আদিবাসী অধিকার রক্ষা কর্মী স্ট্যান স্বামীকে গ্রেপ্তার করল এনআইএ


  • October 8, 2020
  • (0 Comments)
  • 1783 Views

রাঁচির বাসভবনে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর এনআইএ অশীতিপর স্ট্যান স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছে। মানবাধিকার ও সমাজকর্মী, ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব স্ট্যানকে দীর্ঘ দু’বছর ধরে এলগার পরিষদ মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ৮ অক্টোবর গ্রেপ্তারের দু’দিন আগে সামাজিক আদিবাসী অধিকার নিয়ে তাঁর ভূমিকা নিয়ে এবং এনআইএ তদন্ত সম্পর্কে তার বক্তব্য ভিডিও রেকর্ড করেন। আমরা সেই বক্তব্য প্রকাশ করলাম।

 

এনআইএ-র হাতে আটক হওয়ার দু’দিন আগে ভিডিও রেকর্ড করা ফাদার স্ট্যান স্বামীর সম্পূর্ণ বক্তব্যের বাংলা অনুবাদ:

 

আমি কী পরিস্থিতিতে রয়েছি সেই প্রেক্ষাপট বলে আমি এই ভিডিওটা শুরু করতে চাই। এই মুহূর্তে এনআইএ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তারা আমাকে ইতিমধ্যেই ১৫ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে ফেলেছে এবং তাও তারা এখনও চায় আমি বোম্বে যাই, যার উত্তরে আমি বলেছি আমি বম্বে যাব না, যার কারণ আমি পরে ব্যাখ্যা করব।

 

এবার আমার বিষয়ে এবং ঝাড়খন্ড একটি পৃথক রাজ্য হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে আমার সক্রিয় কাজকর্ম বিষয়ে কিছু কথা। সকলেই এটা চাইতেন, কিন্তু নানা সমস্যা ছিলই। সমস্যাগুলি বিশেষত ছিল উচ্ছেদ, খননের জন্য জমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, দুর্ঘটনা, ছোট ছোট টাউন তৈরি হয়ে যাওয়া, বাঁধ। এবং সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস অর্জনও করা যায় না। হয়তো…সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ তাদের দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং, আমরা এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম কীভাবে তরুণ প্রজন্ম কীভাবে এটাকে জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে নিন ও বিষয়টা লড়ে বুঝে নিক। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই, বেশ কিছু সহায়ক রায় ও আইন পাশ করে ভারতীয় সংসদ। নির্দিষ্টভাবে, পিইএসএ অ্যাক্ট যা গ্রামসভাকে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা দেয়, গ্রামে যাই হোক গ্রামসভার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে ও তার অনুমতি পেতে হবে। অপরটি হল ল্যান্ড অ্যাকুইসিজন অ্যাক্ট যা প্রথম বারের জন্য মানুষের, জমি মালিকদের মতামত/অনুমতি নেওয়াকে, তাদের ভালো রকম ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে চিহ্নিত করে। এগুলি এক রকমভাবে আমাদের সামনে পথ খুলে দিল আর মানুষ তাদের অধিকার দাবি করতে লাগলেন। কিন্তু যেই তারা দাবি জানাতে শুরু করলেন, তাদের স্রেফ জেলে ছুঁড়ে ফেলা হল।

 

তাই, ২০১৭ সালে আমি যাঁদের চিনতাম তাঁদের সকলকে ডাক দিলাম, শুধুমাত্র ঝাড়খন্ডে নয় কিন্তু সব ক’টি আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যে, যেমন মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা আর পশ্চিমবঙ্গ। এভাবেই আমরা একসাথে হলাম, আমরা একটা উদ্যোগ নিলাম যার নাম ‘পার্সিকিউটেড প্রিজনার্স সলিডারিটি কমিটি’ আর এর মাধ্যমে আমরা যা যা করার পরিকল্পনা করলাম – প্রথমত, এই সমস্ত রাজ্যে বিচারাধীন বন্দীদের প্রকৃতি বিষয়ে একটা সমীক্ষা করা এবং তারপর আইনি ব্যবস্থা নিয়ে যাতে ন্যায় পাওয়া যায় তারজন্য যথেষ্ঠ রিসোর্স তৈরি রাখা। এই প্রক্রিয়ায় আমি ঝাড়খন্ড রাজ্যের বিরূদ্ধে ঝাড়খন্ড হাই কোর্টে একটি মামলা করি ৩০০০ জন তরুণ আদিবাসীর তরফ থেকে, যারা জেলে পচছেন। রাজ্যের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির এটাই সূত্রপাত, এবং তারা আমাকে তাদের পথ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল, এবং তার একটা সহজ উপায় ছিল কোনও জটিল মামলায় আমাকে জড়িয়ে দেওয়া। এবং তারপর ঘটনাচক্রে এল এই কেস – ভীমা কোরেগাঁও, একটা জায়গা যেখানে আমি আমার সারা জীবনে কোনওদিন যাইনি – আমাকে সেখানে ফাঁসিয়ে দেওয়া হল, আমাকে দু’বার ‘রেইড’ করা হয়। প্রথমে পুনে পুলিশ করল, তারপর জোর করে কেসটি নিয়ে নিল এনআইএ। তারা গত জুলাই মাসে প্রায় ১৫ ঘন্টা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।  ৫ দিন ধরে আমাকে মোট ১৫ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমার জীবনপঞ্জী ছাড়া তারা পিপিএসসি, পাথালগড়ি কেস, ভীমা কোরেগাঁও আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে তারা আমাকে তথ্যনির্ভর কিছু প্রশ্ন নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে, এবং আমি যতটা সম্ভব পেরেছি তাদের সাহায্য করেছি। এই প্রক্রিয়ায় এমন কয়েক জন মানুষের মুখোমুখি হই, যারা আমার সামনে পেশ করতে শুরু করে এমন কিছু লেখালেখির অংশ যা না কি আমার কম্পিউটার থেকে সংগৃহীত, লেখালেখির এমন অংশবিশেষ যা মনে হতে পারে মাওবাদীরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, এবং কিছু অংশে আমার নামও উল্লেখ করা হয়েছে, তাই তারা জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনাদের কোথায় দেখা হয়েছিল?” আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, “এটা যিনি লিখছেন তিনি কে? এটা কাকে লেখা হয়েছে? কোন্‌ তারিখে এটা লেখা হয়েছে? যা লেখা হয়েছে তাতে কি কোনও সই আছে?” এর কোনও কিছুই ছিল না। সুতরাং আমার সামনে লেখালেখির যা কিছু অংশ পেশ করা হয় আমি তার প্রতিটি অস্বীকার করি ও বলি তা একেবারেই আমার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। একমাত্র সেটি ছাড়া যেখানে আমি ও সুধা ভরদ্বাজ – আমরা দু’জন পিপিএসসি-র যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলাম – আমরা সারা দেশের  সব মানবাধিকার সংগঠনগুলিকে ফোন করেছিলাম, পিপিএসসি কী তা ব্যাখ্যা করেছিলাম এবং তাদের অনুরোধ করেছিলাম আমাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে, কারণ এটা সকলের উদ্যোগ। সুতরাং এই সমস্ত কিছুই আমার কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাই আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল হয়েই রইলাম।

 

আর এখন শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে বোম্বে যেতে বলছে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, যাতে আমি একেবারেই রাজি নই। কারণ…আমার বয়স, আমার কিছু শারীরিক অসুস্থতা আছে, সারা দেশ জুড়ে চলছে ভয়াবঝ মহামারি এবং ঝাড়খন্ড সরকার নিজেই এমন নির্দেশ জারি করেছেন যে বয়স্ক মানুষেরা নাও বেরোতে পারেন বা জনসমক্ষে নাও আসতে পারেন। আমি নিজে ঝুঁকি নিতে চাই না আবার আমি এনআইএ-র পরের জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও রাজি, কিন্তু ভিডিও কনফারেন্স-এর মাধ্যমে। আমি এগুলি তাদের জানাচ্ছি এবং আশা করছি যে তাদের মধ্যে কোনও মানবিকতা জেগে উঠবে এবং যদি তা না হয়, আমি রাজি এবং আমি আশা করব আমাদের সবাই, সবাই যারা আমাকে চেনেন আর আমার সম্পর্কে চিন্তা করেন যার মুখোমুখি হতে হবে তার জন্য প্রস্তুত থাকবেন। আমি এই বলে শেষ করতে চাই, আমার সঙ্গে যা হচ্ছে তা এমন কিছু নতুন ব্যাপার নয় যা একমাত্র আমার সঙ্গেই হচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে যে বৃহত্তর প্রক্রিয়া চলছে এটা তারই অংশ। আমরা সকলেই অবগত যে কিভাবে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, লেখক, কবি, ছাত্রনেতারা – সকলকে জেলে আটক করা হয়েছে, শুধুমাত্র এই কারণে যে তাঁরা তাঁদের বিরূদ্ধ মত জানিয়েছেন বা প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের শাসক গোষ্ঠীর বিরূদ্ধে। সুতরাং, আমরা এই প্রক্রিয়ার অংশ। আসলে এক দিক থেকে আমি খুশি, এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পেরে কারণ আমি একজন নির্বাক দর্শক নই, কিন্তু আমি এর অংশ, এই খেলার অংশ। আমি দাম দিতে তৈরি, তা যাই হোক।

 

আপনাদের মনোনিবেশের জন্য ধন্যবাদ।

 

৮ অক্টোবর গ্রেপ্তারের দু’দিন আগে  রেকর্ড করা ভিডিও :

 

 

Share this
Leave a Comment