বেঙ্গল কেমিক্যালসের ঠিকা কর্মীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ


  • August 15, 2019
  • (0 Comments)
  • 1517 Views

১৪ দিন ধরে চলছে বেঙ্গল কেমিক্যালসের ঠিকে কর্মচারীদের বিক্ষোভ। এক দিকে কেন্দ্রীয় সরকার নীতি আয়োগের বক্তব্য অনুসারে বেসরকারি হাতে যেতে চলেছে এই ঐতিহ্যশালী সংস্থাএবং অন্য দিকে সংস্থার কর্তৃপক্ষ বাইরের পথ দেখাচ্ছে ৪৫ জন ঠিকে শ্রমিককে। গ্রাউন্ডজিরোর প্রতিবেদন।

 

 

বেঙ্গল কেমিক্যালস-এর বেসরকারিকরণের কারণে চাকরি হারাবেন বেশ কিছু শ্রমিক। বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার ফলস্বরূপ ভিআরস ও ভিএসএস নিতে বাধ্য হবেন ১৯৫ জন স্থায়ী কর্মচারী এবং চাকরি হারাবেন ঠিকে শ্রমিকরা, জানা গেল বেঙ্গল কেমিক্যালসের কর্মরত স্থায়ী কর্মচারীদের সঙ্গে কথাবার্তায়।

 

সংস্থাটির বেসরকারিকরণের আগেই ঠিকে কর্মীদের কাজ ছাড়তে চাপ সৃষ্টি করছিল সংস্থার ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষ। গত ৬ অগাস্ট ৪৫ জন ঠিকে শ্রমিক বিক্ষোভ দেখান বেঙ্গল কেমিক্যালস-এর হেড অফিসের সামনে। কথা বলেন কম্পানির অ্যাক্টিং এম ডি-র সাথে। অগাস্ট মাসের পয়লা তারিখ থেকে ঠিকে কর্মীরা অবস্থান চালাচ্ছেন বেঙ্গল কেমিক্যালস- এর মানিকতলা ইউনিটের সমানে। তাদের বক্তব্য থেকে উঠে আসে যে ১৫-২০ বছরের কর্মজীবনে এরকম অভিজ্ঞতা তাদের কাছেও নতুন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঠিকা কর্মী জানালেন, “আমরা ১৫-২০ বছর ধরে কাজ করছি। আমরা প্রথমে ছিলাম ৬০ জন আজ ছাঁটাই হতে হতে ৪৫ জনে এসে দাঁড়িয়েছি। এই ৪৫ জনকেও কোম্পানি বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।”

 

ঠিকে শ্রমিক হিসেবে তাদের রোজকার কাজের মাইনে ২৩৫ টাকা এবং খাবার জন্যে বরাদ্দ ৪০ টাকা। মাসে ২৫ দিন কাজ করলে ৫৫০০-৬০০০ টাকার মতো আয়। কিন্তু জুলাই মাস থেকে কোম্পানি ৪৫ জন শ্রমিকের জন্যে প্রতি মাসে মোট ৩৫০ ম্যান ডেজ বেঁধে দিয়েছে। ম্যানেজমেন্টের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান ও তাদের সাথে কথাবার্তার পর সেটা হয় ৭০০ ম্যান ডেজ। ৪৫ জন শ্রমিক ৭০০ ম্যান ডেজ পেলে, প্রত্যেকে মাসে ১৫-১৬ দিনের কাজ পাবে যাতে তাদের গড় আয় হবে ৩৫০০ টাকা। কোম্পানির এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে প্রত্যেক দিন ৩০ জন ঠিকা শ্রমিক কাজ করছিলেন কিন্তু ১লা অগাষ্ট মানেজমেন্ট জানায় তাদের প্রত্যেক দিন শুধুমাত্র ১২ জন ঠিকা কর্মীরর দরকার। অর্থাৎ একজন ঠিকা কর্মী প্রত্যেক মাসে ৭ দিন কাজ পাবে।

 

সংস্থার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঠিকা শ্রমিকরা অবস্থান শুরু করেন মানিকতলা ইউনিটের বাইরে এবং ১লা অগাষ্ট গণেশ চন্দ্র এভিনিউর হেড অফিসে কথা বলেন ম্যানেজমেন্ট-এর সাথে। সেই মিটিং-এ তাদের এইচ আর ম্যানেজার জানান যে শেষ তিন মাস কোম্পানির লোকসান হয়েছে তাই কোম্পানি ঠিকে কর্মী কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি কোম্পানির লোকসানই হয়ে থাকে তাহলে কোম্পানির ম্যানেজার ও স্থায়ী কর্মীরা শেষ আর্থিক বছরের লাভের অংশ থেকে বোনাস কি করে পেলেন ঠিকা কর্মীদের এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি ম্যানেজমেন্ট।

 

এক জন ঠিকা মজুর জানান, “বেশ কয়েক বছর ধরে আমদের মাইনে বাড়েনি। কিন্তু কোম্পানি যেহেতু লাভ করেছে তাই আমাদের মাইনেটা বাড়িয়ে দেওয়া হোক। আমাদের জানানো হয়, যে ব্যবস্থায় কাজ করছি তাতেই কাজ করতে হবে। কিন্তু হঠাৎই আমাদের বলল তোমরা বসে যাও, তোমাদের আর লাগবে না।” তারা এটাও জানালেন শেষ আর্থিক বছরে কোম্পানি ২৫ কোটি টাকা লাভ করায় কোম্পানি বেসিক বেতনের ওপর বোনাস ধার্য করেছে স্থায়ী কর্মচারীদের জন্যে। সেই বোনাস দরুন স্থায়ী কর্মচারীর অনেকেই পেয়েছেন ৬০০০ টাকা করে, উচ্চস্তরের ম্যানেজমেন্টের কর্মীরা পেয়েছে ৬ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। ঠিকে কর্মীদের দেওয়া হয়েছে ১০০০ টাকার কুপন। “কোম্পানি যদি নিজের লাভের অংশ কর্মীদের মধ্যে ভাগ করে দিতে চায় সেটা বেসিক-এর ওপর দেবে কেনো? সবাই সমান ভাবে কাজ করেছি তাই বোনাসও সবারই সমান পাওয়া উচিত,” জানালেন একজন ঠিকে কর্মচারী।

 

কোম্পানি কর্মী নিয়োগ করা বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কিছু বছর ধরে। কোম্পানির এক প্রাক্তন কর্মচারী গ্রাউন্ডজিরোকে জানিয়েছেন, “কোম্পানির মুনাফার একটা মূল কারণ হলো আগের থেকে অনেক কর্মচারী কমে গেছে। ১৯৮২-৮৪ তে ৩০০০ কর্মচারী থেকে আজ ২০০ জনেরও কম। বম্বেতে কোম্পানির জমিতে একটি বিল্ডিং বানিয়েছে তার থেকেও কোম্পানি একটি বড় মুনাফা আয় করছে।”

 

কোম্পানির শেষ তিন বছরের মুনাফা নিয়ে জিজ্ঞেস করতে আর এক জন স্থায়ী কর্মচারী জানালেন, “বেশ কিছু কর্মচারী কমেছে, তাছাড়া শুরু করা হয়েছে একটি নতুন ইউনিট আর তারপর কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতা।” একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী জানান, “সরকার (বি আই এফ আর) যে ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছিল সেটা দিয়ে দুটো স্টেট অফ আর্ট বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছিল, ২০১৪ থেকে সেগুলো চালু হয়। সেগুলোতে, একটাতে আমরা ড্রাই পাউডার ইনজেকশন, ক্যাপসুল আর বিটাল্যাক্টাম ট্যাবলেট বানাচ্ছি আর একটিতে আমরা নন-বিটার ট্যাবলেট কম্প্রেসান আর কোটিং করছি। এইগুলো ২০১৪ থেকে শুরু হয়েছে। এইগুলো সব নন-ফাংশনাল করে রেখে দিয়েছিল আগের সব এম ডি-রা। আর প্রভিডন আয়োডিনের যে সলিউশন লাইনটা যেটা প্রাথমিক ভাবে বড় বড় সরকারি হাসপাতাল ও প্রতিরক্ষাবাহিনী নিয়ে থাকে, সেটাও শুরু হয় ২০১৪ সালে। আমরা নতুন প্রোডাক্ট হিসেবে বেনফ্লাম নামের একটি ওষুধও তৈরি শুরু করেছিলাম যা বিভিন্ন ইএসএইতে ভালো গ্রহণযোগ্য হয়েছে এবং কদিন আগেই আমরা চণ্ডীগড় হরিয়ানা থেকে ১লাখ টিউবের অর্ডার পেয়েছি।”

 

ঠিকে কর্মীরা আবেগের সাথে জানান, “আমাদের যে মাইনে তা সরকারের ন্যূনতম মাইনের থেকে কম। বিগত ৫ বছর ধরে আমাদের মাইনে বাড়ানো হয়নি। তবুও আমরা কোম্পানি যা বলে তাই কাজ কই। আজ কোম্পানি ২৫ কোটি টাকা লাভ করেছে এবং এর জন্যে যদি সব থেকে বেশি কারোর অবদান থাকে সেটা এই ৪৫ জন ঠিকা কর্মচারীর। আমরা আসলে আনস্কিল্ড লেবার। যখন ঢুকেছিলাম তখন আমাদের কাজ ছিল চা জল দেওয়ার। কিন্তু থাকতে থাকতে এখন কেউ অপারেটর হয়ে গেছে, কেউ প্যাকার হয়ে গেছি, কেউ পিয়নের কাজ করি এবং কেউ স্টোর সামলায়। এখন আমরা কেউ আনস্কিল্ড লেবারের কাজ করি না। এই কাজগুলো ছিল পার্মানেন্ট লেবারদের যারা ২৫ হাজার ৩০ হাজার টাকা মাইনে পায়। কিন্তু আমরা কোনো দাবি করি না। এটা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের তৈরি করা কারখানা। এই কারখানার একটি ঐতিহ্য আছে। আমরা চাইনা যে এ কারখানাটা বন্ধ হয়ে যাক। এই কারখানা আচার্য ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী সংগ্রামের সময় তৈরি করেছিলেন। এটার সাথে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে আছে।”

 

ওনারা আরো জানালেন, “আজ ম্যানেজমেন্ট-এর জন্যে কোম্পানির এই হাল। আমরা কেউ কেউ এক সময় মার্কেট সার্ভের করেছি, তাই জানি বেঙ্গল কেমিক্যালস-এর প্রোডাক্টের আজও বাজারে চাহিদা আছে। হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল যদি নিজেদের মাল বেচে কোটি কোটি টাকা কামাতে পারে, বেঙ্গল কেমিক্যালস-এর ফিনাইল কেন মার্কেট-এ চলবে না? এই সংস্থার কেন লোকসান করবে?” আক্ষেপ করে বললেন, “আমরা জানি কোম্পানিতে কাজ আছে কিন্তু অ্যাক্টিং এম ডি স্থায়ী কর্মচারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আমাদের কাজ কেড়ে নিচ্ছে।”

 

গত ৬ অগাষ্ট গণেশ চন্দ্র এভিনিউর অফিসে এই সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে চাইলে, কর্তৃপক্ষ কোনো সাড়া দেননি। তখন তারা কম্পানির গেটের বাইরে বিক্ষোভে বসেন। পুলিস এসে বিক্ষোভ বন্ধ করতে চাইলে তারা পুলিসকে বিক্ষোভের কারণ জানান এবং পুলিস মধ্যস্ততা করে। “সেখানে ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফাইন্যান্স (ও অ্যাক্টিং ম্যানেজিং ডিরেক্টর) পি এম চন্দ্রাইয়া একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যান। উনি বলেন বোর্ড নেশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং এজেন্সি (এনপিপিএ)-র অর্ডারটা পাস করেনি তাই আমরা কন্ট্রাক্ট লেবার রাখতে পারবো না,” জানালেন একজন ঠিকা কর্মী। প্রত্যেক বছর কন্ট্রাক্ট শেষ হবার পর দু তিন মাস সময় লাগে পেপারওয়র্ক শেষ করে নতুন কন্ট্রাক্ট তৈরি হতে কিন্তু এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। ওনারা এটাও জানান, “ঠিকা কর্মীদের নিযুক্ত করার দায়িত্ব লোকাল ম্যানেজমেন্টের এবং ভেতরের সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে বোর্ড কোনো ডিসিশন পাস করেনি।”

 

এই অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠিকা কর্মীরা দেখা করেছেন লোকাল কাউন্সিলর সুনন্দা গুহ, এলাকার এমএলএ সাধন পান্ডে এবং রাজ্যসভার সদস্য ও প্রাক্তন অল ইন্ডিয়া তৃণমূল ট্রেড ইউনিইয়ান কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট দোলা সেনের সাথে এবং বারংবার তাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ওই ৪৫ জনের সাথেই জুড়ে আছে ৪৫টি পরিবারের আর্থিক অনিশ্চয়তা।

 

Share this
Leave a Comment