আগামীকাল দিল্লীর রাজপথ দখল নেবেন হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ


  • March 1, 2019
  • (0 Comments)
  • 1657 Views

প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়নগুলির বাইরে বেশ কয়েকটি রাজ্যের ভিন্ন-ধারার ট্রেডইয়নিয়ন ও শ্রমিকসংগঠনগুলির উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘মজদুর অধিকার সংঘর্ষ অভিযান (MASA)’ নামে একটি যৌথমঞ্চ। ১৭-দফা দাবীসনদকে সামনে রেখে আগামী ৩মার্চ, দিল্লীতে একটি সর্বভারতীয় শ্রমিক-সমাবেশ, মিছিল ও পার্লামেন্ট-অভিযানের ডাক দিয়েছে ‘মাসা’। একটি গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন। 

 

 

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলন আমাদের দেশে নতুন নয়। সর্বভারতীয় স্তরে শ্রমিকদের দাবীদাওয়া তুলে ধরার জন্য দেশে ‘কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়ন’ও কম কিছু নেই। কংগ্রেস প্রভাবিত INTUC, সিপিআই প্রভাবিত AITUC, সিপিএম প্রভাবিত CITU, বিজেপি প্রভাবিত BMS প্রভৃতি কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়নগুলিতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-সদস্যও রয়েছেন। কিন্তু বাস্তবটা হলো, এই প্রতিটি ইউনিয়নের কাছেই আম-শ্রমিকদের অর্থনৈতিক স্বার্থের চেয়েও মাথার ওপরে থাকা পার্টি-সংগঠনগুলির রাজনৈতিক স্বার্থের গুরুত্ব চিরকালই অনেক বেশী থেকেছে। যখনই এই দুটির মধ্যে সঙ্ঘাত বেধেছে, ইয়নিয়নগুলো পার্টির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, প্রয়োজনে শ্রমিক-স্বার্থের সঙ্গে সমঝোতা করেই। নব্বই-এর দশকে কংগ্রেস যখন সংগঠিত শিল্পে ঢালাও উদারীকরণ – বেসরকারীকরণের রাজনৈতিক প্রোগ্রাম গ্রহণ করে, কার্যতঃ বিনা প্রতিরোধে INTUC তা মেনে নেয়। ২০০৩ সালে বামফ্রন্ট সরকার যখন পশ্চিমবাংলায় চরম শ্রমিকস্বার্থবিরোধী SEZ-বিল পাশ করায়, শ্রমিকদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তাতে সম্মতি দেয় CITU, AITUC-র মত ট্রেডইউনিয়নগুলো। আজও, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার শিল্পপতিতের স্বার্থে যখন দেশের চালু শ্রম-আইনকেই বদলে ফেলতে চাইছে, ‘ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট’-এর নামে শিল্প থেকে স্থায়ী-শ্রমিকের ধারনাটাই তুলে দিতে চাইছে, তখন শ্রমিকস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে যথারীতি চুপচাপই রয়েছে BMS-ও।

 

 

এই প্রেক্ষাপটেই ২০১৬ সালের ৩১ অগাস্ট, প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়নগুলির বাইরে বেশ কয়েকটি রাজ্যের ভিন্ন-ধারার ট্রেডইয়নিয়ন ও শ্রমিকসংগঠনগুলির উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘মজদুর অধিকার সংঘর্ষ অভিযান (MASA)’ নামে একটি যৌথমঞ্চ। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠন বা সংগঠনগুলির স্বার্থ-সিদ্ধি নয়, বরং আম-শ্রমিকদের সার্বিক স্বার্থে প্রচার আন্দোলন তথা লড়াই গড়ে তোলাই এই মঞ্চের উদ্যেশ্য; এবং তার মধ্যে দিয়েই গোটা দেশ জুড়ে শ্রমিকশ্রেনীর একটি সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তোলাটাই এই মঞ্চের লক্ষ্য। বস্তুতঃ, শ্রমআইন-সংস্কারই হোক কিংবা ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট অথবা বেসরকারিকরনের মতো যে ‘পলিসিগত’ আক্রমণগুলি আজ শ্রমিকশ্রেণীর ওপর নামছে, কোনও একটি বিশেষ কারখানায় বা বিশেষ শিল্পে তাকে রুখে দেওয়া আজ কোনও একটি ইউনিয়নের পক্ষেই সম্ভব নয়। তার জন্যে প্রয়োজন দেশ জোড়া শ্রমিক-ঐক্য, দেশ জোড়া শ্রমিক-আন্দোলন। সেই বাস্তবতাও কাজ করেছে ‘মাসা’ গড়ে ওঠার পিছনে। বর্তমানে এই মঞ্চে রয়েছে All India Workers Council (AIWC), Grameen Mazdoor Union (Bihar), Indian Centre of Trade Unions (ICTU), Indian Federation of Trade Unions (IFTU), IFTU Sarwahara, Inqlabi Kendra Punjab, Inqlabi Mazdoor Kendra (IMK), Jan Sangharsh Manch (Haryana), Shramikshakthi Karnataka, Socialist Workers Centre Tamil Nadu, Struggling Workers Co-ordination Committee (SWCC) West Bengal, Trade Union Centre of India (TUCI), Workers Solidarity Centre (Gurgaon), Workers Solidarity Centre (Uttarakhand) -সহ বেশ কিছু সংগঠন। এই সংগঠনগুলি কর্নাটক, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, কেরল, মহারাষ্ট্র, গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, ছত্তিশগড়, ওড়িশা, দিল্লী, হরিয়ানা, রাজস্থান, পাঞ্জাব, উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন পকেটে দীর্ঘদিন ধরে ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলন তথা শ্রমিকআন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।

 

 

২০১৬ সালে প্রাথমিক ভাবে ন্যূনতম মজুরী, শ্রমআইন সংশোধন ও ঠিকাপ্রথা নিয়ে কাজ শুরু করলেও বিভিন্ন রাজ্যের শ্রমিকদের জীবনের বাস্তব সমস্যাগুলি নিয়ে প্রায় দেড়বছর ধরে লাগাতার আলোচনা ও মত-বিনিময়ের পর ‘মাসা’ ১৭-দফা দাবীর একটি দাবী-সনদ চূড়ান্ত করেছে, যা নিম্নরূপ :

 

 

১) সমস্ত শ্রমিকের মাসিক ন্যূনতম মজুরী হিসাবে ২৫০০০টাকা দিতে হবে।

 

২) সরকারী ও বেসরকারী ক্ষেত্রে সমস্ত স্তরের শ্রমিককের জন্য (স্থায়ী,অস্থায়ী, ঠিকা, মহিলা সহ) সমকাজে সমবেতন লাগু কর।

 

৩) শ্রমআইনে শ্রমিক বিরোধী বদল বাতিল কর। শ্রমিকস্বার্থে শ্রম আইন সংশোধন করতে হবে।

 

৪) সমস্ত ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রথা বন্ধ কর। স্থায়ী কাজে কর্মরত ঠিকা বা সমস্ত অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ী করতে হবে। সকলকে সাপ্তাহিক ছুটি দিতে হবে।

 

৫) অস্থায়ী, ঠিকা, ক্যাজুয়াল, ট্রেনী সহ সমস্ত যোজনা-কর্মীদের (অঙ্গনওয়াড়ি – মিডডে মিল – আশা ইত্যাদি) শ্রমিকের মর্যাদা দিতে হবে। সেই অনুযায়ী ন্যুনতম মজুরি, অধিকার ও সুবিধা দিতে হবে।

 

৬) আবেদনের ৩০ দিনের মধ্যে ট্রেডইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন-এর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আইনি ব্যবস্থা করতে হবে। আবেদনের দিন থেকেই আবেদনকারীদের ‘সুরক্ষিত শ্রমিক’ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। কর্তৃপক্ষ দ্বারা শ্রমিক ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দেওয়ার আইন করতে হবে।

 

৭) কারখানা ও কারখানা সংলগ্ন এলাকায় শান্তিপূর্ণ ধর্না-সমাবেশ করার অধিকারকে সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ধর্না – সমাবেশ – বিক্ষোভ – ধর্মঘট ইত্যাদিতে পুলিশ-প্রশাসনের অন্যায় ও জোর-জবরদস্তি হস্তক্ষেপ বন্ধ কর।

 

৮) কঠোরভাবে ৮ ঘণ্টার কাজ লাগু কর। বাধ্যতামূলক ওভারটাইম আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গন্য করতে হবে।

 

৯) অসংগঠিত/অপ্রচলিত ক্ষেত্রের শ্রমিক (ভূমিহীন মজুর, গৃহকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, ১০০ দিনের কাজে রত শ্রমিক, অঙ্গনওয়ারী, আশা ইত্যাদি) সহ সমস্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের বিমা-পি.এফ-পেনশন যোজনার আওতায় আনতে হবে। বাসস্থান, বিনামুল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা-সুরক্ষা সহ অন্য চালু সুবিধা সুনিশ্চিত করতে হবে। অপ্রচলিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য স্পষ্ট ও প্রভাবশালী আইন বানাতে হবে।

 

১০) পিসরেট অনুযায়ী কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য ‘পিসরেট’-‘নির্ধারিত সুবিধা’-‘সুরক্ষা’ সম্বন্ধে কার্যকরী আইন করতে হবে।

 

১১) দেশের প্রত্যেকটি রাজ্যে প্রবাসী বা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় রেজিস্টার ও পরিচয়পত্র সহ প্রয়োজনীয় সুবিধা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

 

১২) সমস্ত ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের জন্য ৩৩% সংরক্ষণ করতে হবে। সুরক্ষা-মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্ন প্রাপ্য সুবিধার নিশ্চয়তা করতে হবে। নাইট শিফটে কাজ নারী শ্রমিকদের ইচ্ছাধীন করতে হবে। কাজের জায়গায় যৌন হেনস্থা রুখতে নারী শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় সুরক্ষার বন্দোবস্ত করো।

 

১৩) ছাঁটাই-লেঅফ-লক আউট রুখতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারকে বন্ধ কারখানা অধিগ্রহন করে পুনরায় চালু করতে হবে।

 

১৪) নুন্যতম মজুরী বা শেষ প্রাপ্ত মজুরি বা বেতনের ২/৩ অংশের ভিত্তিতে সকলের জন্য পেনশন লাগু করতে হবে।

 

১৫) সবাইকে কাজ দাও। বেকারদের যুক্তিসঙ্গত ও স্পষ্ট আইনি পরিভাষা দিতে হবে। বেকার ও কর্মহীন পর্যায়ে সকলকে মাসিক ১৫০০০ টাকা ‘বেকার ভাতা’ দিতে হবে।

 

১৬) মুল্যবৃদ্ধি আটকাতে কার্যকরী ব্যবস্থা নাও। সার্বজনীন বণ্টন ব্যবস্থার মারফৎ কমদামে চাল-ডাল-গম-চিনি-তেল-জ্বালানী সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করতে হবে।

 

১৭) কারখানা কর্তৃপক্ষ ও সরকারী প্রশাসনিক আক্রমনের শিকার ‘মারুতি’-‘প্রিকল’-‘গ্রেজীয়ানো’ সহ সমস্ত  জেলবন্দী শ্রমিকদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ দ্বারা ‘অন্যায় বরখাস্তের’ মাধ্যমে কাজ হারানো সকল শ্রমিক-কর্মচারীদের অবিলম্বে পুনর্বহাল করতে হবে।

 

 

১৭-দফা এই দাবীসনদকে সামনে রেখে আগামী ৩মার্চ, দিল্লীতে একটি সর্বভারতীয় শ্রমিক-সমাবেশ, মিছিল ও পার্লামেন্ট-অভিযানের ডাক দিয়েছে ‘মাসা’। তৈরি হওয়ার পর থেকে এটিই ‘মাসা’-র ডাকে এই পর্যায়ের সর্ববৃহৎ কেন্দ্রীয় কর্মসূচি। আপাততঃ, তারই প্রস্তুতিতে ব্যস্ত রয়েছেন বিভিন্ন রাজ্যের সংগ্রামী শ্রমিকরা।

 

 

Share this
Leave a Comment