দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যদি আজ বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি ভিত্তিক পরিচয় তুলে ধরে, তাহলে ইতিহাসে ফিরে তাকালেই বোঝা যায় কীভাবে সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতেই গড়ে উঠেছিল দুর্গা পূজোর ইতিহাস।
সোহিনী সাহা
Groundxero | Oct 08, 2025
বাঙালি ও সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস আলোচনার বিষয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছু দিন আগেই। ১৯৪৬ এর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে বাঙালির ভূমিকাকে কেন্দ্র করে উঠেছিল তর্ক। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ সিনেমাটিতে হিন্দুদের রক্ষাকর্তা হিসেবে গোপাল পাঁঠার চিত্রায়নকে ঘিরে যে বিতর্ক উঠে এসেছিল, তাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল বাঙালিদের একটা প্রতিবাদমূলক প্রতিক্রিয়া। এই সংঘর্ষের নিরিখে বাংলা ও বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতাকে, তাঁদের স্বাধীন উদারবাদী চিন্তা ও চেতনাকে এবং বাঙালির সংহতিমূলক ভূমিকাকে এই প্রতিবাদ তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। গোপাল পাঁঠার পরিবারও প্রতিবাদ জানিয়েছিল তাঁর এই মুসলমান বিদ্বেষী চিত্রায়নের বিরূদ্ধে।
তারপরেও এই প্রতিবাদ সীমিত থাকেনি কেবলমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া বা পত্রিকায় লেখালেখিতে। অন্যভাবে তা উঠে এসেছিল সদ্য সমাপ্ত দুর্গা পুজোর পান্ডালগুলোতেও। যেমন বালিগঞ্জ সমাজ সেবী পূজা – ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরিপেক্ষিতে বাঙালিদের সংহতিমূলক ভূমিকাকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছিল। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এবারের দুর্গা পূজোকে কেন্দ্র করে মূলত কলকাতা কেন্দ্রীক পুজোগুলির অনেকগুলিতেই গড়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এক ধরনের প্রতিবাদ। সম্ভবত এই প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে দিয়ে শহুরে বাঙালি নিজের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক পরিচয়ের একটি চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছিল।
অন্যদিকে, এই প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়াগুলো যেমন ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সেগুলো ঢেকে ফেলছিল ইতিহাসের বহু জটিলতাকে। এই লেখা বাঙালির এই পরিচয়, দুর্গা পুজো ও সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসের জটিলতাকে কেন্দ্র করেই। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যদি আজ বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি ভিত্তিক পরিচয় তুলে ধরে, তাহলে ইতিহাসে ফিরে তাকালেই বোঝা যায় কীভাবে সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতেই গড়ে উঠেছিল দুর্গা পূজোর ইতিহাস। এই দুর্গা পুজোর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত কলকাতার ব্যায়াম সমিতির ইতিহাসও, যেগুলি হয়ে উঠেছিল বিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্র। এই লেখার উদ্দেশ্য এই ব্যায়াম সমিতি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা এবং দুর্গা পুজোর একটা সংযোগ তুলে ধরাও। তবে এই জটিল পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে যাওয়ার মধ্যে ঢোকার আগে বোঝা প্রয়োজন সাম্প্রদায়িকতা।
জয়া চ্যাটার্জী (১৯৯৪) “ভদ্রলোক সাম্প্রদায়িকতার” দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যার মধ্যে দিয়ে বিংশ শতাব্দীতে আমরা হিন্দু বাঙালির সাম্প্রদায়িক পরিচয় গঠন হতে দেখতে পাই। জয়া চ্যাটার্জির মতে আমরা সাম্প্রদায়িকতাকে কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক হিংসা, দাঙ্গা কিংবা ধর্মীয় প্রতীকের মধ্যে দিয়ে ভেবে থাকি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হিংসার বাইরেও যে সংস্কৃতি ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা আছে, যার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’-র পার্থক্য, তিনি সেটাই তুলে ধরেন। বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা কোনও দাঙ্গা বা হিংসা কেন্দ্রীক বিদ্বেষের থেকে নয়, বরং উদারবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রলোক’ সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এখানে তাই একটা পার্থক্য চলে আসে। বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে “সাম্প্রদায়িকতা নেই” বলতে আমরা যেটা বুঝি সেটা হচ্ছে দেশের অন্যান্য অংশ বা রাজ্যের (মূলত উত্তর ভারত) তুলনায় প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক হিংসার অনুপস্থিতি।
তাই আজকে যখন আমরা পেছনে ফিরে তাকাই বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ আমাদের কাছে হয়ে ওঠে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সেই সাম্প্রদায়িক হিংসার দাগ মুছে ফেলতে অনেক সময় আমরা তুলে ধরতে চাই সেই সময় মানুষের সংহতিমূলক ভূমিকা। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, কোথাও গিয়ে তা আবার দৈনন্দিন সাম্প্রদায়িকতা বা সংস্কৃতি ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয় না। মনে রাখা দরকার সেই সময় এইসব সংঘর্ষগুলি শুধুমাত্র অপ্রত্যাশিত ঘটনামাত্র ছিল না। এই সংঘর্ষগুলি অনেক ক্ষেত্রেই বাঙালি সমাজকে পরিবর্তন করছিল। সেরকমই এই সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই সাম্প্রদায়িকতাকে কেন্দ্র করে এক ধরনের বাঙালি হিন্দু সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের রাজনীতি গড়ে উঠতে। এই সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের রাজনীতিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠছিল সেই সময়কার কিছু ব্যায়াম সমিতি।
এখনও কলকাতা শহরে ছড়িয়ে আছে অনেক ব্যায়াম সমিতি যেগুলো গড়ে উঠেছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। এই ব্যায়াম সমিতিগুলিকে তাই দেখা হয়ে থাকে এক ধরনের বিপ্লবী কেন্দ্র হিসেবে। এই ব্যায়াম সমিতির ইতিহাস ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সম্পর্ক কেবল মাত্র ঔপনিবেশিক বিরোধিতায় নয়, পাশাপাশি এই ঔপনিবেশিকতার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা পরিচয়ের রাজনীতি নিয়েও। এই বিভিন্ন ব্যায়াম সমিতিগুলিকে আজ দেখা হয়ে থাকে তাদের দুর্গা পূজো এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্য। কিন্তু এগুলির গড়ে ওঠার পেছনে থাকা সাম্প্রদায়িক প্রসঙ্গ সঠিকভাবে উঠে আসে না।
মূলত বেশির ভাগ ব্যায়াম সমিতিগুলি একটি রাজনৈতিক সংহতকরনের নিরিখে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এই সংহতকরণ ‘হিন্দু’ কেন্দ্রীক ছিল। ব্যায়াম সমিতি নিয়ে এথনোগ্রাফিক কাজের সূত্রে বুঝতে পারি এইসব ব্যায়াম সমিতিগুলি মূলত হিন্দু তরুণদের শক্তি গঠনের জন্য তৈরি হয়েছিল। এখানে তাই সম্প্রদায় ও পুরুষতত্ব বা পুরুষ পরিচয় – এই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। “সিমলা ব্যায়াম সমিতির গোড়ার কথা (১২৫–১৯৩০)” বইটি থেকে জানা যায় এই সমিতির উৎপত্তি একটি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরিপেক্ষিতে। বলা হয়ে বাঙালি (হিন্দু) পুরুষদের মধ্যে পুরুষত্ব ও শক্তি ফিরিয়ে আনতে এই প্রচেষ্টা করা হয়েছিল (বাগচী, ২০১৮)। সেই সময় ব্রিটিশদের দ্বারা হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষদের চিত্রিত করা হতো মেয়েলি হিসেবে। মৃণালিনী সিনহা তাঁর বই “The Manly Englishman and the Effeminate Bengali Babu” (১৯৯৫) লেখাতে পাঠকদের এই পুরুষত্ব কেন্দ্রীক রাজনীতির বিষয়ে অবহিত করেন। ব্রিটিশদের দাগিয়ে দেওয়া এই পুরুষত্বহীনতাকে মুছে ফেলতে হিন্দু বাঙালি পুরুষত্ব ফিরিয়ে আনতে এক দীর্ঘ লড়াইয়ে নেমে পড়েন। তার একটি দিক বলা যেতে পারে এই ব্যায়াম সমিতিগুলোর গড়ে ওঠা। ১৯০০–১৯৩০–এর মধ্যে অনেকগুলি ব্যায়াম সমিতি হিন্দু বাঙালি তরুণদের শরীর ও পুরুষত্ব গঠনকে কেন্দ্র করে এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে।
এই বিভিন্ন উদহারন আমাদের দেখিয়ে দেয় কীভাবে ব্যায়াম সমিতিগুলো ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী জায়গার পাশাপাশি এক ধরনের হিন্দু সাম্প্রদায়িক পরিচয় গঠনের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে উঠেছিল। শক্তি বৃদ্ধি শুধু সীমিত থাকে না ব্যায়ামে, শক্তির সঞ্চয় করার জন্য প্রয়োজন হয় শক্তির আরাধনার। ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখা যায় এই ব্যায়াম সমিতি আর দুর্গা পুজোর একটা ইতিহাস আছে এই শহরে, কলকাতায়। শক্তি অথবা যেটাকে আমরা বলে থাকি, feminine power, সেই হিন্দু কেন্দ্রীক মাতৃশক্তির প্রতীক ভিত্তি করে গড়ে ওঠে শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির চর্চা। হিন্দু পুরুষদের মধ্যে পুরুষত্ব তৈরির প্রচেষ্টা হয়ে ওঠে মাতৃশক্তিকে কেন্দ্র করে। আজ যে শক্তির আরাধনাকে নারীশক্তির প্রতীক হিসেবে মানা হয়ে, সেই শক্তির আরাধানা গড়েই উঠেছিল পুরুষত্বকে কেন্দ্র করে।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই এই ধরনের বিভিন্ন হিন্দু প্রতীকের মাধ্যমে আমরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখতে পারি। ধর্ম কেন্দ্রীকতার সঙ্গে শারীরিক গঠনের একটা সংযোগ গড়ে ওঠে বিরাষ্টমী পুজোর মধ্যে দিয়ে। এই উৎসব দুর্গা পূজোর অষ্টমীর দিনকে কেন্দ্র করে কিছু ব্যায়াম সমিতিতে হয়ে থাকে, যেমন সিমলা ব্যায়াম সমিতি, হাটখোলা ব্যায়াম সমিতি, বাগবাজার। এই উৎসব মূলত বিভিন্ন রকমের শরীর চর্চার একটা সমাবেশ যেখানে কুস্তি থেকে লাঠি বা তরোয়াল খেলার প্রদর্শনী হয়। কিন্তু এটা শুধুই প্রদর্শনী বা শরীর চর্চাতে সীমিত থাকে না। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও পুজোকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। যেমন ইতিহাসের কিছু বইয়ে উল্লেখ (বাগচী, ২০১৮) (কুমার, ১৯৯৩) আছে বিরাষ্টমী পুজোয় তরোয়াল পুজো করা হয়ে থাকে। কিছু ব্যায়াম সমিতি এই পুজো যেমন দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে করে থাকে, অন্য দিকে কিছু ব্যায়াম সমিতিতে এই পুজো হনুমান কে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। হনুমানের পূজোকে শক্তির পুজোর নিরিখে নিয়ে আসে এই ব্যায়াম সমিতি গুলো যারা নিজেরাও শক্তি সঞ্চয় করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। আজকের হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রতীক হনুমান, বহুদিন ধরেই এই ব্যায়াম সমিতি ও আখড়াগুলোতে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। এই বাংলাতেও তা আমরা দেখতে পাই সেই বিংশ শতাব্দী থেকেই।
বাগবাজারের একটি পুজো কমিটির সদস্য থেকে জানতে পারি এই বিরাষ্টমীর সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোনো যোগাযোগ নেই। এই পুজোকে কেন্দ্র করে মূলত একটা রাজনৈতিক সমাবেশ গড়ে উঠত জাতীয়তাবাদীদের। ব্যায়াম সমিতির এই দুর্গা পুজোগুলো হয়ে উঠত বিপ্লবীদের একসঙ্গে হতে পারার সমাবেশ। এই বক্তব্যটি জরুরি, কারণ এখানে “ধর্মনিরপেক্ষ” জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের থেকে “ধর্ম” কে আলাদা করা হয়েছে। এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে কোথাও বাঙালির পরিচয় থেকে ধর্মকেন্দ্রীকতাকে মুছে একটা বিপ্লবী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ধর্মের সম্পর্কগুলোকে অগ্রাহ্য করা যায় না বলেই মনে হয়। ধর্ম ও রাজনীতি এখানে মিলেমিশে যায়।
এই রাজনৈতিক সমাবেশ যে এক হিন্দু পুজোকে প্রতীক মেনে গড়ে ওঠে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারণ শক্তির আরাধনা একটা রাজনৈতিক মোড় নেয় এই পূজোর মধ্যে দিয়ে। রাচেল ফেলল মাকডারমট (২০১১) তাঁর বইয়ে আমাদের দেখিয়েছেন কি ভাবে দুর্গা বা কালী বিংশ শতাব্দীতে একটি রাজনৈতিক প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এই রাজনৈতিক প্রতীক কেবলমাত্র ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার পরিপ্রেক্ষিতে না, মুসলমান বিদ্বেষকে উপলক্ষ করেও গড়ে উঠে। রাধা কুমার তাঁর লেখা বই “The history of doing” (১৯৯৩) –এ দেখান এই বিরাষ্টমীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন হিন্দু বাঙালি দেশপ্রেমিককে চিত্রিত করে (হিন্দু) বাঙালিকে দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। এখানে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে কেন্দ্র করে দেশপ্রেমের একটি আখ্যান গড়ে ওঠে।
একই ভাবে সর্বজনীন দুর্গা পুজো নিয়ে মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালির যে গর্ব সেটিও খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় তারও পেছনে একটি সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি আছে। রাচেল ফেলল ম্যাকডারমট তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন যে বিংশ শতাব্দীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নিরিখে উঠে আসা সর্বজনীন দুর্গা পুজো জাত ও শ্রেণী সচেতনতাকে যতটা জায়গা করে দিয়েছিল, ধর্মের দিক থেকে ততটা হয়ে উঠতে পারিনি। তাই সর্বজনীন পুজো যেমন বিভিন্ন জাত ও শ্রেণীর মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে আসতে পেরেছিল, পুজোর মধ্যে তা সীমাবদ্ধ ছিল হিন্দু ধর্মের মানুষকে কেন্দ্র করেই। বরং বলা যায় যে এই সর্বব্যাপী সর্বজনীন পুজোর রাজনীতি ছিল একটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক পরিচয় গঠনের যার উদ্দেশ্য ছিল সব শ্রেণী ও জাতের মানুষের একীকরণ। সেই কারনেই ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন কীভাবে ধর্মীয় পুজো ও উৎসবকে কেন্দ্র করেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি গড়ে উঠছিল (ম্যাকডারমট ২০১১ ও জয়া চ্যাটার্জি ১৯৯৪)।
সর্বজনীন পূজা যেমন ক্ষমতাবান জমিদার বাড়ির ভেতর থেকে প্রকাশ্যে এনে দুর্গা পুজোকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে এসেছিল, তেমনই ঘর থেকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে পুজোও হয়ে উঠেছিল সেই সময়কার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও পরিচয়ের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দুর্গা পূজো হয়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক একটি প্রতীক এবং মিলে গেছিল হিন্দু বাঙালির সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে। আজও একই ভাবে দুর্গা পুজো হয়ে ওঠে “বাঙালি” (হিন্দু) ও বাঙালিয়ানার প্রতীক। আজ দুর্গা পূজো হয়ে উঠেছে হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং সর্বব্যাপী উৎসব। শিল্প ও নন্দনতত্ত্বের (art & aesthetics) এক নতুন রাজনীতির মাধ্যমে আজ পুজো ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি বিংশ শতাব্দীর সময়কাল থেকে খুব একটা আলাদা নয় যখন পুজো হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতীক। আজ তা-ই হয়ে উঠেছে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালির প্রতীক, যে বাঙালি হিন্দু, মূলত মধ্যবিত্ত বাঙালি। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু বাঙালি পরিচয়ের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে গেছে দুর্গা পুজো।
প্রশ্ন জাগে কোন ধর্মীয় উৎসব “ধর্ম” থেকে শুধু “উৎসব”-এ পরিণত হতে পারে? কোন ধর্মীয় উৎসব সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারে? কোন ধর্মীয় উৎসব ধর্ম থেকে বেরিয়ে একটা সর্বব্যাপী সংস্কৃতিতে পরিণত হতে পারে? এই “ধর্ম” থেকে “উৎসব”-এ পরিণত হওয়া একটা ক্ষমতার কথা বলে। সংখ্যারগুরুর ক্ষমতা। আদিবাসীদের কোনো উৎসব বা মুসলমানদের কোনো উৎসব কি কখনও এই প্রকার সর্বব্যাপী, সর্বজনীন, ধর্ম থেকে বেরিয়ে, ধর্মনিরপেক্ষ জায়গা গঠন করে উঠতে পারবে? এই সর্বব্যাপী সর্বজনীন হয়ে ওঠার রাজনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিরিখেই গড়ে উঠে।
জয়া চ্যাটার্জি (১৯৯৪) তাঁর লেখায় দেখিয়েছিলেন ধর্ম নয়, সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে বাঙালি সাম্প্রদায়িক পরিচয় গঠন হয়েছে। তিনি দেখান সংস্কৃতি কীভাবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হিন্দু পরিচয়ের কেন্দ্রীয় প্রতীক হয়ে ওঠে। আজ দুর্গা পুজো সেই সংস্কৃতির জায়গাটা গ্রহণ করেছে বলা যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীর সর্বজনীন পুজো ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজনীতি থেকে এখনকার সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক উৎসবের রাজনীতি, হিন্দু বাঙালির সাম্প্রদায়িকতাকে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃত তে পরিণত করেছে। ১৯২০ সালকে মাথায় রেখে জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে (১৯৯০) বলেছিলেন, “Nationalism was nothing but communalism driven into secular channels” । আমার মতে বাঙালি (হিন্দু) জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুধুমাত্র হিন্দুর দ্বারা প্রচলিত হওয়ার ফলে হিন্দু কেন্দ্রীক নয়। বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালি পুরুষালি পরিচয়ের পরিপেক্ষিতেও গড়ে ওঠে। তাই জাতীয়তাবাদী ইতিহাস, দুর্গা পুজোর ইতিহাস, ও হিন্দু বাঙালির পরিচয়ের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকবে সাম্প্রদায়িকতা ও পুরুষত্বর এক আশ্চর্য সংযোগ। এই সংযোগকে বাদ দিয়ে বাঙালিয়ানা (হিন্দু) বা বাঙালির ইতিহাস বোঝা সম্ভব নয়।
_______________
সোহিনী সাহা একজন শিক্ষাবিদ।

