‘এনজয় তামিল ব্রাহ্মিনিকাল কুইজিন’– কলকাতার রেস্তোরাঁর হোর্ডিং, ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির স্পষ্ট ছবি


  • May 21, 2022
  • (1 Comments)
  • 2007 Views

কলকাতায় অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা সুসজ্জিত রেস্তোরাঁ, কফিশপ অনেকের কাছেই কাজ, নিজস্ব সময়, প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর জায়গা। সুস্বাদু, ভালো মানের খাবার ও পানীয় বাড়তি আকর্ষণ। সেখানেই যদি এভাবে ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্যবাদ, খাবারের রাজনীতি, জাতি-বর্ণের স্টিরিওটাইপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তাহলে তাকে প্রশ্ন করতে থাকা আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে সময়ের দাবি। সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।

 

খাস কলকাতায় এক রেস্তোরাঁর বিরাট বড় হোর্ডিং-এ সম্প্রতি চোখ আটকে যায়। এক দশক পেরোনো এক রেস্তোরাঁ চেইন-এর জনপ্রিয় তামিল খাবারের দোকানের নতুন বিজ্ঞাপন। সেখানে ধুতি, পাঞ্জাবি, উত্তরীয়তে সজ্জিত এক ব্যক্তি একটি ধোসার প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ও সেই হোর্ডিং-এ ব্যবহৃত বিজ্ঞাপনের ভাষাটি হল ‘এনজয় তামিল ব্রাহ্মিনিকাল কুইজিন’ অর্থাৎ উপভোগ করুন তামিল ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ রান্না। এই বিজ্ঞাপন দেখে বাস্তবিকই অবাক হয়ে যেতে হয়। যে কলকাতায় ধর্মনিরপেক্ষতা, বর্ণবাদ-বিরোধিতা নিয়ে অন্তত কিছুটা হলেও গর্ব করার জায়গা ছিল এতদিন, আচমকাই একটি প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় রেস্তোরাঁর তার বিপরীতে দাঁড়ানো বিরাট বিজ্ঞাপন দেখে আশঙ্কা জন্মায়। খাবারের রাজনীতি, যা আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে শাসকের, রাষ্ট্রের বৈষম্য, হিংসা, দ্বেষ তৈরি করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, তা যে এইভাবে ধীরে ধীরে এ রাজ্যেও বাসা বেঁধেছে তা চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। এবং এক্ষেত্রে কলকাতা তথা এ রাজ্যের বাসিন্দা হিসাবে আমাদেরও কোথাও একটা এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার দায়িত্ব থেকে যায়। কারণ দেশের কোনও একটি অঞ্চলের বা নির্দিষ্ট কোনও গোষ্ঠীর খাবারকে একমাত্রিকভাবে দেখার প্রবণতাই এই চরম বর্ণবাদ ও খাবারকে ধর্মীয় রূপ দেওয়ার জায়গাটি তৈরি করে দিয়েছে। যেমন কলকাতায় সেই সত্তরের দশকের শেষাশেষি বা আশির দশক থেকে ক্রমশ বাড়তে থাকা দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা মানুষদের ও তাদের খাদ্যাভ্যাসকে ‘দক্ষিণ ভারতীয়’ বলে দেগে দিয়ে স্টিরিওটাইপ তৈরি করে দেওয়া, যে তাঁরা নাকি শুধুই ইডলি-ধোসা-উত্থপম জাতীয় নিরামিষ খাবার খান।

 

দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষদের বিবিধ খাদ্যাভ্যাস, সেখানকার আমিষ খাবারের বৈচিত্র্য, সেখানকার বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের যে আলাদা ধরনের জীবনযাপন ও সেই অনুযায়ী খাবার-দাবারের বিভিন্নতা, তা বোঝার ও জানার চেষ্টাও করিনি আমরা কখনও। যেভাবে দক্ষিণ ভারতের পৃথক রাজ্যের ভাষার যে পার্থক্য, তা-ও অনেক সময়ই মনে রাখার চেষ্টা করি না আমরা। যার ফলস্বরূপই হয়তো এ ধরনের বর্ণবাদী মানসিকতা প্রশ্রয় পেয়ে যায় বিজ্ঞাপনের ভাষায়। যখন এ দেশে ফ্রিজে কী খাবার রয়েছে তার ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ মারা যায়, তখন খাদ্য ব্যবসায় জড়িত থাকা মানুষদের ভাষা প্রয়োগে আরও বেশি সচেতন ও সংবেদনশীল হওয়া উচিত নিঃসন্দেহে। নিজেদের রেস্তোরাঁ সকলের জন্য উন্মুক্ত করতে গিয়ে আসলে তাঁরা বৈষম্যবাদকেই পরোক্ষে জায়গা করে দিচ্ছেন।

 

কেন তাঁরা এই হোর্ডিং-এ ‘ব্রাহ্মিনিকাল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা জানতে এই প্রতিবেদক ফোন করেন রেস্তোরাঁটি যে কোম্পানির অধীন সেই কোম্পানিতে। কথা হয় কোম্পানির তিন কর্ণধারের অন্যতম অনিন্দ্য পালিতের সঙ্গে। এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জানান যে, কোনও বর্ণবাদী মনোভাব থেকে নয়, তাঁরা তামিল জনগোষ্ঠীর মানুষদের কিছু ধর্মীয় উৎসবে যে বিশেষ খাবার ঈশ্বরকে নিবেদন করে পরিবেশন করা হয়, সেই বিশেষ খাবারের মেনু বোঝাতেই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সেইসব অনুষ্ঠানের বিশেষ সুস্বাদু খাবার কলকাতায় সবার জন্য নিয়ে আসার উদ্দেশ্যেই এই বিজ্ঞাপন ও ওই শব্দ ব্যবহার। তাঁকে বারেবারে প্রশ্ন করেও বোঝানো সম্ভব হয়নি যে, একটি নির্দিষ্ট প্রদেশের মানুষকে একটিমাত্র বাক্সে বন্দী করা যায় না, বা কোনও খাবারকে নির্দিষ্ট বর্ণের বলা মানেই বৈষম্য তৈরি করা। কেন শুধুমাত্র ‘তামিল ফেস্টিভ্যাল কুইজিন’ বলা হল না তা জানতে চাইলে তিনি জানান, দক্ষিণ ভারতে এ ধরনের অনেক উৎসব থাকে যেখানে ব্রাহ্মণেরাই নির্দিষ্টভাবে কিছু খাবার তৈরি করেন, ফলে ‘এক্সক্লুসিভ’ খাবার বোঝাতেই ওই শব্দবন্ধ ব্যবহার। এর মাধ্যমে তাঁরা যে ব্রাক্ষণ্যবাদকেই উসকে দিচ্ছেন, সেই যুক্তি দেখতে তিনি অপারগ থাকেন। বরং কথাবার্তার শেষে সবকিছুতেই বিতর্ক তৈরি করতে চাওয়ার ইচ্ছে থেকে বিজ্ঞাপনটির সমালোচনা করা হচ্ছে, এবং দেশে যখন সংরক্ষণ প্রথা চালু থাকে ও তাতে পিছিয়ে থাকা শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী বা চাকরিপ্রার্থীরা লেখাপড়ায় সুযোগ বা পেশার জায়গায় চাকরি পেয়ে যান, তখন আমরা কেন চুপ করে থাকি, তিনি সেই প্রশ্নটিও তোলেন। এই দু’টি বিষয়ের মধ্যে যে আপাতভাবে কোনও যোগ নেই ও সংরক্ষণের বিষয়ে তাঁর মনোভাব যে ‘ব্রাহ্মিনিকাল’ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ, তা মেনে নিতে তৈরি ছিলেন না তিনি।

 

এই জায়গাতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় অনুষা চন্দ্রশেখরনের বক্তব্য। অনুষা একজন ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনাল। তাঁর পরিবার বহুদিন কলকাতার বাসিন্দা ছিল। অনুষার বেড়ে ওঠা, স্কুল, ইউনিভার্সিটি কলকাতায়। তাঁর পরিবার আপাতত মূল আবাস কোয়েম্বাটুর-এ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাকরিসূত্রে থেকে অনুষা এখন আবার কলকাতায়। তিনি জানালেন, “সত্তর ও আশির দশকে যে মানুষেরা ভারতের দক্ষিণ (বিশেষত তামিলনাড়ু ও কেরালা) থেকে কলকাতায় পরিযায়ী হয়ে আসেন, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিলেন উচ্চবর্ণের। তাঁদের উপস্থিতি ও সামাজিক পুঁজি একটি নতুন শহরের খাদ্যসংস্কৃতিকে প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এমনকি তামিলদের ‘ইডলি-ধোসা’ বলে ঠাট্টা অবধি করা হত। এবং আজ সেই শহরে তৈরি হয়েছে ‘সারাভানা ভবন’, যারা তামিল নিরামিষ খাবার পরিবেশন করে মেইন থেকে মেক্সিকো পর্যন্ত সর্বত্র। তামিলনাড়ুতে কম প্রভাবশালী বর্ণের মানুষেরা যে খাবার বানান, তা কখনওই ওই রাজ্যের বাইরে খুব একটা পৌঁছতে পারে না, এমনকি কলকাতার মতো জায়গায়তেও। কেন? সেই প্রশ্নটাই তো করা উচিত। আমার এক বন্ধু যেমন বলছিলেন, মহারাষ্ট্রের ধারাবির মতো জায়গায়, যেখানে মূলত দলিত ও অন্যান্য কম প্রভাবশালী জাত-বর্ণের মানুষেরা ও নিম্ন বর্গের মানুষেরা পরিযায়ী হয়ে পৌঁছেছিলেন, সেখানে তামিল খাবার হিসাবে পরিচিত হল পরোটা আর বিভিন্ন আমিষ খাবার। কলকাতায় তামিল খাবার মানেই তামিল ব্রাহ্মণদের খাবার – এটা স্বীকার করে নিতেই হবে। তিনি বলেন – “এমনকি আমি নিজেও তামিলনাড়ুতে যে বিশাল আমিষ খাবারের পরিধি রয়েছে, তার মাত্র কয়েকটি – যেমন ফিশ কুলাম্ভ, এগ রোস্ট, মাটন বিরিয়ানি – এ ছাড়া প্রায় কিছু জানিই না। শুনেছি তামিলনাড়ুতে অ-ব্রাহ্মণরাও নিরামিষ হোটেল চালান, যেগুলিকে তাঁরা বলেন হাই ক্লাস ভেজ হোটেল, এটা বোঝাতে যে রান্নাটা সেখানে ব্রাহ্মণরাই করেন।” তিনি আরও জানালেন সারা তামিলনাড়ুতেই ছড়িয়ে রয়েছে জাতি-বর্ণনির্দিষ্ট খাবারদাবার – রাওথর বিরিয়ানি থেকে শুরু করে চেট্টিনাড় কুইজিন। তামিল ব্রাহ্মণদের খাবার অ-ব্রাক্ষণদের থেকে আলাদা হয় রসুনের ব্যবহার ও কম ঝাল ব্যবহারে। “হয়তো এই বিজ্ঞাপনটি নিয়ে কথা শুরু হওয়ার পর এই সুযোগটিকে কাজে লাগানো যেতে পারে বাংলায় অন্যান্য অ-ব্রাহ্মণ তামিল কুইজিন (নিরামিষ, আমিষ দুই’ই) জনপ্রিয় করে তোলার জন্য। কেউ হয়তো এই চ্যালেঞ্জটিও নিতে পারেন – এমনই বক্তব্য তাঁর।

 

অ্যান্ড্রিউ জোসেফ (নাম পরিবর্তিত) অবশ্য সরাসরিই এই বিজ্ঞাপনের ভাষার সঙ্গে সারা দেশ জুড়ে খাদ্যের যে রাজনীতি চলছে তার স্পষ্ট যোগ খুঁজে পান। যেভাবে একেকটি ধর্মীয় পরিচিতির সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া নির্দিষ্ট খাবার, উচ্চ বর্ণ-নিম্ন বর্ণের খাবারের মধ্যে পার্থক্য করা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে দেশে বিভেদ ও হিংসার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে কলকাতার এই বিজ্ঞাপনের কথা জানতে পেরে আশঙ্কিত তিনি। অবশ্য তামিলনাড়ুতে এমন ঘটনা ঘটলে যে সঙ্গে সঙ্গেই বিক্ষোভ শুরু হয়ে যেত, দূরাভাষে সে কথাও বললেন তিনি। তাঁর মতে, কলকাতায় আচমকা এমন ঘটনায় মানুষ প্রথমে হতবাক হয়ে যাবে – এমনটাই স্বাভাবিক। তবে তারপর প্রশ্ন তোলা ও প্রতিবাদ করাও জরুরি। না হলেই খাবার থেকে শুরু করে সমস্তকিছুতেই উচ্চবর্ণের মানুষদের প্রাধান্য তৈরি করা সহজ হয়ে যাবে। উৎসব-অনুষ্ঠানের খাবার, ঈশ্বরকে নিবেদন ইত্যাদি বলে, সরাসরি ‘ব্রাহ্মিনিকাল’ শব্দ ব্যবহার করে জাত-বর্ণের বৈষম্য তৈরি করা হচ্ছে – জানালেন তিনি। ছোট ছোট কিছু বিষয়েও এই বৈষম্য থাকতে পারে, যেমন রান্নায় ব্রাহ্মণরা যে ঘি ব্যবহার করে তা অন্যদের থেকে আলাদা, ফলে ব্রাহ্মণদের খাবার বললে এমন অনেক বৈষম্যকে মেনে নেওয়া হয়। তামিলনাড়ুতে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণদের আলাদা আমিষ, নিরামিষ দু’রকমেরই ক্যুইজিন আছে ও অন্যান্য রাজ্যে যেমন পশ্চিমবঙ্গে সেগুলির প্রচার হওয়া, পরিবেশন হওয়া দরকার আরও বেশি করে, এমনটাই তাঁর বক্তব্য। তাছাড়া নিরামিষ খাবারকে উচ্চবর্ণের, ব্রাহ্মণদের খাবার বলে দাগিয়ে দেওয়ার মধ্যে সারা দেশের খাদ্য রাজনীতিরই প্রতিচ্ছবি। হিন্দুদের খাবার মানেই নিরামিষ খাবার, উচ্চবর্ণের খাবার মানেই নিরামিষ খাবার, এক রাষ্ট্র এক খাদ্যের নীতি চালু করার কথা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে রুখে দাঁড়ানোর পক্ষে সওয়াল করেন তিনি।

 

প্রায় একই সুর শোনা যায় তামিলনাড়ুর আরেক বাসিন্দা সৌমায়া-র কন্ঠেও। তিনি প্রথমেই জানান, এই বিজ্ঞাপনটির সরাসরি প্রতিবাদ করা উচিত ও এর বয়ানটি অত্যন্ত সমস্যাজনক। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও পেশাগত জায়গায় তৈরি হওয়া রাজনৈতিক ভাবনার জায়গা থেকে বলেন, এভাবে নিজেদের বর্ণকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়াটা সমস্যাজনক। মালিকপক্ষের বিবৃতি শোনার পর তিনি বলেন, “আমার মনে হয় না, এই যুক্তিটি খুব সঠিক, কারণ শুধুমাত্র ব্রাহ্মণরাই তো আর উৎসব-অনুষ্ঠানে যায় না। উৎসবে মন্দিরে যে খাবার পরিবেশন হয়, উনি যদি সেই খাবারের কথা বলেন, তাহলে বলতে হয় মন্দিরে শুধু ব্রাহ্মণরা যায় না – তামিলনাড়ুতে নানা বর্ণের বহু মানুষকে খাওয়ানোটাও উৎসবের অংশ। এই ধরনের বক্তব্য সমাজের ভেদাভেদপূর্ণ মানসিকতায় আরও একটি স্তর যোগ করে। যদি এই রেস্তোরাঁর মালিক এটা না-ও বলে থাকেন যে, আমি আমার রেস্তোরাঁয় দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের আসা ও খাওয়ায় কোনও বাধা দিচ্ছি না – আমরা কিন্তু ভুলতে পারি না যে, গত কয়েক বছরে আমরা আমাদের চারপাশেই এ ধরনের বাধা দানের ঘটনা আমরা অনেক ঘটতে দেখেছি, যার জন্য আমরা নিজেদের উপরেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করি – যেমন পুরীর মন্দিরে লেখা থাকে দলিত ও আদিবাসীদের প্রবেশ নিষেধ। যদি কেউ নিজের শিক্ষা, জানা-বোঝার জায়গা থেকে এই ভাবনা পেরিয়েও যান, তবু তাঁরা অহেতুক সমস্যা এড়াতে সাধারণত এরকম নিয়মগুলি মেনে নেন। আমরা তৈরি করতে চাইছি একটি ‘ইগালিটেরিয়ান’ ব্যবস্থা, যেখানে কেউ কিছু থেকে বাদ পড়বেন না। এ ধরনের বিজ্ঞাপন হয়তো না চাইতেই এমন বেশ কিছু ন্যারেটিভকে পুষ্ট করে দেয়, যা বর্তমানে অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছে। সম্পূর্ণ নিরামিষ রেস্তোরাঁ হওয়ার মধ্যে সেভাবে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু এখানে যে খাবার পরিবেশন করা হয়, সাধারণভাবে সেইসব ইডলি-ধোসাকে কলকাতার মানুষ তামিলনাড়ুর খাবার, ‘সাউথ ইন্ডিয়ান’ খাবার বলেই দেগে দেয়; সেগুলিকে ব্রাহ্মণদের খাবার বলে লেবেল লাগিয়ে দেওয়া আমার কাছে অযৌক্তিক। খাবারের বিষয়টি পুষ্টি ও কোথায় কী পাওয়া যাচ্ছে তাই দিয়েই বিবেচনা করা উচিত।” তিনি উল্লেখ করেন সারা তামিলনাড়ু জুড়ে চলা ভর্তুকি দেওয়া ক্যান্টিন বা জয়া ক্যান্টিনের কথা, যেখানে প্রতিদিন ইডলি, ধোসা ও পোঙ্গল পরিবেশন করা হয়, যেগুলিকে আদৌ বর্ণবাদী বা কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য ‘এক্সক্লুসিভ’ মনে করা হয় না।

 

তামিলনাড়ুর মানুষদের এই যে স্টিরিওটাইপ তৈরি করে দেওয়া ও দেশের অন্যান্য রাজ্যে তাঁদের কীভাবে দেখা হয় তা বুঝতে হয়তো বলিউডে বা হিন্দি সিনেমায় তামিল কোনও চরিত্রের চরিত্রায়ণ দেখাই যথেষ্ঠ। যেন ধরেই নেওয়া হয় যে প্রত্যেক তামিল মানুষ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে রেঁস্তোরায় গিয়ে ইডলি, সম্বর, ধোসা ও নির্দিষ্টভাবে ফিল্টার কফি খান। কথা হচ্ছিল সামাজিক ক্ষেত্রের কর্মী রূপেশ কুমারের সঙ্গে যিনি সামাজিক ন্যায় নিয়ে কাজ করেন, বললেন, “আমি জানি না কবে তামিলদের নিয়ে এই স্টিরিওটাইপ উপস্থাপনা বন্ধ হবে তবে আমাদের দিক থেকে বেশ দীর্ঘ প্রতিবাদ চালিয়েই যেতে হবে, এটুকু জানি। তামিল মানুষেরা কারা, তাঁদের সংস্কৃতিই বা কী তা যেভাবে মূলস্রোতে দেখানো হয় তা খুবই সমস্যাজনক ও এগুলিকে লাগাতার প্রশ্ন করে যেতে হবে। আমি বলতে চাই এটা জাতপাত, বর্ণবাদের বিষয় নয়। এইটি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিষয়। আমাদের স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে বর্ণবাদ বর্ণ কাঠামোর উপর তৈরি হওয়া সামাজিক ব্যবস্থার কথা বলে। একটি সামাজিক সিঁড়ি যদি কল্পনা করা হয়, তাহলে কে কোথাও রয়েছে তা বর্ণবাদ দিয়ে বোঝা যায়। ব্রাহ্মণ্যবাদ তার চেয়েও বেশি কিছু। ব্রাহ্মণ্যবাদের মধ্যে বহুস্তরীয় বৈষম্য রয়েছে, যার উপরের দিকেই থাকবে লিঙ্গ বৈষম্য। শুধু নারীরাই নন, রয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরাও। ব্রাহ্মণেরা যাঁদের বিরুদ্ধে রায় দেন যে তাঁদের জনসমক্ষে যেন দেখা না যায়। যখনই ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রশ্ন করা হয়, তখনই তারা একে ঐতিহ্য ইত্যাদি বলে এড়িয়ে যেতে চায়, স্পষ্টভাবে তাকে বর্ণবাদী না বলে। আমাদের নিরন্তর প্রশ্ন তুলে যেতে হবে, যে, এই ঐতিহ্যর পেছনে আসল গল্পগুলি কী। আসলে নিজেদের সুবিধার জন্য এই ঐতিহ্যকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু আমাদের কাজই হল তার গভীরে যাওয়া, বৈষম্য দূর করতে হলে প্রয়োজনে তা ভেঙে ফেলা।”

 

রূপেশ বলছিলেন পেরিয়ার-এর কথা। তামিলনাড়ুতে সম্ভবত আইয়ার কফিশপ নামে একটি দোকান খোলা হয়। পেরিয়ার জানান দোকানের নাম না বদলানো পর্যন্ত তাঁর আন্দোলনের সাথীদের মধ্যে কেউ না কেউ রোজ গিয়ে প্রতিবাদ দেখাবেন ও সত্যিই টানা প্রতিদিন চার-পাঁচ’জন গিয়ে পোস্টার নিয়ে, শ্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ দেখাতে থাকেন। সেই সময়ে তাঁদের নাম ছিল ব্ল্যাক শার্ট আর্মি। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে দেখে দোকান মালিক যখন পেরিয়ারকে প্রশ্ন করেন কেন তিনি এমনটা করছেন, তার উত্তরে পেরিয়ার জানান, যখনই সেই দোকান মালিক নিজের ব্রাহ্মণ পদবী দোকানের নামে দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন এটি একজন ব্রাহ্মণের দোকান, তাহলে বাকিরা কারা? দীর্ঘদিন তাঁর এই প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার ফলে অবশেষে সেই দোকান মালিক দোকানের নাম বদলাতে বাধ্য হন। তামিলনাড়ুতে এই রকম নামের দোকানের সংখ্যা এখন অত্যন্ত কম যা সরাসরি ‘ব্রাহ্মণ’ পরিচয়ের জানান দেয়, কারণ এর পেছনে পেরিয়ার ও তাঁর সমর্থনকারীদের দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। ফলে সর্বত্রই এহেন ব্রাহ্মণ্যবাদী পরিচয়ের সরাসরি প্রকাশ অবশ্যই সমস্যাজনক, যা পরোক্ষে বোঝায় বাকিরা যেন অপবিত্র, উচ্চ পর্যায়ের নয়, সরাসরি না বললেও, মানেটা তাই দাঁড়ায়। যা নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য নয়।

 

কলকাতায় অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা সুসজ্জিত রেস্তোরাঁ, কফিশপ অনেকের কাছেই কাজ, নিজস্ব সময়, প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর জায়গা। সুস্বাদু, ভালো মানের খাবার ও পানীয় বাড়তি আকর্ষণ। সেখানেই যদি এভাবে ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্যবাদ, খাবারের রাজনীতি, জাতি-বর্ণের স্টিরিওটাইপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তাহলে তাকে প্রশ্ন করা আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে সময়ের দাবি।

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Apurba Mandal on May 22, 2022

    এই কলমচী কর্মসূত্রে বিগত আট বছর যাবত চেন্নাই এর বাসিন্দা। সনকর্মীরা ও বন্ধুরা বড় অংশ সেখানকার ভূমিপুত্র তামিল। এই সূত্রে সামান্য নিবেদন।
    হয়তো ভৌগলিক দূরত্বের কারণে তামিল সঙস্কৃতি নিয়ে বাঙালীদের বেশ ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে।যেমন, তামিলরা বেশীরভাগ নিরামিষাশী। সত্যিটা হল ওখানকার অন্ততঃ ৮৫ শতাংশ মানুষ আমিষাশী। ব্রাম্ভন সম্প্রদায় ( যারা এখন জনসংখ্যার ১ শতাংশ) কিন্তু নিরামিষাশী। অব্রাহ্মণ মধ্যে কিছু মানুষ মাছ মাংস খান না, তবে সেটা সেচ্ছায়। তামিলরা বেশীরভাগই মাছ খায় কিন্তু সেসব মিষ্টি জলের মাছ নয়,সামুদ্রিক মৎস( তেলেগুদের সম্পর্কে ও একথা সত্যি)।
    বাঙালীরা মনে করেন, তামিলরা ইডলি ও ধোসা খেয়ে দিনযাপন করেন। সত্যটা হল, ইডলি ধোসা পোঙ্গল ইত্যাদি খাবার তারা প্রাতরাশে ভোজন করে। দুপুরে অধিকাংশ আমাদের মতোই ভাত খান। সঙ্গে নানান ভাজা ও তরকারি ও সম্বর ।তবে তাদের তরকারির ধরন বাঙলার থেকে ভিন্ন।সেখানে টমেটোর ব্যবহার বেশী,আমাদের আলু। সঙ্গে থাকে সামুদ্রিক মাছের পদ কদাচিৎ চিকেন/মাটন।

Leave a Comment