লাভের পথে ফিরতেই ঐতিহ্যের বেঙ্গল কেমিক্যালকে বেচে দেওয়ার ছক।


  • August 7, 2019
  • (0 Comments)
  • 1698 Views

বেঙ্গল কেমিক্যালের অ্যাক্টিং ম্যানেজিং ডিরেক্টর পি. এম. চান্দ্রাইয়া জানিয়েছেন, সময় দেওয়া হলে ২০২৩ সালের মধ্যে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য বহনকারী এই সংস্থাকে পুরোপুরি ঋণ মুক্ত করা সম্ভব। একটি গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন।

 

 

২ আগস্ট ২০১৯, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মদিনে বেঙ্গল কেমিক্যালের বেসরকারিকরণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মঞ্চ থেকে উঠে এল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি বিরোধিতার সুর। ১২৭ বছরের ঐতিহ্য বহনকারী দেশের অন্যতম ওষুধ তৈরির সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা আচার্য নিজেই। আজও সংস্থাটি বহু প্রচলিত দ্রব্য ক্যান্থারাইডিনে, ন্যাপথালিন, ফাইনালিন তৈরিতে স্বপ্রতিভ। এইরকম একটি স্বপ্রতিভ সংস্থার বেসরকারিকরণের উদ্যোগী কেন্দ্রের মোদী সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটিকে কোনো একটি বেসরকারি সংস্থার কাছে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।

 

কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা একমাত্র ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এই বেঙ্গল কেমিক্যালস যারা অয়েনমেন্ট তৈরি করে। এছাড়াও তাদের অন্যান্য প্রোডাক্টগুলি হল বিভিন্ন জীবনদায়ী ড্রাই পাউডার ইনজেকশন এবং গ্রেড ফোর অ্যান্টিবায়োটিক্স। তেলেঙ্গানা, হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার তাদের ইএসআই এবং সরকারি হাসপাতালের ওষুধ এই সংস্থার থেকে কেনে এবং কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীও তাদের ওষুধের জন্য এই সংস্থার ওপর নির্ভরশীল। ডিসেম্বর ২০১৮ অবধি কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি অনুসারে সব সরকারি সংস্থাকে ওষুধ কিনতে হলে প্রথমে সরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলোতে আর্জি জানাতে হত। তারা দিতে না পারলে তখন বেসরকারি সংস্থা থেকে কেনা হত। এই ফার্মাসিউটিক্যাল পারচেজ পলিসি আর কার্যকরী থাকবে না বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর প্রকোপ শুধু মাত্র কেন্দ্রীয় ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলির ওপর পড়বে না, আর ফলে সরকারি কোষাগারের ওপর আর্থিক চাপও বাড়বে। এই পলিসি অনুসারে, সরকারি সংস্থাগুলি ২০১৩ সাল অবধি ৩৫ শতাংশ ছাড়ে এবং ২০১৮ অবধি ১৬ শতাংশ ছাড়ে ওষুধ কিনত এবং একই সঙ্গে বেসরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গুলির চড়া মূল্য থেকে বাঁচার উপায়ও ছিল এই পলিসি। যদিও কেন্দ্রের এই ঘোষণার পরও একইরকম ওষুধের চাহিদা আছে বিসিপিএল-র, জানালেন সংস্থার ম্যানেজমেন্ট।

 

১৯৬৭-৬৮ থেকে ক্রমাগত লোকসানে চলতে থাকা এই সংস্থার উন্নতিকরণের উপায় হিসাবে মোদী সরকার ২০১৬ সালে সংস্থাটির পশ্চিমবঙ্গ, মুম্বাই, এবং কানপুরে চারটি কারখানার উদ্বৃত্ত প্রায় ৭০ হাজার একর জমির কিছুটা বিক্রি করা এবং পরে সরকারের অংশীদারিত্ব কোনো বেসরকারি সংস্থাকে বিক্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব আনলে সেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সংস্থাটির শ্রমিক সংগঠন কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে। কিন্তু বিচারপতি দেবাংশু বসাক সেই বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ার ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে দেন। বেসরকারিকরনের স্বপক্ষে সরকারের প্রথম যুক্তি ছিল বি সি পি এল জীবনদায়ী যেমন, যে সমস্ত ওষুধ ক্যান্সার বা এইডস এর মতো মারাত্মক রোগের প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহৃত হয়, সেই রকম কোনো ওষুধ তৈরি করে না। কিন্তু সংস্থার এক কর্মচারীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে গ্রাউন্ডজিরো জানতে পারে যে, একসময় সাপের বিষের প্রতিষেধক (যেটি একটি অন্যতম জীবনদায়ী ওষুধ)-এর নির্মাতা এই বি সি পি এল। যে ভারতে বছরে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, সেই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এই রকম একটি জীবনদায়ী ওষুধ তৈরির বন্ধ করে দেয় এবং বি সি পি এল-কে নিজের দায়িত্বে সেই ওষুধ প্রস্তুতির কার্য চালাতে বলে। সংস্থাটি প্রথম দিকে কিছুদিন এই প্রতিষেধকটির নির্মাণ চালু রাখলেও পরের দিকে অর্থের অভাবে তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। যদিও তারা আবার ২০২০ থেকে এই প্রতিষেধকের নির্মাণ অব্যাহত রাখবে বলে ঠিক করে। দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার আদালতে জানায় যে, এই সংস্থার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন উন্নত-মানের যন্ত্রপাতি, বেতন নীতি এবং ভি.আর.এস-এর জন্য বি.আই.এফ.আর ২০০৬ সালে ৪১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও সংস্থার ভাগ্য ফেরেনি, তারা আবার মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ হয়। যদিও গত তিন বছর ধরে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছিল এই সংস্থাটি। ২০১৮-১৯ বছরে তারা প্রায় ১১৯.৭ কোটি টাকার ব্যবসা করে এবং প্রায় ২৫ কোটি টাকার মুনাফা এবং ২৮ কোটি টাকার ঋণ শোধ করতে সক্ষম হয় তারা। কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ওই বছরেই (২০১৮) এপ্রিল মাসে আদালতের ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানায়। ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলা মুলতুবি থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার জানায় যে কর্নাটক অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া বাকি চারটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মধ্যে ইন্ডিয়ান ড্রাগ অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকাল লিমিটেড এবং রাজস্থান ড্রাগ অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকাল লিমিটেড এই দুটি কোম্পানিকে বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং হিন্দুস্তান অ্যান্টিবায়োটিক লিমিটেড এবং বেঙ্গল কেমিক্যাল ফার্মাসিউটিকাল লিমিটেড-কে বেসরকারিকরণ করা হবে।

 

গ্রাউন্ডজিরো -র প্রতিনিধিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কোম্পানির এক কর্মচারী জানান যে, ” সরকারের মত অনুযায়ী আমাদের কোম্পানি এখনো নেগেটিভ প্রফিটে আছে কারণ আমরা এখনো বিআইএফআর -এর দেওয়া ঋণের টাকা শোধ করতে পারিনি। তাই তাকে প্রফিটেবল কোম্পানি বলে মানতে সরকার এখনো নারাজ। কিন্তু বিগত এক বছরে ২৫ কোটি টাকা মুনাফা ছাড়াও আমরা বিআইএফআর এর কিছু ঋণ শোধ করতে এবং ব্যাঙ্কের কিছু মর্টগেজ ছাড়াতে সমর্থ হয়েছি।” তিনি আরও জানান যে, “অ্যাক্টিং ম্যানেজিং ডিরেক্টর জানিয়েছেন সময় দেওয়া হলে ২০২৩ সালের মধ্যে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য বহনকারী এই সংস্থাকে পুরোপুরি ঋণ মুক্ত করা সম্ভব।”

 

কেন্দ্রীয় সরকারের বি সি পি এল -এর উদ্বৃত্ত জমি বিক্রি এবং বেসরকারিকারণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিক সংঘঠনের স্বপক্ষে যুক্তি হাজির করার সময় শ্রমিক সংগঠনের আইনজীবী আদালতকে জানান যে বি সি পি এল- এর যথাযথ দেখাশোনায় কেন্দ্রীয় সরকার ব্যর্থ। ‘কাটচ’ কমিটি (Katoch Committee) রিপোর্ট অনুসারে আইনজীবী জানান যে বি সি পি এল -এর কাছে অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্টস (এ পি আই) উৎপাদন করার উপযুক্ত পরিকাঠামো বর্তমান। সুতরাং কাটচ কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী বি সি পি এল-এর আধুনিকীকরণের দিকে আরো নজর দেওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নির্মিত কাটচ কমিটির মুখ্য ভূমিকা হল ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরের সমস্যার ওপর দৃষ্টিপাত করা। ২০১৫-১৬ সালে তৈরি হওয়া এই কমিটির রিপোর্টের মূল বক্তব্য ছিল কীভাবে ভারতবর্ষের আমদানিকৃত এ পি আই-এর ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যায়। ২০১৪ সালে ভারতবর্ষ ২.৪৬ লক্ষ টন এ পি আই (মোট চাহিদার ৭২%) দেশের বাইরের থেকে আমদানি করে, যার ৬০ শতাংশ চীন থেকে। ২০১৮ সালে একই ভাবে আমদানিকৃত মোট ৩.১০ লক্ষ টন এ পি আই এর ৬০% চীনের থেকে। এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে কমিটি জানায় যে পাবলিক সেক্টরে যথাযথ পরিকাঠামো নির্মাণ করা দরকার পর্যাপ্ত এ পি আই উৎপাদনের স্বার্থে। রিপোর্টে আরো জানানো হয় যে এ পি আই উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় হল ১০০০ থেকে ২০০০ হেক্টর জমি এবং ৭৫০ থেকে ১০০০ কোটি টাকার মূলধন।

 

অন্যদিকে বিগত একদশক ধরে বেঙ্গল কেমিক্যালে নতুন শ্রমিক সেইভাবে নিযুক্ত করা হয়নি। ম্যানেজমেন্ট পদে কিছু নিযুক্ত হলেও বহু পদ এখনো শূন্য। দিনে দিনে কন্ট্রাক্ট শ্রমিক এর হার বেড়েছে। ৫বছর আগে মোট শ্রমিক ছিল ৫০০, বর্তমানে তার সংখ্যা দাড়িয়েছে ১৯৫। বি সি পি এল-এর এক কর্মচারী গ্রাউন্ডজিরোকে জানায়, ” ২০১৬ সালের বিলগ্নিকরণের পর থেকে নতুন শ্রমিক নিয়োগ করা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার এবং পরবর্তী দু-তিন বছরে শ্রমিক সংখ্যা আরও কমবে। ওরা (কেন্দ্রীয় সরকার) এই সংস্থাটির বাঁচার আশা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে তুলেছে যাতে এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যুর পথে নিয়ে যাওয়া যায়।”

 

২ অগাস্টের প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে এই বক্তব্য উঠে আসে যে বেঙ্গল কেমিক্যলসকে বেসরকারি হাতে যাওয়ার থেকে বাঁচানোর জন্য শ্রমিক এবং নাগরিক সংগঠন গুলো আগামী দিনে একসাথে লড়াই করবে । প্রয়োজনে রাজ্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে এই ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর জন্য, এই দাবিও ওঠে। বি সি পি এল- এর এক প্রাক্তন কর্মচারী জানান, ” রাজ্য সরকার আমাদের থেকে কোনো ওষুধ ক্রয় করেন না।” তাই তিনি রাজ্য সরকারকে আবেদন জানান বেঙ্গল কেমিক্যালস- এর থেকে ওষুধ কেনার জন্যে।

 

 

Share this
Leave a Comment