আসামে বাংলাভাষী মুসলমানদের উপর বাড়ছে সরকারী মদতপুষ্ট ঘৃণা ও হিংসাত্মক আক্রমণ : ইন্ডিয়া হেট ল্যাব


  • August 16, 2025
  • (0 Comments)
  • 470 Views

আসামে বাংলাভাষী মুসলমানদের “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে ঘৃণা প্রচার চালাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র, হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এবং স্থানীয় অহমিয়া উগ্র-জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি। এই বিষয়ে ইন্ডিয়া হেট ল্যাব (আইএইচএল) -এর একটি প্রতিবেদন (গ্রাউন্ডজিরো দ্বারা বাংলায় অনুবাদিত) আমরা প্রকাশ করছি

 

Groundxero | Aug 16, 2025

 

চলতি বছরের জুন মাস থেকে উত্তর-পূর্বের আসামে বাংলাভাষী সংখ্যালঘু মুসলমান মানুষদের বিরূদ্ধে ধারাবাহিকভাবে চলছে ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ উসকানিমূলক ভাষণ, হেনস্থা, সহিংস আক্রমণ এবং রাষ্ট্র-পোষিত উচ্ছেদ কর্মসূচী। ‘অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী উচ্ছেদ’ প্রচার চালিয়ে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের এক নতুন পর্ব শুরু করেছে আসামের বিজেপি সরকার।

 

আসামের মুখ্যমন্ত্রী ও বরিষ্ঠ বিজেপি নেতা হেমন্ত বিশ্বশর্মা সরকারীভাবে এই প্রচারসূচীতে সিলমোহর দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। গত ২৮ মে মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মা এক সাংবাদিক সম্মেলনে একটি নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেন। সেখানে বলা হয় ‘অরক্ষিত এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল’-এর জনজাতির মানুষদের, বিশেষ করে যাঁরা বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় বাস করেন তাঁদের অস্ত্র রাখার লাইসেন্স দেবে সরকার। তিনি নির্দিষ্টভাবে পাঁচটি মুসলিম অধ্যুষিত জেলার নাম প্রাথমিকভাবে উল্লেখ করেন লাইসেন্স দেবার ক্ষেত্রে। তিনি জানান অস্ত্র রাখার লাইসেন্স দেওয়ার এই উদ্যোগটি নেওয়া হচ্ছে “শত্রু মহল থেকে আসা বেআইনি হুমকি মোকাবেলা করার” জন্য।

 

এরপর ৯ জুন প্রকাশ্য জনসভায় তিনি দাবি করেন “নতুন আগত” মুসলিমরা স্থানীয় হিন্দুদের তাড়ানোর জন্য গরুর মাংস ভক্ষণ এবং আজানকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। গত ২১ জুলাই দারাং-এ রাজ্য সরকারের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাভাষী মুসলমানদের “সন্দেহভাজন বাংলাদেশি” বলে উল্লেখ করেন। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্লোগানগুলিকে নির্বোধ বলে উড়িয়ে দেন এবং দাবি করেন যে মুসলমানদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করা জমি আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পরিস্থিতি হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে কি না এই প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মা ঠান্ডা গলায় উত্তর দেন যে তিনি চান “আসামের পরিস্থিতি বিস্ফোরক হোক”, এবং আরও যোগ করেন যে অসমীয়া জনগণ কেবল তখনই বেঁচে থাকতে পারবে যদি তারা সশস্ত্র থাকেন। এই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে স্থানীয় জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবাদী সংগঠনের প্রধান শৃঙ্খল চালিহা বলেন যে, যদি পুলিশ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার দল উচ্ছেদ কর্মসূচী নিজেদের হাতে তুলে নেবে।

 

বাংলাভাষী মুসলমানদের “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে এই প্রচার একজোট হয়ে চালাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র, হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এবং স্থানীয় অহমিয়া উগ্র-জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি। সমালোচকরা বলছেন এগুলি সবই করা হচ্ছে ‘গির গরু কেলেঙ্কারি’ থেকে চোখ ঘোরানোর জন্য। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হওয়া গরুখুটি বহুমুখী কৃষি প্রকল্প (জিবেকেপি)-এ দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও স্বজনপোষন করার অভিযোগে জড়িত রয়েছে একাধিক বিজেপি নেতারা। এর বিরুদ্ধে সারা রাজ্য জুড়েই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। আসামে আগামী ২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা।

 

৯ জুলাই থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে, ইন্ডিয়া হেট ল্যাব (আইএইচএল) আসামের ১৪টি জেলায় ১৮টি মিছিল ও প্রতিবাদ সভা নথিভুক্ত করে। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতা বা সমর্থকদের দ্বারা সংগঠিত বা সমর্থিত এই অনুষ্ঠানগুলিতে প্রচার করা হয়েছে ঘৃণাভাষণ, উদযাপিত হয়েছে হিংসাত্মক উচ্ছেদ এবং ডাক দেওয়া হয়েছে “অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের” বাড়ি ও ব্যবসাপাতি ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার। অনেক জায়গাতেই, বিক্ষোভকারীরা প্রতীকী বুলডোজার নিয়ে হাজির হয়ে রাষ্ট্রীয় হিংসাকে একটি দেশাত্মবোধক কাজ হিসাবে তুলে ধরেছেন।

 

যোনাই, গোলাঘাট, হাজো, জোরহাটে ‘বাংলাদেশীরা ফিরে যাও’ (বাংলাদেশীস গো ব্যাক) ও ‘মিয়াদের উচ্ছেদ করো’ (এভিক্ট মিয়াস)-র মতো স্লোগান বারবার তোলা হয়েছে। জোরহাটের মারিয়ানি-র বিজেপি সাংসদ রূপজ্যোতি কুর্মি বারবার বাঙালি মুসলমানদের ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। অভিযোগ করেছেন যে তাঁরা আসামের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছেন এবং তাঁরা ‘দশের বেশি মহিলা’কে বিয়ে করে ‘ভৌগলিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি’ বদলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছেন। আসামের ক্যাবিনেট মন্ত্রী জয়ন্ত মাল্লা বড়ুয়া, যার ফার্ম-এর নাম ‘গির গরু কেলেঙ্কারি’তে জড়িত, তিনি যাঁরা উচ্ছেদের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের মুসলিম লীগ-এর সঙ্গে তুলনা করে ঘোষণা করেন উচ্ছেদ জারি থাকবে। তিনি দাবি করেন, সামাজিক মাধ্যমে যাঁরা সক্রিয়ভাবে এর বিরোধিতা করছেন তাঁদের পদবী দেখে চিহ্নিত করা যাবে এবং তাঁদের বাংলাদেশী বলে উল্লেখ করেন। একাধিক জায়গায়, বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি তোলে যে, সাম্প্রতিক উচ্ছেদ কর্মসূচীতে যে মুসলমানদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তাঁদের যেন সংলগ্ন এলাকায় আশ্রয় বা পুনর্বাসন না দেওয়া হয়।

 

এই সমস্ত জমায়েত ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণামূলক বক্তব্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিকারক ভাষার উপর নির্ভরশীল ছিল। বাংলাভাষী মুসলমানদের বারেবারে ‘বাংলাদেশী’, ‘দখলকারী’, ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘মিয়া’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘মিয়া’ শব্দটি অপমানসূচকভাবে ও প্রায়শই গালি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। নির্দিষ্ট লক্ষ্যর গোষ্ঠীর সদস্যদের বিরূদ্ধে গো-মাংস খাওয়াকে ‘হাতিয়ার’ হিসাবে ব্যবহার করা, হিন্দু এলাকাগুলিকে দূষিত করা এবং অহমিয়া পরিচিতিকে ত্রস্ত করার অভিযোগ আনা হয়ে। এই তকমাগুলি ব্যবহার করা হয়েছে হিংসা, বর্জন ও অপসারনকে ন্যায্যতা দেবার জন্য।

 

১৯ জুলাই থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে ইন্ডিয়া হেট ল্যাব হিংসা ও হেনস্থার ৯’টি ঘটনা নথিভুক্ত করে। উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের আশ্রয় দিয়েছেন এই অভিযোগে ছাপাইডাঙায় মুসলমান শ্রমিকদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয় ও তাঁদের ঘরবাড়ি তছনছ করে দেওয়া হয়। কালিয়াবোরে অহমিয়া মুসলমান পরিবাররা তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে থাকতে গেলে জাতিসত্তা-জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী বীর লাচিত সেনা বাধা সৃষ্টি করে। মারিয়ানিতে এই গোষ্ঠীটি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বাংলাভাষী মুসলমানদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে, নির্দেশ দেয় দু’দিনের মধ্যে পুলিশের কাছে নথিপত্র জমা করতে। গোলাঘাটের দেরগাঁওতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন সচেতন যুবা মোর্চা একজন বাড়িওয়ালার উপর চাপ তৈরি করে তাঁর মুসলমান ভাড়াটেকে বের করে দেওয়ার জন্য। তারা দাবি করে তাদের এই ধরনের কর্মসূচি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

 

গত এক মাসে পাঁচটি বড় ধরনের ভাঙন ও উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে, যার ফলে হাজার হাজার বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। শুধু ধুবরিতেই ৮ জুলাই ১৬০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয় আদানি গোষ্ঠীর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য। গোয়ালপাড়ায় ১২ জুলাই ১০০০-এরও বেশি বাড়ি ও মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়, তারপর ১৭ জুলাই যাঁরা এই উচ্ছেদ প্রতিরোধ করছিলেন তাঁদের উপর পুলিস গুলি চালায়, যাতে এক জনের মৃত্যু হয় ও অনেকে আহত হন। ২৬ জুলাই, ডিমা হাসাওতে একটি মসজিদ সহ অনেকগুলি কাঠামো ভেঙে ফেলা হয়, বনভূমি পরিস্কার করার অজুহাতে। ২৯ জুলাই উরিয়ামঘাটে ২৫০-রও বেশি বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়, যার শিকার হন মুসলমানেরা। তাঁরা অভিযোগ করেন যে শুধু তাঁদের সম্প্রদায়কেই টার্গেট করা হচ্ছে।

 

অনেক মিছিল, আক্রমন ও ভাংচুরের ভিডিও হয় সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল বা পরে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও এক্স-এ আপলোড করা হয়েছিল, যা দ্রুত ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং “অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা” জোর করে রাজ্য দখল করে নিচ্ছে এই মিথ্যা ভাষ্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইন্ডিয়া হেট ল্যাব এই রকম অনেকগুলি ভিডিও পর্যালোচনা করে নিশ্চিত হয়ে এই প্রচার কর্মসূচীকে জোরদার করতে ডিজিটাল মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এই মাধ্যমগুলি ঘৃণাভাষণ ও উস্কানিমূলক বিষয় প্রচার করার ক্ষেত্রে নিজেদের ঘোষিত নীতি অনুযাই পদক্ষেপ নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।

 

সুপারিশ

 

  • আসামে বাংলাভাষী মুসলমান সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে চলা সমস্ত উচ্ছেদ ও ভাংচুর রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। উচ্ছেদ হওয়া সকলের জন্য পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যারা ঘৃণা ছড়াতে উস্কানি দিয়েছে ও বক্তৃতা বা কাজের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়েছে সেই সব সরকারী আধিকারিক ও রাজনৈতিক নেতাদের দায়ি করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

  • জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-এর উচিৎ ভাংচুর, ঘৃণাভাষণ ও স্থানচ্যূত হওয়ার সাথে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তথ্যানুসন্ধানের কাজ শুরু করা।

 

  • নির্বাচন কমিশনের উচিত আসামে নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে ঘৃণামূলক বক্তব্যে ও উচ্ছেদ এর রাজনীতিকরণর বিষয়ে তদন্ত করা।

 

  • স্থানীয় প্রশাসনের উচিৎ কার্যকরী পুলিশি সুরক্ষা ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে বীর লাচিত সেনা ও সচেতন যুবা মঞ্চের মতো গোষ্ঠীগুলির থেকে নিরাপত্তা দেওয়া।

 

  • ভারতীয় আদালতগুলির উচিৎ আসামে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য গণহারে উচ্ছেদ ও ঘৃণাভাষণের বিরূদ্ধে স্যুও মোটো কেস গ্রহণ করা।

 

  • বাংলাভাষী মুসলমানদের উচ্ছেদ বা ঘৃণা ভাষণকে প্রচার করছে এমন বিষয়বস্তুকে মেটা, এক্স, ইউ টিউব, টেলিগ্রাম ইত্যাদির উচিৎ তৎক্ষণাৎ সরিয়ে দেওয়া বা জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেওয়া। সামাজিক মাধ্যমগুলির উচিৎ আঞ্চলিক ভাষার বিষয়বস্তু বিশেষত অহমিয়া ও বাংলায় যেগুলি, সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাতে সহিংস, চরমপন্থী বিষয়বস্তু বাছা যায় ও সেগুলিকে সরিয়ে ফেলা যায়।

 

  • সামাজিক মাধ্যমগুলিকে রাষ্ট্রকর্তিক ঘৃণামূলক বিষয়বস্তুর সরাসরি সম্প্রচার চিহ্নিত করে তাকে অবনমন করতে হবে। মাধ্যমগুলির পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত এবং অফলাইন সহিংসতার দিকে পরিচালিত করতে পারে এমন ঘৃণামূলক প্রচারণাগুলিকে চিহ্নিত করে পূর্ব সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত।

 

(এই রিপোর্টি ইন্ডিয়া হেট ল্যাব-এর ‘আর্লি ওয়ার্নিং, আর্লি রেস্পন্স (ইডব্লিউইআর)’ উদ্যোগের অংশ। ইন্ডিয়া হেট ল্যাব সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ অরিজিনাল হেট (সিএসওএইচ)-এর একটি প্রকল্প।)  

 

Share this
Leave a Comment