আজিজুরের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক ছাত্রছাত্রীদের


  • February 12, 2020
  • (0 Comments)
  • 2058 Views

বইমেলার ঘটনার প্রেক্ষিতে ছাত্র আজিজুর রহমানকে গতকাল রাতে জিজ্ঞাসাবাদ করার নামে থানায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল বিধাননগর পুলিশ আজ সকালে আজিজুরকে অ্যারেস্ট করে কোর্টে তোলা হয় ন’দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে কোর্টগ্রাউন্ডজিরোর রির্পোট।

 

গত শনিবার ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় এনআরসি এনপিআর সিএএ বিরোধী প্রচার চালানোর সময় প্রচারকারী ছাত্রছাত্রীদের উপর ৩৭৬ নং স্টল  “জনবার্তা” (বিজেপির স্টল) থেকে যে গুন্ডাবাহিনী হামলা চালায় তাকে সামাল দিতে বিধাননগর পুলিশ ছাত্রছাত্রী সহ গণআন্দোলনের কর্মীদের উপর চড়াও হয়ে তাদের কয়েকজনকে মেলার কন্ট্রোলরুমে এবং কয়েকজনকে বিধাননগর ইষ্ট ও নর্থ থানায় তুলে নিয়ে যায়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় পুলিশ এনআরসি এনপিআর সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রী সহ মানবাধিকার কর্মী, গণআন্দোলনের কর্মীদের মাটিতে ফেলে পেটাচ্ছে। ছাত্রীরা যৌথ হেনস্থার অভিযোগ জানাতে গেলে এফআইআর নেওয়া হয় না, উল্টে মারধর করা হয় প্রতিবাদীদের। এরপর থানার সামনে ও বইমেলায় লাগাতার বিক্ষোভের মুখে পড়ে সেদিনই পি.আর বন্ডে সই করিয়ে প্রতিবাদকারীদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। এই পর্যন্ত আমরা সকলেই মোটামুটি নিউজ চ্যানেল, সমাজমাধ্যম, প্রত্যক্ষ্যদর্শীর বক্তব্যের মাধ্যমে জেনেছি।

 

কিন্তু গতকাল অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার, বাংলার ছাত্রছাত্রীদের বানানো একটি ফোরাম “Students Against NRC NPR CAA”-এর একজন ছাত্র আজিজুর রহমানকে সন্ধে নাগাদ তার রাজারহাটের বাড়ি থেকে তুলে যায় বিধাননগর পুলিশ। আজিজুর প্রথমে ওয়ারেন্ট আছে কি না জিজ্ঞেস করলে পুলিশ তাকে জানায় যে তাকে (আজিজুরকে)  অ্যারেস্ট বা ডিটেইন করা হচ্ছে না, শুধুমাত্র জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর বিধাননগর নর্থ থানায় আজিজুরকে নিয়ে আসলে “Students Against NRC NPR CAA” ফোরামের ছাত্রসদস্যরা,  মানবাধিকার সংগঠন APDR এর কর্মীরা সহ আরো আন্দোলনকারীরা সেই রাতেই পৌঁছন থানার সামনে। বার বার পুলিশের কাছে তারা জানতে চান কেন আজিজুরকে তুলে আনা হয়েছে। কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি পুলিশের তরফ থেকে। এরপর মধ্যরাত নাগাদ পুলিশ জানায় যে “যা হওয়ার কাল সকালে (১২ ফেব্রুয়ারি) হবে। আজিজুরকে আজ রাতে ছাড়া যাবে না।” সেই মতোই আজ সকাল ৮টা থেকে ছাত্রছাত্রী, মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী সহ আন্দোলনকারীরা থানার সামনে জড়ো হন। বেশ কিছুক্ষণ বাদে পুলিশ তাদের জানায় যে আজিজুরের নামে মোট ৯টি ধারায় (যার মধ্যে ৭টি জামিন অযোগ্য ধারা) পুলিশ FIR করেছে এবং অ্যারেস্ট করেছে। এরপর আজিজুরকে বিধাননগর কোর্টে (ময়ুখ ভবন) তোলা হয়। প্রথমে ১২ দিনের জেল হেফাজত  ঘোষণা করে। পরে আন্দোলনকারী এবং উকিলের চাপে সেই মেয়াদ কমিয়ে ৯ দিন করা হয়। এরপরের হিয়ারিং ২১ ফেব্রুয়ারি।

 

যে যে ধারায় আজিজুরের নামে অভিযোগ আনা হয়েছে ১৮৬, ৩৫৩, ৩৫৪, ৩৩২, ৩৩৩, ৪২৭, ৫০৬, ৩৪ জেপিসি এবং ৩০ পিডিপিপি। অর্থাৎ সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা, যৌন নিগ্রহ, সরকারি কাজে বাধা প্রদান, পুলিশি নিগ্রহ ইত্যাদি।

 

কিছু প্রশ্ন আগেরদিনের থেকে যায়। প্রথমত, ৮ তারিখের ঘটনায় পুলিশের হাতে বিনা দোষে মার খেতে হয়েছিল এই আজিজুর রহমানকেই। দ্বিতীয়ত, তারপর পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে গেলে সেই অভিযোগ কেন নেওয়া হল না পুলিশের তরফ থেকে? তৃতীয়ত, বইমেলায় বিজেপির স্টল থেকে যে ৪০-৫০ জন গুন্ডা বেরিয়ে এসে ছাত্রীদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি, পেটে লাথি, মাটিতে ফেলে লাথি চালাল তার বিরুদ্ধে ছাত্রীরা যৌন নিগ্রহের অভিযোগ জানাতে গেলে অভিযোগপত্র না নিয়ে উল্টে প্রতিবাদকারীদের উপর চড়াও হল কেন পুলিশ? অথচ বিজেপি কর্মীদের “জামাই আদরে” বইমেলা থেকে যেতে দেওয়া হল কেন? চতুর্থত, বইমেলা আয়োজন করে ” সেই পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড” কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে কোনোরকম খবরটুকুও দেওয়া হল না কেন পুলিশের তরফ থেকে? গিল্ডের মতামত ছাড়াই পুলিশ নিজের হস্তক্ষেপে কীভাবে মেলা প্রাঙ্গণে বইমেলায় অংশ্রগহণকারীদের ‘আটক’ করতে পারে? বইমেলাতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বহু রাজনৈতিক দল, গণআন্দোলনের ব্যক্তিবর্গ, অপর্ণা সেন, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় প্রত্যেকে এনআরসি এনপিআর সিএএ-এ নিয়ে কথা বলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, প্রচার করেছেন, পত্রিকা বের করেছেন। বিজেপিও সিএএ এনআরসি-র সমর্থনে প্রচার চালিয়েছে। তাহলে শুধুমাত্র এক্ষেত্রেই কেন ছাত্রছাত্রীদের উপর পুলিশের এই ধরণের আক্রমণাত্মক আচরণ দেখা গেল? এই প্রশ্নগুলোর কোনো সঠিক উত্তর পুলিশের দিক থেকে আজও পাওয়া যায়নি। ঠিক এরপরেই বইমেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে একজন ছাত্রকে বিনা ওয়ারেন্টে জিজ্ঞাসাবাদ করার নামে থানায় তুলে নিয়ে এসে একরাত রেখে পরের দিন তার নামে এফআইআর করে অ্যারেস্ট করা হয় কোন ভিত্তিতে? অনেকক্ষণ ধরে বাইরে অবস্থানকারী মানবাধিকার কর্মীদের আজিজুর সম্পর্কে জানতে দেওয়া হয় না কেন? বার বার আজিজুরকে চাপ দিয়ে আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করতে বলা হয় কেন?

 

আজিজুর রহমান এর নামে ঠিক যে যে ধারায় অভিযোগ এনেছে পুলিশ তার প্রত্যেকটির সাথেই আজিজুরের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে? পুলিশের উপর আক্রমণ। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে কিছু আন্দোলনকারী একজন মহিলা পুলিশের চুল ধরে টানছে। কিন্তু সেখানে আজিজুরকে দেখা যায়নি। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট। সেখানেও কোনোরকম ভাবেই আজিজুরের যোগ নেই। (সরকারি সম্পত্তি নষ্ট বলতে ঠিক কী কী সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারও কোনো তথ্য বা হিসেব পুলিশ দেখাতে পারেনি। যৌন হেনস্থা। আমরা ৮ তারিখের ভিডিও ফুটেজে দেখেছিলাম একজন প্রতিবাদকারী আইনের ছাত্রী যৌন নিগ্রহের অভিযোগ জানাতে গেলে অভিযোগ না নিয়ে উল্টে তাকে পুরুষ পুলিশ হেনস্থা করে। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনায় আজিজুর রহমানের উপস্থিতির কোনো ভিডিও ফুটেজ বা তথ্য পুলিশ দেখাতে ব্যর্থ। পুলিশের কন্ট্রোলরুমে ছাত্রছাত্রীদের উপর মারধর এর ফুটেজ ও দেখাতে অস্বীকার করে পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজ দেখাতে অস্বীকার কেন করল পুলিশ? এই গোটা ঘটনাটায় পুলিশের বর্বরতার নৃশংস দৃশ্য যে পুলিশকেই অপরাধী হিসেবে  দাঁড় করাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

পরিশেষে গোটা ভারতবর্ষে এনআরসি এনপিআর সিএএ  বিরোধী আন্দোলন চলছে। দিল্লিতে দেখা গেছে আন্দোলনকারীদের উপর দিল্লি পুলিশের (কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন) “লাইসেন্সড অত্যাচার”। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এনআরসি এনপিআর সিএএ বিরোধী আন্দোলনের মুখ। সেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে থাকা বিধাননগর পুলিশ এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের উপর এরকম আক্রমণ চালাচ্ছে কেন? আজিজুর রহমান মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। এখন টিউশন পড়িয়ে নিজের এবং পরিবারের দেখভাল করে।যবে থেকে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হয় তবে থেকেই আজিজুরকে দেখা গেছে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আজিজুরের কলমেই একটি লেখা এখানে উদ্ধৃত করছি:

 

 “আমি কোনো বিপ্লবী না। কিছুদিন আগে পর্যন্ত স্কুলে বৃক্ষরোপণ আর বিভিন্ন দিবস পালন ছাড়া কোনোদিন আন্দোলনে নামিনি। ব্যক্তিগত লড়াই ছাড়া কারোর জন্য রাস্তায় নামিনি। জীবনের এতটা সময় শান্তির ঘুমে কাটিয়েছি। টিভি আর সোশাল মিডিয়াতে অন্যায় দেখলে বাড়িতে বসে প্রতিবাদ জানিয়েছি। নিজের শখ পূরণের জন্য উদগ্রীব ছিলাম এতদিন। দূর থেকে বিপ্লবের খবর পেলে খুশি হতাম ঠিকই কিন্তু দিনের কোনো কাজে তার প্রভাব থাকেনি। তারপরে আস্তে আস্তে একদিন দূরের অন্যায় গুলো আমাদের ঘরের কাছে এগোতে শুরু করলো। আমার হঠাৎ চোখগুলো আমার আরামের গণ্ডির থেকে বেরোতে শুরু করলো। দেখতে থাকলাম যে আমার ভাতের থালার মধ্যেও কাদের অক্লান্ত পরিশ্রম চুরি করে রাখা আছে। বড়ো বড়ো ইমারতের মধ্যেও কাদের শ্রমচুরির ইতিহাস লেখা আছে। তারপরে চেনা পৃথিবীটা অচেনা লাগতে শুরু করলো।বড়ো বড়ো প্রাসাদের নীচের ভাঙাচোরা ঘরগুলো বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করলো। আমার দেশের স্বল্প কিছু সম্পদ নিয়ে কোটি কোটি মানুষের লড়াই ভীষণ ভাবে স্পষ্ট হতে শুরু করলো। আবার দেখলাম দিগন্ত বিস্তীর্ণ সম্পদের মালিকানা মাত্র কটা কালো হাতে আটকে বন্দী রয়েছে। ইতিহাসের কথা খুব মনে পড়ছিল। বুঝলাম পুরোটা ইতিহাস এই এক চিত্রের অনেকগুলো রূপ মাত্র। এর মধ্যে আমাদের প্রথাগত শাসশ্রেণী মানুষের মাঝে সেই প্রাচীন ধর্মীয় নেশার বিষ ছেটাতে শুরু করলো। দেশের মধ্যে শুরু হলো ভিনদেশী বানানোর এক অদ্ভুদ প্রক্রিয়া। বাড়িতে বসে বসে কেমন যেন অস্থির লাগতে শুরু করলো। রাস্তায় না নামার আর কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। জানিনা কীভাবে ঠিক লড়তে হবে। আমি হয়তো কোনোদিন কোনো আন্দোলনে সার্থকতা আনতে পারবোনা। আমি কোনো জটিল বিপ্লবী তত্ত্ব বুঝিনা। লড়াইটা সঠিক ভাবে কীভাবে করবো জানিনা। আমার শিক্ষা ভীষণ স্বল্প, যা আমাকে খুব গভীর কোনো বিষয়ের কিনারায় নিয়ে যেতে পারেনা। তবে এটুকু বুঝি যারা এতদিন আমার নিশ্চিন্তে ঘুমের পিছনে দিনরাত পরিশ্রম করতো তারা ভালো নেই। তাই পরের সুখের রাত আসার আগে রাস্তায় নেমে সাথ দিতে হবে মানুষের লড়াইকে।” (বানান অপরিবর্তিত)

 

“Students Against NRC NPR CAA” ফোরামের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে আজিজুরকে নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে তারা বৃহত্তর আন্দোলনে যাবেন। আগামীকাল আজিজুরের নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে ও পুলিসি নির্যাতনের বিচারে দাবীতে বিকেল ৪ঃ৩০ এ কলেজ স্ট্রীটে জমায়েত ও মিছিল করবে ছাত্রছাত্রীরা।

 

Share this
Leave a Comment