হিন্দুত্বের ক্রোনোলজি ও স্বাতন্ত্র্যবীর সাভারকার : দ্বিতীয় কিস্তি


  • June 23, 2020
  • (2 Comments)
  • 3030 Views

বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’ তত্ত্বের উপর গড়ে উঠেছে আজকের আরএসএস-বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতি। গোহত্যা, জাতিভেদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে সাভারকারের মত থেকে বর্তমান মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শাসকশক্তি আজ অনেকটাই সরে এসেছে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব আসলে একদিকে সাভারকার আর অন্যদিকে হেডগেওয়ার আর গোলওয়াকারের ধর্মভাবনার এক খিচুড়ি তত্ত্ব। এই প্রেক্ষিতে সাভারকারের মতবাদ ও জীবন নিয়ে কয়েকটি কিস্তিতে দীর্ঘ আলোচনা রাখলেন পার্থ প্রতিম মৈত্র

 

প্রথম কিস্তি : গো-পূজন বিরোধিতা ও বর্তমান স্বীকৃতি পর্ব

 

দ্বিতীয় কিস্তি : স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নির্বাচনী পরাজয় পর্ব

 

বিনায়ক দামোদর সাভারকারের জীবনের প্রথম অধ্যায়ের সঙ্গে পরবর্তী অধ্যায়ের কোনও মিল নেই। পরিবর্তনের ধারাটি অনুধাবন করা দরকার। তা না হলে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা বুঝতে চেয়ে আমরা গোলকধাঁধাঁয় ঘুরপাক খেয়ে মরবো। সাভারকারের উচ্চ বিদ্যালয়ের দিনগুলিতে, বাল গঙ্গাধর তিলক (যাকে সাভারকার তাঁর গুরু হিসাবে বিবেচনা করতেন) শুরু করেছিলেন শিবাজি উৎসব এবং গণেশ উৎসব। এতে অংশ নিয়ে সাভারকার পরিচালনা করতেন বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী থিমের নাটক। ১৯০১ সালের মার্চ মাসে তিনি যমুনাভাইকে বিয়ে করেন। বিবাহোত্তর, ১৯০২ সালে, বীর সাভারকার পুনের ফার্গুসন কলেজে যোগদান করেন। পুনেতে, সাভারকার ‘অভিনব ভারত সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একটা সময় পর্যন্ত তিনি স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এবং পরে তিলকের স্বরাজ পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর উস্কানিমূলক দেশাত্মবোধক বক্তৃতা এবং ক্রিয়াকলাপ ব্রিটিশ সরকারকে প্ররোচিত করেছিল তাঁর বি.এ. ডিগ্রী প্রত্যাহার করে নিতে।

 

১৯০৬ সালের জুনে, বাল গঙ্গাধর তিলক তাঁকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পরামর্শ দেন। সাভারকার ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। বৃটেনের ভারতীয় ব্যারিস্টার ও বিপ্লবী শ্যামজী কৃষ্ণ ভার্মা সাভারকার এবং আরও কয়েকজন ভারতীয় যুবকের শিক্ষার ব্যায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এই ছাত্রদের সেন্ট্রাল লন্ডনের (ইন্ডিয়া হাউস) একটি বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যা হয়ে উঠেছিল সমস্ত ভারতীয় ছাত্র বিপ্লবীদের আবাসস্থল ও মিলনস্থল। লন্ডনে তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের একত্রিত এবং উদ্বুদ্ধ করতেন। ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সোসাইটি ভারতীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাগ্র ছিল। ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য তিনি অস্ত্রব্যবহারের পক্ষে ছিলেন এবং ইংল্যান্ডে অস্ত্রসজ্জিত ভারতীয়দের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন।

 

১৯০৮ সালে তিনি ‘ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৮৫৭’ সম্পর্কিত একটি তথ্যমূলক গবেষণা প্রকাশ করেন। এই যুদ্ধকে ব্রিটিশরা ১৮৫৭ সালের ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ হিসাবে অভিহিত করতো। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটেন এবং ভারত উভয় ক্ষেত্রেই বইটির প্রকাশনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে, হল্যান্ডের ম্যাডাম ভিকাইজি কামা বইটি প্রকাশ করেছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে কর্মরত বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সে বই ভারতে পাচার করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে সাভারকারই ভারতীয় ছাত্র বিপ্লবীদের নেতা হিসাবে পি. এন. বাপটকে প্যারিসে গিয়ে একজন রাশিয়ান বিপ্লবীর কাছ থেকে বোমা তৈরির শিল্প শিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ১৯০৯ সালে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জনকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টার পরে সাভারকারের সক্রিয় অনুসারী মদনলাল ধিংড়া স্যার উইলিকে গুলি করে হত্যা করেন। সাভারকার সুস্পষ্টভাবে এই কাজের নিন্দা করেননি। কিন্তু তৎকালীন নাসিকের ব্রিটিশ কালেক্টর, এ.এম.টি. জ্যাকসনকে এক যুবকের গুলি করে মারার ঘটনায় বীর সাভারকার শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের জালে পড়েন। ১৯১০ সালের ১৩ই মার্চ লন্ডনে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সাভারকারকে গ্রেপ্তার করে ভারতে প্রেরণ করে।

 

সাভারকারকে গ্রেপ্তারের পরে তিনি মার্সাই বন্দরের কাছে ব্রিটিশ জাহাজ এস এস মোরিয়া থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে সাঁতরে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন যা তাকে যুক্তরাজ্য থেকে ভারতে নিয়ে যাচ্ছিল। তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং ভারতে নির্বাসিত করা হয়। একটি আনুষ্ঠানিক বিচারের পরে, সাভারকারকে অস্ত্রের অবৈধ পরিবহন, উস্কানিমূলক বক্তৃতা এবং রাষ্ট্রদ্রোহের গুরুতর অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়, এবং তাকে ৫০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তাঁকে আন্দামান সেলুলার কারাগারের কালাপানিতে (ব্ল্যাকওয়াটারস) নির্বাসন দেওয়া হয়। আদালতে তাঁর বিচার হয় এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার কারাগারে ৫০ বছরের মেয়াদে প্রেরণ করা হয়। কারাগারের জীবন তাঁকে এক নির্জন পরিবেশ দেয়, যেখান থেকে তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু। ১৯২০ সালে, বিঠ্‌ঠল ভাই প্যাটেল, মহাত্মা গান্ধী এবং বাল গঙ্গাধর তিলক সহ অনেক বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী সাভারকারের মুক্তি দাবি করেছিলেন। ১৯২১ সালের ২ মে সাভারকারকে রত্নগিরি কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। রত্নগিরি কারাগারের বন্দীজীবনে সাভারকার ‘হিন্দুত্ব’ বইটির খসড়া লিখতে শুরু করেন, যা পরবর্তী সময়ে শান্তির দ্বীপ ভারতবর্ষকে অশান্ত এবং হিংসালয় করে তুলবে। ১৯২২ সালে রত্নগিরি কারাগারে বন্দী থাকাকালীনই তিনি ‘এসেনশিয়ালস অফ হিন্দুত্ব’ লিপিবদ্ধ করেন, যা তাঁর হিন্দুত্ব তত্ত্বের সূচনা করে। ১৯২৪ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি মুক্তি পান। তবে কর্তৃপক্ষের আদেশে তাঁর গতিবিধি রত্নগিরি জেলায় সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি গৃহবন্দী হওয়ার সময় ডঃ আম্বেদকর, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং মহাত্মা গান্ধীর মতো উল্লেখযোগ্য লোকের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। প্রথমে সাভারকার তিলকের স্বরাজ পার্টিতে যোগ দেন এবং তার অব্যবহিত পরেই হিন্দু মহাসভা একটি পৃথক রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি মহাসভার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন।

 

সাভারকার ছিলেন একাকী হিন্দুত্ববাদী, যার বক্তব্যে বারবার দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রতিফলন ঘটেছে, এবং তা জিন্নারও আগে। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে হিন্দু মহাসভার কলকাতা অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণে সাভারকার ঘোষণা করেছিলেন যে “আমরা হিন্দুরা নিজেরাই একটি জাতি”। এই ভাষণে তিনি মুসলমানদেরকে জাতির এই সংজ্ঞা থেকে স্পষ্টতই বাদ দিয়েছিলেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, এই ভাষণের কয়েক মাস বাদে জিন্না এবং মুসলিম লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিজাতীয় তত্ত্ব গ্রহণ করেছিল। এর চার বছর পরে ১৫ আগস্ট, ১৯৪৩ সালে, ‘হিন্দুরা একটি জাতি’ বক্তৃতায় সাভারকার বলেছিলেন:

 

“গত ৩০ বছর ধরে আমরা ভারতের ভৌগোলিক ঐক্যের আদর্শে অভ্যস্ত এবং কংগ্রেস সেই ঐক্যের প্রবল সমর্থক ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সংখ্যালঘু মুসলিমরা, যারা একের পর এক ছাড় আদায় করেছে সাম্প্রদায়িকতার পুরষ্কার হিসেবে, তারা পৃথক রাষ্ট্রের দাবীতে সোচ্চার হলো। ফলে আমাদেরও এই দাবি নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত যে মুসলিমরা একটি পৃথক জাতি। মিঃ জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের সাথে আমার কোনও বিরোধ নেই। আমরা হিন্দুরা নিজেরাও একটি জাতি এবং এটি ঐতিহাসিক সত্য যে হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি।”

 

এই বিবৃতিতে সম্পর্কে তিনটি উল্লেখযোগ্য বিষয় রয়েছে। প্রথমত, ১৯৩৯ সালের বা তার আগের ভাষণ সত্ত্বেও, সাভারকার মুসলিম লীগের দাবীতে অদ্ভুত প্রভাব ফেলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি স্বীকারও করেছেন যে কংগ্রেসই প্রবলভাবে ভারতের ঐক্যের পক্ষে ছিল। তৃতীয়ত, তিনি জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বকে সমর্থন করেন। আশ্চর্যজনক এই যে, সাভারকার হিন্দু ও মুসলমান পৃথক নেশন, এই অবস্থান গ্রহণের পরেও, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠিগুলি অখণ্ড ভারতের ব্যানার তোলার দাবি করে (এমনকি এর নামে গান্ধীকে হত্যাও করে)। সাভারকারের মতো শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে, এটি অবশ্যই ধরে নেওয়া উচিত, যে তিনি তাঁর বক্তব্যগুলির প্রভাব সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর উত্থাপিত দাবী ভৌগোলিক বিভাজনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। যদিও তারা অখণ্ড ভারত স্লোগান তুলেছিল, তবুও হিন্দুত্ববাদীদের আসল অভিযোগ হ’ল, গান্ধী, নেহেরু এবং কংগ্রেসের সম্মিলিত সংস্কৃতি ‘জাতি’র এমন একটি ধারণায় বিশ্বাসী ছিল, যার সঙ্গে তারা কোনওভাবেই সহমত নয়। এ কারণেই গান্ধী জীবন হারান এবং এ কারণেই নেহেরু আজও আক্রমণের মুখে।

 

প্রশ্ন হলো যে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি উচ্চকিত গান্ধী, নেহেরু এবং কংগ্রেস বিরোধিতা করা সত্বেও এবং ভারতের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠি দেশভাগ বিরোধী ছিলেন এই দাবী নিয়ে নির্বাচনে লড়ার পরও –

 

    • প্রথম লোকসভায় (এপ্রিল ১৯৫২ থেকে এপ্রিল ১৯৫৭) নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস পেলো একাই ৩৯৮, কমিউনিস্ট পার্টি ১৭ এবং স্যোশালিস্ট পার্টি ১১টি আসন। পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির মধ্যে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা পেল ৪, ভারতীয় জনসঙ্ঘ ৩ এবং অখিল ভারতীয় রামরাজ্য পরিষদ ৩টি মাত্র আসন। প্রধানমন্ত্রী হলেন জওহরলাল নেহেরু।

 

      • দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে বাংলার নোয়াখালি এবং বিহারের বেশ কয়েকটি গ্রামে।
      • ভাষা দাঙ্গা তথা বঙ্গাল খেদা আন্দোলন ঘটে আসামে।

 

    • দ্বিতীয় লোকসভায় (এপ্রিল ১৯৫৭ থেকে মার্চ ১৯৬২) নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস পেলো একাই ৪০৬, কমিউনিস্ট পার্টি ২৯ এবং প্রজা স্যোশালিস্ট পার্টি ১৭টি আসন। পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির মধ্যে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা পেল ২ ও ভারতীয় জনসঙ্ঘ ৫টি আসন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু।

 

      • রামনাড দাঙ্গা ছিল ১৯৫৭ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দক্ষিণের তামিলনাড়ুতে রামনাড জেলায় সহিংস সংঘর্ষ। বছরের শুরুর দিকে মাদ্রাজ বিধানসভা নির্বাচনের পরে অনুষ্ঠিত একটি উপনির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই দাঙ্গা হয়েছিল ফরোয়ার্ড ব্লকপন্থী ও কংগ্রেসপন্থীদের মধ্যে।
      • হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে প্রথম বৃহত্তম দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৬১ সালে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে।

 

    • তৃতীয় লোকসভায় (এপ্রিল ১৯৬২ থেকে মার্চ ১৯৬৭) নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস পেল একাই ৩৯৪, কমিউনিস্ট পার্টি ৩০, স্বতন্ত্রতা পার্টি ২৫ এবং প্রজা স্যোশালিস্ট পার্টি ১৩টি আসন। পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির মধ্যে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা পেল ১ ও ভারতীয় জনসঙ্ঘ ১৪টি আসন। প্রধানমন্ত্রী মে ১৯৬৪ থেকে জুন ১৯৬৪ গুলজারিলাল নন্দা (অ্যাক্টিং), জুন ১৯৬৪ থেকে জানুয়ারী ১৯৬৬ লালবাহাদুর শাস্ত্রী, জানুয়ারী ১৯৬৬ থেকে জানুয়ারী ১৯৬৬ গুলজারিলাল নন্দা (অ্যাক্টিং), জানুয়ারী ১৯৬৬ থেকে জানুয়ারী ১৯৬৭ ইন্দিরা গান্ধী।

 

      • ১৯৬৭ সালের রাঁচি-হাতিয়া দাঙ্গা ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা – বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাঁচির আশেপাশে সংঘটিত হয়েছিল। দাঙ্গাগুলি ১৯৬৭ সালের ২২ থেকে ২৯ আগস্টের মধ্যে হয়েছিল। ১৮৪ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়, ১৯৫টি দোকান লুটপাট করা হয়েছে এবং আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

 

    • চতুর্থ লোকসভায় (মার্চ ১৯৬৭ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭০) কংগ্রেস পেলো একাই ৩০৩, কমিউনিস্ট পার্টি ২৪, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ১৯ এবং স্বতন্ত্র পার্টি ৪৫টি আসন। পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির মধ্যে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা ১, স্বতন্ত্র পার্টি ৪৫, ভারতীয় জনসঙ্ঘ ৩২। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মার্চ ১৯৬৭ থেকে মার্চ ১৯৭১।

 

      • ১৯৬৯ সালের গুজরাটের দাঙ্গাটি ভারতের গুজরাটে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিচায়ক। এই সহিংসতা গুজরাটের প্রথম বৃহত্তম দাঙ্গা ছিল, যাতে ব্যাপক পরিমাণে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট জড়িত ছিল। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর থেকে এটি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, ৬৬০ জন মারা গিয়েছিল, ১০৪৪ জন আহত হয়েছিল এবং ৪৮,০০০-এরও বেশি লোক সম্পত্তি হারিয়েছিল। বেসরকারী মতে দাবি করা হয় যে ২০০০ জন মারা গেছে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি আক্রান্ত এবং ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। দাঙ্গায় ৪২ মিলিয়ন টাকার সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছিল, যার মধ্যে মুসলমানদের ক্ষতির সংখ্যা ৩২ মিলিয়ন। দাঙ্গার সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতা হিতেন্দ্র দেশাই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সরকার গঠিত বিচারপতি রেড্ডি কমিশন এই সহিংসতার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলিকে দায়ী করে। ২০০২সালে মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বে ১৯৬৯-এরই ‘অ্যাকশান রিপ্লে’ হয়।
      • এর পরে উত্তর প্রদেশে দাঙ্গা হয়েছিল এবং পর্যায়ক্রমে অন্যত্র সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

 

    • পঞ্চম লোকসভায় (মার্চ ১৯৭১ থেকে জানুয়ারী ১৯৭৭) কংগ্রেস পেল একাই ৩৭২, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ২৪, কমিউনিস্ট পার্টি ২৫, স্বতন্ত্রতা পার্টি ৭ এবং প্রজা স্যোশালিস্ট পার্টি ২টি আসন। পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির মধ্যে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা ০, ভারতীয় জনসঙ্ঘ ২৩। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মার্চ ১৯৭১ থেকে মার্চ ১৯৭৭।

 

      • ১৯৭৪ সালের ৫ জানুয়ারী থেকে এপ্রিলের মধ্যে মুম্বইয়ের ওরলি এলাকায় যে হিংস্র দাঙ্গা চলে তার নাম ওরলি দাঙ্গা। একদিকে দলিত প্যান্থার্স, অন্যদিকে শিবসেনা এবং পুলিশের মধ্যে নিয়মিত সংঘর্ষ বেশ কয়েক মাস অব্যাহত ছিল। দলিত প্যান্থারদের একটি সমাবেশে বক্তাদের উপর পাথর ছোঁড়ার পরে এই হিংসা শুরু হয়েছিল: তাদের বিরুদ্ধে হিন্দু দেবদেবীদের সম্পর্কে অশ্লীল বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। দাঙ্গায় ছয়জন নিহত হয়েছিল এবং প্রায় ১১৩ জন আহত হয়েছিল; গৃহনির্মাণের কাজেও বিস্তৃত সম্পত্তির ক্ষতি ঘটে। এই দাঙ্গাগুলিকে দলিত বিরোধী হিংসা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

 

অর্থাৎ পাঁচটি লোকসভা নির্বাচনে মানে পঁচিশ বছরে দেশভাগের যাবতীয় দায়ভার নেহেরু, গান্ধী এবং কংগ্রেসের উপর চাপানো হলেও কংগ্রেস সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠির আস্থা অর্জন করে গেছে এবং হিন্দুত্ববাদীদের সংখ্যা দশ থেকে চল্লিশের মধ্যে আটকে থেকেছে। অতএব হয় ভারতীয় নির্বাচকমণ্ডলী নির্বোধ অথবা লড়াইয়ের স্ট্র্যাটেজি পাল্টানো প্রয়োজন। প্রথমটির পরিবর্তন দুঃসাধ্য, দ্বিতীয়টি সহজ।

 

এর আগেই অবশ্য একদা আগুনখেকো বিপ্লবী সাভারকারের রূপান্তর সম্পূর্ণ হয়েছে। সেলুলার জেলে থাকার সময় একের পর এক মার্সি‌ পিটিশনের চতুর্থ করুণ আবেদনটি জমা দিয়েছিলেন ৩০ মার্চ ১৯২০ সালে। ব্রিটিশ সরকারের কাছে বলেছিলেন:

 

“বাকুনিন ঘরানার জঙ্গি সংগ্রামে বিশ্বাস করা থেকে এখন আমি সরে এসেছি। এমনকি আমি ক্রপটকিন বা টলস্টয়ের শান্তিপূর্ণ এবং দার্শনিক নৈরাজ্যবাদেও আর আস্থা রাখি না। এখন কেবল এই ক্ষমাপ্রার্থনার কারণেই শুধু নয়, অতীতে আমার বিপ্লবী প্রবণতাগুলি সম্পর্কে বহু বছর ধরেই আমি সরকারকে জানিয়েছি এবং এ-ও লিখেছি যে, মিস্টার মন্টেগু সংবিধানের কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়া শুরুর সময় থেকেই (১৯১৪, ১৯১৮ সালেও) আমি বলে আসছি সংবিধানে আস্থা রাখা ও এর পাশে দাঁড়ানোর কথা। পরবর্তী সংস্কার এবং তার ঘোষণা আমার ভাবনাকে সুদৃঢ় করেছে এবং বর্তমানে আমি প্রকাশ্যে জানাচ্ছি সুশৃঙ্খল এবং সাংবিধানিক উন্নয়নে আত্মনিয়োগে আমার বিশ্বাস এবং প্রস্তুতি অর্জনের কথা।”

 

তৃতীয় কিস্তি : হিন্দু ধর্ম ও হিন্দুত্ব পর্ব 

 

গ্রন্থসূত্র ও তথ্য সূত্র:

  1. The Origins of Religious Violence : An Asian Perspective by Nicholas F. Gier
  2. Hindutva. Who is Hindu? by V.D. Savarkar
  3. The Hindu Mahasabha and the Indian National Congress, 1915 to 1926, by Richard  Gordon
  4. Demons in Hindutva: Writing a Theology for Hindu Nationalism, by M. Reza Pirbhai
  5. Country First? Vinayak Damodar Savarkar (1883–1966) and the Writing of Essentials of Hindutva, by Janaki Bakhle
  6. Patriots and Partisans: From Nehru to Hindutva and Beyond, by Ramchandra Guha
  7. The History of Hindu India, by Satguru Bodhinatha Veylanswami
  8. Uproot Hinditva: The Fiery Voice of the Liberation Paathers, by Thirumaaialavan, translated from the Tamil by Meenakandasamy
  9. The Saffron Wave: Democracy And Hindu Nationalism In Modern India, by Thomas Blom Hansen
  10. Savarkar: Echoes from a Forgotten Past, by Sampath, Vikram.
  11. The Brotherhood in Saffron: The Rashtriya Swayamsevak Sangh and Hindu Revivalism, by Walter Anderson & Shridhar D. Damle
  12. Savarkar’s views on Hindu Nationalism, by Sauro Dasgupta
  13. Swami Vivekananda : The Friend of All, by Swami Lokeswarananda

 

লেখক প্রাবন্ধিক ও কবি। মতামত লেখকের নিজস্ব।

 

Share this
Recent Comments
2
  • বুকানন ঘরানা নয় বাকুনিন ঘরানা হবে। যে প্রসংগে
    ( নৈরাজ্যবাদ ) নামটির উল্লেখ হয়েছে, তাতে বুখারিনের প্রাসংগিকতা নেই , বাকুনিনের আছে।

  • comments
    By: groundxero on July 18, 2020

    ধন্যবাদ। বদলে দেওয়া হল।

Leave a Comment