ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের জয় : কিছু জিজ্ঞাসা


  • December 1, 2021
  • (0 Comments)
  • 901 Views

অনেকে এই আন্দোলনের ভেতর ট্রাক্টরমালিক ধনী চাষি থেকে লাঙ্গলবিহীন ক্ষেতমজুর পর্যন্ত কৃষকসমাজের ঐক্য লক্ষ করে আশান্বিত হয়েছেন যারা জাতের রাজনীতিকে প্রাধান্য দেন তাঁদের চোখে আবার সমস্ত কৃষিজীবী শূদ্রদেরঐক্যবদ্ধ লড়াইটাই এই আন্দোলনের সবচেয়ে আশাব্যাঞ্জক দিক এই সমস্ত পর্যবেক্ষণই হয়ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু যারা চেয়েছিল এই আন্দোলনের পথ ধরে দেশজুড়ে মেহনতী শ্রেনিগুলির ঐক্য তৈরি হোক আর কৃষকবিরোধী কৃষি আইনগুলোর পর এই সরকারেরই আনা শ্রমিকবিরোধী শ্রম কোডগুলোকেও ঝেঁটিয়ে বিদেয় করুক, তাদের আশাপূরণের সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না লিখেছেন নীলাঞ্জন দত্ত

 

আমরা অনেকেই একটু থমকে গেলাম, যারা উত্তেজেনায় টানটান হয়ে উঠেছিলাম ঠিক এক বছরের মাথায় কৃষক আন্দোলনের জয় ঘোষিত হয়েছে বলে। উত্তেজিত হওয়ারই কথা, কারণ সেই জয় ঘোষণা করেছেন আবার আন্দোলনকারীদের কোনও মুখপাত্র নয়, যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেই কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং, যার মাথা নাকি কোনও চ্যালেঞ্জের সামনেই নত হয় না।

 

কিন্তু এত বড় জয় নিয়ে লোক সভায় বিরোধীরা গলা ফাটানোর কোনও সুযোগই পেল না! The Farm Laws Repeal Bill, 2021 বা Bill No. 143-C of 2021 মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ২৯ নভেম্বর পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই পরপর পাস হয়ে গেল, বিতর্কের বিন্দুমাত্র অবকাশ ছাড়াই।

 

এতবড় একটা ঐতিহাসিক ঘটনার এমন ফুস করে ফুরিয়ে যাওয়ায় আমাদের মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু ব্যাপারটা তো এভাবেও ভাবা যায়, যে আমাদের শাসকরা হয়ত এটাই চেয়েছিল। এমন সুন্দর তিন-তিনটে কৃষি আইন এক বছর ধরে কাজে লাগানো গেল না, তারপর ফিরিয়ে নিতে হল, এই জ্বালা কে আর মনে রাখতে চায়? তার চেয়ে এমন করে শেষটা হওয়াই ভাল, যাতে বিশেষ কোনও স্মৃতিই না থাকে। এটা নতুন কিছু নয়। এরকম ভাবেই তো শাসকরা চিরকাল ইতিহাসকে গড়াপেটার চেষ্টা করে।

 

স্মৃতি ফিরিয়ে আনার একটা পদ্ধতি হিসেবে বহুকাল ধরে মনোচিকিৎসায় ‘শক ট্রিটমেন্ট’ প্রচলিত ছিল। সে ব্যাপারে এই পদ্ধতি কতটা কার্যকর তা নিয়ে অবশ্য বিতর্কের শেষ হয়নি। কিন্তু অন্যদিকে, স্মৃতিকে মুছে দেওয়ার জন্যেও শক ট্রিটমেন্টই বেছে নেয় শাসকেরা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কয়েক বছর আগের এক রাতে দেশবাসীকে শক দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল করা হল। দেশে কালো টাকার চলাচল বন্ধ করতেই এই পদক্ষেপ। আর কে না জানে, কালো টাকাই হল সমস্ত দুর্নীতির মূল? কালো টাকা কীভাবে তৈরি হয়, কাদের হাতে থাকে, তারা কীভাবে তা কাজে লাগায়, এসব যে দেশের মানুষের অজানা ছিল তা নয়। নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই তারা তা হাড়েহাড়ে বুঝতো। নোট বাতিলের শক ট্রিটমেন্টের পর সেই অভিজ্ঞতাপ্রসূত স্মৃতির ওপর প্রচারের বুলডোজার চলল। রোদে-বৃষ্টিতে কৃপণ এটিএম বা ব্যাঙ্কের সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে কিছু লোকে ভাবতে শুরু করল, অর্থনীতির এত বড় শুদ্ধিকরণ যজ্ঞের জন্য কিছু তো ত্যাগস্বীকার করতেই হবে। এক বছর তুমুল আন্দোলনের মুখে অনড় থাকার পর রাতারাতি সেই আন্দোলনের দাবি মেনে তিনটি সদ্যপ্রণীত কৃষি আইন রদ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সাতসকালে দূরদর্শনের পর্দায় আবির্ভূত হয়ে দেশবাসীকে প্রায় সেই রাতের মতই শক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

 

তার সঙ্গে আরও একটা কথা বলেছেন, যা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। হ্যাঁ, এটাও আন্দোলনকারী সহ সমস্ত বিরোধীদের উল্লসিত হওয়ার একটা বড় কারণ বটে। তবে উল্লাসের স্রোতে কথার খেইটা হারিয়ে গেলে মুশকিল। ক্ষমা কি তিনি তাঁর বা তাঁর সরকারের কৃতকর্মের জন্য চেয়েছেন? কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে দেশের কৃষিব্যবস্থাকে তুলে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করা হচ্ছিল বলে তার ভুল স্বীকার করে চেয়েছেন? এক বছর আন্দোলন চলাকালীন শহিদ হওয়া কৃষকদের স্মৃতিতর্পণ করে চেয়েছেন? না। বরং ১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের ‘কৃষক ও কৃষি কল্যাণ মন্ত্রক’ লোকসভায় বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিল, আন্দোলন চলাকালীন কৃষক মারা যাওয়ার কোনও রেকর্ড সরকারের কাছে নেই। প্রধানমন্ত্রীও তাঁর ঘোষণায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, আর কোনও কারণে নয়, তিনি এবং তাঁর সরকার এই কৃষি আইনগুলো করার মাধ্যমে যে মহান কাজটা করতে চেয়েছিলেন, তার মহত্ব আপামর কৃষকসমাজকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই ক্ষমা চেয়েছেন। কাদের কাছে এই ক্ষমা চাওয়া? আন্দোলনকারী কৃষকদের কাছে অবশ্যই নয়। ভাল করে ঠাহর করে দেখুন। এইখানে আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট মিস করছি না তো?

 

পয়েন্টটা হল এই যে সরকারের এমনভাবে কৃষি আইনগুলোকে গুটিয়ে নেওয়াটা তার অতি বড় অর্থনৈতিক তাত্ত্বিকরাও একটা পরাজয় হিসেবেই দেখছে। পূঁজিবাদী অর্থনীতির বড় পূজারীদের লেখালেখি আর বলাবলিতে সংবাদমাধ্যম আর ইন্টারনেট ভরে যাচ্ছে। যার মূল কথা একটাই — ১৯৯১ সালে ‘নয়া অর্থনীতি’র পথে পা বাড়ানোর পর এই প্রথম ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা মৌলিক ‘সংস্কার’ হতে যাচ্ছিল, যার থেকে পিছিয়ে এসে সরকার একটা গর্হিত অর্থনৈতিক অপরাধ করল। একানব্বই সালের ‘উদারীকরণ’ ভারতকে হালফ্যাশানের বিশ্ব-পূঁজিবাদের সঙ্গে গাঁটছড়াটা কষে বাঁধতে শিখিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একটা জায়গা ঢিলা থেকে গিয়েছিল। সেখানে মাঝেমাঝেই এদিক ওদিক থেকে টান লেগে বেকায়দা অবস্থা হচ্ছিল। কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিক্ষেত্রকেই যদি বর্তমান বিশ্বের হাটখোলা অর্থনীতির সঙ্গে তাল রেখে খুলে না দেওয়া গেল, তবে আর সংস্কারটা হল কী? তার জন্যে তিন দশক অপেক্ষার পর এত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েও শেষে এই পশ্চাদপসারণ? তাও আবার বোল্ড বিজেপি সরকারের? তাহলে আর কংগ্রেসের নেতৃত্বে জোড়াতাপ্পি ইউপিএ-কে ‘নড়বড়ে হাঁটু’ বলে এত গাল দিয়ে বিদেয় করে কী লাভ হল?

 

আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে যেমন করেই হোক। ক্ষমা তো চাইতেই হবে সেই কর্পোরেট পুঁজিপতিদের কাছে, আপাতত প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার জন্য। সেই সঙ্গে কিছু লোককে যদি ধোঁকা দিয়ে বিশ্বাস করানো যায় যে সরকার আন্দোলনের কাছে হেরে গিয়ে ‘অন্নদাতাদের’ কাছেই ক্ষমা চাইছে, তাহলে আসন্ন নির্বাচনগুলোতে তাদের ভোট পাওয়ার আশাও করা যেতে পারে। ধনিক প্রভুদের বোঝানো যেতে পারে, ভোট পেয়ে সরকারটা রাখতে পারলে ভবিষ্যতে এরকম আরও সংস্কার করার পথ খোলা থাকবে। নইলে সব বন্ধ। মনে রাখবেন, এত তীব্র আন্দোলনের সম্মুখীন না হয়েও এরা যখনই বেগতিক দেখেছে, তখনই ‘সংস্কার’ আপাতত শিকেয় তুলে রাখতে দ্বিধা করেনি। যেমন হয়েছে ২০১৫ সালে জমি অধিগ্রহণ আইনের সংশোধনীর ক্ষেত্রে, ২০১৮ সালে ফাইনানশিয়াল রেজোলিউশন অ্যান্ড ডিপোজিট ইনশিওরেন্স বিল-এর ক্ষেত্রে অথবা ২০১৯ সালে অরণ্য আইন সংশোধনীর ক্ষেত্রে। আগামীকাল এক কদম এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখতে আজ দু কদম পিছিয়ে আসার রণনীতি লেনিনের নামে খ্যাত হয়েছে বটে, কিন্তু আসলে এতে কমিউনিস্টদের কোনও পেটেন্ট নেই।

 

ভোট ছাড়াও পিছিয়ে আসার আরও একটা বড় কারণ রয়েছে। এই কৃষক আন্দোলন যেহেতু উত্তর ভারতের ‘সবুজ বিপ্লবের’ এলাকাগুলিতেই দানা বেঁধেছিল, সরকারপক্ষের লোকেরাও তাকে ‘পাঞ্জাবের আন্দোলন’, ‘শিখদের আন্দোলন’ ছাপ্পা লাগিয়ে গোটা দেশের থেকে আলাদা করে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেটা যে আবার শিখ জাতীয়তাবাদের নিবুনিবু আঁচে হাওয়া দিতে পারে তা কে ভেবেছিল! শেষপর্যন্ত শাসকেরা কৃষক আন্দোলনের মধ্যে ‘খালিস্তানের’ ভূত দেখতে আরম্ভ করল। তবে এটা হয়ত কাকতালীয় যে প্রধানমন্ত্রী যেদিন তাঁর তিন আইন প্রত্যাহারের ঘোষণাটি করলেন, সেই দিনটা শুধু গুরু নানকেরই জন্মদিন ছিল না, ছিল খালিস্তান আন্দোলনের চরমপন্থীদের হাতে নিহত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীরও জন্মদিন।

 

চিন্তা অন্য কিছু বিষয় নিয়ে। ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপির ইরেজার দিয়ে এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের কর্পোরেট-বিরোধিতার দিকটাকে ঘষে তুলে দেওয়া যাবে না তো? স্মৃতি-বিস্মৃতির খেলায় কিছুই বলা যায় না। ইতিমধ্যেই তো এক বছর চলা এই আন্দোলনকে বামপন্থীরাও অনায়াসে ‘ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম কৃষক আন্দোলন’ বলে মেনে নিয়েছে। যদিও এর আগে বাংলায় তেভাগা চলেছে চার বছর (১৯৪৬-৫০), তেলেঙ্গানায় কৃষক বিদ্রোহও তাই (১৯৪৭-৫১), নকশালবাড়িতে — পরে ছড়িয়ে পড়ার কথা বাদ দিয়ে — কৃষক সংগ্রাম চলেছে প্রায় দেড় বছর (১৯৬৭-’৬৮), শ্রীকাকুলামে তিন বছরের ওপর (১৯৬৭-৭০)। এই আন্দোলনগুলির ধারাবাহিকতায় বা প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনকে দেখলে কি তার গুরুত্ব কোনওভাবে কমে যেত?

 

অনেকে আবার এই আন্দোলনের ভেতর ট্রাক্টর-মালিক ধনী চাষি থেকে লাঙ্গলবিহীন ক্ষেতমজুর পর্যন্ত কৃষকসমাজের ঐক্য লক্ষ করে আশান্বিত হয়েছেন। যারা জাতের রাজনীতিকে প্রাধান্য দেন তাঁদের চোখে আবার সমস্ত ‘কৃষিজীবী শূদ্রদের’ ঐক্যবদ্ধ লড়াইটাই এই আন্দোলনের সবচেয়ে আশাব্যাঞ্জক দিক। এই সমস্ত পর্যবেক্ষণই হয়ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যারা চেয়েছিল এই আন্দোলনের পথ ধরে দেশজুড়ে মেহনতী শ্রেনিগুলির ঐক্য তৈরি হোক আর কৃষকবিরোধী কৃষি আইনগুলোর পর এই সরকারেরই আনা শ্রমিকবিরোধী শ্রম কোডগুলোকেও ঝেঁটিয়ে বিদেয় করুক, তাদের আশাপূরণের সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

 

  • লেখক মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী।

 

Share this
Leave a Comment