শপথও নেওয়া হয়নি, খুন-সন্ত্রাস শুরু


  • May 3, 2021
  • (0 Comments)
  • 1360 Views

তৃতীয় তৃণমূল সরকার এখনও শপথ গ্রহণ করেনি। ইতিমধ্যেই শীতলকুচি থেকে সুন্দরবন লাগামহীন সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস দলের তরফ থেকে দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে ওঠা সন্ত্রাসের রাশ টানা দূরে থাক সন্ত্রাসের অস্তিত্বই স্বীকার করা হয়নি। লিখছেন দেবাশিস আইচ

 

৩ মে ফেসবুক পোস্টে অমিতাভ ভট্টাচার্য লিখছেন,

“এই মুহূর্তে সুন্দরবনের হেমনগরে এমকেপি-র বর্ষীয়ান নেতা কমরেড পরিমল মিস্ত্রী ও তার ছেলে শৌভিক মিস্ত্রীর ওপর নৃশংস অত্যাচার চালাল তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। এই ভয়াবহ হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।”  অমিতাভ মজদুর ক্রান্তি পরিষদের নেতৃত্বস্থানীয় কর্মী। ২ মে, ভোটের ফল প্রকাশের পর রাত ১০টায় আক্রান্ত হন সুন্দরবনের হেমনগরে এমকেপির কর্মী বিপ্লব বাউলিয়া। তাঁর বাড়ি ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়।

 

সুদূর সুন্দরবন নয়, ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক সন্ত্রাস। মূল অভিযুক্ত বিপুল ভোট ও আসনে জিতে আসা তৃণমূল কংগ্রেস। আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য বিজেপি। টার্গেট সিপিএমও। এমকেপি-র মতো ছোট সংগঠনও রেহাই পায়নি। কোচবিহারে তৃণমূল কংগ্রেসের উপর বিজেপি সমর্থকদের আক্রমণের খবরও পাওয়া গিয়েছে। রাজ্য জয়ের গন্ধ পেতেই বিরোধী দলের প্রার্থী থেকে কর্মীদের উপর শুরু হয়ে গিয়েছিল আক্রমণ। একাধিক গণনা কেন্দ্রে বিজিত প্রার্থীরা হেনস্থার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সময় যত গড়িয়েছে আক্রমণের ধার বেড়েছে তত। গ্রামছাড়া, পাড়াছাড়া বহু মানুষ অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ অভিযোগ জানিয়েছেন, রাজ্য জুড়ে বিগত ২৪ ঘণ্টায় তাঁর দলের ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট মৃত ন’জন। নির্বাচন পরবর্তী হিংসার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক।

 

তৃতীয় তৃণমূল সরকার এখনও শপথ গ্রহণ করেনি। ইতিমধ্যেই শীতলকুচি থেকে সুন্দরবন লাগামহীন সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস দলের তরফ থেকে দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে ওঠা সন্ত্রাসের রাশ টানা দূরে থাক সন্ত্রাসের অস্তিত্বই স্বীকার করা হয়নি। প্রতিবাদ যেটুকু দেখা যাচ্ছে তা সমাজমাধ্যমে। এমন ঘটনাগুলির নিন্দা করে প্রতিবাদ জানিয়েছে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলন খ্যাত  ‘ফ্যাসিস্ত আরএসএস বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’ মঞ্চ। মঞ্চটি হিংসার অবসানে শাসক দলের ‘তৎপরতা’ দাবি করেছে। তবে, একই সঙ্গে অভিযোগ উঠেছে এই সন্ত্রাসের আবহকে কাজে লাগিয়ে মিথ্যা ভিডিও, ছবি পোস্ট করে পরিবেশ আরও ভয়াবহ করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপির আইটি সেল। সিপিআইএম-এর দলীয় কর্মীদের পক্ষ থেকেই মিথ্যা খবরের নিন্দা করা হয়েছে।

 

ঝড় না উঠলেও একমাত্র সমাজমাধ্যমেই স্পষ্ট ভাষায় তৃণমূল কংগ্রেসের নিন্দা করেছেন গবেষক, অধ্যাপক, সমাজকর্মীরা। গবেষক ও সমাজকর্মী শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত লিখেছেন, “মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, আপনাকে মানুষ ভোট দিয়েছে, বিরোধীদলের কর্মী-সমর্থক, অফিসের উপর আপনার ভাইদের হামলা করার অধিকার দেয়নি। এই আক্রমণ অবিলম্বে বন্ধ করুন।”

 

সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্য লিখেছেন, “টিএমসি স্টপ ভায়োলেন্স। নাউ। ডোন্ট ইনসাল্ট আওয়ার ভোটস।” তার পোস্টে শ্রীমন্ত মিত্রের মন্তব্য, “সো ট্রু… দ্য পিপল অফ বেঙ্গল শাওয়ার্ড দেম উইথ অল দেয়ার লাভ অ্যান্ড হোপ। প্লিজ ডোন্ট ব্রেক দেয়ার ট্রাস্ট।” অধ্যাপিকা জুঁই চক্রবর্তী লিখছেন, “একদম সহ্য করতে পারছি না। বাড়ির সামনে সিপিআইএম অফিস ভেঙেচুরে একাকার।” তিনি আরও লিখেছেন, সিপিএমের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় পার্টি অফিস লাগোয়া এক ‘প্রেসওয়ালা’-কে সপরিবারে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। তিনি ও তাঁর স্বামী হস্তক্ষেপ করলেও শ্রমজীবী পরিবারটি পাড়াছাড়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি অধ্যাপিকা।

 

৩ মে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে প্রকাশিত হিংসা ও মৃত্যুর কয়েকটি ঘটনা এখানে তুলে দেওয়া হলো।

 

# ২ মে রাতে কাঁকুরগাছির শীতলাতলা লেনে বিজেপির ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী অভিজিৎ সরকারকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ করেছে তাঁর পরিবার। অভিযোগ, পুলিশের সামনেই তাঁকে পিটিয়ে মারা হয়। এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। অভিযোগের আঙুল তৃণমূলের দিকে, যা তারা অস্বীকার করেছে।

 

# ২ মে সোনারপুরের প্রথমনগরে অঞ্চলে মেটিয়ারিতে বিজেপি কর্মী হারান অধিকারীকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় দুই মহিলা-সহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।

 

# ৩ মে কোচবিহারে শীতলকুচির বুড়াপঞ্চার হাট এলাকায় তৃণমূল ও বিজেপির সংঘর্ষের মধ্যে  গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় মানিক মৈত্র নামে এক যুবকের। বিজেপির দাবি তিনি দলের সদস্য।

 

#  একই জেলার দিনহাটার পেটলা গ্রাম পঞ্চায়েতের জামাদার বস এলাকায় হারাধন রায় নামে এক বিজেপি কর্মীকে পিটিয়ে খুন করার অভিযোগ উঠেছে।

 

# ৩ মে পূর্ব বর্ধমানের রায়নার সমসপুরে তৃণমূল ও বিজেপির সংঘর্ষের মধ্যে বর্ষীয়ান গণেশ মালিককে পিটিয়ে খুন করা হয় বলে পরিবারের অভিযোগ। তিনি তৃণমূল কর্মী বলে দাবি করা হয়েছে। রাত প্রায় ১১টা নাগাদ সংবাদসংস্থা পিটিআই-এর ট্যুইটে জানানো হয়েছে, ৩ মে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

 

# ৩ মে উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গায় এক আইএসএফ কর্মীকে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

 

# হুগলির ভদ্রেশ্বরে এক বিজেপি কর্মী খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ।

 

# ভাঙড়ে শনিবার দুষ্কৃতীদের গুলিবিদ্ধ হন রফিক মোল্লা। রবিবার তিনি হাসপাতালে মারা যান। রফিক তৃণমূল কর্মী বলে দাবি করা হয়েছে।

 

# যাদবপুরের গাঙুলিবাগানে সিপিএম নেতা খোকন ঘোষ দস্তিদার ও চন্দনা ঘোষ দস্তিদার, রমেন চক্রবর্তী, বাঘাযতীনে গণেশ মজুমদারের বাড়ি লক্ষ্যে করে বোমা ছোঁড়ার অভিযোগ। রবীন্দ্রপল্লি ও রায়পুরে সিপিআইএমের চারটি পার্টি অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ। গান্ধী কলোনিতে সিপিএমের বুথ অফিস ভাঙচুর। রামকৃষ্ণ উপনিবেশে বিজেপি কর্মীদের বাড়ি ঢুকে ঢুকে হামলার অভিযোগ। হুগলির কোন্নগরের মাস্টারপাড়ায় এবং চোপড়ায় সিপিএম পার্টি অফিস ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

 

# ২ মে রাতে হেমনগরে এমকেপি কর্মী বিপ্লব বাউলিয়ার বাড়ি, রান্নাঘর তছনছ করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এছাড়াও এলাকায় দোকান-পাট ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে। ৩ মে সন্ধ্যায় ওই একই দলের কর্মী প্রবীণ পরিমল মিস্ত্রি এবং তার ছেলে শৌভিক মিস্ত্রিকে তৃণমূল কর্মীরা নৃশংসভাবে মারধর করে অভিযোগ করেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।

 

# ২ মে ফলপ্রকাশের মধ্যেই নন্দীগ্রামে ভাঙচুর করা হয় বিজেপির পার্টি অফিস, টাউন ক্লাব। লাগানো হয় আগুন। এবং নন্দীগ্রামের বাজারের হসপিটাল মোড় এলাকায় দোকান-পাট ভাঙচুর, লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। খেজুরি, ভগবানপুর, উত্তর কাঁথি থেকেও একই অভিযোগ এসেছে।

 

# দুবরাজপুরের রেগনা গ্রাম পঞ্চায়েতে, উত্তর ২৪ পরগনার মল্লিকপাড়ায়, মিনাখাঁর সালিপুর পঞ্চায়েত এলাকায় বিজেপি কর্মীদের বাড়ি ভাঙচুর ও লুঠের অভিযোগ উঠেছে। উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে স্থানীয় নেতা সৌমেন দে এবং হাওড়ার বালির ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপির বুথ সভাপতি আক্রান্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ। তাঁদের বাড়িও ভাঙচুর করা হয় বলে খবর। মুর্শিদাবাদের কান্দিতে বিজেপি কর্মীর বাড়িতে বোমা ছোঁড়া হয় বলে অভিযোগ। সোনারপুরের প্রসাদপুরে এক তরুণ বিজেপি কর্মী লাঠির ঘায়ে গুরুতর আহত হন বলে খবর।

 

# বিধাননগরের সুকান্তনগর, দত্তাবাদে আক্রান্ত হন বিজেপি কর্মী সমর্থকরা। নিউটাউনের পাথরঘাটা বালিগুড়িতে এবং ভাঙড়ে তৃণমূল ও আইএসএফের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বেলেঘাটায় এক বিজেপি কর্মীর বাড়ির গ্যারেজে ও একতলায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলে দমকল এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

 

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী সব অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট তৃণমূল নেতৃত্ব।

 

Share this
Leave a Comment