কবিতা যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার: কিস্তি ১


  • August 8, 2020
  • (0 Comments)
  • 1788 Views
লাতিন আমেরিকার বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা বড়ো সময় জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে একনায়কতন্ত্র, যার বিরুদ্ধে বহুধারার লড়াই লাতিন আমেরিকার দেশগুলির সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনের অঙ্গাঙ্গী অংশ। আজ যখন আমাদের দেশে হিন্দুত্ববাদী একনায়কতন্ত্রের বাস্তবতা, তখন কীভাবে দেখব আমরা এই আন্তর্জাতিক ইতিহাসকে ? কি শিক্ষা নেব লাতিন আমেরিকার সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের ধারা থেকে ? বিশেষ করে যখন কারারুদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীরা, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিকরা ? যখন রাষ্ট্র, ভারভারা রাও, জি. এন. সাইবাবার মতো কবিদের জেলে পুরে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করতে তৎপর?
 
লাতিন আমেরিকার সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের ধারার তিন কবি – পাবলো নেরুদা, ভিকতোর হারা ও হুয়ান হেলমানকে নিয়ে লিখছেন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। প্রথম কিস্তি – পাবলো নেরুদাকে নিয়ে।

 

কিস্তি ১ – রাষ্ট্রের ক্ষমতা কি পাবলো নেরুদাকে হত্যা করেছিল?

 

পাবলো নেরুদার মৃত্যু হয় পিনোচেতের অধীনে সামরিক অভ্যুত্থান শুরুর বারো দিন পরে, ১৯৭৩ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর। হাসপাতালের ডেথ সার্টিফিকেট অনুযায়ী তাঁর মৃত্যুর কারণ প্রস্টেটের ক্যান্সার এবং অত্যধিক ‘কাকেক্সিয়া’ অর্থাৎ দুর্বলতা ও অপুষ্টি। তারপর দীর্ঘ আটত্রিশ বছর কেটে যায়। ২০১১ সালের মে মাসে মেহিকোর ‘প্রোসেসো’ কাগজে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় নেরুদার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও গাড়ির চালক মানুয়েল আরাইয়া ওসোরিয়ো প্রথম এ নিয়ে আঙুল তোলেন; তিনি বলেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় পিনোচেতের সরকার নেরুদাকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করে। এর পরেই চিলের কম্যুনিস্ট পার্টি ও কবির ভাইয়ের ছেলে রোদোলফো রেইয়েস কবির মৃত্যুর বিজ্ঞানসম্মত তদন্তের দাবি নিয়ে বিচারবিভাগের দ্বারস্থ হন। অনুসন্ধান করে দেখা যায় সান্তা মারিয়া হাসপাতালে, যেখানে নেরুদা মৃত্যুর সময়ে ভর্তি ছিলেন, রুগীর কোনও কাগজপত্রই সংরক্ষিত নেই, যা ওই দেশের নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুর পর ৪০ বছর পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকার কথা। শুধু তাই নয়, ওই বছরে অন্য যে যে হাসপাতালে নেরুদার চিকিৎসা হয়েছিল সেখানেও কোনও নথি সংরক্ষিত হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই কবির ব্যথা উপশমের জন্য শেষ যে ইঞ্জেকশনটি তাঁকে দেওয়া হয় সে সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। বিশেষ করে আরাইয়ার বক্তব্য অনুযায়ী ওই ইঞ্জেকশনটি দেওয়ার পরেই নেরুদার অবস্থার অবনতি ঘটে। এ ছাড়াও হাসপাতালে শেষ মুহূর্তে যা যা ঘটেছিল, তার মধ্যেও অনেকগুলো অসঙ্গতি ধরা পড়ে।

 

১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আইয়েন্দের হত্যা সংঘটিত হলে তাঁর ঘনিষ্ঠ, চিলের অন্যতম বিখ্যাত কম্যুনিস্ট ব্যক্তিত্ব পাবলো নেরুদার বিপদ ঘনিয়ে আসে। তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মেহিকো যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যায় এবং মেহিকোর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লুইস এচেবেরিয়াও প্রস্তুত ছিলেন তাঁর নির্বাসনকে স্বাগত জানাতে। সেই অনুযায়ী নেরুদা তাঁর ইসলা নেগ্রার বাসভবন থেকে রাজধানী সান্তিয়াগোয় চলে আসেন। অনেকে মনে করেন অসুস্থতার কারণেই তিনি এসেছিলেন; কিন্তু আসল কারণ ছিল এই যে, মেহিকোর সরকার প্রেরিত বিমানটি তার জন্য অপেক্ষা করছিল সান্তিয়াগোতে।  কিন্তু বিমানে ওঠার আগেই তাঁর পেটে যন্ত্রণা শুরু হয় এবং ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি সান্তা মারিয়া হাসপাতালে ভর্তি হন। তাই বলে তিনি যে অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, এমনটা নয়। আরাইয়ার বয়ান থেকে জানা যায়, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে তিনি বেশ ফুর্তিতেই ছিলেন। অনেক বন্ধু-বান্ধবরা এসেছিলেন দেখা করতে। চিলেয় মেহিকোর রাষ্ট্রদূত গোনসালো মার্তিনেস এলে তাঁর সঙ্গে তিনি দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন বিমানের খুঁটিনাটি, ভিসা এবং কীভাবে তাঁর পরবর্তী গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ও লেখার খাতা নিয়ে যাওয়া হবে সে ব্যাপারে। ২২ তারিখে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী স্ত্রী মাতিলদে ও আরাইয়া দেশ ছাড়ার আগে শেষ মুহূর্তের দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার জন্য ইসলা নেগ্রায় রওনা হন, ফলে হাসপাতালে তিনি একা, অসুরক্ষিত থেকে যান। তারপর আসে একটি টেলিফোন যা এই সমস্ত পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ নেরুদা নিজেই ফোনটা করেন এবং বলেন যে তিনি যখন হাসপাতালের ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন তখন কয়েকজন এসে তাঁর পেটে একটা ইঞ্জেকশন দেয় এবং তার পর থেকেই তিনি অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেছেন। তাঁরা ছুটে আসেন হাসপাতালে, অনেক কষ্টে কবির দেখা পান, কিন্তু ততক্ষণে জ্বরের প্রকোপে তাঁর দেহ রক্তবর্ণ হয়ে গিয়েছে, ভেজা তোয়ালে দিয়ে জড়ানো তাঁর গা। আরাইয়াকে বলা হয় কিছু ওষুধ কিনে আনতে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরোতেই পিনোচেতের এজেন্টরা তাঁকে ঘিরে ধরে, নেরুদার সম্বন্ধে জানতে চায় ও তাঁর উপর অত্যাচার শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর পায়ে গুলি করে। এর কয়েক ঘন্টা পরেই মারা যান ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি আশাহতের গান’-এর কবি পাবলো নেরুদা। নেরুদা প্রস্টেটের ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু মৃত্যুর আগের দিন যে ব্যক্তি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে আত্মজীবনী ‘আমার বেঁচে থাকার স্বীকারোক্তি’ লেখা শেষ করেন, তাঁর কি করে ‘চরম অপুষ্টি’-তে মৃত্যু হতে পারে? তাছাড়াও সেরহিয়ো দ্রাপের নামে যে ডাক্তারটি নেরুদাকে ইঞ্জেকশন দিয়েছিল তাকে নিয়েও সন্দেহ রয়েছে, কারণ তার সঙ্গে মিলিটারি হাসপাতালের দীর্ঘদিনের যোগসূত্র ছিল এবং নেরুদার মৃত্যুর মাত্র তিন দিন আগে সে এই হাসপাতালে কাজে যোগ দেয়।

 

এখানে মনে রাখতে হবে দুটি কথা: রাষ্ট্রের ক্ষমতা যে কোনও রকম প্রতিবাদকে নিপুণভাবে স্তব্ধ করে দিতে পারে, সুতরাং নেরুদা যে পিনোচেতের একনায়কতন্ত্রের নিশানা হবেন, সেটাই স্বাভাবিক এবং এই একনায়কের শাসনকালে হাসপাতালে গোপনে হত্যার আরও অনেক ইতিহাস বর্তমান। যেমন, ২০১২ সালে প্রাক্তন মন্ত্রী হোসে তোয়ার দেহাবশেষের পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয় যে তিনি আত্মহত্যা করেননি, বরং ১৯৭৪ সালে সান্তিয়াগোর মিলিটারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। তবে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এদুয়ার্দো ফ্রেই মোনতালভার মৃত্যুর সঙ্গে নেরুদার ঘটনার অধিক সাদৃশ্য আছে। ১৯৮২ সালে ফ্রেই যখন একনায়কতন্ত্রের প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন সান্তিয়াগোর একই হাসপাতালে অর্থাৎ সান্তা মারিয়ায় মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করা হত যে তাঁর মৃত্যুর কারণ সেপ্টিসেমিয়া। কিন্তু ২০০৯ সালে এক বিচারবিভাগীয় তদন্তের শেষে দেহাবশেষের পরীক্ষার মাধ্যমে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটিত হয় এবং তা ছিল বিষপ্রয়োগ।

 

২০১১ সালে আরাইয়ার অভিযোগ দিয়ে যে বিচারবিভাগীয় তদন্তের সূচনা হয়, তারই ফলশ্রুতিতে বিচারপতি নেরুদার দেহাবশেষের ফরেন্সিক পরীক্ষার রায় দেন। ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল ইসলা নেগ্রায় সমুদ্রের ধারে কবির সমাধি থেকে তুলে আনা হয় তাঁর দেহাবশেষ। চিলে সহ বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে সেই দেহাবশেষ পরীক্ষিত হয়, যার ফলাফল হিসাবে জানা যায় যে কবির দেহে কোনও রাসায়নিক বিষ প্রয়োগের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে এক বিশেষ ধরণের ব্যাকটিরিয়া পাওয়া গেছে যার সঙ্গে ক্যান্সারের কোনও সম্পর্ক নেই। তার চেয়েও বড় কথা এই ব্যাকটিরিয়ার অধিক সংক্রমণে মৃত্যু ঘটতে পারে। কিন্তু এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে, বিশেষত মৃত্যুর প্রায় ৪০ বছর পরে ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্ত নথি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছান সম্ভব নয়। তাই ক্যান্সারে মৃত্যুর তথ্যই বলবৎ থাকে। তবুও সব সন্দেহের নিরশন না ঘটায়, মৃত্যুর কারণ হিসাবে কোনও তৃতীয় উপকরণের উপস্থিতির সরাসরি প্রমাণ খুঁজে না পেলেও, বিচারক কারোসা কেস সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেননি।

 

রাষ্ট্রের ক্ষমতা তো চিরন্তনকাল ধরে এভাবেই প্রতিবাদী কন্ঠ রোধ করে এসেছে। তাই আজ, বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে যখন দক্ষিণপন্থার জয়জয়কার, সামান্যতম বিরোধিতাকেও যখন রাষ্ট্রদ্রোহের তকমা লাগিয়ে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন সেই দমনের ইতিহাসকে ফিরে দেখা জরুরী হয়ে পড়েছে। যদিও নেরুদার মৃত্যুরহস্য সম্পূর্ণ ইতিহাস হয়ে যায়নি, কারণ অতি সম্প্রতি, গত ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখে ইতালীয় ভাষায় নেরুদার উপর একটি বই প্রকাশিত হয় – নাম ‘নেরুদা হত্যা’ (Delito Neruda), লেখক রোবের্তো ইপ্পোলিতো। এই বইতে নেরুদার জীবনের শেষ দিনগুলোর কথা সবিস্তারে বলা হয়েছে। সাংবাদিক ইপ্পোলিতো কবির অন্তিম সময়ে যাঁরা তাঁর কাছে ছিলেন, তাঁদের সবিস্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তারপর তিনি একভাবে নিশ্চিত হয়ে যান যে কবি মরণাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হননি এবং ওই বিশেষ ইঞ্জেকশনটিই তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিল। তাছাড়াও বিচারবিভাগীয় তদন্তের ভুল-ত্রুটির দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যেমন, ডেথ সার্টিফিকেটে উল্লিখিত আছে চূড়ান্ত অপুষ্টির কথা, অথচ মৃত্যুর সময় নেরুদার ওজন ছিল ৯০ কেজি, যা কোনওভাবেই অপুষ্টি নয়, বরং ওজন আধিক্যের কথাই বলে। এ ব্যাপারে সব থেকে বড় প্রমাণ হল নেরুদার মৃতদেহে পরিহিত বেল্ট। এরকম একটি উপকরণকে ‘পাবলো নেরুদা ফাউন্ডেশন’ নিজেদের অধিকারে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু বিচারপতি কারোসা সে অনুমোদন দেননি বলে লেখক তাঁকে ধন্যবাদ জানান। তবে চিলের বর্তমান সরকারের দিকে তিনি সরাসরি আঙুল তোলেন। তাঁর দুটি প্রশ্ন: নেরুদার কবর থেকে নেওয়া মাটির নমুনা কিভাবে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং সরকার কেন তদন্তের ব্যায় হিসাবে ৪০,০০০ ডলার এখনও বাকি রেখেছে। সব থেকে বড় কথা, নেরুদার একটি দাঁতের মধ্যে যে ব্যাকটিরিয়ার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, তা কখনোই বাইরে থেকে আসা সম্ভব নয়, অর্থাৎ তা ছিল দেহের অভ্যন্তরেই। তবে কেন মৃত্যুর কারণ হিসাবে তৃতীয় কোনও উপকরণ উপস্থিত নেই বলে মেনে নেওয়া হল। ইপ্পোলিতো দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছেন যে এখনও চিলেয় এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা একনায়কতন্ত্রের নস্টালজিয়ায় ভুগছেন – তাঁরা চান না কবির মৃত্যুর যথাযথ তদন্ত হোক। তবে এই বইটি প্রকাশের পর থেকেই নেরুদার মৃত্যু নিয়ে আবার চাঞ্চল্য শুরু হয়েছে। তাই আশা জাগে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা যতই বলীয়ান হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত যা উচ্চারিত হবে তা ক্ষমতার নয়, মানুষের কন্ঠ, জনগণের স্বর।

 

দ্বিতীয় কিস্তি (আমার পৌত্রী বা পৌত্রের প্রতি খোলা চিঠি : হুয়ান হেলমান) এই লিঙ্কে

তৃতীয় কিস্তি (আমার পৌত্রী বা পৌত্রের প্রতি খোলা চিঠি : হুয়ান হেলমান) এই লিঙ্কে

 

লেখক স্পেনীয় ভাষার অধ্যাপক ও অনুবাদক

 

ফিচার ছবি – ফ্যাব্রিজিও ক্যাসেটা

Share this
Leave a Comment