‘সন্ধ্যা সুরির সন্তোষ রাষ্ট্রের পক্ষে একটি বিপজ্জনক সিনেমা; তাই তা ভারত রাষ্ট্রে নিষিদ্ধ!’
দেবারতি গুপ্ত
Groundxero | June 25, 2025
সন্ধ্যা সুরির ‘সন্তোষ’ ছবিটি গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবের আন সার্টেন রিগার্ডস বিভাগে দেখানো হয়। যে বছর পায়েল কাপাডিয়ার ‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাস লাইট’ মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে অংশগ্রহণ করে গ্রাঁ প্রি জয়ী হয় সেই বছর, অর্থাৎ ২০২৪। বছরটা অবশ্যই পায়েলের ছিল, কিন্তু বছরটা সন্ধ্যার এবং সন্তোষেরও ছিল। সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এভাবে বলার কারণ একটাই, তা হল ভারতীয় সেন্সর বোর্ডের কল্যাণে সমকাল তার যাবতীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়েছে সন্ধ্যার ছবিটি যাতে এদেশের মানসপটে বিন্দু মাত্র জায়গা না পায়। কাজেই ভুলে যাওয়া তো পরের কথা, যে তথ্য কোনদিন স্মৃতিতে জায়গাই পেল না তাকে আর বিস্মৃতিতে পাঠানোরও কোন ঝক্কি নেই। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মিলান কুন্দেরার সেই অমোঘ কথাটি মনে পড়ে যায়, পৃথিবীর ইতিহাসে ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই হল বিস্মরণের বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই। তাই দায়িত্বশীল সিনে-দর্শকদের উচিত এ ধরণের ছবিকে আলোচনায় ফিরিয়ে আনা।
সাহানা গোস্বামী অভিনীত সন্তোষের পুলিশ কনস্টেবল স্বামীর মৃত্যু হয় হিন্দু-মুসলিম বিবাদের জেরে। শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সইবে না বলে স্বামীর চাকরিতে বহাল হয় সন্তোষ। সম্বলহীন বিধবা যে সহানুভূতি খাতে স্বামীর চাকরি পায় সেরকম। শুরুতেই যে কেসের সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ে তা একটি দলিত মেয়ের মৃত্যু। সেই মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল উত্তর ভারতের কাল্পনিক কোন গ্রাম চিরাগ প্রদেশের কুয়োর জলে। মেয়েটিকে বলাৎকার করে তারপর খুন করা হয়। সন্দেহ যায় একটি মুসলিম ছেলের ওপর যার সঙ্গে সম্ভবত মেয়েটির সম্পর্ক ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই কেসটির দায়িত্ব পায় সন্তোষের সিনিয়র গীতা শর্মা। যে চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন সুনীতা রাজোয়ার। অথবা কিছুই অভিনয় করেন নি। সুনীতাকে দেখে মনে হয়ছে ওরকম এক বর্ষীয়ান মহিলা পুলিশ বাস্তবেই প্রত্যক্ষ করছি।
এ আর কি নতুন কথা যে নারী দেহে লুকনো পুরুষতন্ত্র হল সবচেয়ে দুর্গম আর দুরূহ। ভারত তথা যে কোন দেশের পুলিশতন্ত্র ঠিক সেনাবাহিনীর মতোই পিতৃবাদকে রাষ্ট্রের সীলমোহর দিয়ে মান্যতা দেয়। সুনীতা অভিনীত গীতা শর্মা এক ক্ষমতালিপ্সু নারী – যে পুলিশি ক্ষমতার পুরুষতান্ত্রিক চরিত্রে থিতু হয়ে বসেছে। আর সন্তোষ গীতার শিক্ষানবিশ হিসেবে সেই ছাঁচে নিজেকে ঢালতে তৎপর, কিন্তু তার বিস্ফারিত চোখের চাওয়ায় এখনো দুর্নীতি দেখলে বিস্ময়! আর সেখানেই সমস্যা।
আনকোড়া কিন্তু চটপট শিখে নিতে চাওয়া কর্মনিষ্ঠ সন্তোষকে গীতার বেশ ভাল লেগে যায়। দলিত মেয়েটির হত্যার দায় যে মুসলিম ছেলেটির ওপর গিয়ে পড়ে তাকে খুঁজে বের করার ভার দেওয়া হয় সন্তোষের ওপর। মেন্টর গীতা শর্মার কথা অনুযায়ী যে ছেলে এরকম ঘৃণ্য কাজ করেছে তাকে কঠিনতম শাস্তি দিয়ে নজির তৈরি করা উচিত, যাতে ভারতের কোন পুরুষ আর কোন নারীকে শুধুমাত্র যৌন কামনার বস্তু হিসেবে দেখার সাহস না পায়। এতো খুব উচিত কথা। প্রতি মুহূর্তে হয় শারীরিক অথবা মানসিকভাবে যৌন হেনস্থা আর নিজের লিঙ্গ পরিচিতির জন্যে নিত্য কুমন্তব্য – এসব যাদের রোজের গা সওয়া হয়েও হয় নি, যাদের অন্যায়ের বিরূদ্ধে বহুদিন ধরে রাগ চাপা আছে, তাদের স্বাভাবিক ভাবেই দীপার এই কথাগুলো সমর্থনযোগ্য মনে হবে। অপরাধীর শাস্তি হোক এই দাবী মানবিক, কিন্তু কেমন শাস্তি দেওয়া জরুরি তা আলোচনা সাপেক্ষ – এবং মৃত্যুদণ্ড যে অপরাধ কমাতে কোন কাজে আসে না; তা নিয়ে দেশে বিদেশে অনেক আলোচনা আছে। তবে নিরপরাধের শাস্তি যেন না হয় – এই বার্তা সভ্যতার সেই প্রথম সকালের। কিন্তু ন্যায় বিচারের এই ন্যূনতম দাবী রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের খুব বেশি গরজ দেখা যায় না। ক্ষমতার অঙ্গুলি হেলনে রাষ্ট্র হামেশাই নিজের সুবিধে অনুযায়ী অপরাধী নির্ধারণ করে শাস্তি দিয়ে দেয়। লিঙ্গ রাজনীতির লেন্স দিয়ে সন্ধ্যা সুরি ক্ষমতা আর অক্ষমতার নানান স্তরে বহুধা বিভক্ত ভারতীয় সমাজের আনাচ কানাচ দেখিয়েছেন। তদন্তকারী পুলিশ কনস্টেবল সন্তোষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আর সাহানার বিস্মিত চোখের পরিমিত অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছে দর্শকের আতসকাচ। এরকমই আরো দুটি আতসকাচের স্মৃতি উস্কে দেয় সন্তোষ – গোবিন্দ নিহালানির অর্ধ সত্য, মনে পড়ে যায় ইভান এয়ারের সোনি।
সন্তোষ তদন্ত করতে গিয়ে নিহত মেয়েটির ফোনে সেলিম বলে একটি ছেলের নম্বর পায়। যার নম্বর থেকে বেশ কয়েকবার ফোন এসেছে। মেয়েটির বাড়ির লোক বলে এরকম কোন ছেলেকে তারা চেনে না। কারণ কোন মুসলমানকে তারা চেনে না। সন্তোষের মাথায় গোয়েন্দাগিরি চেপে বসে। সেলিমের এলাকায় গিয়ে জানতে পারে ছেলে এখন মীরাটে। সন্তোষ সদ্য শেখা পুলিশি আদবে সেলিমের বন্ধু বান্ধবকে ঠান্ডা গলায় হুমকি দিয়ে আসে।
তদন্ত সূত্রে সন্তোষ মীরাট যায় এবং একটি সরাইখানায় কর্মরত সেলিমকে খুঁজে বের করে। এরপর গীতা ম্যাডামের সাহায্যে ছেলেটিকে পাকড়াও করার পর ইন্টারোগেশনে বেধরক পিটিয়ে জিগ্যেস করা হয় কেন সে এই ঘৃণ্য অপরাধ করেছে? সেলিম ভয়ানক মারের মুখেও যখন সমানে বলে চলে যে সে কিছু করে নি, গীতা তখন ক্লান্ত হয়ে সন্তোষকে বলে অপরাধীকে মারতে। সন্তোষের স্বামীর মৃত্যু হয়েছে এক মুসলমানের হাতে। ওর সামনে পড়ে রয়েছে একটি মুসলমান ছেলে যার অপরাধ কবুল করাতে পারলেই কেল্লা ফতে! হিন্দি ছবির চেনা ছকে এবার মুসলিম বিরোধী আবেগ উস্কে দেওয়ার প্রবল সুযোগ। মূলধারার দর্শকের প্রতিনিধি স্বরূপ সন্তোষকে দিয়ে স্বামী হত্যার বদলা নেওয়াতে পারলে একদম খুন ভরি মাঙ্গ হয়ে যেত। কিন্তু সন্ধ্যা সেই পথের উলটো দিকে দাঁড়িয়েছেন।
সেলিমকে মারার আগে সন্তোষ রূপী সাহানার চোখে এক অদ্ভুত চেনা তবু চেনা নয় গোছের অভিব্যক্তি দেখতে পাই আমরা। চেনা কারণ এধরণের ধর্ম সংকটে আমাদের নিত্য পড়তে হয়, তাই হয়তো শুরুর দিকে আমাদেরও মুখে এই অভিব্যক্তি দেখা দিত। আর চেনা নয় কারণ নিজেদের সেই মুখগুলো আমরা কোনদিন আয়নায় দেখে উঠতে পারি নি। দেখতে পেলে হয়তো নিজেদের জীবনেও সন্তোষের মতো উপসংহার লিখতাম অনেকেই। সে যা হোক, গীতার কথায় দ্বিধা নিয়েই সন্তোষ তার সদ্য শেখা পুলিশি হিংসা প্রয়োগ করে সেলিমের ওপর।
সেলিম এনকাউন্টারে মারা যায়। সন্তোষ আরো বিস্ফারিত চোখে দেখে সে তার সহকর্মীদের কাছে হিরো হয়ে উঠেছে। আর ঠিক এই সময় তার সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হয় – সেলিম আসলে অপরাধী নয়। আর সে কথা গীতাও জানতো! এই প্রথম সন্তোষ গীতা ম্যাডামের কাছে কৈফিয়ত চায়। সেলিম কি বলতে চাইছিল সেই বয়ান তো আমরা শুনিই নি, তার বদলে ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছি। গীতা তখন সন্তোষকে এক দারুণ কথা বলে – ভারতে দু প্রকারের অস্পৃষ্যতা আছে। এক ধরণ যাদের লোকে ছুঁতে চায় না। আরেক ধরণ যাদের লোকে ছুঁতে পারে না। সেলিম অপরাধী কি নিরপরাধ সেটা বড়ো কথা নয় – ‘হামনে দুনিয়া কি নজর মে তো ইনসাফ কর হি দিয়া না?’
এই অমোঘ বাক্যটির পাল্টা অভিব্যক্তি স্বরূপ সন্ধ্যা তার প্রটাগনিস্টের মুখে কোন ভারী সংলাপ বসান নি। বরং ক্যামেরা ঘুরিয়ে দিয়েছেন এনকাউন্টার রুমের খোলা জানলার দিকে। যেদিকে কোন পুলিশ নেই, অপরাধীও নেই। এবড়ো খেবড়ো দেয়াল পেরিয়ে এক আয়তক্ষেত্র জানলা যেটার কোন পাল্লা বা গ্রিল কিছুই নেই। জানলার এপারে ঘরের মধ্যে টিমটিমে টিউবলাইট আর ওপারে অন্ধকারে কিছু গাছপালা দাঁড়িয়ে। সঙ্গে রয়েছে পুলিশের মারের শব্দ আর তারপরেই সেলিমের গোঙানির আওয়াজ।
রাষ্ট্র আর তার সহযোগী বন্ধু প্রশাসন – এই দুয়ে মিলে নিজেদের সুবিধে মতো যে বয়ান তৈরি করেছে তার পক্ষে জনমত তৈরির জন্যে এ এক মহৎ কাজ। ‘দুনিয়া কি নজরোমে ইনসাফ’ এর নামে যে বিপুল বেইনসাফি চলে আসছে তাকেই দেশপ্রেম নাম দেওয়া হয়ে থাকে। এই বয়ানের পক্ষে কাশ্মীর ফাইলস থেকে কেরালা স্টোরিস বানিয়ে আসমুদ্র হিমাচলকে মাতিয়ে রাখেন যেসব ফিল্মের পরিচালক তারা দেশভক্ত। সন্ধ্যা সুরির নায়িকা সন্তোষ এই জনপ্রিয় বয়ানের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করছে। গীতা শর্মার ইনসাফের ভঙ্গি সন্তোষ মেনে নিতে পারে না। এর চেয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে বাপ-মায়ের গলগ্রহ হয়ে থাকা শ্রেয় বলে মনে হয়। এই কঠিন বিকল্পের সামনে পুলিশি ইনসাফের কারবার সন্তোষের কাছে কঠিনতর। তবে আমলাতন্ত্রের কদর্য জটিলতার চেয়ে সামন্ততন্ত্রের যন্ত্রণা তাঁর কাছে তুলনায় পরিচিত। সন্তোষ চেনা যন্ত্রণাকে বেছে নেয়।
এহেন ছবি ভারত রাষ্ট্রের পছন্দ হবার কথা নয়। তাই সন্তোষ ছবিটি সেন্সরবোর্ডের কুনজরে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এই ছবি ভারতের দর্শককে দেখতে দিলে বিপদ আছে। তবে ছবিটি যে আমরা হলে গিয়ে বা বাড়ি বসেও দেখতে পেলাম না – এটা ভুলতে দেওয়া যায় না। কারণ এই বিস্মৃতির বিরুদ্ধে আমাদের স্মৃতির লড়াইটাই মানব সভ্যতার ইতিহাসকে টিঁকিয়ে রাখতে পারে। তাই রাষ্ট্রের তৈরি বয়ানের বিপরীতে যারা দাঁড়াতে কুন্ঠা করেন না, তাদের প্রত্যেকের চেতনায় আর স্মৃতিতে যেন এই খবরটি জায়গা করে নেয় – ‘সন্ধ্যা সুরির সন্তোষ রাষ্ট্রের পক্ষে একটি বিপজ্জনক সিনেমা; তাই তা ভারত রাষ্ট্রে নিষিদ্ধ!’
________________
দেবারতি গুপ্ত ফিল্মমেকার, প্রাবন্ধিক ও গ্যেস্ট লেকচারার।
পড়ুন: গার্লস উইল বি গার্লস – ছবিটি দেখার অভিজ্ঞতা সঙ্গে আরো কিছু
We really need to watch this kind of film.