ক্রিস হেজেস সম্প্রতি দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ইউনিভার্সিটিতে এডওয়ার্ড সাঈদ স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেছেন। তাঁর বক্তৃতার শিরোনাম ছিল “রেকুইয়েম ফর গাজা”। এটি ২০২৫ সালের ২০ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল প্রেস ক্লাব (NPC)-এ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এনপিসি বক্তৃতার সংক্ষিপ্তসার পর্যালোচনা করার পর, ইসরায়েলপন্থী লবির চাপে পড়ে অনুষ্ঠানটি বাতিল করে।
গাজার গণহত্যা নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভূমিকার কঠোর সমালোচক ক্রিস হেজেস ১৮অক্টোবর একই বক্তৃতা ২০২৫ সালের এডওয়ার্ড সাঈদ স্মারক বক্তৃতা হিসেবে প্রদান করেন।
গ্রাউন্ডজিরো এই বক্তৃতার পূর্ণ পাঠ বাংলায় প্রকাশ করছে। অনুবাদ করেছেন মীনাক্ষী সরকার।
গাজার জন্য প্রার্থনা: ক্রিস হেজেস
Groundxero | Nov 7, 2025
৭ই অক্টোবর সকালের গাজা – যে গাজায় আমি কাজ করেছি, যে গাজাকে আমি চিনতাম – সেই গাজা আর নেই। অবিরাম বোমাবর্ষণ, গোলাগুলি, বুলডোজারের ধাক্কায় সেই গাজা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চারিদিকে শুধু ধ্বংসস্তুপ, ধুলোয় মিশে যাওয়া বাড়িঘর, আর ভেঙ্গে যাওয়া কংক্রিটের চাঙড়।
আমার নিউ ইয়র্ক টাইমসের অফিসটা ছিলো গাজা শহরের একদম মাঝখানে। আর থাকতাম আহমেদ এল-আজিজ স্ট্রিটের মারিনা বোর্ডিং হাউসে। মালকিন উত্তর গ্যালিলির সাফাদ থেকে আসা শরণার্থী এক বৃদ্ধা – মার্গারেট নাসার। সারাদিন কাজের পর, ওনার সাথে বসে চা খেতাম। শেষবার যখন মারনা হাউসে গেছিলাম, ফেরার সময় ঘরের চাবিটা ফেরত দিতে ভুলে গেছিলাম। মারনা হাউস, গাজা, লেখা একটা ডিম্বাকৃতি প্লাস্টিকের রিঙে লাগানো সেই ১২ নম্বর ঘরের চাবিটা এখনও আমার ডেস্কের উপর রাখা থাকে।
দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, বেশিরভাগ বন্ধু ও সহকর্মীরা, হয় গাজা থেকে পালিয়ে গেছেন, না হয় মৃত। বেশিরভাগই নিখোঁজ— নিঃসন্দেহে তাঁরা এই ধ্বংসস্তূপের নিচে দাফন হয়ে গেছেন।
স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে গেছে গাজায়। ওমারি মসজিদ গাজার সবচেয়ে বড় আর পুরানো। ঢোকার মুখে ছিল জুতো রাখার তাক। সাদা পাথরের দেওয়ালে ছিল সূঁচালো খিলান। একটি উঁচু অষ্টভুজ মিনার, খোদাই করা কাঠের বারান্দা দিয়ে ঘেরা। আর মসজিদের চূড়ায় ছিল এক ফালি চাঁদ।
প্যালেস্টানীয় ও রোমান মন্দির আর বাইজান্টাইন চার্চের ধ্বংসস্তূপের উপর তৈরি এই মসজিদ। ওযু করার জন্য জলের কল ছিলো বাইরে, যেখানে হাত, পা, মুখ ধুয়ে ঢুকতাম মসজিদে। মসজিদের ভেতরটা নীল কার্পেটে ঢাকা, শান্ত। গাজার কোলাহল, ধুলো, ধোঁয়া এবং উন্মত্ত গতি যেন নিমেষে মিলিয়ে যেত।
৮ই ডিসেম্বর, ২০২৩-এ ইজরায়েলি বিমান হানায় ধ্বংস হয়ে গেছে এই প্রাচীন মসজিদ।
গাজাকে এই ভাবে ধূলোয়ে মিশিয়ে দেওয়া খালি প্যালেস্টাইনের মানুষের প্রতি অন্যায় নয়। পৃথিবীর সাংস্কৃতিক আর ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের প্রতি চরম অপরাধ – আঘাত আমাদের স্মৃতির উপর । অতীতকে না বুঝলে, বর্তমানকে বোঝা যাবে না, বিশেষত প্যালেস্টাইন আর ইজরায়েল নিয়ে লেখার সময়।
সেই জিমি কার্টারের সময় থেকে, অধিকৃত প্যালেস্টাইনের যাবতীয় শান্তি চুক্তি ব্যর্থ – যদিও সবগুলোই অনেক ভেবেচিন্তে, নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে তৈরি হয়েছিল। সব শান্তিচুক্তির পরিণতি একই – ইজরায়েল প্রথম থেকে যা দাবি করে, সেটাই পেয়ে যায়। এবারের চুক্তিতেও তাই হবে। ইজরায়েলের দাবি অনুযায়ী পণবন্দী ইজরায়েলিরা মুক্তি পেয়ে যাবে। কিন্তু চুক্তির বাকি কোনও শর্ত তারা নিজেরা মানবে না, আর অপেক্ষা করে থাকবে, কবে আবার প্যালেস্টাইনের উপর আক্রমণ শুরু করতে পারবে।
এটি একটি নিষ্ঠুর খেলা। মৃত্যুর এক ঘূর্ণায়মান চক্র/ নাগরদোলা। আদতে এই যুদ্ধবিরতি একটা প্রহসন। মৃত্যুদণ্ডের আসামিকে গুলিতে ঝাঁঝরা করার আগে শেষ সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দেওয়ার মত।
একবার ওই পণবন্দীরা মুক্তি পেয়ে গেলেই আবার শুরু হবে গণহত্যা। কত তাড়াতাড়ি সেটা জানি না। খালি আশা করতে পারি এই লোকদেখানো শান্তি চুক্তির খাতিরেই যদি এই হত্যাযজ্ঞ কিছু সপ্তাহ বন্ধ থাকে। গণহত্যায় একটি সাময়িক বিরতিই এই মূহুর্তে আমাদের জন্য সর্বোচ্চ প্রত্যাশা। এই দু বছর ধরে ক্রমাগত বিমান হানায়, গাজা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যতক্ষণ না পৃথিবীর বুক থেকে গাজা মুছে যাচ্ছে, ইজরায়েল এই হত্যালীলা চালিয়ে যাবে।
আর তখন জায়নবাদীদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
৭ই অক্টোবর, ২০২৩ থেকে আজ অব্দি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েলকে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্য দিয়েছে। আমেরিকা কিছুতেই এই সাহায্য বন্ধ করবে না—অথচ এই অনুদান বন্ধ করাই সম্ভবত গণহত্যা থামানোর একমাত্র উপায়।
ইজরায়েল, যেটা তারা বরাবরই করে থাকে, এবারেও চুক্তিতে নিরস্ত্রীকরণের যে শর্ত, সেটা না মানার জন্য – যেটা আদতে সত্যি নাও হতে পারে – হামাস আর প্যালেস্টালীয়দের দোষারোপ করবে। আর আমেরিকা হামাসের এই চুক্তি লঙ্ঘনকে সামনে এনে, ইজরায়েলকে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেবে, যাতে একদিন ট্রাম্পের সেই ‘গাজা রিভিয়েরা’র উদ্ভট স্বপ্ন – যেখানে প্যালেস্টাইনকে ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ বানিয়ে, ওখানে বসবাসকারী সব প্যালেস্টিনীয়দের ‘ডিজিটাল টোকেনের বিনিময়ে, ‘স্বেচ্ছায়’ স্থানাতরিত করা হবে – সেই স্বপ্ন সফল হয়।
বিগত কয়েক দশক ধরে যে অগুন্তি শান্তি চুক্তি হয়েছে, এখনকারটা মনে হয় সবচেয়ে গুরূত্বহীন। যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার ৭২ ঘন্টার মধ্যে, হামাস সব পণবন্দীদের মুক্তি দেবে, এই রকম একটা দাবি ছাড়া, বাকি কোন কিছুওরই কোনও নির্দিষ্ট কর্মসূচী বা সময়সীমার উল্লেখ নেই। চুক্তিটিতে এমন সব সতর্কীকরণ ধারা (caveats) রয়েছে যা ইজরায়েলকে যে কোনও সময়ে এই চুক্তি বাতিলের সুযোগ করে দেবে। ইতিমধ্যেই ইজরায়েল সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে, রাফা সীমান্ত খুলতে অস্বীকার করেছে, প্রায় ছয়জন প্যালেস্টালীয়কে হত্যা করেছে। বাকি পণবন্দীদের মৃতদেহ এখনও ফেরত না আসায়, চুক্তিতে যে প্রতিদিন ৩০০ ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় যেতে দেওয়ার কথা বলা আছে, সেটাকে অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে।
এই লোকদেখানো শান্তি চুক্তির অবমাননা করাটাই আসল কথা। চুক্তিটা যে সত্যিই ওই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তৈরি করা হয় নি, সেটা ইজরায়েলের বেশিরভাগ নেতারাও বঝেন। প্রয়াত ক্যাসিনো ব্যবসায়ী শেলডন অ্যাডেলসনের শুরু করা ‘ইজরায়েল হায়োমল – ইজরায়েলের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ। এই কাগজটা শুরুই হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মুখপত্র হিসাবে আর মেসানিক জায়নবাদের প্রচার করতে। তারাও তাদের পাঠকদের গাজা রিভিয়েরার এই পরিকল্পনাকে গুরূত্ব দিতে বারণ করেছে। তাদের মতে এটা শুধুই ট্রাম্পের আলঙ্কারিক বচন।
এবারের চুক্তি কতটা দিশাহীন তার আরেকটা প্রমাণ, যেখানে বলা আছে, “হামাস যতদিন চুক্তি সম্পূর্ণরূপে মেনে চলবে, ততদিন ইজরায়েল যে এলাকাগুলো থেকে সরে এসেছে সেখানে ফিরে যাবে না।” এবার, হামাস সেই শর্ত পুরোপুরি মেনে চললো কিনা সেটা দেখবে কে? ইজরায়েল! ইজরায়েলের সদিচ্ছার প্রতি কারোরই কি কোনও ভরসা আছে? আদপেও কি ইজরায়েলকে, এই চুক্তির ‘নিরুপেক্ষ পপর্যবেক্ষক হিসবে মেনে নেওয়া যায়? হামাস – যারা একটা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত, তারা কোনও শর্তে আপত্তি জানালে, কেউ কি সেটা শুনবে? আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (International Court of Justice) ২০২৪ সালে তাদের মতামতে (Advisory Opinion) জানিয়েছিল, ইজরায়েলের এই প্যালেস্টাইন দখল করা অবৈধ এবং অবিলম্বে এটা বন্ধ হওয়া উচিৎ। কী করে সেই মতকে উপেক্ষা করে শান্তি চুক্তি তৈরি হতে পারে?
কী করে প্যালেস্টিনীয়দের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে উপেক্ষা করতে পারে এই চুক্তি?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ইজরায়েলের মতো দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের অধিকার আছে প্রতিটি প্যালেস্টিনীয়র। কি করে এই চুক্তিতে প্যালেস্টিনীয়দের নিরস্ত্র হওয়ার দাবি দেওয়া হচ্ছে, অথচ অবৈধভাবে দখল করেছে যে ইজরায়েল, তাকে নিরস্ত্র হতে বলা হচ্ছে না?
কোন অধিকারেই বা আমেরিকা, প্যালেস্টিনীয়দের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে অস্বীকার করে, ‘অস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ (ট্রাম্প আর টনি ব্লেয়ারের তথাকথিত “শান্তি বোর্ড”) তৈরি করে?
“আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী” (International Stabilization Force) আসলে বিদেশী আগ্রাসনেরই প্রতিশব্দ। গাজায় এই বাহিনী পাঠানোর অধিকারই বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কে দিয়েছে?
গাজার সীমান্তে “নিরাপত্তা বেষ্টনী” (security barrier) আদতে প্রমাণ করে ইজরায়েলের দখলদারিত্ব চলতে থাকবে। প্যালেস্টিনীয়রা কীভাবে এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেবে?
কি করে কোনও চুক্তি এই চলতে থাকা গণহত্যা আর ইজরায়েলের এই ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে নিজেদের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার চেষ্টাকে উপেক্ষা করতে পারে?
গাজাকে পুরো ধ্বংস করে দেওয়ার পরও কেন ইজরায়েলকে কোনও ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয় নি?
চুক্তিতে প্রস্তাব দেওয়া আছে যে গাজার মানুষদের ‘উগ্রপন্থা-মুক্ত’ (de-radicalized) করতে হবে। প্যালেস্টিনীয়রা এর কি মানে বুঝবেন? কি ভাবেই বা একটা গোটা জনগোষ্ঠীকে ‘উগ্রপন্থা-মুক্ত’ করা হবে? পুনঃশিক্ষণ শিবিরে (Re-education camps) পাঠিয়ে? ব্যাপক সেন্সরশিপ করে? স্কুলের পাঠ্যক্রম নতুন করে লিখে? নাকি মসজিদের যেসব ইমামরা ইজরায়েলের বিরূদ্ধে কথা বলেন, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে?
অন্যদিকে ইজরায়েলি নেতারা যে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন, যেখানে প্রায়শই প্যালেস্টিনীয়দের ‘মানুষরূপী পশু’ বা প্যালেস্টাইনের বাচ্চাদের ‘ছোট ছোট সাপ’ বলা হয়, তার কী হবে?
রাব্বি রোনেন শাউলভ, যিনি রেভারেন্ড স্যামুয়েল মার্সডেনের ইজরায়েলি সংস্করণ, প্রকাশ্যে বলেছিলেন, “গাজার সবাই এবং গাজার প্রতিটি শিশু যেন ক্ষুধায় মারা যায়।”
“যারা, কয়েক বছর বাদে, বড় হয়ে, আমাদের করুণা করবে না, তাদের প্রতি আমারও কোনও করুণা নেই। একমাত্র সেই বোকারা, যারা দেশে থেকে দেশের শত্রুকে সহানুভূতি দেখায়, আসলে যে দেশকেই ঘেন্না করে, তাদেরই একমাত্র এই ভবিষ্যতের উগ্রপন্থীরা, আজ না খেতে পেয়ে মরছে, দেখে দয়া হয়। আমি চাই, তারা না খেতে পেয়েই মরুক। আর এটা বলছি বলে যদি কারুর আপত্তি থাকে, সেটা তাদের সমস্যা।”
ইজরায়েল আগেও যে বহুবার এই শান্তি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, তার ঐতিহাসিক নজির রয়েছে।
১৯৭৮ সালে মিশরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত এবং ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন, ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করেন (যে চুক্তি তৈরিতে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-এর কোনও ভূমিকা ছিল না) । তার ফলস্বরূপ ১৯৭৯ সালে মিশর-ইজরায়েল শান্তি চুক্তি হয়, যা ই্জরায়েল এবং মিশরের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করে।
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পরবর্তী পর্যায়গুলোতে ইজরায়েল বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যেমন, জর্ডন আর মিশরের সাথে বসে, প্যালেস্টাইনের সমস্যা সমাধান, বা, পাঁচ বছরের মধ্যে, ওয়েষ্ট ব্যাঙ্ক আর গাজায় বসবাসকারী প্যালেস্টিনীয়দের স্বশাসনের অধিকার দেওয়া, আর পূর্ব জেরুজালেমে সহ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলি কলোনি তৈরি বন্ধ করা। এর কোনটাই পরবর্তীতে কার্যকর হয় নি।
অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৩-তে। সেই চুক্তিতে পি.এল.ও. ইজরায়েলের অস্তিত্ব স্বিকার করে আর ইজরায়েলও প্যালেস্টিনীয়দের বৈধ প্রতিনিধি হিসাবে পি.এল.ও.-কে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল পি.এল.ও.-র ক্ষমতা হ্রাস করা হল আর পি.এল.ও.-কে একটা ঔপনিবেশিক পুলিশ বাহিনীতে রূপান্তরিত করা হল। ১৯৯৫-তে স্বাক্ষরিত দ্বিতীয় অসলো চুক্তি (Oslo II)-তে, বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে কি ভাবে ওই অঞ্চলে শান্তিস্থাপন করা আর রাষ্ট্র হিসেবে প্যালেস্টাইনের স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেই চুক্তিও পরে কোনও স্থায়ী সমাধান দিতে পারে নি।
দ্বিতীয় অসলো চুক্তিতে বলা হয়েছিল, চুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনা (“final” status talks) (seনা হওয়া পর্যন্ত, বেআইনি ইহুদি বসতি settlement) নিয়ে কথাবার্তা স্থগিত থাকবে। ততদিনে ইজরায়েল, অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করবে। ওখানকার শাসনভার ইজরায়েল থেকে তথাকথিত অস্থায়ী প্যালেস্টিনীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরিত হবে।
কিন্তু তার বদলে, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে তিনটি ভাগে ভাগ করা হল – area A, B, আর C। প্যালেস্টিনীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা সীমিত থাকল Area A আর Area B-তে। আর Area C, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের প্রায় ৬০ শতাংশ জায়গা যার মধ্যে পরে, সেখানকার শাসনভার থাকল ইজরায়েলের হাতেই।
১৯৪৮ সালে, ইজরায়েল তৈরির সময়, যে অঞ্চলে বহু যুগ ধরে প্যালেস্টিনীয়রা বসবাস করতেন, ইহুদীরা সেই জমি কেড়ে নিয়েছিল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্যালেস্টিনীয় উদ্বাস্তুদের, সেখানে ফিরে আসার অধিকার ছিল। পি.এল.ও. (PLO) নেতা ইয়াসির আরাফাত সেই অধিকার ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্তের কারণে, বহু প্যালেস্টিনীয়দের সঙ্গে তাঁর একটা দূরত্ব তৈরি হয়। গাজায় বসবাসকারীদের অধিকাংশই – প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ- সেই জমি হারানো প্যালেস্টিনীয় উদ্বাস্তুদের বংশধর। পিএলও-র এই পদক্ষেপে, ক্ষুব্ধ গাজার অধিবাসিরা তখন হামাসকে সমর্থন করা শুরু করেন।
এডওয়ার্ড সঈদ অসলো চুক্তিকে “প্যালেস্টিনীয়দের আত্মসমর্পণের হাতিয়ার, প্যালেস্টিনীয়দের ভার্সাই” বলে অভিহিত করেছিলেন এবং আরাফাতকে “প্যালেস্টিনীয়দের পেতাঁ” (Pétain of the Palestinians) বলে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।
অসলো চুক্তিতে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে ইজরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা কখনই বাস্তবায়িত হয় নি। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্রায় ২৫০,০০০ ইহুদি দখলদার (colonist) থাকতো। আজ তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০,০০০।
স্বনামধন্য সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক অসলো চুক্তিকে একটা মিথ্যা প্রহসন বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, আরাফত আর পি.এল.ও. দীর্ঘ ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যা চেয়ে এসেছেন, যার জন্য যুদ্ধ করেছেন, অসলো চুক্তি আসলে কৌশলে তাদের সেই সংগ্রাম থেকে দূরে সড়িয়ে দেওয়ার আর মিথ্যা আশা দিয়ে প্যালেস্টানীয় রাষ্ট্রের দাবিকে দূর্বল করে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা।
গত মার্চ মাসের ১৮ তারিখে গাজায় আকস্মিক বিমান হামলা চালিয়ে, এককভাবে ইজরায়েল, দুই মাসব্যাপী চলা সাম্প্রতিকতম যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে। পুনরায় সামরিক অভিযান শুরু করার কারণ হিসেবে নেতানিয়াহুর দপ্তরের বক্তব্য ছিল—হামাস পণবন্দীদের মুক্তি দিতে অস্বীকার করেছে, যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে এবং পুনরায় সশস্ত্র হওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করেছে।
যুদ্ধবিরতির ভঙ্গ করার পর, প্রথম রাতভর হামলায় ইজরায়েল ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে এবং ৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে আহত করে – আর এই হত্যাকাণ্ড চলেছিল যখন মানুষগুলো ঘুমিয়ে ছিল। এই আক্রমণ চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়টিকে বানচাল করে দেয়, যেখানে প্যালেস্টিনীয় বন্দীদের বিনিময়ে এবং গাজার ওপর ইজরায়েলি অবরোধ তুলে নেওয়ার পাশাপাশি একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার শর্তে হামাসের কাছে থাকা অবশিষ্ট জীবিত পুরুষ পণবন্দীদের—সাধারণ নাগরিক ও সৈন্যদের—মুক্ত করার কথা ছিল।
বহু দশক ধরে ইজরায়েল গাজার উপর বিধ্বংসী হামলা চালিয়েছে, যেটাকে তারা শ্লেষাত্মকভাবে বলে, বাগানের আগাছা পরিস্কার করা (mowing the lawn) । কোনও শান্তিচুক্তি বা যুদ্ধবিরতি বেশিদিন তাদের এই আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি। তাই এবারের যুদ্ধবিরতিও কোনও ব্যতিক্রম হবে না।
এই রক্তাক্ত উপাখ্যান চলতেই থাকবে। ইজরায়েলিদের লক্ষ্য একটাই: প্যালেস্টিনীয়দের, তাদের নিজেদের জায়গা থেকেই উচ্ছেদ করা ও তাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা।
ইজরায়েল প্যালেস্টানীয়দের একমাত্র কবরের/সমাধিস্থলের শান্তিই দিতে চায়।
ওই অঞ্চলের আসল ইতিহাস জায়নবাদী প্রকল্পের (Zionist project) পরিপন্থী। ইতিহাস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কি নৃশংশভাবে, আরব দুনিয়ার উপর, ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কি নির্মম ভাবে, আরব দেশগুলোকে আরব-মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
আরবদের প্রতি, তাদের সংস্কৃতি, তাদের ঐতিহ্যর প্রতি পাশ্চাত্যের যে মজ্জাগত জাতিবিদ্বেষ, তার নজির ইতিহাস তুলে ধরে। আর ইতিহাসের এই বিবরণ, ইহুদিদের মধ্যে প্রচলিত কল্পকথা – ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইহুদ বারাকের ভাষায়, ‘জায়নবাদীরা জঙ্গলের মধ্যে একটা প্রাসাদ বানিয়েছে – মিথ্যা প্রমাণ করে। প্যালেস্টাইন একান্তভাবে ইহুদিদের জন্মভূমি – জায়নবাদী এই মিথ্যা প্রচারকে উপহাস করে ইতিহাস। পরিবর্তে ওই অঞ্চলে শতাব্দী প্রাচীন প্যালেস্টিনীয় উপস্থিতি মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাস প্রমাণ করে দেয় একটা চুরি করা ভূখণ্ডে, জায়নবাদের বহিরাগত সংস্কৃতি জোড় করে রোপণ করার চেষ্টা চলছে।
বসনিয়ার গণহত্যা নিয়ে কাজ করার সময় আমি দেখেছি, সার্বরা শুধু মসজিদগুলো বোম মেরে ভেঙ্গে দিচ্ছে না, তারা ধ্বংসাবশেষগুলোও সরিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ওই ভেঙ্গে দেওয়া মসজিদ্গুলো নিয়ে যাতে কেউ আলোচনা না করে, সে ব্যপারেও সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে । গাজাতেও লক্ষ্যটা একই – অতীতকে মুছে দিয়ে, গণহত্যাসহ ইজরায়েলের যাবতীয় অপরাধ লুকিয়ে, এক মিথ্যা আখ্যান প্রতিষ্ঠা করা।
১৯২০ সালের প্যালেস্টিনীয়দের তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা, ১৯৪৮ আর ১৯৬৭-তে, জাতিগতভাবে তাদের নির্মূল করা – যেগুলো জায়নবাদী প্রকল্পের অন্তর্নিহিত হিংস্রতাকে তুলে ধরে, ইতিহাস মুছে ফেলার যে এই বিশাল আয়োজন, আসলে সেই হিংসাকে ঢেকে রাখারই চেষ্টা।
ইজরায়েলিরা যে সবসময় প্রমাণ করতে চায় যে তারাই আসলে বঞ্চিত/প্রতারিত, সেই দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার একমাত্র রাস্তা ওই অঞ্চলের ঐতিহাসিক সত্য আর জাতিগত পরিচয়কে অস্বীকার করা। আসল ইতিহাস ভূলে গিয়ে তারা তাদের মনগড়া অতীত নিয়ে মিথ্যে স্মৃতিমেদুরতা বজায় রাখে। সত্যটাকে স্বীকার করলে তাদের অস্তিত্বসংকট তৈরি হবে। সত্য ইতিহাস তাদের বাধ্য করবে নিজেদের আসল পরিচয় নিয়ে ভাবতে। এই সাজানো মিথ্যেয় মজে থাকাটাই তাই বেশিরভাগ ইজরায়েলিদের পছন্দ। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টার থেকে, অন্ধবিশ্বাসে ভুলে থাকার ইচ্ছে আসলে অনেক বেশি শক্তিশালী।
সত্য গোপন করে, বা সত্য সন্ধানকারীদের মুখ বন্ধ করে, একটা সমাজের/জাতির পক্ষে নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং সংস্কার করা অসম্ভব। তখন সমাজের অগ্রগতি থমকে যায়। সবসময়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় নতুন মিথ্যা, নতুন ভণ্ডামিকে সত্য বলে প্রমাণ করার। এরকম সমাজের জন্য আসল সত্য খুবই বিপজ্জনক । কারণ একবার যদি সত্যটা সামনে চলে আসে, সেটা অস্বীকার করার আর উপায় থাকে না।
ট্রাম্প প্রশাসনও এই ব্যাপারে ইজরায়েলেরই মতো। তারাও বাস্তবের থেকে কল্পিত মিথ্যার আখ্যানকেই প্রাধান্য দেয়। যারা অতীতের মিথ্যা প্রচার বা বর্তমানের মিথ্যাকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখায় তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়।
গাজার গণহত্যা একটা ঐতিহাসিক পদ্ধতির/ ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত পরিণতি। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইজরায়েল রাষ্ট্রের এই আগ্রসী সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের অভিশাপ এই গণহত্যা। একটা বর্ণবিদ্বেষী রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে এই গণহত্যার বীজ।
নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইজরায়েলকে এই পর্যায়েই নামতে হত। এই গণহত্যায় ইজরায়েলের প্রত্যেকটা ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ পূর্বপরিকল্পিত। বহু দশক ধরে এর নকশা তৈরি হয়েছে। এই ইজরায়েলি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের একদম কেন্দ্রে আছে প্যালেস্টিনীয়দের নিজেদের জায়গা থেকে যেকোন প্রকারে উচ্ছেদ করার চেষ্টা।
এই উচ্ছেদের কিছু নাটকীয় ঐতিহাসিক মুহূর্ত আছে, যেমন, ১৯৪৮ এবং ১৯৬৭ সালে যখন ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের বিশাল অংশ দখল করেছিল ইজরায়েল আর, লক্ষ লক্ষ প্যালেস্টিনীয়কে জাতিগতভাবে নির্মূল (ethnically cleansed) করা হয়েছিল। আবার কখনও উচ্ছেদ ঘটেছে ধীরে ধীরে —পূর্ব জেরুজালেম সহ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে, ধাপে ধাপে জমি অধিগ্রহণ এবং ক্রমাগত প্যালেস্টিনীয়েদের হত্যা করা।
এই মূহুর্তে যে ভাবে প্যালেস্টিনীয়দের উপর সোজাসুজি হামলা চলছে, এই বিশালতা হয়তো আগে দেখা যায় নি। কিন্তু বহুদিন ধরে চলে আসা বিভিন্ন পন্থা, যেমন, সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করা, জাতিগতভাবে নির্মূল করার চেষ্টা, নির্বিচারে প্যালেস্টিনীয়েদের আটক করা, নির্যাতন, গুম করে দেওয়া, প্যালেস্টিনীয় গ্রাম বা শহরগুলিকে অবরূদ্ধ করার চেষ্টা, বাড়ি ঘর ভেঙ্গে দেওয়া, বসবাস করার অনুমতি/নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া, তাদের নিজদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা, সুশীল সমাজের মৌলিক পরিকাঠামো ধ্বংস করা, জনবসতির বিভিন্ন অংশ সামরিক ভাবে দখল করে নেওয়া, অমানবিক ভাষা ব্যবহার, প্রাকৃতিক সম্পদ চুরি (বিশেষ করে প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ জলাধার বা অ্যাকুইফার)- এই সবই আসলে ধাপে ধাপে প্যালেস্টিনীয়েদের বিলুপ্ত করার ইজরায়েলি অভিযানকে সংজ্ঞায়িত করে।
হামাস আর অন্যান্য প্রতিরোধী গোষ্ঠীরা যে ৭ই অক্টোবর ইজরায়েলি সীমানার মধ্যে অনুপ্রেবেশ করে, আর ফলস্বরূপ ইজরায়েলি নাগরিক, পর্যটক, এবং পরিযায়ী শ্রমিকসহ মোট ১১৫৪ জন মারা যান, ২৪০ জন পণবন্দী হন, সেই ঘটনা আসলে ইজরায়েলের হাতে, তাদের ‘ফাইনাল সল্যুশান’/ চূড়ান্ত সমাধান বাস্তবায়িত করার, বহুকাঙ্ক্ষিত একটা অযুহাত তুলে দেয়।
৭ই অক্টোবর আসলে সময়ের একটা বিভাজন – যার আগে, প্যালেস্টিনীয়েদের প্রতি নিষ্ঠুরতা আর তাদের পরাধীন করে রাখার ইজরায়েলি নীতি কায়েম ছিল। আর সেদিনের পর থেকে, প্যালেস্টিনীয়েদের সম্পূর্ণ ভাবে নির্মূল করা আর ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইন থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়ার যে ইজরায়েলি পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়ন শুরু হয়।
ক্ষূধাকে যে ভাবে ইজরায়েল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, যে কোনও গণহত্যার পরিণতি সেটাই হয়। জেনারেল এফ্রাইন রিওস মন্টের নেতৃত্বে, গুয়াতেমালায় যে গণহত্যা চলেছিল, তখন পার্বত্য গুয়াতেমালায় পরিকল্পিত খাদ্য সঙ্কটের ভয়াবহ প্রভাব আমি দেখেছি। দক্ষিণ সুদানের দূর্ভিক্ষ, যাতে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ মারা যান –রাস্তায়ে ছড়িয়ে থাকা গোটা পরিবারের দুর্বল ও কঙ্কালসার মৃতদেহর পাশ দিয়ে হেঁটেছি আমি। তারও পরে, বসনিয়ার যদ্ধের সময়, সার্বরা যখন স্রেব্রেনিকা এবং গোরাঝদে খাবার আর ত্রাণ আটকে দিয়েছিল, সেখানেও একই ছবি।
অটোমান সাম্রাজ্য আর্মেনীয়দের ধ্বংস করার জন্য অনাহারকে অস্ত্র করেছিল। ১৯৩২ এবং ১৯৩৩ সালে, লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনীয়কে হত্যা করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যাবহার করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, ঘেটোয়ে আটক ইহুদীদের বিরূদ্ধেও নাৎসিরা একই পন্থা অনুসরণ করেছিল। জার্মান সৈন্যরা ইজরায়েলিরা এখন যেমন করছে, সেরকমই, খাদ্যসামগ্রীকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করত।
ওয়ারশ ঘেটোর খিদেয় মরিয়া পরিবারগুলোকে মৃত্যুশিবিরে (death camps) পাঠানোর জন্য প্রলুব্ধ করতে তারা তিন কিলোগ্রাম রুটি এবং এক কিলোগ্রাম মার্মালেড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মারেক এডেলম্যান তাঁর ‘দ্য ঘেটো ফাইটস্’ বইতে লিখেছেন: “তিন কিলোগ্রাম রুটি পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ মানুষের সংখ্যা এতটাই বেশী ছিল, যে, ১২,০০০ লোক একসাথে নিয়ে যাওয়ার পরিবহনগুলি, যা এখন দিনে দু’বার ছাড়ছে, তাতেও সকলের জায়গা হত না।” আর যখন, গাজার মতই, অপেক্ষামান জনতা বিশৃঙ্খল হয়ে উঠতো, তখন জার্মান সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালাত শীর্ণদেহী মহিলা, শিশু বা বৃদ্ধদের উপর।
ইতিহাসে যুদ্ধ যবে থেকে আছে, ক্ষূধাকে অস্ত্র করার কৌশলও তখন থেকেই আছে।
পাউরুটি তৈরির দোকানগুলোয়ে (bakeries) বোমা ফেলে, বা গাজায় খাদ্যসামগ্রী আমদানিতে বাধা দিয়ে, গণহত্যার শুরু থেকেই, ইজরায়েল পরিকল্পিতভাবে, খাদ্য সরবরাহের উৎসগুলিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। গত মার্চে এটা চরমে পৌঁছায় যখন তারা গাজার প্রায় সমস্ত খাদ্য সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
‘ইউনাইটেড নেশানস্ রিলিফ অ্যাণ্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্ট (UNRWA) – খাদ্যের জন্য বেশিরভাগ প্যালেস্টিনীয়ই এই সংস্থাটির উপর নির্ভরশীল। আর তাই কোনও প্রমাণ ছাড়াই, এই সংস্থার কর্মচারীদের বিরূদ্ধে, ৭ই অক্টোবরের হামলায়ে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে, ইজরায়েল তাদের সরবরাহ ব্যবস্থাকে নিশানা বানিয়েছে।
২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংস্থাকে ৪২২ মিলিয়ন ডলার আর্থিক অনুদান দিয়েছিল। কিন্তু UNRWA-এর বিরূদ্ধে মিথ্যা এই অভিযোগ আমেরিকার হাতে অযুহাত তুলে দিয়েছে আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার। পরবর্তীতে ইজরায়েল এই সংস্থাটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
২রা মার্চ থেকে গাজার খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা (humanitarian aid)-র উপর ইজরায়েল আরোপিত সম্পূর্ণ অবরোধ (blockade) গাজার মানুষদের চরম করুণার পাত্রে পরিণত করেছে। শুধু একটু খাবার পাওয়ার আশায়ে, তারা তাদের হত্যাকারীদের কাছে মাথা নিচু করে, ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়েছে। অপমানিত, ভীতসন্ত্রস্ত, সামান্য কিছু খাবারের টুকরোর জন্য মরিয়া গাজার মানুষদের থেকে তাদের আত্মমর্যাদা, স্বায়ত্তশাসন এবং ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আর এই পুরোটাই পূর্বপরিকল্পিত।
যারা একসময়ে ৪০০টি UNWRA ত্রাণ শিবিরের উপর নির্ভর করত, গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের মাত্র চারটি ত্রাণশিবির প্যালেস্টিনীয়দের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তৈরি হয়নি। যে কোনও একটা শিবিরে পৌঁছানোর যে ভয়াবহ যাত্রা, তা আদতে গাজার মানুষকে উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ গাজায় যেতে বাধ্য করার কৌশল।
বিতরণ কেন্দ্রগুলিতে পৌঁছাতে গেলে, সংকীর্ণ ধাতব বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গার মধ্যে দিয়ে, যেতে হয়। খাবারের আশায়ে, গবাদি পশুর মত করে প্যালেস্টিনীয়রা সেই ঘেরা জায়গায় জড়ো হয় আর ভারি অস্ত্রে সজ্জিত ভাড়াটে সৈন্যরা পাহারা দেয় বিতরণ কেন্দ্রগুলিকে। ভাগ্যবান কিছু মানুষ একটি ছোট খাবারের বাক্স পায়। বেশিরভাগই কিছুই পায় না। আর যখন খাবারের জন্য বিশৃঙ্খল ঠেলাঠেলিতে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে জনতা, তখন ইসরায়েলি আর ভাড়াটে সৈন্যরা তাদের গুলি করে, তাতে ১,৭০০ জন নিহত এবং আরও হাজার হাজার মানুষ আহত হয়।
এই গণহত্যা পুরানো সব ছককে ভেঙ্গে দিয়েছে। ইজরায়েলের সব মিথ্যার মুখোশ খুলে দিয়েছে। দুটি আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করার প্রতিশ্রুতি (two state solution) মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কোনও যুদ্ধ চলাকালীন, বিপক্ষের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বজায় রাখার যে নিয়ম, ইজরায়েল সেই নিয়ম যে মানে না তা প্রমাণ হয়ে গেছে। হামাস হাসপাতাল এবং স্কুলগুলিকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে বলেই ইজরায়েল সেগুলিতে বোমা ফেলে, সেই অজুহাত মিথ্যে।
হামাস সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, সেটাও মিথ্যা। ইজরায়েল নিজেই নিয়মিতভাবে, বিস্ফোরক থাকতে পারে এমন (booby trapped) বাড়ি বা সুড়ঙ্গে প্রবেশ করার সময়, ইজরায়েলি সৈন্যদের আগে, হাত বাঁধা, ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর পোশাক পরানো প্যালেস্টিনীয় বন্দিদের ঢুকতে বাধ্য করে। প্যালেস্টীনিয় রকেট ভুল করে হাসপাতাল, জাতিসঙ্ঘের অফিস ধংস করেছে বা সাধারণ মানুষের প্রাণহানি করেছে, আর জন্য দায়ী হামাস বা প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ, বোঝা যাচ্ছে সেই বক্তব্যও মিথ্যে। আরেকটা মিথ্যা হল, হামাস ত্রাণবাহী ট্রাক দখল করে, সেগুলো ব্যবহার করে অস্ত্র বা যুদ্ধের অন্যান্য সরঞ্জাম পাচার করছে, তাই গাজার ত্রাণ আসা বন্ধ হয়ে গেছে। ইজরায়েলি শিশুদের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে বা প্যালেস্টিনীয়রা ইজরায়েলি মহিলাদের উপর যৌন হামলা চালিয়েছে এই প্রচারও মিথ্যা প্রমাণিত।
গাজায় নিহত দশ হাজার মানুষের ৭৫ শতাংশই হামাস “সন্ত্রাসবাদী”- আরেকটা মিথ্যা। হামাস অস্ত্র যোগাড় করে, নতুন সদস্য নিয়োগ করছে বলে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গের জন্য তারাই দায়ী – সেটাও মিথ্যা।
ইজরায়েলি গণহত্যার নগ্ন চেহারাটা সামনে এসেছে।
“গ্রেটার ইজরায়েল”-– যার মধ্যে আছে গোলান হাইটসের দখল করা সিরিয়ান ভূখণ্ড, দক্ষিণ লেবানন, গাজা আর অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, যেখান থেকে প্রায় ৪০,০০০ প্যালেস্টিনীয়কে ঘরছাড়া করা হয়েছে, আর আমার মনে হয় শীঘ্রই এই অঞ্চলটাও ইজরায়েলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে – সেই গ্রেটার ইজরায়েলের সম্প্রসারণ আরও নিশ্চিত হচ্ছে।
গাজার গণহত্যা একটা খারাপ সময়ের সূচনা মাত্র। এমনিতেই, তীব্র জলবায়ু সঙ্কট, ফলস্বরূপ ব্যাপক অভিবাসন (migration), ভেঙ্গে পড়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা, ভয়ানক দাবানল, হারিকেন, ঝড়, বন্যা, খরাতে, পৃথিবীকে ধ্বংসের দিক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে অস্থিরতা যত বাড়বে, শিল্পোন্নত দেশদ্বারা যে সুসংগঠিত সন্ত্রাস (industrial violence) এখন শুধু প্যালেস্টাইনকে ধ্বংস করছে, তা সর্বব্যাপী আকার নেবে।
গাজাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যে ইজরায়েলি প্রচেষ্টা, তা আসলে আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন দিয়ে পরিচালিত বিশ্বব্যাপী সুশৃঙ্খলতার (গ্লোবাল অর্ডার) মৃত্যুকে চিহ্নিত করে। যদিও প্রায়শই, আমেরিকা ভিয়েতনাম, ইরাক বা আফগানিস্থানের বিরূদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে এই নিয়ম লঙ্ঘন করে, কিন্তু তাও একটা কাল্পনিক (utopian) আদর্শ হিসাবে এগুলো এতদিন স্বীকৃতি পেতো।
আমেরিকা, আর তার পশ্চিমী মিত্ররা (western allies) এই গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার অস্ত্রই শুধু জোগান দিচ্ছে তা না, গাজায় মানবিক আইন মানার যে দাবি বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্র পেশ করছে, তাতেও বাধা দিচ্ছে। ইয়েমেন – একমাত্র দেশ যারা এই গণহত্যা বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল, তাদেরকে আক্রমণও করা হয়েছে।
তাদের বক্তব্যটি খুবই স্পষ্টঃ
আমাদের সব কিছু আছে। তোমরা যদি তা কেড়ে নিতে চাও, তোমাদের মেরে ফেলব।
মিলিটারি ড্রোন, হেলিকপ্টার গানশিপ, সীমানার প্রাচীর, চেকপয়েন্ট, কাঁটা তারের বেড়া, ওয়াচ টাওয়ার, ডিটেনশান সেন্টার, নির্বাসন, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, এন্ট্রি ভিসা বাতিল হওয়া, পরিচয়পত্র না থাকার জন্য যে বৈষম্যমূলক জীবনযাত্রা, ব্যক্তিগত অধিকার হরণ, ইলেক্ট্রনিক নজরদারি, এগুলো যেমন মেক্সিকোর সীমানা দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করা বা ইউরোপে ঢুকতে চাওয়া মরিয়া অভিবাসীদের সুপরিচিত, তেমনি নিজেদের দেশে থাকা প্যালেস্টিনীয়দের কাছেও পরিচিত।
রোনেন বার্গম্যান, তাঁর ‘রাইজ অ্যাণ্ড কিল ফার্স্ট’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ইজরায়েল “যে কোনও পশ্চিমী দেশের তুলনায় অনেক বেশী গুপ্তহত্যা করেছে”। আর তারাই আবার নাৎসি হলোকাস্টকে ব্যবহার করে, তাদের পূর্বপুরুষদের নিপীড়নের মাহাত্ম্য প্রচার করে, তাদের এই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, বৈষম্যমূলক আচরণ, তাদের এই গণহত্যা, আর ‘লেবেন্সরাউম’-এর জায়নবাদী সংস্করণকে ন্যায্যতা দেয়।
আর এই কারণেই, আউশউইৎস থেকে বেঁচে ফিরে আসা লেখক প্রিমো লেভির মতে, হলোকাস্ট বা ষোয়াহ্ হল ‘একটা অপরিসীম মন্দের উৎস’, যা ‘বেঁচে ফিরে আসা মানুষদের মধ্যে এমন ঘৃণার সঞ্চার করে, যা তাদের নিজের অজ্ঞাতেই, কখনও প্রতিশোধস্পৃহা হিসাবে, বা নৈতিক অধঃপতন হিসাবে, অথবা নেতিবাচকতা, ক্লান্তি বা জীবন থেকে হাল ছেড়ে দেওয়া, এমন বিভিন্ন ভাবে বেড়িয়ে আসে।’
গণহত্যা বা কোনও জাতিতে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া কেবল ফ্যাসিবাদী জার্মানি বা ইজরায়েলই করেছে এমন নয়।
এমে সেযেয়ার তাঁর ‘ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজম্’ বইতে লিখেছেন, হিটলারের নিষ্ঠুরতাকে ব্যতিক্রমী মনে হয় কারণ তাঁর তত্ত্বাবধানে ‘শ্বেতাঙ্গ মানুষদের অপমান’ করা হয়েছিল। আর সেই ‘সান্রাজ্যবাদী অত্যাচার, যা তার আগে পর্যন্ত আলজিরিয়ার আরব, ভারতীয় কুলি বা আফ্রিকার নিগ্রোদের উপর করা হত’, সেই অত্যাচার হিটলার ব্যবহার করেছিলেন ইওরোপিয়ানদের উপর।
তাসমানিয়ার আদি জনগোষ্ঠীর প্রায়-সম্পূর্ণ বিলুপ্তি, হেরেরো ও নামাকুয়াদের জার্মান গণহত্যা, আর্মেনীয় গণহত্যা, ১৯৪৩ সালের বাংলার দূর্ভিক্ষ – যে দূর্ভিক্ষে, প্রায় তিন মিলিয়ন হিন্দুর মৃত্যুকে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল অবহেলায়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কারণ মৃতরা ছিল ‘কদর্য ধর্মের জঘন্য জাতি’ – এ ছাড়া, হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে সাধারণ মানুষের উপর ফেলা পারমাণবিক বোমা, এই সব কিছুই পাশ্চাত্য সভ্যতার একটা মৌলিক দিক তুলে ধরে।
পাশ্চাত্যের নৈতিক আদর্শ তৈরি করেছেন যে দার্শনিকরা – ইমানুয়েল কান্ট, ভলতেয়ার, ডেভিড হিউম, জন স্টুয়ার্ট মিল এবং জন লক – তাঁরা প্রত্যেকেই, ক্রীতদাস বা নিপীড়িত জনগণ, আদি জনগোষ্ঠীর মানুষ, বিভিন্ন উপনিবেশের সাধারণ মানুষ, সমস্ত জাতির মেয়েদের, এবং আইনের চোখে অপরাধী – সবাইকেই তাদের নৈতিকতার হিসাবনিকেশের বাইরে রেখেছিলেন।
তাদের মতে ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরাই পৃথিবীকে আধুনিকতা, নৈতিকতা, বিচার ব্যবস্থা আর স্বাধীনতার মর্ম বুঝিয়েছে। আর তাই, ঔপনিবেশিকতা, ক্রীতদাস প্রথা, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার আদি জনজাতির (নেটিভ আমেরিকান ও অস্ট্রেলিয়ার ফার্স্ট নেশান) গণহত্যা, বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প এবং আমাদের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের প্রতি মোহ – এই সব কিছুকে ন্যায্য প্রমাণ করতে সাহায্য করেছে ব্যক্তি পরিচয়ের এই বর্ণবিদ্বেষী সংজ্ঞা।
সুতরাং, যখন আপনি শোনেন যে পাশ্চাত্যের নৈতিক অনুশাসন একটি অপরিহার্য বিষয়, তখন নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন: কার জন্য?
কবি ল্যাংস্টন হিউজ বলেছিলেন ‘ফ্যাসিজম্ আসলে কি, তা আমেরিকার নিগ্রোদের বোঝাতে হয় না। আমরা এমনিই জানি। নর্ডিক/শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য বা অর্থনৈতিক দমননীতির তত্ত্বগুলি আমাদের দীর্ঘদিনের চেনা বাস্তব।’
আমেরিকার জিম ক্রো-র আমলে প্রচলিত জাতিবিদ্বেষী ও বৈষম্যমূলক আইনের অনুকরনে, নাৎসিরা নিউরেমবার্গ আইন তৈরি করছিল। যদিও নেটিভ আমেরিকান বা ফিলিপিনোরা, আমেরিকা বা আমেরিকার অধিকৃত অঞ্চলেরই আদি বাসিন্দা, আমেরিকা তাদের নাগতিকত্ব দিতে নারাজ ছিল। সেই একই ভাবে জার্মান ফ্যাসিবাদীরা ইহুদিদের থেকে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল।
আমেরিকান ‘অ্যান্টি-মিসিজেনেশন আইন’ (anti-miscegenation laws) যে কোন আলাদা জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে বিবাহকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করত। সেই অনুকরণেই, জার্মান ইহুদি আর আর্যদের মধ্যে বিবাহও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
আমেরিকার তৎকালীন বিচারব্যবস্থা, কারুর যদি বংশলতিকায়ে, এক শতাংশও কৃষ্ণাঙ্গ পূর্বপুরুষ থাকে, ‘ওয়ান ড্রপ রুল’ অনুযায়ী তাকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই গণ্য করত।
মজার ব্যপার, নাৎসিরা এই বিষয়ে আমেরিকার থেকে বেশি নমনীয়তা দেখিয়ে ছিল। তাদের নিয়মে,কারুর তিন বা তার বেশি ইহুদি পূর্বপুরুষ থাকলে, তখন সে ইহুদি বলে গণ্য হবে।
বিভিন্ন দেশ, যেমন মেক্সিকো, চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, কঙ্গো বা ভিয়েতনাম – যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঔপনিদেশিকতার শিকার হয়েছে অতীতে, তারা তাই ইহুদিদের এই ফাঁকা দাবি, যেখানে তারা তাদের জাতিগত কারণে নিপীড়িত হওয়াকে তুলনাহীন বলে প্রমাণ করতে চায়, সেটায়ে কর্ণপাত করে না। ওই দেশগুলিও একদিন গণহত্যার শিকার হয়েছিল, খালি পাশ্চাত্যের সেই হত্যাকারীরা ওই গণহত্যার গুরূত্ব অস্বীকার করে।
পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে অঙ্গাঙ্গী ভাবে মিশে আছে বিভিন্ন গণহত্যার ইতিহাস। কিন্তু গাজার গণহত্যা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, নৃতত্ববিদ অর্জুন আপ্পাদুরাই-র কথায়ে তা হল, ‘বিশ্বায়নের যুগে বিজয়ীদের জন্য বিশ্বকে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে, পরাজিতদের অস্বস্তিকর আওয়াজ (inconvenient noise) চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য করা বিশ্বব্যাপী এক ম্যালথুসিয়ান সংশোধন।’
ইজরায়েল সেই জাতি-রাষ্ট্রবাদের মূর্ত রূপ, যা যে কোনও চরম ডানপন্থীদের স্বপ্ন – যেখানে যাবতীয় রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ/বৈচিত্র্যকে, বা আইনি, কূটনৈতিক এবং নৈতিক রীতিনীতি উপেক্ষা করা যায়। এই প্রোটো-ফ্যাসিস্টদের ইজরায়েলকে পচ্ছন্দ হওয়ার/সমীহ করার কারণ, রাষ্ট্রের চোখে যারা কলুষিত মানুষ, যাবতীয় মানবিক আইন উপেক্ষা করে, তাদের সমাজ থেকে নির্মূল করতে ইজরায়েলের মত দেশ নির্বিচারে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারে পিছপা হয় না।
আর ইজরায়েল কোন ব্যতিক্রম নয়। এগুলো আসলে মানুষের মনের অন্ধকারতম প্রবৃত্তিগুলির প্রকাশ, আর আমি তাই আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।
এই ইহুদি ফ্যসিবাদের শুরুটা আমি দেখেছি। উগ্রবাদী মায়ার কাহানেকে নিয়ে লিখেছি আমি, যাকে পরবর্তীতে নির্বাচনে দাঁড়াতে দেওয়া হয় নি এবং যার কাখ পার্টিকে ১৯৯৪ সালে, ইজরায়েল আর আমেরিকা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে বেআইনি ঘোষণা করে।
বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশেও আমি গেছি। তখন তিনি, ডানপন্থী আমেরিকার বিপুল অর্থসাহায্য নিয়ে, ইতঝাক রাবিনের বিরূদ্ধে লড়ছেন – ইতঝাক রাবিন যিনি সেই সময় প্যালেস্টাইনের সাথে একটা শান্তিচুক্তি তৈরির চেষ্টা করছিলেন। নেতানিয়াহুর সমর্থকরা স্লোগান দিত – রাবিনের মৃত্যু চাই। তারা নাৎসি পোশাকে সাজানো রাবিনের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছিল। এরকম একটি নকল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সামনে নেতানিয়াহু মিছিলেও হেঁটেছিলেন।
১৯৯৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর, রাবিন নিহত হন এক গোঁড়া ইহুদির হাতে। রাবিনের বিধবা স্ত্রী লিহা, তাঁর স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছিলেন নেতানিয়াহু আর তাঁর সমর্থকদের।
নেতানিয়াহু প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। রাজনৈতিক জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে ইতামার বেন-গ্ভির, বেযালেল স্মোট্রিচ, আভিগডর লিবেরমান, গিডিয়ন সা’আর এবং নাফ্তালি বেনেট্-র মতো বিভিন্ন ইহুদি উগ্রপন্থীর সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে চলেছেন।
নেতানিয়াহুর বাবা, বেঞ্জিওন, যিনি জায়নবাদের পথিকৃত ভ্লাদিমির জাবতিনস্কি- যাকে মুসোলিনি ভাল ফ্যাসিবাদী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন – তাঁর সহকারি ছিলেন। বেঞ্জিওন সেই হেরাট পার্টির নেতা ছিলেন, যারা ইহুদি রাস্ট্র তৈরি করার জন্য, ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের সমস্ত জমি কেড়ে নেওয়ার দাবি জানাত।
১৯৪৮ সালের যে যুদ্ধ অবশেষে ইজরায়েল রাষ্ট্র তৈরি করে, হেরাট পার্টির অনেকেই সেই সময় সন্ত্রাসবাদী হামলায়ে অংশ নিয়েছিল। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, হানাহ্ আরেণ্ডট, সিডনি হুক সহ, অন্যান্য ইহুদি বুদ্ধিজীবীরা ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত বিবৃতিতে, হেরাট পার্টিকে একটি “রাজনৈতিক দল, যার সংগঠন, কর্মপদ্ধতি, রাজনৈতিক দর্শন এবং সামাজিক আবেদন/ অবস্থান, নাৎসি ও ফ্যাসিবাদী দলগুলির সাথে নিবিড়ভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ” বলে বর্ণনা করেন।
জায়নবাদী প্রকল্পের মধ্যে সবসময়ই ইহুদি ফ্যাসিবাদের ধারা বিদ্যমান ছিল, যা আমেরিকান সমাজের ফ্যাসিবাদের প্রতিচ্ছবি। দুর্ভাগ্যবশত, ইজরায়েলি এবং প্যালেস্টিনীয়দের জন্য এই ফ্যাসিবাদী ধারাগুলি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
হলোকস্ট থেকে বেঁচে ফিরে আসা জেভ স্টার্নহেল ইজরায়েলি ফ্যাসিবাদ বিশেষজ্ঞ। তিনি ২০১৮ সালে আমাদের সতর্ক করেন, ‘এখানে যে বিষাক্ত উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটছে, তার বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বামপন্থীদের সাধ্যের বাইরে। ইওরোপে, একটা সময়, এই রকম উগ্র জাতীয়াবাদের কারণেই, আজ ইহুদিদের একটা বড় অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।‘ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কেবল একটি ক্রমবর্ধমান ইজরায়েলি ফ্যাসিবাদই দেখছি না, তার সাথে নাৎসিবাদের প্রাথমিক পর্যায়ের মতো বর্ণবাদও দেখছি।”
এই যে গাজাকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার সিদ্ধান্ত, কাহেনের আন্দোলনের উত্তরসূরী, চরম ডানপন্থী জায়নবাদীদের তা দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন ছিল। ইহুদি পরিচয় আর ইহুদি জাতীয়াবাদ নাৎসিদের ‘ব্লাড অ্যাণ্ড সয়েল’ তত্ত্বেরই জায়নবাদী সংস্করণ। ইহুদি আধিপত্য ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য, তেমনি প্যালেস্টিনীয়দের হত্যাও একটা পবিত্র কাজ। বাইবেলে বর্ণিত আছে ভগবানের আদেশে ইজরায়েলিরা আমালেকিয় জনজাতির গণহত্যা করেছিল। নেতানিয়াহু প্যালেস্টিনীয়দের সেই আমালেকিয়দের সাথে তুলনা করেছেন। আমেরিকান উপনিবেশগুলিতে ইউরো-আমেরিকান বসতি সেটলাররাও আদি আমেরিকানদের গণহত্যাকে ন্যায্যতা দিতে, বাইবেলের এই অনুচ্ছেদই ব্যবহার করেছিল।
শত্রুরা – এক্ষেত্রে অবশ্যই মুসলিমরা – যাদের বিলুপ্তি নিশ্চিত, তারা অমানুষ, শয়তানের মূর্ত প্রতিচ্ছবি। ইহুদিদের ঐন্দ্রজালিক জাতীয়তাবাদের বৃত্তের বাইরে যারা আছে, তারা শুধুই সহিংসতা আর সন্ত্রাসের ভাষাই বোঝে।
যখন সমস্ত প্যালেস্টিনীয়দের বহিস্কার সফল হবে, তখন আবার মসীহা আসবেন মুক্তির বাণী (Messianic redemption) নিয়ে। (ইহুদিরা বিশ্বাস করে, এই মসীহার পূনরাভির্ভাবের সময়, ধ্বংস হয়ে যাওয়া মন্দির আবার তৈরি হবে।) মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্র উপাসনালয় আল-আক্সা মসজিদ, যা ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সৈন্যদের হাতে ধংস হওয়া দ্বিতীয় ইহুদি মন্দিরের ধংসাবশেষের উপর তৈরি, ইহুদি চরমপন্থীরা সেই মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার আহবান জানায়।
মসজিদটির জায়গায়ে ‘তৃতীয়’ ইহুদি মন্দির তৈরি করার যে পরিকল্পনা, তা বাকি মুসলিম বিশ্বকে চরম ভাবে উত্তেজিত করবে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, যাকে ধর্মান্ধ চরমপন্থীরা ‘জুডেয়া ও সামারিয়া’ (বাইবেলে বর্ণিত প্রাচীন ইজরায়েলি সাম্রাজ্যের কেন্দ্র) বলে, ইজরায়েল সেই ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক দখল করে নেবে। ‘শাস’ বা ‘ইউনাইটেড তোরাহ জুডাইজম’ পার্টির মতো অতি গোঁড়া (ultra orthodox) রাজনৈতিক দলগুলির চাপানো ধর্মীয় আইন দ্বারা পরিচালিত হয়ে, ইজরায়েল ইরানের একটি ইহুদি সংস্করণে পরিণত হবে।
ইজরায়েলে এবং তার অধিকৃত অঞ্চলে বসবাসকারী প্যালেস্টিনীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করে এমন ৬৫টিরও বেশি আইন আছে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্যালেস্টিনীয়দের নির্বিচারে হত্যা, প্রায় ১০,০০০-রও বেশি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত ইহুদি মিলিশিয়ার হত্যালীলা, সেই সঙ্গে যে ঘরবাড়ি ও স্কুল ভেঙ্গে ফেলা, প্যালেস্টিনীয়দের অবশিষ্ট জমি দখল করে নেওয়া – এই সবই আরো তীব্রতর হচ্ছে।
একই সাথে, ইজরায়েল, দেশে এবং বিদেশে থাকা “ইহুদি বিশ্বাসঘাতকদের” ওপর চড়াও হচ্ছে— যারা ক্ষমতাসীন ইহুদি ফ্যাসিবাদীদের উন্মাদ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এবং এই গণহত্যার নিন্দা করে। ফ্যাসিবাদের পরিচিত শত্রুরা— সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, নারীবাদী, উদারপন্থী, বামপন্থী, সমকামী এবং শান্তিবাদীরা— আক্রান্ত হচ্ছেন।
নেতানিয়াহুর প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশের বিচার ব্যাবস্থা ক্ষমতাহীন হয়ে যাবে। প্রকাশ্য বিতর্ক বন্ধ হয়ে যাবে। সুশীল সমাজ বা শাসনব্যবস্থা থাকবে না। ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে যাঁরা চিহ্নিত হবেন, তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে।
ইজরায়েল চাইলেই হামাসের কাছে থাকা পণবন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে, ইজরায়েলের কারাগারে আটক হাজার হাজার প্যালেস্টিনীয় বন্দীদের মুক্তি দিতে পারত – ৮ই অক্টোবর যে কথা ভেবেই ইজরায়েলিদের পণবন্দী করেছিল হামাস।
আর এখন এটাও প্রমাণিত হয়েছে, হামাস জঙ্গীরা ইজরায়েলে ঢোকার পর যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, তখন ইজরায়েলি সৈন্যরা, হামাস যোদ্ধা এবং তাদের সাথে থাকা ইজরায়েলি পণবন্দীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি করার সিদ্ধান্ত নেয়, যার ফলে তাদের নিজেদের সৈন্য ও সাধারন নাগরিকসহ সম্ভবত শতাধিক মানুষ সেদিন মারা যায়।
জেমস বল্ডউইনের মতে, ইজরায়েল এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা এক ‘ভয়ানক সম্ভাবনার’ দিকে এগোচ্ছে। যেখানে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলি, ‘তাদের বন্দীদের কাছ থেকে যা কেড়ে নিয়েছে, তা আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করবে এবং নিজেদের স্বরূপ দেখতে অক্ষম হওয়ায়, তারা বিশ্বজুড়ে এমন এক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে যা পৃথিবী থেকে প্রাণের চিহ্ন মুছে না দিলেও, এমন এক জাতিগত যুদ্ধ ডেকে আনবে যা পৃথিবী আগে কখনো দেখেনি।’
ইজরায়েলের এই গণহত্যায় আমেরিকা বা ইওরোপীয় রাষ্ট্রগুলি যেভাবে অর্থ বা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি হওয়া আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। ওই আইনগুলির আর কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা রইল না। এমতাবস্থায়, পশ্চিম বিশ্ব কাউকে আর গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা পশ্চিমী সভ্যতার গুণাবলী নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জায়গায় নেই।
পঙ্কজ মিশ্রের কথায়, ‘গাজার এই পরিস্থিতি যেমন বিভ্রান্তি তৈরি করে, এক বিশৃঙ্খলা এবং শূন্যতার অনুভূতি জাগায়, তেমনি, অগণিত ক্ষমতাহীন মানুষের কাছে এটা একুশ শতকের রাজনৈতিক এবং নৈতিক চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পশ্চিমের একটা গোটা প্রজন্মের উপর প্রভাব ফেলেছিল।’
নিজেদের অভ্যন্তরের অন্ধকারকে চিহ্নিত করে তার মোকাবিলা আমাদেরই করতে হবে। আমাদের অনুতপ্ত হতে হবে। আমদের স্বেচ্ছায় চোখ বন্ধ করে রাখার প্রবণতা, ঐতিহাসিক সত্যগুলিকে ভূলে থাকার চেষ্টা, আইনি শাসনব্যবস্থার প্রতি দ্বায়বদ্ধতাকে উপেক্ষা করা, শিল্পভিত্তিক সহিংসতা (industrial violence) ব্যবহার করে অন্যের উপর আমাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার আছে বলে যে আমাদের বিশ্বাস, এই সবই, আমার আশঙ্কা, শিল্পোন্নত দেশগুলির দ্বারা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান দরিদ্র ও দুর্বল মানুষের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যা অভিযানের – শেষ নয়, বরং শুরুকে চিহ্নিত করে।
এটি হল কেইনের অভিশাপ। গাজায় এই গণহত্যা একটি ব্যতিক্রম না হয়ে নিয়মে পরিণত হওয়ার আগেই, আমাদের এই অভিশাপ দূর করতে হবে।
________________
ক্রিস হেজেস একজন পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক এবং দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রাক্তন বৈদেশিক বিভাগের সংবাদদাতা। তাঁর লেখাগুলি পাওয়া যাবে chrishedges.substack.com-এ। তাঁর সর্বশেষ বইয়ের নাম A Genocide Foretold।

