই নিয়েছিলেন নিজে নিহত হয়ে হত্যাকে হত্যা করার চেষ্টা করা। এর বিপরীতে গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে বুদ্ধ সম্ভবতঃ অহিংসার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক এবং তিনি সত্য ও প্রেমের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে শিখিয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্মকে এই অবিশ্বাস্য শত্রুতা সহকারে বিদ্রূপের বিষয় করে তোলার পরেও, ভারতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তখনও হিন্দুত্বের মধ্যেই ধরা হয়েছিল, এবং সাভারকার এমনকি ইসলামের শক্তির বিরুদ্ধে একটি প্যান হিন্দু-বৌদ্ধ জোট শুরু করেছিলেন। সাভারকার অনুভব করেছিলেন যে বিবেকানন্দ, চৈতন্যদেব, গান্ধী, রাধাকৃষ্ণণ এবং অন্যদের দ্বারা হিন্দুধর্মের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের অ্যাডভোকেটরা হিন্দুদের উপর এক দুর্বলতার প্রভাব আরোপ করেছিল এবং মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের দ্বারা তাদের নিপীড়নের প্রতি প্রতিরোধহীন মূক করে রাখার ইচ্ছায় হিন্দুদের বশীভূত ও দুর্বল করা রাখা হয়েছিল।

 

সাভারকারের অনুগামীরাও বিশ্বাস করেন যে ভারতের ইতিহাসে কোনও নেতার সাভারকারের মতো তৎকালীন ভারতের জাতীয় সুরক্ষার বিপদগুলি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। কথিত আছে ১৯৩৭ সালে, যখন সাভারকার ১৪ বছরের সর্বাধিক কঠোর কারাবাস এবং ১৩ বছরের আন্দোলন নিষেধাজ্ঞার পরে মুক্তি পেয়েছিলেন, তখন কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক দল তাঁকে দলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে সাভারকার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন যে কংগ্রেস যে কোনও মূল্যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে ভারতের স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হিসাবে তৈরি করে সবচেয়ে বড় ভুল করেছে। তিনি বলেছিলেন যে কংগ্রেসের বিশ্বাস যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। হিন্দু অধিকারের বিনিময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ অধিকার পাওয়ার জন্য কংগ্রেস মুসলিম তোষণ করে আসছিল। সাভারকার বলেছিলেন যে, এই নীতি হিন্দু ও মুসলমানদের আরও কাছাকাছি আনার পরিবর্তে ছিন্নভিন্ন করবে। সাভারকার তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছিলেন: “আমি বিশ্বাসঘাতকদের প্রথম সারির চেয়ে দেশপ্রেমিকদের শেষ সারিতে দাঁড়াতে চাই।”

 

দশম কিস্তি : হিংস্র হিন্দুত্ব, স্টেইনস, পুনর্ধর্মান্তরকরণ পর্ব 

 

গ্রন্থসূত্র ও তথ্য সূত্র:

  1. The Origins of Religious Violence : An Asian Perspectiveby Nicholas F. Gier
  2. Who is Hindu?by V.D. Savarkar
  3. The Hindu Mahasabha and the Indian National Congress, 1915 to 1926, by Richard  Gordon
  4. The Gandhian Confusion by D. Savarkar
  5. Hindu Rastro Darshan D. Savarkar
  6. Country First? Vinayak Damodar Savarkar (1883–1966) and the Writing of Essentials of Hindutva, by Janaki Bakhle
  7. Third Way by Dattopant Thengadi
  8. Savarkar: Echoes from a Forgotten Past, by Sampath, Vikram.
  9. The Brotherhood in Saffron: The Rashtriya Swayamsevak Sangh and Hindu Revivalism, by Walter Anderson & Shridhar D. Damle
  10. Marathi – Gandhi Hatya Abhiyogatil Savarkaranche Nivedan
  11. Economic Thoughts of Swami Vivekananda by Sebak Kumar Jana
  12. Bunch of Thoughts by Golwalkar
  13. भावी भारत का निर्माण – दत्तोपंत ठेंगड़ी
  14. Global Economic System-A Hindu View
  15. Mohan Bhagwat’s Speech Reflects Concerns About Prime Minister Narendra Modi – By Mani Shankar Aiyar
  16. small is beautiful by E.F. Shumakher
  17. Full Text of speech by RSS Sarasanghachalak Mohan Bhagwat’s RSSVijayadashami Speech-2015
Share this
Leave a Comment