পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোট জয়-পরাজয়— বামপন্থীদের কাছে কীসের ইঙ্গিত?


  • May 8, 2021
  • (0 Comments)
  • 2376 Views

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সিপিএম-সিপিআই এর মতো সংসদীয় বামপন্থী দলগুলোর ওপর রাজ্যের শ্রমজীবীরা কোনো ভরসাই করতে পারেন নি। তাদের বেশিরভাগটাই তৃণমূল-বিজেপিতে বিভক্ত হয়ে গেছে। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের পরে কেন এই পরিণতি ঘটল তা একটু গভীরে গিয়ে বিচার করা দরকার। বিশেষত যারা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের বাম মনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক কর্মী তাদের কাছে এই চর্চা খুব জরুরি বলে মনে হয়। লিখেছেন অমিতাভ ভট্টাচার্য

 

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জীর দলের বিপুল সাফল্য ও বিজেপির পরাজয় নিয়ে সর্বত্রই নানান কাটাছেঁড়া চলছে। ফ্যাসিস্ত সংঘ-পরিবারের রাজ্যের গদিতে আসীন হবার সম্ভাবনা আপাতত দূর হয়েছে। তৃতীয়বারের জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে নীলবাড়িতে শ্রীমতী মমতা ব্যানার্জী। এরাজ্যে এই প্রথম একটা বিধানসভা গঠিত হল যেখানে সংসদীয় বামপন্থীরা (সিপিএম-সিপিআই) নেই। নেই কংগ্রেসও। অর্থাৎ রাজ্যের সংসদীয় কাঠামোয় ক্ষমতায় বসলো একটি দক্ষিণপন্থী বুর্জোয়া দল। আর তাদের বিরোধীপক্ষে বসলো ফ্যাসিস্তরা। অন্য আর কেউ নেই (এক্ষেত্রে আইএসএফ-র ১টা আসন হিসেবে নেওয়া হয় নি) যে বা যারা বিধানসভায় অন্য কিছু বলবে। এখন প্রশ্ন হল রাজ্যে ফাসিস্ত শক্তির যে ক্ষমতা তৈরী হয়েছে আর গত ১০ বছরে তৃণমূলের আমলে যে স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ব তৈরী হয়েছিল, তা এরাজ্যের সকল শ্রমজীবী (শ্রমিক–কৃষক-কর্মচারী-ছোট দোকানদার-হকার-বেকার যুবক-যুবতী ও ছাত্রছাত্রী) মানুষের জীবনে কোন বার্তা নিয়ে এল? পরিবর্তন হলে যে ভয়ানক পরিণতি হত তা বলাই বাহুল্য। প্রত্যাবর্তন আগামী ৫ বছরে আমাদের কী কী দিতে পারে তার মোটামুটি আভাস গত ১০ বছরে পাওয়া গেছে। এবারের নির্বাচনে সিপিএম-এর স্লোগান ছিল-ফেরাতে হাল ফেরাও লাল। তাতে সিপিএম-এর ভোট ৫ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে। এই ফলাফলে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সিপিএম-সিপিআই এর মতো দলগুলোর ওপর রাজ্যের শ্রমজীবীরা কোনো ভরসাই করতে পারেন নি। তাদের বেশিরভাগটাই তৃণমূল-বিজেপিতে বিভক্ত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর প্রায় ২৫ বছরের কংগ্রেস রাজত্ব, ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের পরে কেন এই পরিণতি ঘটল তা একটু গভীরে গিয়ে বিচার করা দরকার। বিশেষত যারা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের বাম মনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক কর্মী তাদের কাছে এই চর্চা খুব জরুরি বলে মনে হয়।

 

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার সময় সিপিএম-এর মূল স্লোগান ছিল—‘বামফ্রন্ট সরকার সংগ্রামের হাতিয়ার’। ক্ষমতার প্রথম ১৫বছরের পর এই স্লোগান বদলে গিয়ে হয়েছিল—‘বামফ্রন্ট সরকারকে নয়নের মণির মতো রক্ষা করুন’। এখন আমরা যদি এই সময়কালের গভীরে প্রবেশ করি তাহলে দেখব তিনটে ব্যাপার সামনে এসেছিল এই পর্বে। এক, অপারেশন বর্গা। ভূমি সংস্কার কর্মসূচি সামনে রেখে বামফ্রন্ট সরকার বর্গা চাষীদের অধিকার সুরক্ষিত করার কথা বলছিল। ল্যান্ড সিলিং আইন সংশোধন করে জোতদার-ধনী কৃষকের জমি বাজেয়াপ্ত করে বর্গা চাষীদের চাষের ও ফসলের ওপর অধিকার সুনিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭৭-এর পরের ১৫ বছরে এই অপারেশন বর্গার কী পরিণতি হয়েছিল আজ আর তা খুব একটা কেউ আলোচনা করেন না। কিন্তু বাস্তব চিত্র হল ল্যান্ড সিলিং আইন অনুযায়ী মোট কত একর জমি সরকার খাস জমিতে পরিবর্তন করতে পেরেছিল আর তার কতটাই বা ভূমিহীনদের মধ্যে বর্গাকৃত হয়েছিল সে তথ্য অস্পষ্ট থেকে গেছে। বাস্তব চিত্র হল বহু জমির মালিকরা কোর্টে মামলা দায়ের করে অপারেশন বর্গা আটকে দিয়েছিল। এই জমি মালিকদের অধিকাংশই ছিল গ্রামাঞ্চলের সেই সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর মানুষ যারা সিপিএম-এর নতুন নেতা হয়ে বসেছিল। আমূল ভূমি সংস্কারের বিকল্প হিসেবে অপারেশন বর্গা গ্রামীণ শ্রমজীবীদের কত শতাংশকে জীবিকার প্রশ্নে স্থায়িত্ব দিয়েছিল তার গবেষণা আজ জরুরি। এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছু জমি বর্গাদারদের হাতে গেছিল যা একটা বড় সময় জুড়ে সিপিএম-কে তার গ্রামীণ গণভিত্তিকে ধরে রাখতে সহায়তা করেছিল। এখানে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার দাবিদার হিসেবে সিপিএম সর্বত্র গলা ফাঠায়। মনে রাখতে হবে যে এই আইন সিপিএম এরাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগেই কংগ্রেস কেন্দ্রীয়ভাবে প্রণয়ন করেছিল। তাতে সিপিএম-এর কোনো কৃতিত্ব নেই। বরং এপ্রশ্নে নকশালবাড়ির লড়াই অনেক বেশি দাবিদার। তাদের লড়াইয়ের পরে পরেই দেশে ব্যাঙ্ক ও কয়লা শিল্প জাতীয়করণ, পঞ্চায়েতী রাজ আইন ইত্যাদি কিছু আপাত-জনমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল তত্কালীন কেন্দ্রীয় শাসকদল কংগ্রেস। বাম আন্দোলনের পীঠস্থান বাংলায় নকশাল আন্দোলন ভেঙ্গে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএম রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর সরকারী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তার পার্টিতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলা বিকল্প বামশক্তির অভাবে অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে ওঠে। পার্টিতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত এক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করার কাজটি বর্তমান ব্যবস্থায় ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদীরূপে ধরে রাখার পথে এক অন্যতম কৌশল ছিল। ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার পতনের থেকে তারা এই শিক্ষা নিয়েছিল। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনের পরে সিপিএম আর কখনই কোনো গণ-আন্দোলনের সামনের সারিতে এসে দাঁড়ায় নি। নকশালবাড়ি আন্দোলনে তাদের ভুমিকা ছিল দমনকারীর। ১৯৭৭ সালে যে সংসদীয় ক্ষমতা সিপিএম পেল, তার একমাত্র দিশা ছিল দীর্ঘমেয়াদীভাবে ক্ষমতায় থাকার বাসনা। খুচরো সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতাকে আরও নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরা। যার অবধারিত পরিণতি হিসেবে আমরা দেখব কীভাবে সিপিএম নয়া-উদারবাদের কাছে, কর্পোরেট পুঁজির কাছে আত্মসমর্পণ করল।

 

দুই, সিপিএম ক্ষমতায় আসার পর বাংলার শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে এক বিরাট বিপরীত যাত্রা শুরু হল। ১৯৭৭-পরবর্তী সময়ে বাংলার শিল্পাঞ্চলগুলিতে বিশেষত জুট, ইঞ্জিনিয়ারিং, চা ইত্যাদি শিল্পে ও কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নামে সিটুর নেতৃত্বে একধরনের দাদাগিরি চালু হলো। কারখানায় কারা কাজ পাবে, কী ধরনের কাজ করবে, কে মজুরি কত পাবে, কত উত্পাদন করতে হবে—সমস্ত শ্রমআইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এসব কিছুই ঠিক করে দিতে শুরু করল পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা। মালিকপক্ষের সাথে চুক্তির নামে একধরনের বোঝাপড়া হতে শুরু করল যা ইতিহাসে ‘কালাচুক্তি’ নামে কুখ্যাত হয়েছে। শ্রমিকরাই এই চুক্তিগুলিকে কালাচুক্তি বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই চুক্তিতে লাভবান হয়ে পুঁজিপতিরা সিপিএম-এর ট্রেড ইউনিয়ন তথা পার্টির নেতাদের স্থায়ী মাসোহারার বিনিময়ে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে তাদের ন্যায্য পাওনা ও অধিকার থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত করে। মালিকের মাসোহারা পাওয়া হাজার হাজার ট্রেড ইউনিয়ন নেতা তৈরি করেছিল সিপিএম সারা রাজ্যের অগণিত কারখানায়। শ্রমিকদের কোনো ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন গড়ে উঠলে পার্টির পেশিশক্তি অর্থাৎ গুন্ডাবাহিনী আর পুলিশ প্রশাসন দিয়ে তা দমন করেছে। এমনকী আজও অর্থাৎ গত ১০ বছরে এরা যেখানে যেটুকু ক্ষমতা দেখাবার সুযোগ পেয়েছে, শ্রমিকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। হিন্দমোটর, রাজ্যের জুটমিলগুলো, কয়লা খনি, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, চা-শিল্প এমনকী অসংগঠিত ক্ষেত্রেও একই বিশ্বাসঘাতকতা চলছে। আজ বিপক্ষকে ‘চালচোর’ বলে সেই দুর্নীতিগ্রস্ত শ্রমিকনেতাদের অনেককেই সিপিএম-এর ঝান্ডা হাতে পাড়ায়-পাড়ায় মিছিল-মিটিং করতে দেখা যায়। এভাবে সিপিএম অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাজ্যের শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনকে শেষ করে দিয়েছে।

 

তিন, রাজ্যের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে সিপিএম পার্টির আঞ্চলিক শাসনকাঠামো। প্রথম বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি অঞ্চল থেকে যে কোনো ধরনের বিরোধীদের (এমনকী শরিকদেরও) অস্তিত্ব মুছে ফেলতে সবধরনের সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছিল সিপিএম। এলাকার সর্বময় কর্তা (কর্ত্রীর সংখ্যা খুব কম ছিল) হয়ে উঠেছিল আঞ্চলিক কমিটির সেক্রেটারীরা। এলসিএস-রাই থানাগুলোকে পরিচালনা করত। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি পরিবারের ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য চালাত সিপিএম নেতারা। যে কোনো সমালোচনা বা বিরোধিতাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে অত্যন্ত তত্পর সিপিএম বুঝিয়ে দিত তারাই শেষ কথা। এই রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন এরাজ্যের অসংখ্য মানুষ। বীরভূমের মুলুকে, বর্ধমানের করন্দায় গণহত্যা করেছে সংগ্রামী কৃষক আন্দোলনের সাথীদের। কলেজে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএফআই-এর বকলমে নির্মম সন্ত্রাস চালিয়েছে বিরোধী যে কোনো শক্তির ওপর। সেই নৃশংসতা যারা দেখেছেন তারাই তার ভয়াবহতার মাত্রা জানেন। আজ চাইলেই বামপন্থার এই কলঙ্কজনক অতীতকে মুছে ফেলা যাবে না। নিজেদের আমূল না বদলে ফেলতে পারলে এই ‘বামপন্থীরা’ বাংলার বাম আন্দোলনে যে ক্ষতি করেছে, তা অপূরণীয়।

 

১৯৯১ সালে দেশে নয়া-উদারবাদের ব্যবস্থাপনা লাগু হতে শুরু করলে একদিকে সিপিএম সর্বভারতীয় স্তরে এক আন্দোলন আন্দোলন খেলা শুরু করে। বিশ্বায়নের-এর বিরোধিতায় বাত্সরিক ভারত বনধ, দিল্লির ধর্ণার নাটক যেমন একদিকে চলল, তার বিপরীতে আরও জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে নয়া-উদারনীতির প্রয়োগ। ১৯৯৪ সালে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে রাজ্যে যে নয়া শিল্পনীতি ও কৃষি নীতি চালু করা হয়েছিল তার মর্মবস্তু ছিল নয়া-উদারবাদের পথে বুক চিতিয়ে এগোনো। ব্রিটিশ শিল্পপতিদের রাজ্যে লগ্নি করানোর উদ্যোগ দিয়ে সিপিএম বাংলার সম্পদ পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিল।

 

১৯৯৭ সালে জ্যোতি বসুদের ডাকে বাংলায় এসেছিল ম্যাকিনসে। এক বিখ্যাত মার্কিন বহুজাতিক। ইতিমধ্যে পলিটব্যুরো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে বিশ্বায়নের যুগে রাজ্যে বিদেশী পুঁজি স্বাগত। ম্যাকিনসে-কে বলা হল রাজ্যের শিল্প আর কৃষির ভবিষ্যত নিয়ে এগোনোর রূপরেখা তৈরী করে দিতে। তাদের দেখানো শিল্পের ভবিষ্যত পথ ছিল রাজ্য সরকারী সংস্থাগুলোকে তুলে দেওয়া বা বেচে দেওয়া। সরকারী কারখানাগুলো তুলে দেওয়ার জন্য নিয়ে আসা হল ব্রিটিশ সরকারী সংস্থা ডিএফআইডি-কে। তারা দায়িত্ব নিল রাজ্য সরকার পরিচালিত ৫০টির বেশি কারখানা তুলে দেওয়ার। প্রথম দফায় ৩৩টি কারখানা ডিএফআইডি-র গর্ভে গেল। কৃষি আমাদের ভিত্তি আর শিল্প আমাদের ভবিষ্যত–এই স্লোগান প্রথম তোলে সিপিএম। কৃষিতে ম্যাকিন্সের প্রস্তাব ছিল চুক্তি চাষ চালু করা। আজ গোটা দেশে কৃষিকে যেভাবে বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তার পথিকৃত সিপিএম। লাভজনক চাষের প্রলোভন দেখিয়ে বহুজাতিকের হাতে চাষীদের তুলে দেওয়া ছিল এরাজ্যের ঐতিহাসিক বাম শাসনের অপারেশন বর্গার পরিণতি!

 

২০০৩ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্ব কালে দেশের মধ্যে প্রথম ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন আইন’ তৈরি করল বামফ্রন্ট। ২০০৬ সালে নির্বাচন জেতার পর সিঙ্গুরে টাটার কারখানা স্থাপনের জন্য বহুফসলী কৃষি জমি কেড়ে নেওয়া বা নন্দীগ্রামে সালেমদের জন্য এসইজেড বানানোর জন্য কৃষিজমি-বাস্তুজমি কেড়ে নিয়ে ও নির্মমভাবে আন্দোলন দমন করে সিপিএম নয়া-উদারবাদের রূপকার হিসেবে নিজেদের “অগ্রণী” অবস্থান স্পষ্ট করে তুলেছিল।

 

পাশাপাশি দীর্ঘ ৩৪ বছরের ক্ষমতার সুবাদে তারা পার্টিতন্ত্রকে এক অবিসংবাদী ক্ষমতার প্রতীক করে তুলেছিল। মাথায় রাখতে হবে এটা বঙ্গ সিপিএম-এর বিশেষ অবদান! নকশাল আন্দোলন চলাকালীন সিপিএম-এর ‘প্রবাদপ্রতিম’ নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত বলেছিলেন, “পুলিশের রাইফেলে কী ‘নিরোধ’ (কনডোম) লাগানো আছে যে একটাও নকশাল মরছে না?” বামজমানায় বানতলায় নারী নির্যাতন ঘটলে জ্যোতিবাবুর মন্তব্য ছিল, “ওরকম তো কতই হয়!” তাদের প্রিয় শিষ্য বুদ্ধবাবু সিঙ্গুরের সময় বললেন, “ আমরা ২৩৫!” নন্দীগ্রামে গুলিচালনা নিয়ে বললেন, “দে হ্যাভ পেড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন!” আরেক সিপিএম নেতা বিনয় কোঙার নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় বললেন যে আন্দোলনরত কৃষকদের ঘিরে দিয়ে তাদের লাইফ হেল করে দেওয়া হবে। ক্ষমতার ঔদ্ধত্ব একটা পার্টিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সিপিএম তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পার্টির হাতে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে বামপন্থা কীভাবে পরাজিত হয় তা আগেই বিশ্ব দেখেছে। সিপিএম-এর বিপর্যয় সেই ইতিহাসেরই নামান্তর।

 

আজ যারা ‘বামপন্থার ভোট বিপর্যয়ে’ ব্যথিত, তারা কোন লাল ফেরাতে চাইছিলেন সেটা কি তাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট? বিশেষত যারা গত ১০ বছরে বামপন্থী রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেছেন, বামপন্থা মানে আত্মসমর্পণ বোঝেন না, লড়াইয়ের একটা ধরনের আকাঙ্ক্ষা যাদের কর্মকান্ডে প্রতিফলিত—সেই বাম মনোভাবাপন্ন যুবসমাজের কাছে এপ্রশ্নের উত্তর কী?

 

৩৪ বছরের বাম শাসন বাংলার অগণিত শ্রমজীবী মানুষের জীবনে শেষত কী বার্তা এনেছিল তার একধরনের পরিণতি আমরা ২০১১-তে দেখি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এক চটকদারী মোড়কে তৃণমূল তথা মমতা ব্যানার্জীর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। ক্ষমতায় বসেই তিনি রাজ্যে যে কোনো ধরনের ধর্মঘট কড়া হাতে মোকাবিলা করবেন জানিয়ে দেন। একের পর এক অবরোধ-বন্ধ আন্দোলন চালিয়ে যার উত্থান তিনি গদিতে বসেই ১৮০ ডিগ্রী উল্টে ধর্মঘট-বিরোধী হয়ে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই লড়াইয়ের সর্বোচ্চ হাতিয়ার হিসেবে ধর্মঘট শ্রমিকদের কাছে দাবি আদায়ের প্রশ্নে যে গুরুত্বে বিবেচিত হয়, তাকে কঠোর হাতে দমনের পক্ষে মতপ্রকাশ করে তিনি কর্পোরেট পুঁজির কাছে নিজের বার্তা স্পষ্ট করে দেন। মমতা ব্যানার্জী তার গত ১০ বছরের শাসনকালে মৌলিকভাবে নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে কখনই কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেন নি।  তিনি বা তার দল গত ২৩ বছরের বেশির ভাগ সময় জুড়ে ভারতের পুঁজিপতিশ্রেণীর প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিনিধি বিজেপি বা কংগ্রেসের বৃত্তের মধ্যেই ঘোরাফেরা করেছেন। এনডিএ হোক বা ইউপিএ–দুই জমানাতেই তৃণমূল কংগ্রেস ধারাবাহিকভাবে সমস্ত নয়া-উদারবাদী নীতির পক্ষেই থেকেছে। গত ১০ বছরে রাজ্যের ক্ষমতায় থাকাকালীন শিল্প বা কৃষির ক্ষেত্রে তাদের নীতি কখনোই নয়া–উদারবাদের অক্ষ থেকে বেরোয় নি। জ্যোতিবাবু-বুদ্ধবাবুরা যে পথ বামপন্থার মোড়কে তৈরী করেছিলেন, মমতা ব্যানার্জী ‘জনপ্রিয় রাজনীতি’র মোড়কে সেটাই চালিয়ে গেছেন।

 

কর্পোরেট পুঁজির মুনাফার স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য গোয়েঙ্কাদের ‘বঙ্গবিভূষণ’ উপাধিতে বিভূষিত করেছেন। আম্বানিদের হাতে পায়ে ধরেছেন। দেশী-বিদেশী কর্পোরেট পুঁজির কাছে কী করে বাংলাকে আরও লোভনীয় করে তোলা যায় পূর্বসুরীদের দেখানো পথে তিনি সেই যাত্রাকেই আরও মনোহরণকারী করে তুলতে চাইছেন। ২০০৫ সালে এক বণিকসভার সম্মেলনে তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন যে তিনি নীতিগতভাবে শ্রমিকদের ধর্মঘটের বিরুদ্ধে। মমতা ব্যানার্জী বুদ্ধবাবুর এই ‘মহান উপলব্ধি’কে একশ শতাংশই গ্রহণ করেছেন। রাজ্যের যে ৫৬ হাজার বন্ধ কারখানা খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মমতা ব্যানার্জী ভোটে জিতেছিলেন, সেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কী পরিণতি হল তা নিয়ে একটি কথাও তিনি আর উচ্চারণ করেন নি। দুটো বন্ধ কারখানা ডানলপ আর জেশপের কিছু শ্রমিককে মাসে ১০ হাজার টাকা ভাতা দেওয়ার ঘোষণা করে তিনি কর্তব্য সেরেছেন। গরীব কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের জন্য সারাবছরের রোজগারের গ্যারান্টি, ফসলের ন্যায্য দাম, ন্যায্য মজুরি কিছুই জোটে নি গ্রামবাংলায়।

 

পার্ক স্ট্রীট, কামদুনির মতো একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনায় তিনি চূড়ান্ত অসংবেদনশীল আচরণ করেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একের পর এক আন্দোলনকে তিনি প্রথমে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন দাগিয়ে দেবার বা পুলিশ পাঠিয়ে দমন করার। শিলাদিত্য-অম্বিকেশদের জেলে পাঠিয়েছেন যে কোনো বিরোধিতাকে দমন করার মানসিকতা থেকে। যে কোনো বিরোধিতাকে দাগিয়ে দেবার রাজনীতিতে সিপিএম-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। কিষেনজীর হত্যাকান্ড দিয়ে যে নতুন শাসনের শুরু তা একের পর এক গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আঘাত নামিয়ে এনেছে। নোনাডাঙ্গা আন্দোলনকে ‘শহুরে মাওবাদী’ বলে চিহ্নিত করে মিথ্যে মামলায় বস্তিবাসী ও আন্দোলনের কর্মীদের জেলে আটকে রাখা, লালগড় আন্দোলনের সংগঠকদের বিনাবিচারে জেলে বন্দী করে রাখা, ভাঙ্গড় আন্দোলনের সংগঠকদের ওপর কুখ্যাত আইন ইউএপিএ প্রয়োগ, দলীয় নেতানেত্রীদের দুর্নীতি, কাটমানি, দাদা-দিদিগিরি এসবের মধ্যে দিয়ে ২০১১-২০১৯ এর সময়পর্বে এমন এক সন্ত্রাসের রাজত্ব তৈরি হয়েছিল যে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে বিজেপি-র দ্বারস্থ হচ্ছিল। গণতন্ত্র কেড়ে নিয়ে শাসন চালানোর পথে মমতা অনেক ক্ষেত্রেই সিপিএম-কেও ছাপিয়ে গিয়েছেন। মমতা ব্যানার্জীর দল থাকলেও সিপিএম-এর মতো পার্টিতন্ত্র নেই। তাই রাজ্যপাট চালাতে তার হাতিয়ার প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সেটাকে এবারে তিনি আরও কুক্ষিগত করে চালানোর চেষ্টা করবেন বলেই মনে হয়। তাতে আবার স্বৈরতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই।

 

তাহলে বাংলায় ফ্যাসিস্তদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়বে কে? সিপিএম বা তৃণমূল যে এই লড়াই লড়তে পারবে না তার মূল কারণ অবশ্যই নয়া-উদারবাদের কাছে তাদের আত্মসমর্পণ। সিপিএম সংসদীয় লড়াইয়ে সেটা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করে দিয়েছে। আর তৃণমূল তা আগেও করে নি এখনও করবে না। অথচ এই ভোটে যে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিল তারা ফ্যাসিবাদ ও নয়া-উদারবাদ বিরোধী লড়াইয়ের প্রাথমিক উপাদান। এরা রাজ্যের কয়েক কোটি সাধারণ মানুষ যারা একদিকে শ্রমজীবী অন্যদিকে হিন্দু, মুসলমান, দলিত, আদিবাসী, ছাত্রছাত্রী-যুব বা নারী। ফ্যাসিবাদ ও নয়া-উদারবাদ এদের ওপর আগ্রাসন চালিয়েই নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকবে। শাসক দলগুলো সেদিকেই অনুগমন করবে। এর বিপরীতে বিপ্লবী শক্তির কার্যকরী সহায়তায় শ্রমিক আন্দোলন বিকশিত না হলে ফ্যাসিস্তদের বিরুদ্ধে এবং কর্পোরেট পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে কোন মজবুত লড়াই (যা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব তৈরী করতে পারে) গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। সারা দেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রমজীবীদের নানাধরনের অধিকার আন্দোলন বিকশিত না হলে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলন কোন নির্ণায়ক জয় হাসিল করতে পারবে না। অথচ তা নিয়ে খুব বেশি আলাপ-আলোচনা বাংলার প্রগতিশীল ও বিপ্লবী কর্মী-সংগঠকদের মধ্যে হচ্ছে না। এটা একটা বড় রকমের দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। একমাত্র সেপথেই রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বামমনোভাবাপন্ন মানুষ পারবেন দলীয় গন্ডীর সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে ‘অগ্রণী’র শক্তিতে সমাবেশিত হতে। বিকল্প কিছু নেই এছাড়া। ফ্যাসিস্ত ও কর্পোরেট পুঁজিকে উত্খাত করার সংগ্রামই একমাত্র শ্রমজীবীদের মুক্তির দিশা হতে পারে। বাংলা আবার সেই সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে কিনা মনোনিবেশ করতে হবে সেখানে।

 

 

লেখক গণআন্দোলনের কর্মী। মতামত লেখকের নিজস্ব।

 

Share this
Leave a Comment