রবীন্দ্রনাথ – প্রমথ চৌধুরী কৃষি বিতর্ক প্রসঙ্গে


  • December 9, 2021
  • (2 Comments)
  • 2067 Views

মানুষের ইতিহাসের একটি বড় অংশ জমির মালিকানা ও জমির জন্য সংগ্রামের সাথে জুড়ে আছে। পশুপালন থেকে জমিদারি, জমিদারি থেকে পুঁজিবাদ – সব দেশে সব কালে যাঁরাই নিজেদের ‘জনগণের বন্ধু’ বলে ভেবেছেন, তাঁরাই জমির মালিকানার প্রশ্নটি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। আজকের কৃষক আন্দোলনের জেরে যখন এ প্রশ্নটি বারবার নানাভাবে উঠে আসছে, তখন দুই বিরাট ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব – রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর কৃষি-সমাজ-অর্থনীতি প্রসঙ্গে বিতর্কটি নিয়ে আলোচনা করলেন শংকর

 

দিল্লি সীমান্তে ধুন্ধুমার কৃষক আন্দোলন ফ্যাসিবাদী নরেন্দ্র মোদি সরকারকে নাকখত দেওয়ানোর পর সারা দেশেই কৃষক আন্দোলন নিয়ে নতুন আগ্রহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য আন্দোলন শুরুর সময় থেকেই কৃষি প্রশ্ন নিয়ে নানা বিতর্ক নতুন করে শুরু হয়ে গেছিল। এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করে ইতিমধ্যেই নানা ধরণের লেখা তৈরি হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধে আমার আলোচ্য বিষয় হলো রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরীর মধ্যে ঘটা একটি বিতর্ক যা কিনা বিংশ শতকের প্রথমার্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিতর্ক। ঠিক ঐ একই বিতর্ক রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিতেও উক্ত সময়ের কয়েক বছর আগে চলেছে এবং সমসাময়িক সময়ে চিনা পার্টিতেও চলেছে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, ধনতান্ত্রিক বিকাশের নিরিখে অপেক্ষাকৃতভাবে পিছিয়ে থাকা দেশের কৃষি বিতর্ক অবধারিতভাবে এই প্রশ্নকে ঘিরে বেশ কিছুদিন আবর্তিত হয়েছে। আমাদের দেশে খুব সম্ভবত এই বিশেষ বিতর্কটি আধুনিক সময়ে রবীন্দ্রনাথরাই শুরু করেছিলেন। কৃষি বিতর্কের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য রেখেই তাই বর্তমান প্রবন্ধের উপস্থাপনা।

 

জমির মালিকানা কার হাতে থাকা উচিৎ তা কৃষিপ্রশ্নে বরাবরই একটি বিতর্কিত বিষয়। কীভাবে বিষয়টি বিতর্কিত হয়ে উঠল তা অবশ্য অন্য কথা। মানব সমাজের দীর্ঘ ইতিহাসে জমি নিয়ে সংগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম হিসাবেই বিবেচিত হয়। প্রাক্-কৃষি আর্য সমাজে প্রধান সম্পদ বলে বিবেচিত হত গরু বা গবাদি পশু। বেদে এই নিয়ে ব্যাপক মারপিটের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কিন্তু উত্তর-বৈদিক যুগে কৃষিকাজ ফলবতী হয়ে ওঠার সাথে সাথে জমিই হয়ে ওঠে প্রধান সম্পদ। ফলত শুরু হয়ে যায় জমির দখলদারি নিয়ে সংগ্রাম। প্রাচীন ভারতের নিয়মকানুন অনুযায়ী রাজাই ছিল সকল জমির মালিক। প্রজারা জমি ব্যবহার করত কিন্তু তাদের মালিকানা-স্বত্ব ছিল না। জমি ব্যবহারের জন্য রাজাকে কর দিতে হত। রাজারা অধিকাংশ সময়ে অবশ্য ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি দান করত।

 

সুতরাং, রাজার নিচে কোটি কোটি জনগণের জমির উপর ব্যক্তি-মালিকানা ছিল না। কথাটা অন্যভাবে বললে, সকলেরই এক প্রকার মালিকানা ছিল। জমি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। ফলে ভারতের সামন্ততন্ত্র ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের থেকে পৃথক ধরণের ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তই প্রথম জমির মালিকানা-স্বত্ব নিরঙ্কুশভাবে জমিদারদের হাতে ন্যস্ত করে। ইউরোপীয় সামন্তব্যবস্থার আদলে ভারতের সামন্তব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর এটি ছিল একটি প্রয়াস। যাই হোক, এর ফলে প্রথমে বাংলায় এবং ধীরে ধীরে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সর্বত্র কৃষকদের জমির উপর থেকে সর্বপ্রকার মালিকানা-স্বত্ব বিলুপ্ত হয়।

 

গত শতকের শুরু থেকে কৃষককে জমির অধিকার ফিরিয়ে দেবার পক্ষে ধীরে ধীরে মতামত গঠিত হতে থাকে। “শান্তি রুটি এবং জমি চাই” স্লোগান দিয়ে রুশ বিপ্লব সফল হবার পর থেকেই জমির দাবী আমাদের দেশেও একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবী হিসাবে দেখা দিতে শুরু করে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরীর “রায়তের কথা”। তাতে জমির মালিকানা-স্বত্ব যে চাষ করে সেই কৃষকের হাতে দেবার সোচ্চার দাবী জানান তিনি। রবীন্দ্রনাথ তার বিরোধিতা করেন। একটি পালটা প্রবন্ধ লিখে তিনি তাঁর মতামত জানান। তার উত্তরে প্রমথ চৌধুরীও আবার একটি লেখা লেখেন। রবীন্দ্রনাথ-প্রমথ বিতর্কই বোধহয় কৃষিপ্রশ্নে, বিশেষ করে, জমির মালিকানা নিয়ে এ যুগে ‘জনগণের বন্ধুদের’ মধ্যেকার প্রথম বিতর্ক।

 

অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে ঠিক জনগণের বন্ধু বলা যায় কিনা তা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। কমিউনিস্টদের একটা বড় অংশ এখনও রবীন্দ্রনাথকে ব্রিটিশের পা-চাটা জমিদার হিসাবেই দেখে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের সময়েও এই নিয়ে যথেষ্ট কটূক্তি তাঁকে শুনতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথও তাঁর জমিদারি পেশা নিয়ে বেশ লজ্জিত এবং সংকুচিত থাকতেন। “রায়তের কথা”-র বক্তব্য নিয়ে যে তর্ক রবীন্দ্রনাথ তুলেছিলেন তার জবাব দিতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী লেখেন, “রায়তকে তাঁর দখলী-স্বত্ব বিশিষ্ট জোত হস্তান্তর করার অধিকার দেওয়া উচিত কি না সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সন্দেহ আছে। তাই তিনি হস্তান্তর করার পক্ষে আমার কী বলবার আছে তা শুনতে চেয়েছেন। ‘রায়তের কথা’-য় এ বিষয়ে আমি কোনো আলোচনা করিনি। এই মাত্র বলেছিলুম যে, এ ব্যাপারের পক্ষে ও বিপক্ষে যে-সব কথা বলবার আছে সে-সব কথা আর যার মুখেই শোভা পাক বাংলার অধিকাংশ জমিদারের মুখে শোভা পায় না। কারণ এ ব্যাপারে তাঁরা যা দেখেন তা প্রজার হিতাহিত নয় – দেখেন শুধু দাখিল-খারিজের নজরের তারতম্য। যে ব্যাপারে নিজের পকেট ভারি হয় তাতে যে অপরেরও হিত হয়, এ রকম মনে করায় বিশেষ আরাম আছে। পৃথিবীর সকল ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ঐ রকম বিশ্বাসের প্রতি মানুষের মন সহজেই অনুকূল।

 

যদিও প্রমথ চৌধুরী “রবীন্দ্রনাথ কবি হিসাবেও যেমন জমিদার হিসাবেও তেমনি unique। আমি সেই সব জমিদারের কথা বলেছি যাঁরা শতকরা নিরানব্বই” – এই লাইনদুটি যোগ করে একটা গার্ড নিয়ে নেন, তথাপি জমিদার এবং জমিদারি নিয়ে তাঁর খোঁচাটা রবীন্দ্রনাথের বুকে বাজারই কথা। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া যেতে পারে প্রমথ চৌধুরী ছিলেন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নে। সুকুমারী দেবীর পুত্র। রবীন্দ্রনাথের থেকে মাত্র সাত বছরের ছোট হবার কারণে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং শ্রদ্ধা ছিল ভাল রকমের। অধিকন্তু, প্রমথবাবু বেশ কিছুদিন রবীন্দ্রনাথের জমিদারিতে আমলাগিরিও করেছিলেন। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে যে, প্রমথ চৌধুরীর খোঁচা হজম করা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সহজ ছিল না। এবং তিনি জানতেন যে, তাঁর পক্ষে কৃষি প্রশ্নে, বিশেষ করে, জমির মালিকানা নিয়ে মতামত দিতে গেলেই এমন কথাবার্তা আসবে। তাই তিনি তাঁর লেখায় আগেভাগেই নিজের পক্ষে কিছু সাফাই গেয়ে রেখেছিলেন। তিনি লিখেছেন,আমি নিজে জমিদার। এইজন্য হঠাৎ মনে হতে পারে, আমি বুঝি নিজের আসন বাঁচাতে চাই। যদি চাই তাহলে দোষ দেওয়া যায় না – ওটা মানবস্বভাব। যারা সেই অধিকার কাড়তে চায় তাদের যে-বুদ্ধি যারা সেই অধিকার রাখতে চায় তাদেরও সেই বুদ্ধি – অর্থাৎ কোনোটাই ঠিক ধর্মবুদ্ধি নয়, ওকে বিষয়বুদ্ধি বলা যেতে পারে।

 

তারপর আবার লেখেন, “আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানাদরি। এই কারণেই জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই। এই জিনিসটার ‘পরে আমার শ্রদ্ধার একান্ত অভাব। আমি জানি, জমিদার জমির জোঁক, সে প্যারাসাইট্, পরাশ্রিত জীব। আমরা পরিশ্রম না ক’রে, উপার্জন না ক’রে, কোনো যথার্থ দায়িত্ব গ্রহণ না ক’রে ঐশ্বর্য ভোগের দ্বারা দেহকে অপটু ও চিত্তকে অলস করে তুলি।

 

কিন্তু তাঁর এই ব্যক্তিগত উলঝানের কী সমাধান, তা রবীন্দ্রনাথ ভেবে পান না। “এখন জমিদারি ছেড়ে দিলেই তো হয়। কিন্তু কাকে ছেড়ে দেব। অন্য এক জমিদারকে? গোলামচোর খেলার গোলাম যাকেই গছিয়ে দিই – তার দ্বারা গোলামচোরকে ঠকানো হয় না। প্রজাকে ছেড়ে দেব? তখন দেখতে দেখতে এক বড়ো জমিদারের জায়গায় দশ ছোটো জমিদার গজিয়ে উঠবে। রক্ত-পিপাসায় বড়ো জোঁকের চেয়ে ছিনে জোঁকের প্রবৃত্তির কোনো পার্থক্য আছে তা বলতে পারিনে।

 

এর থেকে বরং জমিদারি তাঁর হাতে থাকলে প্রজাদের কিছুটা হলেও তিনি রিলিফ দিতে পারবেন, তাদের কষ্টের কিছুটা লাঘব তাতে হবে এটাও জানিয়ে রাখতে ভোলেননি রবীন্দ্রনাথ। মহাজনের খপ্পরে পড়ে চাষীর জমি থেকে বেদখল হবার আশংকা প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছেন, “আমার অনেক রায়তকে এই চরম অকিঞ্চনতা থেকে আমি নিজে রক্ষা করেছি, জমি-হস্তান্তরের বাধার উপর জোর দিয়ে। মহাজনকে বঞ্চিত করিনি, কিন্তু রফা করতে বাধ্য করেছি। যাদের সম্বন্ধে তা করা একেবারে অসম্ভব হয়েছে তাদের কান্না আমার দরবার থেকে বিধাতার দরবারে গেছে। পরলোকে তারা কোনো খেসারত পাবে কিনা, সে তত্ত্ব এই প্রবন্ধে আলোচ্য নয়।

 

এইভাবে নিজের ব্যক্তিগত অবস্থান নিয়ে হাজারো কৈফিয়ত দিয়ে তবেই রবীন্দ্রনাথকে মূল বিষয়ে প্রবেশ করতে হয়েছিল। এবং সে বিষয়ে তিনি সাফ জানিয়ে দেন জমি যদি খোলা বাজারে কেনাবেচা চলতে থাকে তবে রায়ত বা কৃষক, অর্থাৎ কি না যারা প্রকৃত উৎপাদক তাদের অধিকাংশের হাতেই জমি থাকবে না। তা মুষ্টিমেয় ধনী মহাজনের হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবে। “তুমি বলেছ, জমি চাষ করে যে জমি তারই হওয়া উচিত। কেমন করে তা হবে? জমি যদি পণ্যদ্রব্য হয়, যদি তার হস্তান্তরে বাঁধা না থাকে? এ কথা মোটের উপর বলা চলে যে, বই তারি হওয়া উচিত যে-মানুষ বই পড়ে। যে-মানুষ পড়ে না অথচ সাজিয়ে রেখে দেয় বইয়ের সদ্ব্যব্যবহারীকে সে বঞ্চিত করে। কিন্তু বই যদি পটলডাঙার দোকানে বিক্রি করতে কোনো বাধা না থাকে, তাহলে যার বইয়ের শেলফ আছে, সে যে বই কিনবে না এমন ব্যবস্থা কী করে করা যায়। সংসারে বইয়ের শেলফ বুদ্ধির চেয়ে অনেক সুলভ ও প্রচুর। এই কারণে অধিকাংশ বইয়ের গতি হয় শেলফের থাকে, বুদ্ধিমানের ডেস্কে নয়।

 

সুতরাং, “জমি যদি খোলা বাজারে বিক্রি হয়ই, তাহলে যে ব্যক্তি স্বয়ং চাষ করে তার কেনবার সম্ভাবনা অল্পই; যে লোক চাষ করে না কিন্তু যার আছে টাকা, অধিকাংশই বিক্রয়যোগ্য জমি তার হাতে পড়বেই। জমির বিক্রয়ের সংখ্যা কালে কালে ক্রমেই যে বেড়ে যাবে, এ কথাও সত্য। কারণ উত্তরাধিকারসূত্রে জমি যতই খণ্ড খণ্ড হতে থাকবে চাষীর সাংসারিক অভাবের পক্ষে সে জমি ততই অল্প-সত্ব হবেই; কাজেই অভাবের তাড়ায় খরিদ-বিক্রি বেড়ে চলবে। এমনি করে ছোটো ছোটো জমিগুলি স্থানীয় মহাজনের বড়ো বড়ো বেড়াজালের মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে।

 

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মতামতের সঙ্গে যাঁদেরই পরিচয় আছে তাঁরাই জানেন যে, তিনি পুঁজিবাদের বিকাশের বিরুদ্ধে ছিলেন। আলোকিত সামন্তশ্রেণির যে অংশটি রাশিয়ায় পুঁজিবাদের স্তরটিকে বাইপাস করে জমির উপর সাধারণ মালিকানার উপর নির্ভর করে সরাসরি সমাজতন্ত্রে পৌঁছতে চাইত তাঁদের মতামতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতামতের লক্ষ্যণীয় নৈকট্য লক্ষ্য করা যায়। এই লেখাটি লেখার সময়েও রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে, উদারনৈতিক জমিদারতন্ত্র সমস্যার সমাধান নয়, কারণ মানব-চরিত্র এবং অর্থনৈতিক গতির নিরিখে তাঁর মতো জমিদার কমই আছে। বিরলও বলা চলে। তাই জমিদারদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন যে, তারা জমির জোঁক। তবে সমাধান কিসে? ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের কাছে এর কোনো সমাধান ছিল না। তাই “পল্লীর মধ্যে সমগ্রভাবে প্রাণসঞ্চার” জাতীয় বিমূর্ত কথার আশ্রয় তাঁকে নিতে হয়েছিল। ১৯৩০-এ রাশিয়া ঘুরে আসার পরই তিনি জোরেসোরে সমবায়ের কথা বলতে শুরু করেন। কিন্তু যাই হোক না কেন, কৃষি সমস্যার, বিশেষ করে জমি সমস্যার, একটা সমাধান যে তিনি খুঁজছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। তাই তিনি তাঁর লেখাটি শেষ করেন এই কথাগুলি দিয়ে:

 

কেমন করে সেটা হবে? সেই তত্ত্বটাই কাজে ও কথায় কিছুকাল থেকে ভাবছি। ভালো জবাব দিয়ে যেতে পারব কিনা জানিনে – জবাব তৈরি হয়ে উঠতে সময় লাগে। তবু আমি পারি বা না পারি, এই মোটা জবাবটাই খুঁজে বের করতে হবে। সমস্ত খুচরো প্রশ্নের সমাধান এরই মধ্যে, নইলে তালি দিতে দিতে দিন বয়ে যাবে; যার জন্য এত জোড়া-তাড়া সে ততকাল পর্যন্ত টিঁকবে কিনা সন্দেহ।

 

অন্যদিকে প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের যুক্তিকাঠামোর বিরুদ্ধে যা বললেন তাকে বলা যেতে পারে বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী যুক্তি। তিনি সামন্ততন্ত্রের শৃংখলকে অবাধ পুঁজিবাদী বিকাশ দিয়ে ভাঙতে চান। তাই তিনি লেখেন, “আমি অবাধ হস্তান্তরের পক্ষপাতী এই কারণে যে হস্তান্তর করবার অধিকার হচ্ছে ইংরাজীতে যাকে বলে একটা proprietary right এবং সে right আমার মতে যে জমি চষে তার থাকা উচিত। সে চাষী ক অথবা খ তাতে কিছু যায় আসে না। ক জমিদারের স্বত্ব-স্বামিত্বও তো নিত্য খ জমিদারের হাতে যাচ্ছে। এখন কেউ যদি প্রস্তাব করে যে, জমিদারি কেউ হস্তান্তর করতে পারবে না, ক চ ট ত প পঞ্চবর্গ জমিদার পঞ্চমুখে তার প্রতিবাদ করবেন। মানবচরিত্র এই যে কোনোরূপ স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির সঙ্গে কোনো বিশেষ লোককে চিরকাল বেঁধে রাখা যাবে না। লক্ষীর সঙ্গে মানুষের এমন বিবাহ হতে পারে না যার আর ডিভোর্স নেই।

 

অবাধ পুঁজিবাদী বিকাশকে একযুগে মুক্তির উপায় হিসাবে দেখা চলত, কিন্তু ১৯২৬ সালে, বিশেষ করে, যখন রাশিয়ার বিপ্লব ঘটে গিয়েছে এবং ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে তখন পরিস্থিতির বিচারে তা আর অগ্রপদক্ষেপ বলে বিবেচিত হতে পারত না। কিন্তু তখনও দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল এটাই যে, একটি কৃষি কর্মসূচি রচনা করে উঠতে কেউই পারেন নি। কমিউনিস্ট পার্টি সদ্যোজাত। কংগ্রেস তো জমিদারদেরই দল ছিল। তাই প্রমথ চৌধুরী “রায়তের কথা”-তে মন্তব্য করেছিলেন, “বাংলার উকিল-রাজ হচ্ছেন জমিদারের মিত্র-রাজ। এ entente cordiale – এর ভিতর যথেষ্ট অর্থ আছে। এঁরা যে একমাত্র জমিদারের অন্নে প্রতিপালিত, তা অবশ্য নয়। জমিদার ও রায়ত উভয়েই এঁদের মক্কেল; এঁরা গাছেরও পাড়েন, তলারও কুড়োন। তবে তিল কুড়িয়ে তাল করার চাইতে গোটা তাল হাতে পাওয়া ঢের বেশি আরামের ও আহ্লাদের কথা। ফলে এঁদের লুব্ধ দৃষ্টি উপরের দিকেই সহজে আকৃষ্ট হয়, তার পর আর নামে না। অথচ এই দলের লোকই হচ্ছেন আমাদের পলিটিক্সের ল্যাজা-মুড়ো দুই-ই। পলিটিশিয়ানরা প্রজার হয়ে কোনোরূপ দাবি করতে প্রস্তুত নন। আমার এ বিশ্বাস যদি অমূলক হয়, তাহলে তার জন্য প্রধানত পলিটিশিয়ানরাই দায়ী। মডারেট এক্সট্রিমিস্ট কোনো দল থেকেই অদ্যাবধি কোনো প্রোগ্রাম বার হয়নি, এবং তা বার করবার তাঁদের যে কোনোরূপ অভিপ্রায় আছে, তার কোনো আভাসও তাঁহার কাছ থেকে পাওয়া যায় না।

 

এমতাবস্থায় বঙ্কিমচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কৃষি সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে শিল্পী-সাহিত্যিকদেরই এগিয়ে আসতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বা প্রমথ চৌধুরী তাঁদেরই একজন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর মত অভিজ্ঞ লোককেও এই কাজে যথেষ্ট নাস্তানাবুদ অবস্থায় পড়তে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ খোলা বাজারে জমি বিক্রি হলে কৃষকের সর্বনাশ হবে এই যুক্তি হাজির করার পর প্রমথবাবু বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হন। ফলে তাঁকে বলতে শোনা যায়, “যদি কেউ বলেন যে, চাষী প্রজা যে জোত হস্তান্তর করে সে দেনার দায়ে আর সেই সূত্রে মহাজন জোতদার হয়ে ওঠে, তাহলে বলি, জোত খালি মহাজনের দেনার দায়ে বিক্রি হয় না, জমিদারের বাকি খাজনার দায়েও বিক্রি হয়, আর তখন তা হয় সম্পূর্ণ নির্দায়রূপে। সুতরাং জমির কেনাবেচা যেমন চলছে তেমন চলবেই – মহাজন নামক ক্যাপিটালিস্টের হাত থেকে রায়তী জোত আইনতঃ রক্ষা করতে চেষ্টা করলেও জমিদার নামক ক্যাপিটালিস্টের হাত থেকে তাকে রক্ষা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, সেইরকম আইন হওয়া উচিত যাতে জমিদারের হাত থেকে জোতদারের হাতে গেলে রায়তের স্বত্ব-স্বামিত্ব খর্ব না হয়। মধ্যস্বত্বকে খর্ব করাই তার উপায়। কী করে তা করা যাবে তার সন্ধান উকিলবাবুদের কাছে পাওয়া যাবে।

 

রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর এই কথোপকথনে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়। উভয়েই কিন্তু সেই সময়ে বলশেভিকবাদের ঘোর বিরোধী। এর অল্প কিছুদিন পরেই রাশিয়া ভ্রমণ করে এসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুরনো মতামত অনেকাংশে সংশোধন করেছিলেন। প্রমথবাবুর পরবর্তীকালের অবস্থান আমার জানা নেই। কিন্তু ১৯২৬ সালে উভয়েই কমিউনিজমকে প্রবল সন্দেহের চোখে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আলোচনাতে লিখেছেন, “ইদানীং পশ্চিমে বলশেভিজম্, ফাসিজম্‌ প্রভৃতি যে-সব উদ্যোগ দেখা দিয়েছে আমরা তার কার্য-কারণ তার আকার-প্রকার সুস্পষ্ট বুঝি তা নয়; কেবল মোটের উপর বুঝেছি যে, গুন্ডাতন্ত্রের আখড়া জমল।

 

আবার, “রাশিয়ার জার-তন্ত্র ও বলশেভিক-তন্ত্র একই দানবের পাশমোড়া দেওয়া। পূর্বে যে ফোড়াটা বাঁ-হাতে ছিল আজ সেটাকে ডান হাতে চালান করে দিয়ে যদি তাণ্ডবনৃত্য করা যায়, তাহলে সেটাকে বলতেই হবে পাগলামি।

 

অন্যদিকে “রায়তের কথা”-র মূল টেক্সটে শ্রী প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন, “যে প্রজার অধিকারের কথা তোলে, কারও মতে সে ‘বলশেভিক’, কারও মতে সে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শত্রু, আবার কারও মতে বা, সে এক সম্প্রদায়ের সাথে আর এক-সম্প্রদায়ের মারামারি-কাটাকাটির পক্ষপাতী। এঁরা যদি একটু ভেবে দেখেন তাহলেই দেখতে পাবেন যে, এ সকল অপবাদ কতদূর অমূলক। প্রথমত, বলশেভিক জন্তুটি যে কি, তা তাঁরাও জানেন না, আমরাও জানি নে। জুজুর ভয় ভদ্রলোকের পক্ষে অপরকে দেখানোও যেমন অনুচিত, নিজে পাওয়াও তেমনি ছেলেমি।

 

প্রকৃতপক্ষে, সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরীর রাজনৈতিক অবস্থানের মিলের জায়গাটা হল উভয়েই সামন্ততন্ত্র থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছেন। কিন্তু সামন্ততন্ত্রকে প্রতিস্থাপিত করা হবে কী দিয়ে – এই ভাবনার জায়গাতেই উভয়ের চিন্তার পার্থক্য বা বিশিষ্টতা আমরা লক্ষ্য করি। প্রমথ চৌধুরী বেশ কিছুটা পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের রাস্তায় যেতে চাইছেন কৃষক-অর্থনীতির উপর নির্ভর করে। কৃষিতে পুঁজিবাদী বিকাশের এই রাস্তা মার্কসীয় সাহিত্যে “কৃষকপথ” নামে পরিচিত। এর বিপরীতে যে য়ুঙ্কারপথের কথা আমরা জানি, অর্থাৎ য়ুঙ্কার বা জমিদারদের নিজেদেরই কৃষিবুর্জোয়া হয়ে ওঠার রাস্তায় পুঁজিবাদের বিকাশ, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু মোটেই সেই পথের পক্ষে সওয়াল করছেন না। তিনি প্রকৃতপ্রস্তাবে পুঁজিবাদী বিকাশটাই চাইছেন না। পুঁজিবাদী বিকাশের প্রতি তাঁর তীব্র অপছন্দ তিনি কখনোই গোপন করেন নি। কিন্তু তা হলে সামন্ততন্ত্র থেকে মুক্তি ঘটবে কীভাবে? এই উত্তরটা সে সময়ে তাঁর নিজের কাছেও ছিল না, যা তিনি পেলেন রাশিয়াতে। চার বছর বাদে। রাশিয়া থেকে ফিরে জমিদারতন্ত্র এবং কৃষিপ্রশ্ন নিয়ে কী লিখলেন তিনি তা এক প্রণিধানযোগ্য আলোচনা। তবে তা বর্তমান প্রবন্ধের বিষয় নয়।

 

এই লেখা যখন শেষ করছি তখন সরকারের সাথে অন্তিম দফার দর কষাকষি চালাচ্ছে কৃষক সংগঠনগুলি। ইতিমধ্যেই তাদের বাকী দাবিদাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের ঘোষণায় তাঁরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এখন অপেক্ষা সরকারী চিঠির, যেখানে বাকী দাবিদাওয়াগুলি নিয়ে যে ঐক্যমত্য ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে তা লিপিবদ্ধ থাকবে। মনে করা হচ্ছে তা এক-দুদিনের মধ্যেই এসে যাবে এবং এক বছর ব্যাপী দিল্লি সীমান্তে কৃষক অবস্থান অতি শীঘ্রই জিত হাসিল করে  উঠতে চলেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ১০-ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসাবে ঘোষিত হতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষক সমস্যা, কৃষক আন্দোলন, তার শক্তি, দুর্বলতা, বিকাশ এই সমস্ত কিছুই আগামী দিনে আরও বৃহত্তর চর্চার জায়গা হিসাবে দেখা দেবে, তা নিশ্চিত। এই চর্চাকে সঠিকভাবে করতে গেলে আমাদের কৃষিপ্রশ্নকে বড় মাপকাঠিতে বিচার করতে হবে। অতীতের বিতর্ক, সংগ্রাম প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে এই প্রশ্ন কীভাবে বেড়ে উঠল, বিকশিত হল তা নিয়ে আলাপ আলোচনাও তাই আজ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ-প্রমথ চৌধুরী বিতর্ক এই ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভবিষ্যতে আমরা এই বিতর্কের অন্যান্য দিকগুলি নিয়েও আলাপ আলোচনা চালাবার প্রচেষ্টা নেব।

 

সূত্র:
রায়তের কথা / প্রমথ চৌধুরী
পুঁথিপত্র (ক্যালকাটা) প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১৩
রবীন্দ্রনাথের সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি এবং শ্রী প্রমথ চৌধুরীকৃত তার উত্তরপ্রদানমূলক লেখাটি এই সংস্করণে যথাক্রমে ভূমিকা এবং টীকা আকারে সংযোজিত।

 

লেখক বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী

Share this
Recent Comments
2
  • comments
    By: Kirity Roy on December 9, 2021

    ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ। ধন্যবাদ। তবে এ শুধু একটি মাত্র পুস্তকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আরও বিশ্লেষণধর্মী লেখার আশায় রইলাম।

  • comments
    By: Paban Mukhopadhayay on December 10, 2021

    উপকৃত হলাম। প্রাসঙ্গিক চর্চা। ধন্যবাদ।

Leave a Comment