জেল জেলেই আছে। থানা থানাতেই। লালবাড়িই হোক কিংবা…


  • March 15, 2020
  • (2 Comments)
  • 2180 Views

জেল জেলেই আছে। থানা থানাতেই। লালবাড়িই হোক কিংবা নীল-সাদা, ঐতিহ্য হারায়নি কেউ। একটা আপাদমস্তক নিষ্ঠুর ও দুর্নীতিপরায়ণ আইনি ও বিচার ব্যবস্থা যা মূলত দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলিশ-আইনজীবী, পেশাদার সমাজবিরোধী ও রাজনীতিকদের চারটি ঠ্যাঙের উপর – সেখানে মানুষ যে এক মর্যাদাহীন অবমানবে পরিণত হবে এ কথা বুঝতে অতিরিক্ত কোনও জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। তবে, জেল-সাহিত্য বার বার এই মানহীন মানুষদের কালশিটে পড়া, ছাল-চামড়াহীন শরীর ও মনকে আমাদের সামনে হাজির করেছে। জুবি সাহার জেল ডায়েরি’ সেই ইতর ব্যবস্থাটির আর এক উলঙ্গ রূপ। 

 

পর্ব ১

 

আজ থেকে ঠিক দু’বছর আগেকার কথা। সারা দেশজুড়ে তখন তাণ্ডব চালাচ্ছে বিজেপি। ৬ মার্চ ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এসে প্রথমেই লেনিনের মূর্তি ভাঙল ওরা। তারপর শুরু হল চারিদিকে মূর্তিভাঙার পালা। আম্বেদকর থেকে পেরিয়ার, গান্ধী থেকে বিদ্যাসাগর কাউকেই বাদ দিল না। আর তার উল্টোদিকে চলছিল হা-হুতাশের মরাকান্না। সিনেমা হলে যেমন শিফট চলে, তেমন কলকাতায় লেনিনমূর্তির পাদদেশেও বিভিন্ন শিফটে মূর্তিভাঙার প্রতিবাদে মিছিল করে একে একে সবাই ফুলমালা দিয়ে আসছিলেন। অথচ এই ঔদ্ধত্যের দাপটে রাগে-যন্ত্রণায় ছটফটও করছিলেন সবাই।

 

এমনই এক সময় র‍্যাডিকাল-এর পক্ষ থেকে আমরা সামান্য কয়েকজন মিলে খুব দ্রুত স্থির করেছিলাম যে এমন কিছু একটা করা দরকার, যা অন্তত পক্ষে একটা প্রত্যাঘাতের স্পর্ধা রাখে। আমার ঘরে একটা হাতুড়ি ছিল। তখন শিয়ালদায় আমি একটা ক্লাস করতে যেতাম, ফেরার পথে আর একটা হাতুড়ি কিনে এনেছিলাম আর বিশ্বরূপ নিয়ে এসেছিল লাল আর কালো রঙের স্প্রে-পেইন্ট। ছিলাম মাত্র সাতজন। অভিষেক দা, সুরজিৎ, বিশ্বরূপ, সুব্রত, দেবকল্প, দেবজিৎ ও আমি। রাত জেগে আমাদের ঘরে একসাথে মিলে কিছু পোস্টার লিখে ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লাম। দিনটা ছিল ৭ই মার্চ, ২০১৮।

 

কেওড়াতলা শ্মশানের কাছে পৌঁছে দেখলাম তখনও পার্কের গেট খোলেনি। খানিকটা দূরত্বে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর যখনই দেখলাম গেটটা খুলেছে, আমরা পোস্টার হাতে শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেলাম পার্কের দিকে। পার্কের ভেতরে ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মূর্তি। বাংলা ভাগ করার অন্যতম কারিগর আরএসএস এবং বিজেপির কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমাদের অজানা নয়। মূর্তির গায়ে হাতুড়ির দু’চার ঘা পড়তেই স্থানীয় তৃণমূলের দাদারা আমাদের ঘিরে ফেললেন, ততক্ষনে শ্যামাপ্রসাদের মুখ কালো হয়ে গেছে। স্থানীয় দাদারা আমাদের পোস্টার ছিঁড়ে দেয়, মোবাইল কেড়ে নিতে যায় এবং পাশেই পড়ে থাকা ইটের গাদা থেকে ইট তুলে মারতে আসে, এমনকি মেরে ফেলে রেখে দেওয়ার হুমকিও দেয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন একটু ঠান্ডামাথার নেতা ছিলেন, যাঁরা বুঝেছিলেন এটা কোন স্থানীয় ইস্যু নয় এবং আমাদের মারলে তাঁদের বাস্তবিকই কোনো লাভ নেই। তাঁরাই বোধ হয় থানায় খবর দেন। প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট এই ধ্বস্তাধস্তি চলার পর কালীঘাট থানার পুলিশ আমাদের তুলে নিয়ে যায়।

 

ঘটনার খুব সামান্য অংশই আমি ভিডিও করতে পেরেছিলাম এবং পুলিশ গাড়িতে উঠেই ফোনটা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। অনেক কসরত করে কিছুক্ষণ ফোনটা আটকে রাখতে পেরেছিলাম এবং থানায় পৌঁছেই খুব জোরে বাথরুম পেয়েছে বলে প্যান্টির ভেতরে ফোনটা কোনোমতে লুকিয়ে বাথরুমে গিয়ে মাত্র একজনকে সেটা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে পেরেছিলাম এবং আমরা অ্যারেস্ট হয়েছি কালীঘাট থানায় – শুধুমাত্র এইটুকু খবর জানাতে পেরেছিলাম। তখনও বাইরে কেউ কিচ্ছু জানত না। তারপর ধীরে ধীরে সবাই সবকিছু জানতে পারে। এরপর আমাদের ব্যাগ, ওয়ালেট, মোবাইল, বেল্ট, হাতুড়ি, স্প্রে-পেইন্ট সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে নেওয়া হয়।

 

থানায় আমরা ঢুকেছি সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ। সারাদিন বসিয়ে রেখে অনেক জল্পনা-পরিকল্পনার পর দুপুর তিনটে নাগাদ আমাদের অফিশিয়ালি অ্যারেস্ট করা হল। তারপর থানা থেকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে, সেখানে মেডিকাল চেকআপ করিয়ে আলিপুর কোর্ট। এরপর শুরু হল আমাকে আলাদা করার পর্ব, কারণ মেয়ে হিসেবে আমি একাই ছিলাম। আমায় নিয়ে যাওয়া হল মেয়েদের লকআপে। লকআপের ভেতরের দেওয়ালের রঙ কী ছিল তা আজ আর মনে নেই, তবে মাটি থেকে গলা পর্যন্ত ছিল পান আর গুটখার প্রলেপে ঢাকা। ভেতরে জল নেই, অনেক চেঁচামেচি করে একটু জল পেলাম কিন্তু জলটা মুখে দিতেই বুঝতে পারলাম বৃথাই এতক্ষণ চেঁচামেচি করলাম, বরং থুতুটা বাঁচিয়ে রাখলেই ভালো হত, একটু জিভটা ভিজে থাকত, কারণেই ওই জল খাওয়া সম্ভব ছিল না।

 

লকআপে এক শীর্ণকায় বৃদ্ধার সাথে আলাপ হল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কেস?’, বলল, ‘মার্ডার কেস’, ‘কেন, কাকে, কীভাবে মারলে?’ উত্তর এল, তাঁর বাড়ি মেটিয়াবুরুজ এলাকায়, স্বামী মারা গেছে অনেকদিন, ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিয়ে হয়েছে কয়েকজনের, একজনের সাথে প্রেম হয়েছিল, নিজের ছেলেমেয়েরা বারণ করেছিল তবুও তিনি শোনেননি, বলেছিলেন ‘শাদি করে সংসার করে তোরা তো চলে যাবি, আমি কাকে নিয়ে থাকব?’ তাঁর সেই প্রেমিকটি বিবাহিত ছিলেন, কথা দিয়েছিলেন তার বউকে ছেড়ে তাকে নিকাহ করবে, কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও করছিলেন না, উপরন্ত বৃদ্ধার মেয়ের বিয়ের জন্য যে টাকা জমানো ছিল তাও একদিন নিয়ে নেন, বৃদ্ধা তাকে চাপ দিতে থাকেন, একদিন বলেন আজই তোকে নিকাহ করতে হবে, সে রাজি হয়নি, মাথা গরম করে এক ধাক্কা মারেন, মাথায় চোট পেয়ে সেখানেই মৃত্যু হয় তার, আগামী জীবনটা এই বৃদ্ধাকে জেলেই কাটাতে হবে। বাড়ির লোকের যা আর্থিক অবস্থা তাতে তাদের পক্ষে কেস দেখা সম্ভব নয়।

 

তার ছোট ছেলে মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসে, সেদিনও এসেছিল, একটা বাপুজি কেক নিয়ে এসেছিল, পরম ভালোবাসায় তার অর্ধেকের বেশি ভেঙে আমার দিকে তিনি এগিয়ে দিলেন। পানগুটখার গন্ধে ভরপুর ওই ঘরে তাঁকে আমার পরম আত্মীয় বলে মনে হচ্ছিল। উনি কিছুক্ষণ বাদে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘বিটি, কোনও ভয় নেই, জেলে আসলে আমার সাথে দেখা করবি।’

 

আবার আমি একা হয়ে গেলাম। মাঝে আমাদের আইনজীবী অমিতাভ কুন্ডু এবং এপিডিআর-এর রাংতাদি এসে জানিয়ে গেলেন দু’দিনের পুলিশ কাস্টডি হয়েছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর কোর্ট থেকে বার করে গাড়িতে তোলা হল। বাইরে প্রিয়জনদের চোখ যখন দেখি ছলছল করছে, তখন বুকের ভেতরটায় যে কেমন হচ্ছিল তা ঠিক বোঝাতে পারব না, শ্লোগান দিচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু গলা ধরে আসছিল। আলিপুর থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি রওনা দিল লালবাজারের দিকে।

 

অপেক্ষা করতে লাগলাম নতুন এক অভিজ্ঞতার জন্য…

 

 পর্ব দুই

 

কালীঘাট থানা থেকে একজন বয়স্কা মহিলা পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন। লালবাজার পর্যন্ত তিনি আমার সঙ্গেই ছিলেন। কোর্ট থেকে গাড়ি লালবাজারে ঢুকলেই জিজ্ঞেস করা হয়, ‘কটা আসামি এল?’ আমার সাথে থাকা ওই মহিলা কনস্টেবল তার সমস্থানীয় পুলিশদের সাথে সাথেই বলে দিলেন, ‘এরা আসামি নয়, এরা পড়াশোনা করে, ভালো ছেলেমেয়ে’। অমনি দেখলাম পুলিশের আচরণ একটু বদলে গেল। লালবাজারে যিনি আমাদের আইও ছিলেন অর্থাৎ ইনভেস্টিগেটিং অফিসার, তিনি আমাদের সবার ফোনের পাসওয়ার্ড চাইলেন, আমরা না দিতে চেয়ে অনেকক্ষণ তর্কাতর্কি চালালেও শেষমেষ বুঝতে পারলাম টেকনোলজির সাহায্যে ওটা বের করে নেওয়া ওদের কাছে খুব বড় কোনো ব্যাপার নয়। অবশেষে সেটা দিতে হল। আমার কানে রুপোর দুল ছিল, তাও জমা দিতে হল। তারপর শুনলাম সার্চ করা হবে। সাধারণত সবাইকে পুরো জামাকাপড় খুলে সার্চ করা হয়, যদিও আমাদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি তা করা হল না, আমাকে একটা পাতলা ওড়নার আবরণ অ্যালাউ করা হয়েছিল। তারপর নিয়ে যাওয়া হল লকআপে।

 

লালবাজার লকআপে যারা কখনো গেছেন, তাঁরা জানেন সেখানে সূর্যের আলোর রেখা দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। লকআপে ঢোকার আগে আমাকে ওড়না বাইরে খুলে রাখতে বলা হল, সুইসাইড আটকাতে নাকি এই ব্যবস্থা! লকআপের ভেতরেই বাথরুম, যদিও সেখানে কোনো দরজার ব্যবস্থা নেই, পুরোটাই খোলা, শুধু তিনদিক থেকে বুক অবধি দেওয়াল আছে। বাথরুমের জলই খাবার জল, বাথরুমের মগেই তা খেতে হবে। কোনো ফ্যান নেই, কিন্তু চার কোণে চারটে সিসিটিভি আছে। শুধুমাত্র বাথরুমের প্যানের জায়গাটা ছাড়া পুরোটাই সিসিটিভির আওতায় পড়ে, তাই মেয়েরা স্নান করত প্যানের ওপর দাঁড়িয়েই। ঘরটায় প্রচন্ড মশা, বন্দিপিছু একটা শতছিন্ন কম্বল দেওয়া হয়, যেটা গায়ে দিলে চুলকানি নিশ্চিত। কনস্টেবলরাই ইশারায় বলে দিতেন ওগুলো গায়ে না দিতে। দরজার কাছে সব সময় দুজন মহিলা পুলিশ বসে থাকেন। দিনে একবার ডাক্তার আসেন, প্যারাসিটামল ছাড়া তার কাছে কোনো ওষুধ থাকে না এবং যেহেতু লকআপে মার প্রায় সবার কপালেই জোটে, তাই প্রায় জোর করে ডাক্তারের সামনেই প্যারাসিটামল সবাইকে গেলানো হয়, যাতে মেডিকেল টেস্টে তেমন কিছু ধরা না পড়ে। কী ওষুধ দেওয়া হচ্ছে সেটা কাউকে বলা হয় না শুধুমাত্র অন্ধবিশ্বাসে গিলতে হয়।

 

যখন আমি লকআপে ঢুকলাম তখন ঘরটা ফাঁকা, ভাবলাম হয়তো একাই কাটাতে হবে কিন্তু কিছুক্ষণেই ভুলটা ভাঙল। একজন এলেন কাঁদতে কাঁদতে, তাঁরও প্রথমদিন, দু’জন দু’জনকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম তার বাড়ি জয়নগরে, ঢাকুরিয়ার কাছে এক বাড়িতে তিনি কাজ করতেন, সেখানে তার মতোই আরো ছয়জন কাজ করে, বাড়ির মালিক খুব সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, একটা সোনার আংটি খুঁজে পাচ্ছিল না, শুধুমাত্র সন্দেহের বশে এই মহিলাকে ধরে আনা হয়েছে, পুলিশ ঘুষ পেলে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, দিতে পারেনি বলে এই অবস্থা।

 

কিছুক্ষণ আলাপচারিতা এভাবে চলার পর দেখলাম, দুইদল মহিলা এলেন। তারা বেশ ফুর্তিতেই আছেন বলে মনে হলো, মানে বেশ কয়েকদিন আগে এসেছেন। প্রথম দলে ছিলেন আটজন ছিনতাইকারী, যারা একসাথে কাজ করেন, একজন পকেটমারের সঙ্গী, একজন বারড্যান্সার আর দ্বিতীয় দলে ছিলেন পাঁচজন, তারা একই পরিবারের। ছিনতাইকারী দলে যারা ছিলেন তারা রাস্তাঘাটে বাস-ট্রেনে কাজ করেন। এদের মধ্যে কেউ একজন মুখে রুমাল বা অন্যকিছু নাকে গন্ধ শুঁকিয়ে সাময়িক অজ্ঞান করে দেন, তারপর একজন তাকে ধরতে যান, একজন ব্যাগ বা সোনার জিনিসটা নিয়ে বেরিয়ে যায়, আর বাকিরা পাবলিক ডেকে চোখেমুখে জল দিয়ে সারিয়ে তোলেন। দিনে এদের মাথাপিছু গড় আয় তিনশো থেকে পাঁচশো টাকা, এরা দক্ষিণী কোনো ভাষায় নিজেদের মধ্যে মাঝেমধ্যে কথা বলতেন। একটি মেয়ে, একুশ বাইশ বছরের হবে, স্বামী ছেড়ে চলে গেছে, বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করেছে, আমায় বলল ‘কাজ না করলে খাব কী বলো দিদি, লেখাপড়া জানি না, ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়, বাপের বাড়িতে মাকেও দেখতে হয়, কী কাজ করব বলো তো, এ লাইনে আসতাম না, যখন খুব অভাব ছিল তখন পাড়ার এক দিদি খুব সাহায্য করেছিল, সেও এই টিমে আছে, পরে ওর মাধ্যমেই একাজে ঢুকি, এখানে তো কোন রিস্ক নেই, কাজ করলে টাকা পাব, শুধু দু’বছর ছাড়া পুলিশ একবার তুলবে, এই আটজনে পাঁচলাখ দিতে হবে, পুলিশের সাথে সেটিং আছে, সামনের দু’বছর আর গায়ে হাত দেবে না, চোদ্দদিনে ছাড়া পাব, টাকাটা টিমলিডার দেবে, আমাদের কিছু দিতে হবে না, শুধু কষ্টের মধ্যে একটু মার খেতে হবে এই যা!’ অবাক হয়ে শুনতাম ওদের কথা।

 

যে মেয়েটি পকেটমার, ও একটি মেয়েকে ভালোবাসে। আমি যাদবপুরের শুনে খুব উৎসাহিত হয়ে বললো, ‘তোমরা নাকি আমাদের জন্য আন্দোলন কর, আমি কোনদিনও বিয়ে করতে পারব?’ ওর বাবা একটা হোটেলে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করত হঠাৎ মারা যায়, টাকা পয়সা অনেক পাওনা ছিল কিন্তু সেসব কিছুই ফেরত পায়নি, সোনারপুরের দিকে ভাড়া বাড়িতে থাকে, মা খুব অসুস্থ, মাসে বারোশো টাকার ওষুধ লাগে। অনেক কাজ খুঁজে হন্যে হয়ে একদিন দুপুরবেলা হতাশ হয়ে বসেছিল পার্কসার্কাস ময়দানে, সেই অবস্থায় ওর পাশে এসে একজন বসে, চিকেনরোল খাওয়ায়, হাতে কিছু টাকাও দেয় এবং কাজ খুঁজে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। সেই ব্যক্তির সাথেই ও কাজ করে। বাসে পকেটমারি করে। সে পার্সটা তোলে আর ওকে হ্যান্ডওভার করে। পার্সে যত টাকাই থাকুক না কেন ওর মজুরি দিনে আড়াইশো টাকা। পুলিশের এক লাখ টাকাও ওকে দিতে হবে না, শুধু মার খেতে হবে। সেই নিয়ে অবশ্য ওর কোনো চিন্তা নেই, ওর শুধু একটাই চিন্তা ভালোবাসার মানুষটিকে সারা জীবন কাছে রাখতে পারবে তো? ওর প্রেমিকা অবশ্য জানে না যে ও এই কাজ করে। এই কয়েকদিন ফোন করতে পারছে না বলে বেচারার খুব মন খারাপ ছিল।

 

যে মেয়েটি বারে ড্যান্স করত, তার প্রেমিকের বন্ধু কোনো ডাকাতি কেসে জড়িয়ে পড়েছিল, পুলিশ তাদের বাড়িতে রেইড করে, সেদিন মেয়েটি বয়ফ্রেন্ডের সাথে ওই বন্ধুর বাড়িতে ছিল, তাই ওদেরকেও তুলে এনেছে। মেয়েটির বা ওর বয়ফ্রেন্ডের নামে কোন কেসই নেই, তবু পুলিশ বলেছে দুজনের পঞ্চাশ হাজার না দিলে কেস দিয়ে দেবে। প্রসঙ্গত, এই টাকার ডিলটা করেন ঘড়িবাবু অর্থাৎ ওয়াচ অফিসার, মারের দায়িত্বে অন্য একজন। তো সেই ঘড়িবাবু মেয়েটিকে প্রস্তাব দিয়েছে ওর সাথে যদি মেয়েটি শোয় তাহলে টাকা লাগবে না, মেয়েটি খিস্তি দিয়ে চলে এসেছে। মেয়েটা ছিল বড্ড সুন্দরী আর রেগে গেলে ওকে আরো সুন্দর দেখাত। এখন টাকার ব্যবস্থা করছে যদি মিটিয়ে বেরোতে পারে ওরা দু’জনে একসাথে।

 

এই পুরো দলটার সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভালো হয়ে গেছিল। খুব অল্প সময়ে অনেক গল্প করে ফেলেছিলাম। যদিও গোল করে বসে গল্প করা বারণ ছিল, নাহলে সিসিটিভিতে দেখা যাবে। বসে দূর থেকে অথবা শুয়ে কেউ কারোর দিকে মুখ না ফিরিয়ে, কোনও এক্সপ্রেশন না দিয়ে কথা বলতে হত। এরা দুপুর বেলায় চলে যেত, বেরিয়ে ক্যান্টিনে খাবার খেত, তারপর ঘড়িবাবুর ঘরে গিয়ে মার খেত, রোজ এই রুটিন ছিল। ক্যান্টিন থেকে ফেরার সময় মাথায় শ্যাম্পু লাগিয়ে আসত। কারণ শ্যাম্পুর পাতা ভেতরে আনা বারণ ছিল। ক্যান্টিনে যা খরচ হত সব ওই ঘুষের টাকার সাথেই অ্যাডজাস্ট করা হত। একদিন ছিনতাইকারী দলের ছোট মেয়েটি মাথায় শ্যাম্পু লাগিয়ে এনে আমার মাথায় মাথাটা ঘষে দিয়েছিল। ওই আমায় শিখিয়েছিল যে খাবার সময় যে লবণটা দিত, সেটা থালা থেকে সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে জামার খুঁটে বেঁধে নিতে, কারণ ওটা টুথপেস্টের কাজ করবে। লকআপে যারা খেতে দিতেন তারা কেউ কোমর বাঁকাতেন না, থালার সামনে নিয়ে জুতো পরে হেঁটে বেড়াতেন এবং একটুও না ঝুঁকে ওপর থেকে খাবার থালার ওপর ফেলে দিতেন। মেনু ছিল পোকা চালের ভাত আর আধ সেদ্ধ ডাল। দুপুর বেলায় সবাই যখন চলে যেত তখন আমি একা গোটা ঘরটায় পায়চারি করতাম, কতবার যে চক্কর মারতাম তার ঠিক ছিল না, চাইলে ঘুমাতে পারতাম, কিন্তু ঘুম আসত না, অনেক ওপরে একটা ঘুলঘুলি ছিল, সেখানে একটু আলো আসত, যেটা দিয়ে আমি আপ্রাণভাবে বোঝার চেষ্টা করতাম বেলা ঠিক কতটা হল। গেটে সিকিউরিটি গার্ড যিনি ছিলেন, তিনি আমাকে খুব ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে দুটো রুটি আর চিনি দিয়েছিলেন। উনি পেপার পড়ছিলেন, সেটা দেখে আমার খুব লোভ হচ্ছিল, কিন্তু সেটা অ্যালাউড ছিল না, তাই উনি শুধু বলেছিলেন ‘তোমাদের কাজটা নিয়ে অনেক খবর বেরিয়েছে, হইচই শুরু হয়ে গেছে’, সেই সময় ওইটুকু খবর যে কি শান্তি দিয়েছিল তা বোঝাতে পারব না।

 

লকআপের দ্বিতীয় দলটির কথা বলি। ওরা একই পরিবারের দুই বোন, একজন ওদের ভাইয়ের স্ত্রী, ওদের মাসি এবং বাড়ির কাজের লোক। এদের বাঘাযতীনের কাছে বিশাল দোতলা বাড়ি। এরা সবাই একটা ব্যবসার সাথে যুক্ত। বিভিন্ন কমবয়সি মেয়েদের যারা এসকর্ট হতে চায় বা না চাইলে তাদের রাজি করিয়ে বিভিন্ন হোটেলে বাবুদের কাছে পাঠানো হয় এবং এদের বাড়িটিও সেই কাজেই ব্যবহৃত হয়। এদের সাথে পরিবারের ছেলেরাও আছে, এমনকি গাড়ির ড্রাইভারও আছে। মেয়ে দুটির মা এইডস্ আক্রান্ত, খুব অসুস্থ সেজন্য জেলে আছেন। এরা সবাই নিজেদের মধ্যে ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলত। ছোট মেয়েটি লরেটোতে পড়ে। এদের পোশাক, গায়ের রং, মাথার চুল, অত্যন্ত পলিশড, লকআপের মধ্যে ভাত প্রায় খেত না বললেই চলে, ক্যান্টিনে ভালোমন্দ খেয়ে আসত, প্রচন্ড গালিগালাজ করত, আমি যে দলটার সাথে থাকতাম তাদের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করত, শুধুমাত্র আমার সাথে ভালো ব্যবহার করত এবং বোঝানোর চেষ্টা করত যে ওরা আসলে নির্দোষ, ওদের ফাঁসানো হয়েছে। এদের লইয়ারের সাথে আপাতত ৫০ লাখের ডিল হয়েছে, সেটা এদের কাছে তেমন কোনো ব্যাপার ছিল না। ক্লাস সেভেনের একটি মেয়েকে এরা হোটেলে পাঠায়। মেয়েটির এই কাজে ওটাই ছিল প্রথম দিন, ডিল হয়েছিল বারো হাজার টাকার আর মেয়েটিকে ওরা দিয়েছিল সাতশো টাকা। ঝাঁট জ্বলে গিয়ে মেয়েটি থানায় খবর দিয়ে দেয়, ব্যস পুরো চক্র ধরা পড়ে যায়।

 

লকআপে বারড্যান্সার মেয়েটিকে এরা খুব উত্যক্ত করতো, চরিত্র নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করত, একদিন প্রচন্ড ঝাঁঝ নিয়ে মেয়েটি স্পষ্ট বলেছিল ‘তোদের মত কচি মেয়েদের ব্যবসায় তো নামাই না, হ্যাঁ বারে নাচ করি, কিন্তু আমার শরীরে কেউ হাত দিয়ে দেখুক, আমি কী তা ঘড়িবাবু টের পেয়ে গেছে, তোদের খুপড়িতে কিছু আছে নাকি যে তোরা বুঝবি?’ আগেই বলেছিলাম মেয়েটিকে রেগে গেলে খুব সুন্দর দেখাত, এই কথাগুলো বলার সময় ওর চোখেমুখে যেন একটা আভা বেরিয়ে আসছিল, সেটা আর কিছু না, আত্মসম্মানবোধ, কী মারাত্মক ছিল তার তেজ! লকআপের দিনগুলো এভাবেই কেটে গেল, এরপরের অভিজ্ঞতা ছিল আরও অন্যরকম।

 

… (ক্রমশঃ)

 

জুবি সাহা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিকস এন্ড ইনস্ট্রুমেনটেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী, বর্তমানে একজন রাজনৈতিক কর্মী। পরের পর্ব এই লিঙ্কে

Share this
Recent Comments
2
Leave a Comment