যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চে যে শিক্ষকেরা আমরণ অনশনে শামিল হয়েছেন, তাতে ১৭ জুন যোগ দিয়েছেন দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ সাহা। দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষকদের অধিকারের দাবি নিয়ে পথে নামল পশ্চিমবঙ্গের ব্লাইন্ড পার্সন্স অ্যাসোসিয়েশন।
Groundxero | June 18, 2025
২০১৬ সালের এসএসসি প্যানেল বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট দুর্নীতির কারণে। চাকরি হারিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী। যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ ও অশিক্ষক কর্মীদের মঞ্চ তৈরি করে চলছে লাগাতার আন্দোলন, যাতে নতুন করে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা না হয় ও যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে যাতে তাঁদের পুনর্বহাল করা হয়।
এই যোগ্য শিক্ষকদের তালিকায় রয়েছেন প্রতিবন্ধী শিক্ষকেরাও। তাঁরাও এই অধিকার মঞ্চে শামিল হয়ে নিজেদের দাবি তুলে ধরছেন। সারা রাজ্যের ৪০০ একটু বেশি সংখ্যক প্রতিবন্ধী শিক্ষক এক প্যানেল বাতিল হওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন। প্রতিবন্ধী শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষকেরাও। সারা রাজ্যের প্রায় ১০৪ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রয়েছেন যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষকদের তালিকায়। যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চে যে শিক্ষকেরা আমরণ অনশনে শামিল হয়েছেন, তাতে ১৭ জুন যোগ দিয়েছেন দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ সাহা। এবার দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষকদের অধিকারের দাবি নিয়ে পথে নামল পশ্চিমবঙ্গের ব্লাইন্ড পার্সন্স অ্যাসোসিয়েশন। গত ১৬ জুন কলকাতার হাজরা মোড়ে তারা এক পথসভার আয়োজন করে। সেখানে সংগঠনের সদস্যরা, দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষক, পড়ুয়ারা অংশগ্রহণ করে চাকরিহারা দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষকদের সংহতি জানান।
মূলত যে দু’টি দাবি এদিনের সভায় উঠে আসে তা হল –
১) দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী সহ সমস্ত যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের স্বপদে সসম্মানে পুনর্বহাল
২) আসন্ন স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় দৃষ্টিহীন পরীক্ষার্থীদের জন্য যুক্তিসঙ্গত অনুলেখক ঘোষণা
এদিনের সভায় বারেবারেই উঠে আসে যে এই প্যানেল বাতিল হল মূলত যে কারণে এসএসসি দুর্নীতিতে যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের তালিকা রাজ্য সরকারের তরফে প্রকাশ না করা, তা আসলে ২০২০ সালের কেন্দ্রীয় শিক্ষা নীতি ও ২০২৩ সালের রাজ্য শিক্ষানীতিকে বাস্তবায়নের দিকেই একটি পদক্ষেপ। আন্দোলনকারীরা আশাবাদী যে, স্ঠিক আইনজীবীর সহযোগিতায় দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষকেরা ন্যায় পাবেন। তাঁরা আরো জানান, যে ঘুষ দিয়ে চাকরির অভিযোগ উঠছে, তা দৃষ্টি-প্রতিন্ধী সহ অন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মুখ্যত যে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি থেকে পড়াশোনা করে চাকরির পরীক্ষা দেন, তাতে সম্ভব নয়।
ব্লাইন্ড পার্সনস অ্যাাসোসিয়েশন-এর সম্পাদক সৈকতকুমার কর জানান যেহেতু রিভিউ পিটিশন-এর সুযোগ এখনো রয়েছে তাই তাঁরা আশাবাদী যে যোগ্য শিক্ষকেরা অবশ্যই ন্যায় পাবেন। তিনি জানান যে তাঁরা যে রিভিউ পিটিশন করতে যাচ্ছেন তা যেন অন্তত তিন জন বিচারকের ডিভিশিন বেঞ্চে যায় সেই আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁরা এগোচ্ছেন। “দৃষ্টিহীন চাকরিহারা শিক্ষকদের পক্ষে এমন কিছু যুক্তি রয়েছে, যা যদি সঠিকভাবে তুলে ধরা যায়, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্যই তাঁদের পক্ষে ন্যায়পূর্ণ রায় দেবেন এমন আশা আমাদের রয়েছে,” জানান তিনি। তাঁদের হয়ে লড়ছেন সিনিয়র আইনজীবী প্রতীক ধর, যাঁর মতে দৃষ্টিহীন চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকেরা আলাদা করে একটি রিভিউ করুন এবং তা সুপ্রিম কোর্টের কাছে গেলে সুফল পাওয়া যাবে। সুফল পাওয়া অর্থে তাঁরা মনে করছেন, নতুন করে তাঁদের আর পরীক্ষায় বসতে হবে না, পুরনো চাকরিতেই পুনর্বহাল।
সৈকত কর জানান যে আইনি ভাষায় ‘টেইন্টেড’ প্রার্থীদের সামনে রেখে যে দুর্নীতি করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, ওএমআর শিট নষ্ট করা, র্যাঙ্ক জাম্পিং, সুপার নিওমারারি পোস্ট সৃষ্টি করা। তাঁর দাবি, এক্ষেত্রে দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী প্রার্থীরা যে ১% কোটায় চাকরি পেয়েছেন সেখানে কোথাও এই ঘটনা ঘটেছে বলে প্রমাণিত হয়নি। একজন দৃষ্টিহ-প্রতিবন্ধী শিক্ষকের নামও এই ‘টেইন্টেড’ তালিকায় নেই। তিনি জানান, “এমনও বেশ কিছু সাবজেক্ট আছে, যে সাবজেক্ট-এ যতজন দৃষ্টিহীন শিক্ষক চাওয়া হয়েছে, টোটাল দৃষ্টিহীন শিক্ষকের সংখ্যাই তত ছিল না। যত সিট ছিল সব সিট ফুলফিল-ই হয়নি। ফলে এখানে র্যাঙ্ক জাম্পিং-এর ঘটনা তো ঘটতেই পারে না। সেইজন্যই আমরা দাবি করছি, দৃষ্টিহীন শিক্ষকেরা সকলেই ‘আনটেইন্টেড’।”
তিনি জানালেন নতুন করে পরীক্ষা হলে কী সমস্যা হতে পারে। “২০১৬ সালে রস্টারের যে নিয়ম মেনে চাকরিতে নিয়োগ করা হত সেই রস্টার-এর নিয়ম বদলে গেছে। ফলে সেই সময়ে যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁরা অনেকেই বঞ্চিত হবেন। তাই আমরা বলছি, তাঁদের নতুন পরীক্ষায় বসা বা তাঁদের বসতে বাধ্য করা উচিৎ নয়। তাছাড়া তাঁদের যেহেতু শ্রুতিলেখকদের নিয়ে পরীক্ষায় বসতে হয় তাই তাঁদের বিষয়টি স্বতন্ত্র,” জানালেন তিনি।
দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলন মূল আন্দোলনেরই অনুবর্তী বলে এদিন উদ্যোক্তারা জানান। তবে কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় কেবল তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলেই আলাদা করে তাঁদের দাবি সামনে আনতে হচ্ছে। যেমন, রাজ্য সরকারের তরফে যেমনটি বলা হচ্ছে, তাঁদের কাছে বিকল্প কোনো কাজে নিয়োগ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। “এই যে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন আপনারা শিক্ষা দপ্তরে ঢুকতে না পারলে অন্য কোনো দপ্তরে কাজ করবেন। কোনো দৃষ্টিহীন ব্যক্তিকে যেকোনো দপ্তরে ঢুকিয়ে দিলেই কাজ করতে পারবে না কি?” প্রশ্ন তুললেন সৈকত কর।
দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষক সোমপ্রকাশ দাশগুপ্ত ১৬ বছর শিক্ষকতা করছেন। সভায় যোগ দিয়েছিলেন চাকরিহারা সহকর্মীদের ন্যায় পাওয়ার দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে। তিনি স্পষ্টই জানালেন, একবার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন তাঁদের আর প্রমাণ দেওয়ার প্রশ্ন নেই। যাঁরা দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছেন তাঁরা অবশ্যই শাস্তি পান। “সিবিআই বা তদন্ত কমিটি একজন দৃষ্টিহীন শিক্ষকেরও নাম টেইন্টেড লিস্টে দেখাননি। এমনকি এসএসসি-র চেয়ারম্যানও শিকার করেছেন কোনো দৃষ্টিহীন প্রার্থী টেইন্টেড লিস্টে নেই। এতদসত্ত্বেও দৃষ্টিহীনরা তাঁদের চাকরি হারাচ্ছেন। শুধু দৃষ্টিহীন নয়, সমস্ত যোগ্য প্রার্থীর চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে,” বললেন তিনি। তিনি মনে করেন এসএসসি শুরু হওয়ার পর যেভাবে দৃষ্টিহীন প্রার্থীদের তাতে অংশ নেওয়ার জন্য অধিকার আন্দোলন করে জয় পাওয়া গেছিল, সেভাবেই এবারেও সমবেত লড়াই ন্যায় পেতে সাহায্য করবে।
অপর আরেক দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষক প্রতিভা জানালেন, সুপ্রিম কোর্ট রায় দিতে বাধ্য হলেও নিরপরাধ মানুষ এতে শাস্তি পেয়েছেন বলেই তিনি মনে করছেন। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী মহিলা শিক্ষক যাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানের জন্য এই চাকরিটি গুরুত্বপূর্ণ তার উপরও প্রভাব পরবে বলেই তিনি মনে করছেন।
এদিনের আলোচনায় জানানো হয় যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষকদের ন্যায়ের দাবিতে সমান্তরাল আন্দোলন কর্মসূচীও চলবে।