বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ‘হিন্দুত্ব’ তত্ত্বের উপর গড়ে উঠেছে আজকের আরএসএস-বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতি। গোহত্যা, জাতিভেদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে সাভারকারের মত থেকে বর্তমান মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শাসকশক্তি আজ অনেকটাই সরে এসেছে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব আসলে একদিকে সাভারকার আর অন্যদিকে হেডগেওয়ার আর গোলওয়াকারের ধর্মভাবনার এক খিচুড়ি তত্ত্ব। এই প্রেক্ষিতে সাভারকারের মতবাদ ও জীবন নিয়ে কয়েকটি কিস্তিতে দীর্ঘ আলোচনা রাখলেন পার্থ প্রতিম মৈত্র।
প্রথম কিস্তি : গো-পূজন বিরোধিতা ও বর্তমান স্বীকৃতি পর্ব
দ্বিতীয় কিস্তি : স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নির্বাচনী পরাজয় পর্ব
তৃতীয় কিস্তি : হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব পর্ব
চতুর্থ কিস্তি : হিন্দু উত্থান ও নির্বাচনী বিজয় পর্ব
১৮৭৫ সালে বোম্বেতে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। দয়ানন্দের দর্শনকে বলা যায় নব্য হিন্দুইজম। দয়ানন্দ দাবী করতেন যে আর্যরা তিব্বত থেকে উদ্ভূত। রামায়ণ ও মহাভারতে যে হিন্দু স্বর্ণযুগের বর্ণনা রয়েছে তা আর্যরাই ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত করে। সেই মহান স্বর্ণযুগ, যার সমাপ্তি ঘটে মহাভারতে বর্ণিত ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এবং ফলশ্রুতি হিসেবে অন্তত দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। তখন থেকেই হিন্দু সভ্যতা একটি দীর্ঘ পতনের মুখে পড়ে এবং সে পতন প্রলম্বিত হয় বৌদ্ধধর্ম এবং জৈনধর্মের শান্তিবাদ আর নাস্তিবাদের ধারায়। বৌদ্ধধর্ম এবং জৈনধর্ম তাঁর কাছে হিন্দুধর্মের ব্যর্থ সন্তান, হিন্দু ধর্মের থেকে আলাদা কোনও ধর্ম নয়। একাদশ শতকে এই দুর্বল হিন্দুইজম খুব সহজেই মুসলিম আক্রমণকারীদের এবং পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। বিংশ শতকের হিন্দুত্বের জন্য তৈরি মঞ্চ থেকে দয়ানন্দ সরস্বতী প্রাচীনপন্থী হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের উপর ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ শানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন যে, ভারতীয় সমাজে চতুর্বর্ণকে, যা ছিল গুণকর্ম অনুসারে ভাগ, যেভাবে বংশানুক্রমিক ভাবা হচ্ছে, তা এক বিরাট ভুল। দয়ানন্দের মৃত্যুর পর একটি ক্যাম্পেন হয়েছিল দলিতদের নিয়ে, যারা ধর্মান্তরিত হয়ে খৃষ্টান বা মুসলিম হয়েছেন, অথচ হিন্দু উৎসবগুলিতে এখনও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল, পুনর্ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত বিশ্বাসে ফিরিয়ে আনা। এই ‘রিকনভার্শন’ প্রোগ্রাম আজও হিন্দু মৌলবাদীদের প্রচারে এবং সাভারকারের হিন্দুত্বে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের ভারতে গান্ধী হত্যার মুখ্য ষড়যন্ত্রী সাভারকারের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার পিছনে চারটি বিষয় মুখ্য ভূমিকা নেয়।
- এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, হিন্দু-রাষ্ট্রের ধারণার সেন্টার স্টেজ দখল। দীর্ঘকাল ধরে হিন্দুধর্মকে অতিপ্রাসঙ্গিক করতে গিয়ে অন্য সব ধর্মের ভূমিকাকে গৌণ করে দেওয়ার রাজনীতি কাজে দেয়নি। কংগ্রেসের হিন্দু ধর্ম নিয়ে নরম অবস্থান, আর ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সর্বধর্ম তোষণের রাজনীতির কাছে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া আরএসএসের দিশাহীন রাজনীতিহীন অবস্থানকে ব্যাকস্টেজে ঠেলে দিয়ে সাভারকারের কঠোর হিন্দুত্ব আর একবগ্গা রাজনীতির পুনরুত্থান আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল।
- গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা, নব্য হিন্দুত্ববাদীদের নতুন পথের সন্ধান দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনীতি করার জন্য জননেতার প্রয়োজন হয়। শ্যামাপ্রসাদ, দেবপ্রসাদ ঘোষ, বলরাম মাধোক, দীনদয়াল উপাধ্যায়েরা জনভিত্তিহীন। স্বাধীনতা সংগ্রামেই তাদের ভূমিকা কাপুরুষের। বরং হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকার, মদনমোহন মালব্য বা লালা লাজপত রায়ের মত নেতাদের বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াইতে খুব উজ্বল না হলেও একটা ঐতিহ্য ছিল।
- হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টারা বুঝতে পারেন, গান্ধীর অহিংসা নয়, সাভারকারের হিংসাই ‘বেসিক ইন্সটিংক্ট’। এই রাজনীতি দিয়েই সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মুসলিম নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়ায় সামিল করানো সম্ভব।
- আসামের বাইরে সাভারকারই প্রথম নেতা যিনি সতর্ক করেছিলেন যে পূর্ববাংলার মুসলমানদের আসামে অস্বাভাবিকভাবে হারে মাইগ্রেশনে র ফলে ভবিষ্যতে অসমিয়া সংস্কৃতিতে রূপান্তর ঘটবে এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে দীর্ঘমেয়াদী উত্তেজনার সৃষ্টি হবে।
প্রসঙ্গগুলিতে ঢোকবার আগে আসুন আজ পর্যন্ত ভারতীয় সংসদে বিভিন্ন দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তালিকার মুখ্য অংশগুলিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক, যেখান থেকে ভারতীয় নির্বাচকমণ্ডলীর মূল ধারার গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ ভারতে আভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি ছিল।
- ষষ্ঠ লোকসভায় (মার্চ ১৯৭৭ থেকে জানুয়ারী ১৯৮০) মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে আর মূলত ভারতীয় জনসঙ্ঘের শক্তিতে জনতা পার্টি পেলো একাই ৩০২, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ২২, কমিউনিস্ট পার্টি ৭টি আসন আর কংগ্রেস দল নেমে এলো ১৬৪টি আসনে। প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই। মার্চ ১৯৭৭ থেকে জুলাই ১৯৭৯। মোরারজি দেশাইয়ের পদত্যাগের পর স্বল্প সময়ের জন্য তাঁর ডেপুটি চৌধুরী চরণ সিং জুলাই ১৯৭৯ থেকে জানুয়ারী ১৯৮০ প্রধানমন্ত্রী থাকেন।
-
- ১৯৭৯ সালে জামশেদপুর ও আলীগড়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়েছিল।
- ১৯৮০ সালে মোরাদাবাদেও একইভাবে দাঙ্গায় ইন্ধন যাগানো হয়।
- ১৯৮০ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি(বিজেপি)-র জন্ম হয়।
- সপ্তম লোকসভায় (জানুয়ারী ১৯৮০ থেকে অক্টোবর ১৯৮৪) কংগ্রেস পেলো একাই ৩৭৭, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ৩৯, কমিউনিস্ট পার্টি ১৪, জনতা (এস) ৪৩, জনতা পার্টি ১৭ এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ১৩টি আসন। জানুয়ারী ১৯৮০ থেকে অক্টোবর ১৯৮৪ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর (অক্টোবর ১৯৮৪ থেকে ডিসেম্বর ১৯৮৪) স্বল্প সময়ের জন্য রাজীব গান্ধী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হন।
-
- ১৯৮৩তে বাজপেয়ী দলের হয়ে আসাম নির্বাচনের দায়িত্ব পান। বিদেশী ইস্যু উত্থাপন।
- ১৯৮৩তে আসামে গণহত্যা। সরকারী হিসাবে নেলীতে ২০০০ এর উপর মুসলমান হত্যা। বেসরকারী মতে অনেক বেশী।
- ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড শিখ দাঙ্গার সূত্রপাত করেছিল, যে গণহত্যায় ২,৭০০-রও বেশি মানুষ মারা যান এবং হাজার হাজার জন আহত হন।
- কাশ্মীর অঞ্চলে, বিভিন্ন ঘটনায় ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় ৩০০ জন কাশ্মীরি পণ্ডিত মারা যান।
- অষ্টম লোকসভায় (ডিসেম্বর ১৯৮৪ থেকে ডিসেম্বর ১৯৮৯) কংগ্রেস পেলো একাই ৪২৬, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ২৩, কমিউনিস্ট পার্টি ৬, তেলেগু দেশম পার্টি ২,জনতা পার্টি ১৬, অসম গণ পরিষদ ৭ এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) মাত্র ২টি আসন। পূর্ণসময়ের জন্য রাজীব গান্ধী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হন।
-
- আলফা ক্র্যাকডাউন। ১৯৮৫ আসাম চুক্তি পাশ।
- ২১শে মে, ১৯৮৭ মীরাট দাঙ্গা শুরু হয়েছিল এবং দুই মাস অব্যাহত ছিল। সংখ্যাগুরুর দাবী অনুযায়ী প্রাদেশিক সশস্ত্র কনস্টাবুলারি(পিএসি)-র কর্মীদের দ্বারা হত্যার প্রতিক্রিয়ায় হাশিমপুরা এলাকা থেকে একজনকে গ্রেপ্তার করতে গেলে জনতা বাধা দেয়। মুসলিমরা আক্রান্ত হয়। পরের দুই মাসে, ৩৫০ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
- ১৯৮৯ সালের ২৩ শে অক্টোবর ভাগলপুরে পুলিশের নৃশংসতায় মাসব্যাপী দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে পুলিশের নৃশংসতার পরে, ভাগলপুরে গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে থাকে, যেখানে এক হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যান, প্রায় ৫০,০০০ জন বাস্তুচ্যুত হন এবং ১১,৫০০ টি বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
- নবম লোকসভায় (ডিসেম্বর ১৯৮৯ থেকে জুন ১৯৯১) কংগ্রেস পেলো একাই ১৯৫, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ৩৪, কমিউনিস্ট পার্টি ১২, জনতা দল (জেডি) ১৪২, ভারতীয় জনতা পার্টি ৮৯টি আসন। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। নভেম্বর ১৯৯০ থেকে জুন ১৯৯১ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন চন্দ্রশেখর।
-
- ১৯৯০ সালের মার্চ থেকে, ইসলামিক মৌলবাদীদের দ্বারা নিপীড়নের কারণে কাশ্মীরের ৩০০,০০০ থেকে ৫০০,০০০ জন পন্ডিত কাশ্মীর উপত্যকা থেকে মাইগ্রেট করে চলে যান ভাদোদরা।
- সেপ্টেম্বর ১৯৯০, গণেশ বিসর্জন উপলক্ষে, গুজরাতের ভাদোদরা হিংস্রতম দাঙ্গা দেখে। গণেশ বিসর্জন শোভাযাত্রার সময়, পুলিশের উপস্থিতিতে এই দিনটিতে ব্যপক ধ্বংসলীলা চালানো হয়। মনে রাখা দরকার ভাদোদরার এই দাঙ্গার পরেই আদভানির রথযাত্রা শুরু হয়েছিল।
- দশম লোকসভায় (জুন ১৯৯১ থেকে মে ১৯৯৬) কংগ্রেস পেলো ২৫২ ও বিজেপি ১২১টি আসন। জুন ১৯৯১ থেকে মে ১৯৯৬ নরসিমা রাও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হন।
-
- ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস।
- ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারণে দাঙ্গা শুরু হয়। শ্রীকৃষ্ণ প্যানেল ৫০২ জন সাক্ষীকে পরীক্ষা করেছিল, কিন্তু একজন পুলিশ অফিসারও এখন পর্যন্ত শাস্তি পায়নি।
- ১৯৯২ মুম্বাই দাঙ্গা: বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার কয়েক ঘন্টা পরে মুম্বাই ফেটে পড়ে। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারী শহরটিতে প্রায় ১৭৮৮ জন মারা গিয়েছিল।
- একাদশ লোকসভায় (মে ১৯৯৬ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯৭) ভারতীয় জনতা পার্টি একাই পেলো ১৬৩, কংগ্রেস ১৪০, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ৩২, কমিউনিস্ট পার্টি ১২, জনতা দল (জেডি) ৩০ ও শিবসেনা ১৫টি আসন। মে ১৯৯৬ থেকে জুন ১৯৯৬ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি(বিজেপি)-র অটল বিহারী বাজপেয়ী, জুন ১৯৯৬ থেকে এপ্রিল ১৯৯৭ যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেভগৌড়া, এপ্রিল ১৯৯৭ থেকে মার্চ ১৯৯৮ জনতা দলের আই কে গুজরাল প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
-
- কোয়েম্বাটোরে হিন্দু মুসলমান লাগাতার দাঙ্গায় কম করে ৬০ জনের মৃত্যু।
- জাতিসংঘ সুরক্ষা কাউন্সিল ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য নিন্দা করে সর্বসম্মতিক্রমে ভোট দেয়।
- দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে, বিশেষত পেঁয়াজের দাম কমাতে ব্যর্থতার জন্য কংগ্রেস দলের কাছে স্থানীয় নির্বাচন হেরে যায় বিজেপি।
- দ্বাদশ লোকসভায় (মার্চ ১৯৯৮ থেকে অক্টোবর ১৯৯৯) ভারতীয় জনতা পার্টি পেলো একাই ১৮২, কংগ্রেস ১৪২, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ৩২, কমিউনিস্ট পার্টি ৯, সমাজবাদী পার্টি ২০, রাষ্ট্রীয় জনতা দল ১৭, সমতা পার্টি ১২, তেলেগু দেশম পার্টি ১২, জনতা দল (জেডি) ৬, পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেস ৬ ও শিবসেনা ৬টি আসন। মার্চ ১৯৯৮ থেকে অক্টোবর ১৯৯৯ সালে মোট ১৯ মাস আবারও বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্ব।
-
- মে ১৯৯৮ পোখরানে পরপর ভারতের নিউক্লিয়ার পরীক্ষা। জাপান ও আমেরিকার অর্থনৈতিক স্যাংশন জারি।
- জানুয়ারী ১৯৯৯, অস্ট্রেলিয়ান খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ও তাঁর দুই নাবালক পুত্রকে, এক রাতে তাঁরা যখন একটি স্টেশন ওয়াগনে ঘুমোচ্ছিলেন, ওড়িশার কেওনঝড় জেলার মনোহরপুর গ্রামে মৌলবাদী হিন্দু বজরঙ্গ দল জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। অভিযোগ, তাঁরা আদিবাসীদের ধর্মান্তরণে উৎসাহিত করছিলেন।
- ১৯৯৯ সালে, কারগিল যুদ্ধের সময় আহমেদাবাদ শহরে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে, যখন গুজরাটের মুসলমানদের পাকিস্তানপন্থী এবং ভারতবিরোধী বলে সূক্ষ্মভাবে প্রচার এবং আক্রমণ চালানো হয়।
- ত্রয়োদশ লোকসভায় (অক্টোবর ১৯৯৯ থেকে ফেব্রুয়ারী ২০০৪) ভারতীয় জনতা পার্টি একাই পেলো ১৮৯, কংগ্রেস ১১৮, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ৩৫, কমিউনিস্ট পার্টি ৫, তেলেগু দেশম পার্টি ৩০, সমাজবাদী পার্টি ২৯, বহুজন সমাজ পার্টি ১৫, শিবসেনা ১৫, জনতা দল (ইউ) ৯ ও সারা ভারত তৃণমূল কংগ্রেস ৯টি আসন। অটল বিহারী বাজপেয়ী এবার পূর্ণসময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন।
-
- ২০০১ জানুয়ারী, গুজরাটের ভূমিকম্প, ২০০১ ডিসেম্বর, পার্লামেন্টে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ।
- গুজরাট দাঙ্গা ২০০২কে বলা হয় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিশোধের ঘটনা, যদিও বেশীর ভাগ মানবাধিকার সংস্থার মতে বাস্তবে এটি ছিল ‘রাষ্ট্র-অনুমোদিত সুসংগঠিত ২০০০-এর বেশী মানুষের হত্যাসাধন ও লুন্ঠনের ঘটনা’।
- ২০০৩সালে বাজপেয়ী মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার প্রথম ধাপ নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের খোলনলচে পাল্টে দিয়ে সংশোধনী পাশ করান।
- চতুর্দশ লোকসভায় ( মে ২০০৪ থেকে মে ২০০৯) কংগ্রেস পেলো একাই ১৫৯, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ৪৪, কমিউনিস্ট পার্টি ১১, রাষ্ট্রীয় জনতা দল ২৫, বহুজন সমাজ পার্টি ২৪, সমাজবাদী পার্টি ৪০, জনতা দল (ইউ) ১০, ভারতীয় জনতা পার্টি ১৪৪, শিবসেনা ১৪ ও সারা ভারত তৃণমূল কংগ্রেস ১টি আসন। কংগ্রেসের মনমোহন সিং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হন।
-
- গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন চালু।
- গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প চালু।
- আর.টি.আই আইন চালু।
- মুম্বাই টেররিস্ট অ্যাটাক।
- আমেরিকার সঙ্গে নিউক্লিয়ার চুক্তি স্বাক্ষর।
- পঞ্চদশ লোকসভায় (মে ২০০৯ থেকে মে ২০১৪) যেখানে কংগ্রেস পেলো একাই ২১১, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ১৬, কমিউনিস্ট পার্টি ৪, বহুজন সমাজ পার্টি ২১, সমাজবাদী পার্টি ২৩, জনতা দল (ইউ) ২০, ভারতীয় জনতা পার্টি ১১৯, শিবসেনা ১১ ও সারা ভারত তৃণমূল কংগ্রেস ২১টি আসন। কংগ্রেসের মনমোহন সিং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হন।
-
- কমনওয়েলথ গেম দুর্নীতি।
- টুজি স্পেকট্রাম বন্টন দুর্নীতি।
- কয়লা ব্লক বন্টন দুর্নীতি।
- ষোড়শ লোকসভায় (মে ২০১৪ থেকে মে ২০১৯) ভারতীয় জনতা পার্টি পেলো ২৮৯, কংগ্রেস ৫০, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ৯, কমিউনিস্ট পার্টি ১, সারা ভারত তৃণমূল কংগ্রেস ৩৮, সমাজবাদী পার্টি ৭, শিব সেনা ১৮, তেলেগু দেশম পার্টি ১৬ ও এআইইউডিএফ ৩টি আসন। নরেন্দ্র মোদী পূর্ণসময়ের জন্যভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হন।
-
- আসামে এনআরসি প্রক্রিয়া চালু।
- গোরক্ষক বাহিনী, অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড ও স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের তাণ্ডব শুরু।
- গৌরী লঙ্কেশ হত্যা ও দেশজুড়ে কৃষক বিক্ষোভ।
- ফেব্রুয়ারী ২০১৯,পুলওয়ামায় টেররিসিট আক্রমণে ভারতীয় সৈন্যের ক্ষয়ক্ষতি। বালাকোটে অপ্রমাণিত সার্জিকাল স্ট্রাইক এর দাবী। মোদীর জনপ্রিয়তার গ্রাফ উর্দ্ধমুখী।
- সপ্তদশ লোকসভায় (মে ২০১৯ থেকে চলছে)ভারতীয় জনতা পার্টি পেলো ৩০৩, কংগ্রেস ৫২, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ৩, কমিউনিস্ট পার্টি ২, সারা ভারত তৃণমূল কংগ্রেস ২২, জনতা দল (ইউ) ১৫ ও শিব সেনা ১৮টি আসন। মে ২০১৯ থেকে এখনও নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন।
-
- ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে বিশেষ মর্যাদা বা সীমিত স্বায়ত্তশাসন বাতিল।
- তিন তালাক প্রথা বাতিল।
- সারা দেশে এনআরসি প্রক্রিয়া চালু করার ঘোষণাা। সংসদে সিএএ পাশ; দেশজুড়ে বিক্ষোভ।
- নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে মূলতঃ মুসলিম বিক্ষোভে ২০২০ সালে দিল্লিতে একের পর এক দাঙ্গা, যার ফলে ৫৩ জন নিহত এবং ২০০ জনেরও বেশি গুরুতর আহত।
- কোভিড-১৯ লকডাউনে ইতিমধ্যেই বিধ্বস্ত ভারতীয় অর্থনীতির আরও বিধ্বস্ত হয়ে পড়তে থাকা। মুসলিমদের কাঁধে কোভিড-১৯ সংক্রমণের দায় চাপানোর চেষ্টা অব্যাহত।
প্রশ্ন উঠতে পারে এখানে সাভারকারের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়। প্রথমত, ভারতীয় ভোটাররা কখনই ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেয় নি। বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে হিন্দু এবং মুসলিম দলগুলিকে। একদিকে নেহেরু পরিবারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টায়, জরুরি অবস্থায় তিতিবিরক্ত হয়েছে। অন্যদিকে ইণ্ডিয়া শাইনিং এর ঢক্কানিনাদে, বাজপেয়ীর তিন মেয়াদের প্রধানমন্ত্রীত্বকেও ঘাড়ধাক্কা দিয়ে, সোনিয়া-মনমোহনকে ফিরিয়ে এনেছে দু বারের মেয়াদে। নীতিবর্জিত রাষ্ট্রচালনা ভারতীয় নির্বাচকমণ্ডলী পছন্দ করে না। অতএব এখন রাষ্ট্রচালকেরা অনেক অভিজ্ঞ, ধূর্ত। সাভারকারের তত্ত্বের প্রায়োগিক দিকগুলি তাদের হাতের অস্ত্র। কমিউনিস্টদের ম্যানিফেস্টো, মুসলিমদের কোরাণ, খৃস্টানদের বাইবেলের মত এখন হিন্দুরাও মাথায় সাভারকারের হিন্দুত্ব নিয়ে ঘোরে। পরবর্তী পর্বগুলিতে আমরা ব্যক্তি সাভারকারকে কম এবং তাত্ত্বিক সাভারকারকে নিয়ে বেশী কথা বলবো। বর্তমান ভারতনির্মাতাদের বিশ্লেষণ করে দেখবো কোথায় সাভারকারের ছায়াহীন অস্তিত্ব তাদের দিশা দেখাচ্ছে। এই পর্বের তথ্যাবলী পরবর্তীতে ‘রেডি রেকনার’ হিসাবে কাজ করবে।
পঞ্চম কিস্তি : কংগ্রেস রাজনীতি ও সাম্প্রতিক সাভারকার পুনর্বাসন পর্ব
গ্রন্থসূত্র ও তথ্য সূত্র:
- The Origins of Religious Violence : An Asian Perspective by Nicholas F. Gier
- Hindutva. Who is Hindu? by V.D. Savarkar
- The Hindu Mahasabha and the Indian National Congress, 1915 to 1926, by Richard Gordon
- Demons in Hindutva: Writing a Theology for Hindu Nationalism, by M. Reza Pirbhai
- Country First? Vinayak Damodar Savarkar (1883–1966) and the Writing of Essentials of Hindutva, by Janaki Bakhle
- Patriots and Partisans: From Nehru to Hindutva and Beyond, by Ramchandra Guha
- The History of Hindu India, by Satguru Bodhinatha Veylanswami
- Uproot Hinditva: The Fiery Voice of the Liberation Paathers, by Thirumaaialavan, translated from the Tamil by Meenakandasamy
- The Saffron Wave: Democracy And Hindu Nationalism In Modern India, by Thomas Blom Hansen
- Savarkar: Echoes from a Forgotten Past, by Sampath, Vikram.
- The Brotherhood in Saffron: The Rashtriya Swayamsevak Sangh and Hindu Revivalism, by Walter Anderson & Shridhar D. Damle
- Savarkar’s views on Hindu Nationalism, by Sauro Dasgupta
- Swami Vivekananda : The Friend of All, by Swami Lokeswarananda
লেখক প্রাবন্ধিক ও কবি। মতামত লেখকের নিজস্ব।