পশ্চিমবঙ্গে শ্রমজীবী নারীদিবস উদযাপনে এ রাজ্যের অ্যাসিড আক্রমণে শীর্ষে থাকার তথ্যটি এ বছরেও আলোচনার বাইরেই থেকে যাবে। মূলত শহরতলী, গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত অবস্থানের যে মেয়েরা নিজেদের পরিচয় তৈরিতে আগ্রহী তাঁদের সঙ্গে ঘটতে থাকা এই অপরাধ নিয়ে এখনো নারীবাদী আন্দোলন ও সর্বস্তরে বৃহত্তর আলোচনা না হলে সামাজিক মানসিকতা বদল, আইনের বাস্তবায়ন ও সরকারকে দায়িত্ব নিতে বাধ্য করার প্রক্রিয়া আরো মন্থর হবে। লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
Groundxero | March 7, 2025
আন্তর্জাতিক ‘শ্রমজীবী’ নারী দিবস – ৮ মার্চ। ‘শ্রমজীবী’ শব্দটি বিশেষভাবে লেখার কারণ শুধুমাত্র এই দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস নয়, কারণ এই শব্দটিকে ঘিরে মহিলাদের অধিকার, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, রাজনৈতিক মতপ্রকাশ সবটাই দশকের পর দশক ধরে আবর্তিত হয়ে আসছে আর তা অস্বীকার করার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার তাঁদের নাকচ করার পন্থা নিয়ে চলেছে। শুধু নাকচ নয়, নারীর প্রতি সহিংসতার রূপ বদলেছে, বেড়েছে নৃশংসতা। কারণ শুধু বৈষম্য বাড়ানো নয়, তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা নয়, আক্রোশের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ছে তাঁদের শরীর, আরও স্পষ্টভাবে বললে তাঁদের মুখ। তাঁদের বাহ্যিক রূপটিকে বিকৃত, ধ্বংস করে দেওয়াকেই তাদের জীবন, জীবিকা থেকে, তাদের সামাজিক অস্তিত্ব থেকে বিচ্যূত করে দেওয়ার সহজতম পথ বলে ভেবে নেওয়া হয়েছে। এবং রাষ্ট্র, প্রশাসন সেখানে উদাসীন, দায় স্বীকারে তাদের চূড়ান্ত অনীহা। সেই কারণেই অ্যাসিড আক্রমণের মতো চূড়ান্ত সহিংসতা বন্ধে আইন থাকলেও সহিংসতার আলোচনায় সবচেয়ে কম আলোচিত হয় অ্যাসিড আক্রমণ।
বেসরকারী সূত্র অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে অ্যাসিড আক্রান্ত বিভিন্ন বয়সের মেয়ে ও মহিলার সংখ্যা আনুমানিক ৫০০। গত তিন বছর ধরে সারা দেশের মধ্যে অ্যাসিড আক্রমণে শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। অথচ চোখ-কান খোলা রাখলে দেখা যাবে গত তিন বছরে এ রাজ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে যত আলোচনা, সভা, মিছিল, সরকারি পরিসংখ্যানের আদান-প্রদান সেখানে কীভাবে যেন অনুপস্থিত অ্যাসিড আক্রমণ ও অ্যাসিড আক্রমণের সার্ভাইভার নারীরা। অ্যাসিড আক্রমণ সার্ভাইভারদের গোষ্ঠী বাদ দিয়ে সরকার, প্রশাসন তো নয়ই, এমনকি নারীবাদী আন্দোলনেও এই হিংসার কথা সচরাচর উঠে আসে না।
মহিলাদের বাহ্যিক উপস্থিতির সঙ্গে জু্ড়ে থাকা সামাজিক ভাবনা, কোনও মেয়ের মুখ, শরীরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা ট্যাবু, অ্যাসিড আক্রমণের সঙ্গে মেয়েদের চরিত্রকে একসঙ্গে করে দেওয়ার পিতৃতান্ত্রিক ভাবনা থেকেই এসে যায় অ্যাসিড আক্রমণকে নারীর প্রতি সহিংসতার আলোচনায় বাদ দিয়ে রাখার ভাবনা। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে যেখানে সামগ্রিকভাবে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টিই গত এক দশকে যেখানে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়েছে সেখানে অ্যাসিড আক্রমণের মতো নৃশ্নংসতা বহুলাংশেই অনালোচিত রয়ে যায়। সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া সাধারণের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আলোচনা না হওয়ার কারণে এই বিষয়ে সামাজিকভাবে সচেতনতাও বাড়ে না।
এবং বাড়ে না অপরাধপ্রবণতা কমানোর প্রক্রিয়াও। সঠিক সরকারি, প্রশাসনিক, আইনি ব্যবস্থা থাকলে, বিচার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে কার্যকর হলে এবং সামগ্রিকভাবে মহিলাদের প্রতি হিংসা, বৈষম্য নিয়ে অর্ন্তভুক্তিমূলক আলোচনা সর্বস্তরে হলে বিষয়টি প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া সম্ভব হত। অ্যাসিড আক্রমণের সার্ভাইভার নারীরা শুধু ন্যায় পাওয়ার ক্ষেত্রেই নয়, এমনকি নারীর অধিকার, সহিংসতার বিরুদ্ধে নারীর লড়াইতেও এ রাজ্য নিজেদের কিছুটা হলেও একলাই পেয়ে থাকেন। নারী অধিকার ক্ররমীদের আলোচনাতেহ তাঁরা কোথায়?
সারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে রয়েছেন এক বড় সংখ্যক মহিলা যাঁরা তাঁদের জীবনে স্বাধীন, স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নিজের পছন্দের পক্ষে দাঁড়িয়ে অযাচিত প্রস্তাবকে না বলতে পারার জন্য, নিছক একটি শান্ত জীবন কাটাতে চাওয়ার ইচ্ছের কারণে, সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারায় বোড়ে হয়ে গিয়ে অ্যাসিড আক্রমণে হারিয়ে ফেলেন নিজের চেহারা, চেহারার সঙ্গে জু্ড়ে থাকা আত্মপরিচয়, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন আজন্ম পরিচিত চেহারাটা সারা জীবনের মতো অদৃশ্য হয়ে যায়, অবর্ণনীয় শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি নিজের সারা জীবনটিকে নিমেষে হারিয়ে ফেলার যে ভয়াবহ ট্রমা তা নিয়ে এ রাজ্যের নারী অধিকার আন্দোলন থেকে সরকারি স্তর কোথাওই হয় না প্রয়োজনীয় আলোচনা। মহিলা কমিশন অথবা নারী ও শিশু উন্নয়ন দপ্তর – রাজ্যে ক্রমশ বাড়তে থাকা অ্যাসিড আক্রমণ ও লজ্জাজনকভাবে দেশের মধ্যে এই অপরাধে শীর্ষে থাকার বিষয়টি কোনওভাবে কোনও ভাবেই আলোচনায় আনে না। এই নীরবতা, উদাসীনতা আসলে বাস্তবে এই অপরাধ বাড়ানোর পেছনে পরোক্ষে কাজ করতে থাকে।
মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার আঙ্গুরা বিবি যাঁকে কন্যা সন্তান হওয়ার কারণে অ্যাসিড খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল, যিনি আজ আর কর্মক্ষম থাকার মতো শারীরিক পরিস্থিতিতে নেই, অথচ যিনি কেবলই স্বামী-সন্তান নিয়ে স্বাভাবিক জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন, তিনি যখন বলেন, “আমি তো সরকারকে চিনি না, যদি চিনতাম, তার কাছে গিয়ে বলতাম, অপরাধীর শাস্তি হোক, আমার মতো যেন আর কোনও মেয়ের সঙ্গে না হয়। সরকার যদি কিছু করত তা হলেই এইরকভাবে আমাদের মারা বন্ধ হত।”
নদীয়ার পলাশীর মমতা সরকার ভেবেছিলেন পুলিশ হবেন। পড়াশোনা করছিলেন, স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলছিলেন, পারিবারিক সম্পত্তির বিবাদে যখন অ্যাসিডে পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁকে এক লহমায় স্বপ্নগুলি হারিয়ে গিয়েছিল। মুখ ও চেহারার পুড়ে যাওয়া অংশের আস্ত্রোপচারে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আগেই পরিবারে বেড়েছে ঋণ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থাতেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য সাহস ছাড়েননি। সরকারি দপ্তরে অস্থায়ি পদে চাকরি করছেন। আগামী দিনে লড়াইটা দীর্ঘ জানেন, কিন্তু তা ছেড়ে দেবেন না, সে বিষয়েও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
মনীষা পৈলান, দক্ষিণ ২৪ পরগণার তরুণী অযাচিত প্রেমের প্রস্তাবে না করেছিলেন। যাতে জীবনে আর ঘুরে দাঁড়াতে না পারেন তার জন্য অ্যাসিডে সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর মুখ। হারিয়েছেন এক চোখের দৃষ্টি। ঠিক এখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটা শুরু মনীষার। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার, অ্যাসিড খোলা বাজারে বিক্রি বন্ধে জনমত গড়ে তুলে তার যে আইনি নিদান রয়েছে তাকে বাস্তবায়িত করার, ন্যায় পাওয়ার প্রক্রিয়ায় জোটবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার এবং সবচেয়ে বড় বিষয়, অ্যাসিড আক্রমণের সঙ্গে মেয়েদের চরিত্র জুড়ে যে ট্যাবু বাঁচিয়ে রাখা হয় তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে পুড়ে যাওয়া মুখ না ঢেকে সমাজের সামনে নিজের অ্যাসিড আক্রমণ সার্ভাইভার-এর পরিচয় নিয়ে সামনে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে এ রাজ্যে নিজের পরিচিতি তৈরি করেছেন মনীষা।
দৃশ্যমানতা যে কোনো অধিকার আন্দোলনের অন্যতম শর্ত। অ্যাসিড আক্রমণে মহিলা, মুখ ও শরীর পুড়ে গিয়ে তথাকথিত মহিলাচিত অস্তিত্ব হারানো নারীদের তাই প্রাণপন চেষ্টা চলে আড়ালে রাখার। লজ্জা, অস্বস্তি, অপমানে আটকে রাখার। সংবাদপত্রে কেবলই একটি খবর করে রাখার। সেই সব কিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রান্তিক মহিলার পরিচয় নিয়ে, নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছেন এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন বয়সের নারীরা। এই লড়াই সিস্টেম-এর ভেতরে থেকে সিস্টেম বদলের, অধিকার বুঝে নেওয়ার। মনীষা যেমন বলেন, “অ্যাসিডে চামড়াটা পুড়িয়ে দিয়েছে আমাদের সাহস পোড়াতে পারেনি।”
পশ্চিমবঙ্গে শ্রমজীবী নারীদিবস উদযাপনে এ রাজ্যের অ্যাসিড আক্রমণে শীর্ষে থাকার তথ্যটি এ বছরেও আলোচনার বাইরেই থেকে যাবে। অথচ ঘরে-বাইরে, কাজের জায়গায়, শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা হিংসা নিয়ে একমাত্রিক আলোচনায় সভা-মিছিল মুখরিত হয়ে থাকবে। মূলত শহরতলী, গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত অবস্থানের যে মেয়েরা নিজেদের পরিচয় তৈরিতে আগ্রহী তাঁদের সঙ্গে গত এক দশকে ঘটতে থাকা এই অপরাধ নিয়ে এখনো নারীবাদী আন্দোলন ও সর্বস্তরে বৃহত্তর আলোচনা না হলে সামাজিক মানসিকতা বদল, আইনের বাস্তবায়ন ও সরকারকে দায়িত্ব নিতে বাধ্য করার প্রক্রিয়া আরো মন্থর হবে। যা আদপেই কাম্য নয়।