সময়ের স্রোত অপ্রতিরোধ্য। পুরনো দিনের প্রেক্ষাগৃহের দীর্ঘশ্বাস হয়তো বাতাসে মিশে যাবে, কিন্তু বিনোদনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে মাল্টিপ্লেক্স এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের হাত ধরে।
অঞ্জুশ্রী দে
Groundxero | July 16, 2025
সেদিন নিউ মার্কেটের কেক পট্টির গেট দিয়ে বেরিয়ে সোজা তাকাতেই চোখে পড়ল বিবর্ণ এক সবুজ ত্রিপল। অনেকটা ক্রিকেট মাঠের জায়েন্ট স্ক্রিনের মতো করে টাঙানো। মুহূর্তেই বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। এই তো সেদিনও এখানে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল “এলিট”। কত প্রজন্মের হাসি-কান্না, কত না-বলা গল্পের নীরব সাক্ষী এই প্রেক্ষাগৃহ। আজকের ভগ্নদশা ও নীরব ধ্বংসলীলা স্মৃতির পাতায় এক বিষণ্ণ ছবি এঁকে দেয়। ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে এই ছবি দেখছি, তার সামান্য বাম দিকে, কর্পোরেশন বিল্ডিং-এর ঠিক উল্টো কোণে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল একসময়ের “মিনার্ভা” সিনেমা হল। ১৯০৭ সালে এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেস হিসেবে যার পথচলা শুরু। এখানে মূলত হলিউডের ছবিই দেখানো হত— বিশেষ করে চার্লি চ্যাপলিনের ছবি। “দ্য গোল্ড রাশ”, “সিটি লাইটস”, “মডার্ন টাইমস”-এর মতো বিখ্যাত সব ছবি, মিনার্ভার পর্দায় বহু দর্শককে মুগ্ধ করেছে। চার্লি চ্যাপলিনের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ১৯৮০-এর দশকে কলকাতা কর্পোরেশন মিনার্ভা সিনেমার নাম পরিবর্তন করে “চ্যাপলিন” করেছিল। কালের স্রোতে তাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও শেষ রক্ষা হয়নি। অথচ এই প্রেক্ষাগৃহ কত তারুণ্যের প্রথম প্রেম আর কত স্বপ্নিল চোখের আনাগোনার নীরব সাক্ষী। কালের অমোঘ নিয়মে, আজ সেখানে এক ব্যস্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্র, যেখানে অতীতের সেই রঙিন মুহূর্তগুলো নীরবে কাঁদে।
স্মৃতির পাতায় আরও একটি উজ্জ্বল নাম ভেসে ওঠে— “জ্যোতি”। লেনিন সরণীর এই প্রেক্ষাগৃহে, রমেশ সিপ্পির সুপার ডুপার হিট ছবি “শোলে” চলেছিল একশো সপ্তাহেরও বেশি। একবার ভাবুন তো, একটি সিনেমা টানা এত দিন ধরে চলছিল একই হলে! সেই সময়ের মানুষের উন্মাদনা, টিকিটের জন্য লম্বা লাইন, প্রেক্ষাগৃহের ভেতরের দর্শকদের চিৎকার— আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। সেই “জ্যোতি”-ও আজ বন্ধ। লেনিন সরণী ধরে একটু এগোলেই “মেট্রো” সিনেমা। অবশিষ্ট বলতে তার নামফলক টুকুই। আজও যেন পুরনো দিনের সেই মায়াবী সুর, সেই নস্টালজিয়া ক্ষীণভাবে ভেসে আসে। টিমটিম করে জ্বলতে থাকা “সোসাইটি”। নিজাম হোটেলের ডান দিকে তাকালে কেবলই শূন্যতা, যেন এক দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে এই শহরের বাতাসে। এই হলগুলি শুধু ইটের গাঁথুনি ছিল না, ছিল সময়ের জীবন্ত সাক্ষী, বহু মানুষের আবেগ আর স্মৃতির ধারক।
গ্র্যান্ড হোটেলের পাশ দিয়ে যখন কয়েক পা এগোই, স্মৃতিতে ভেসে ওঠে “টাইগার” সিনেমার সেই গমগমে পরিবেশ। যেখানে পর্দা কাঁপানো অ্যাকশন আর রোমান্সের ঢেউ দর্শকদের মনে দোলা দিত। আজ সেখানে থরে থরে সাজানো আধুনিক পোশাক, কালের কী নির্মম পরিহাস! এই স্মৃতিচারণের সঙ্গে যেন মিশে আছে কলকাতার ইংরেজি সিনেমার জন্য বিখ্যাত হলগুলি। তাদের মধ্যে অন্যতম “যমুনা”, “গ্লোব”, “লাইট হাউস” ও “নিউ এম্পায়ার”। কত বিদেশি ছবির উন্মাদনা জাগিয়ে তুলত এই প্রেক্ষাগৃহগুলি! কলকাতার “লাইট হাউস”-এই মুক্তি পেয়েছিল হলিউডের মহাকাব্যিক ছবি “বেন-হার”। ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রেক্ষাগৃহটি বহু বছর ধরে হলিউডের সেরা ছবিগুলি দেখানোর জন্য পরিচিত ছিল। ১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চার্লটন হেস্টন অভিনীত “বেন-হার” সেই সময়ের এক বিশাল সিনেমাটিক ইভেন্ট ছিল। এর বিশাল প্রেক্ষাপট, রোমাঞ্চকর রথের দৌড়ের দৃশ্য এবং শক্তিশালী অভিনয় বিশ্বজুড়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। “লাইট হাউস”-এর বিশাল পর্দায় এই ছবি দেখার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে কলকাতার দর্শকদের জন্য এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ছিল। আজ সেই “লাইট হাউস”শপিং কমপ্লেক্সে রূপান্তরিত হয়েছে, যা কলকাতার বিনোদন জগতের পরিবর্তনের এক নীরব সাক্ষী। কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া কিছু স্মৃতিচিহ্ন মাত্র।
এই প্রসঙ্গে কলকাতার এক সময়ের ‘সিনেমা পাড়া’ হাতিবাগানের কথা না বললেই নয়। সেখানে একসময় অসংখ্য সিনেমা হল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। বিধান সরণীতে আজও সগর্বে দাঁড়িয়ে “মিনার” সিনেমা, পুরনো সিঙ্গল স্ক্রিনের এক জনপ্রিয় ঠিকানা। তবে কালের স্রোতে বন্ধ হয়ে গিয়েছে “মিত্রা” সিনেমা, যেখানে উত্তম কুমারের প্রথম ছবি “দেনা পাওনা” মুক্তি পেয়েছিল। হাতিবাগানের কাছেই “রূপবাণী” একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল, যা ১৯৩১ সালে “ক্রাউন” সিনেমা নামে চালু হয়েছিল এবং পরে “রূপবাণী” নামে পরিচিত হয়। এটি উত্তর কলকাতার প্রথম দিককার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলগুলির মধ্যে অন্যতম। আজ এক বস্ত্র বিপণিরূপে দাঁড়িয়ে। “শ্রী”, “উত্তরা”, “রাধা”, “দর্পণা”, “পূর্ণশ্রী”, “বিধুশ্রী”, “সুরশ্রী”, “টকিশো হাউস”-এর মতো আরও কত হল কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হাতিবাগানের সেই গমগমে সিনেমাপ্রেমীদের ভিড় আজ কেবল স্মৃতি।
উত্তর কলকাতার আরেক প্রান্ত, শিয়ালদহ অঞ্চলের দিকে তাকালে আরও একটি নাম উঠে আসে, যা কালের নিয়মে আজ ভিন্ন রূপে। মিত্র ইনস্টিটিউশনের উল্টোদিকে একসময় সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল “পূরবী” সিনেমা। এই প্রেক্ষাগৃহও কলকাতার বহু মানুষের কাছে ছিল বিনোদনের এক পরিচিত ঠিকানা। কত বিকেল, কত সন্ধ্যায় মানুষ এখানে জড়ো হয়েছে সিনেমার জাদুতে মুগ্ধ হতে। কিন্তু সময়ের চাকা থেমে থাকে না। আজ সেই “পূরবী” সিনেমার স্থানে তৈরি হচ্ছে আধুনিক মল, যা শহরের পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার এক স্পষ্ট প্রতীক। এটি শুধুমাত্র একটি প্রেক্ষাগৃহের বিলুপ্তি নয়, বরং একটি যুগের সমাপ্তি, যেখানে পুরনো স্মৃতির উপরে গড়ে উঠছে নতুন বাণিজ্যিক কেন্দ্র।
লেক টাউনের দিকে পা বাড়ালেই আরও একরাশ স্মৃতি ভিড় করে আসে। একসময় যেখানে সগর্বে দাঁড়িয়ে ছিল “জয়া” এবং “মিনি জয়া” সিনেমা হল, আজ সেখানে শুধুই ফাঁকা মাঠ। ছোটবেলায় বাবা আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে কতবার গিয়েছেন সেখানে সিনেমা দেখতে! সেইসব দিনে সিনেমা দেখাটা যেন একটা উৎসব ছিল, এক পারিবারিক আনন্দের মুহূর্ত। সেই হলগুলো ভেঙে আজ মাঠ হয়ে গেছে। হয়তো অচিরেই সেখানে মাথা উঁচু করে উঠবে কোনও শপিং মল বা হাই-রাইজ বিল্ডিং। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বুকের ভেতরটা আজও কেমন ‘ছ্যাৎ’ করে ওঠে। এই পরিবর্তনে একটা ব্যক্তিগত আক্ষেপও যেন মিশে আছে – বাবার সঙ্গে সিনেমা দেখার সেইসব স্মৃতি আজও অমলিন, কিন্তু আজ আমার নিজের মেয়েকে নিয়ে ঐতিহ্যবাহী কোনও সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সুযোগ আর নেই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সিনেমা দেখার এই অভিজ্ঞতার পরিবর্তন যেন এক নীরব বেদনার জন্ম দেয়।
অন্যদিকে, গ্রামীণ প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। অজপাড়াগাঁয়ে সিনেমা হল তেমন একটা দেখা না গেলেও, মফস্বল বা ছোট শহরগুলিতে একসময় কিছু সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল গ্রামীণ মানুষের বিনোদনের – কেন্দ্র ছিল। সেই হলগুলি হয়তো আজও কিছু প্রবীণের স্মৃতিতে অমলিন।
তবে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে বিনোদনের অন্য মাধ্যম ছিল – বিভিন্ন মেলায় পুরনো প্রজেক্টরের মাধ্যমে কাপড় টাঙিয়ে ছবি দেখানো হতো। সেই সাদামাটা প্রদর্শনী আজকের মাল্টিপ্লেক্সের জৌলুস থেকে অনেক দূরে হলেও, সেই সময়ের মানুষের কাছে সেটাই ছিল সিনেমার জগৎ। তাদের মিলনক্ষেত্রও বটে। যেখানে মানুষ একসাথে হাসত, কাঁদত এবং নিজেদের জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেত।
বিশ্বজুড়ে আজ একক পর্দার প্রেক্ষাগৃহগুলি বিলুপ্তির পথে, তাদের জীর্ণ কাঠামো ভেঙে গড়ে উঠছে ঝকঝকে মাল্টিপ্লেক্সের আধুনিক জগত, যেখানে একাধিক পর্দা আর উন্নত প্রযুক্তির হাতছানি। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, বিশেষ করে ভিডিও ক্যামেরার সহজলভ্যতা কেড়ে নিয়েছে সেলুলয়েডের সেই রূপালী পর্দার মায়াবী আকর্ষণ। ‘সিনেমাওয়ালা’র গল্প ঠিক এই পরিবর্তনের এক নীরব ভাষ্য। ছোট্ট এক শহরের সিনেমা প্রদর্শক প্রণবেন্দু দাসের জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত এই কাহিনি, যেখানে ডিজিটাল প্রযুক্তির দাপটে তার বাবার স্মৃতিবিজড়িত সেলুলয়েড প্রজেকশনের প্রেক্ষাগৃহ ‘কমলিনী’ ধুঁকছে। প্রণবেন্দুর মরিয়া চেষ্টা— কালের স্রোতের বিপরীতে পুরনো ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার এক অসম সংগ্রাম। ‘কমলিনী’ আজ প্রায় অচল, তার পুরনো প্রজেক্টরের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ আধুনিক ডিজিটাল থিয়েটারের কাছে বড়ই বেমানান। অসহায় ‘কমলিনী’র প্রজেক্টর বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়, আর বৃদ্ধ প্রজেকশনিস্ট হরির সেই যন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা যেন এক করুণ চিত্রকল্প। প্রজেক্টরের বিচ্ছেদের শোক সহ্য করতে না পেরে হরির আত্মহত্যা যেন একটি যুগের শেষ কান্না, একটি ঐতিহ্যের করুণ সমাপ্তি। এই প্রেক্ষাপট শুধু একটি ব্যক্তিগত লড়াই নয়, এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র, যেখানে দ্রুত প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে তাল মেলাতে না পেরে বহু ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে।
সিনেমা হলগুলি একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের উপর নেমে এসেছে এক গভীর সংকট। টিকিট বিক্রি ও হলের খাদ্য-পানীয়ের ব্যবসায় ধস নামায় স্থানীয় অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল শূন্যতা। সিনেমা হলকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করা ছোট ব্যবসায়ীরা আজ দিশাহীন, বহু মানুষ হারিয়েছেন তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ। টিকিট কাউন্টারের কর্মী থেকে শুরু করে সিনেমা প্রজেক্টরের অপারেটর পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ আজ কর্মহীন, তাদের পরিবার আর্থিক কষ্টের সম্মুখীন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতির উপরও। এই শিল্পে নতুন করে কাজের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে, ফলে বহু দক্ষ কর্মী আজ তাদের পেশাগত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারছেন না। অন্যদিকে, চলচ্চিত্র বিতরণ ও প্রদর্শন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ায় বিনোদন শিল্পের ভবিষ্যৎ আজ প্রশ্নের মুখে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থাগুলিতে। সরকারও হারাচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব। এই ক্ষতি কেবল আর্থিক নয়, সিনেমা হলগুলি ছিল একটি শহরের সামাজিক মেলবন্ধনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান, সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র। সেই সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া নাগরিক জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি।
তবে সময়ের স্রোত অপ্রতিরোধ্য। পুরনো দিনের প্রেক্ষাগৃহের দীর্ঘশ্বাস হয়তো বাতাসে মিশে যাবে, কিন্তু বিনোদনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে মাল্টিপ্লেক্স এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের হাত ধরে। হয়তো নস্টালজিয়া থাকবে, পুরনো দিনের সেই সম্মিলিত সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার অভাব অনুভূত হবে, কিন্তু প্রযুক্তির হাতছানিকে উপেক্ষা করা কঠিন। এই পরিবর্তন হয়তো অনিবার্য, যেখানে ব্যক্তিগত বিনোদন সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার স্থান নিচ্ছে, এক নতুন যুগের সূচনা করছে।
লেখক প্রাবন্ধিক ও শিক্ষিকা ( মিত্র ইনস্টিটিউশন, মেন, কোলকাতা )
ছবি: বিজয় চৌধুরী






