প্রসঙ্গ: রাজকুমার অথবা গণতন্ত্রের আজব কিসসা্


  • June 4, 2019
  • (0 Comments)
  • 1375 Views

২০১৮ সালের ১৫ই মে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় প্রিসাইডিং অফিসার হিসাবে সরকারি দায়িত্ব পালনে গিয়ে রাজকুমারের নৃশংস মৃত্যু ঘটে। এক তরুণ শিক্ষকের এহেন করুণ পরিণতি রায়গঞ্জ শহরের পরিস্থিতিকে অগ্নিগর্ভ করে তোলে। ১৬ই মে, রাজকুমারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে, ‘রাজকুমার রায় হত্যার বিচার চাই’ মঞ্চের পক্ষ থেকে ‘আমাদের দেশে নির্বাচন গণতন্ত্রের উৎসব না প্রহসন’ বিষয়ক এক আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। লিখেছেন সুমন কল্যাণ মৌলিক 

 

 

রাজকুমার রায় ছিলেন আমাদের সহনাগরিক। উত্তর দিনাজপুর জেলার সদর শহর রায়গঞ্জের এক হাই-মাদ্রাসা স্কুলের তরুণ শিক্ষক। ২০১৮ সালের ১৫ই মে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় প্রিসাইডিং অফিসার হিসাবে সরকারি গুরুদায়িত্ব পালনে গিয়ে রাজকুমারের নৃশংস মৃত্যু ঘটে। পৃথিবীর ‘বৃহত্তম গণতন্ত্র’বলে অহরহ বিজ্ঞাপিত ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের মহান উৎসব সংঘটিত করতে গিয়ে এক তরুণ শিক্ষকের এহেন করুণ পরিণতি এই ছোট্ট শহরটির পরিস্থিতিকে অগ্নিগর্ভ করে তোলে। নিরাপত্তাহীন, ভীত, বিপন্ন ভোটকর্মীরা তাৎক্ষণিক আবেগে ও প্রতিবাদী চেতনায় ক্ষুব্ধ হয়ে বয়কট করে গণনা ট্রেনিং, তাদের প্রতিবাদী স্বর আছড়ে পড়ে শহরের ঘড়ি মোড়ে ও পরে শিলিগুড়ি মোড়ে।

 

যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কিছু প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমায়িত রাখতে চান, বাঁধতে চান নিয়মের নিগড়ে – তারা এই আন্দোলনকে দেখে আশঙ্কিত হয়ে ওঠেন। দলতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে পুঁজি করে পিষে ফেলতে চান সেই অগ্নিবর্ষী প্রতিবাদী চেতনাকে। ফলশ্রুতি রাত্রিবেলায় শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি সশস্ত্র উর্দিধারীদের খানাতল্লাশি, গ্রেপ্তার, কুৎসা প্রচার ও সর্বোপরি রাজকুমারের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেবার চেনা ছক। কিন্তু স্বত:স্ফূর্ত মিছিল, স্টিয়ারিং কমিটি গঠন, রাজপথে স্বাক্ষর অভিযান-আন্দোলনের পরতে পরতে যোগ হয় নতুন অধ্যায়। রায়গঞ্জে শুরু হওয়া গণ-আন্দোলনের আঁচে কলকাতাতেও শিক্ষক এবং ভোটকর্মীরা এক নাগরিক মিছিল ও প্রতিবাদ সভায় সামিল হন। গড়ে ওঠে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চ।

 

সন্ত্রাসের সেই দিনগুলিতে দেশের প্রমুখ অধিকার সংগঠনগুলির যৌথমঞ্চ সি.ডি.আর.ও. (কো অর্ডিনেশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটস অর্গানাইজেশন)-এর পক্ষ থেকে তথ্যানুসন্ধান করতে এসেছিলাম রায়গঞ্জে। দিনটা ছিল ২৮শে মে, ২০১৮। সেদিন সকালে লড়াকু শিক্ষক মহাশয়দের বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছিল না কারণ পুলিশি তল্লাশির কারণে তারা বাড়িতে থাকতে পারছিলেন না। আমরা জেলার পুলিশ প্রধান শ্যাম সিং-এর সঙ্গে দেখা করি। অপরিসীম ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তিনি জানান – প্রশাসন আন্দোলনকারী শিক্ষকদের উচিত শিক্ষা দেবে। অস্বীকার করেন রাজকুমার রায়ের হত্যার ক্ষেত্রে প্রশাসন তথা পুলিশের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অযোগ্যতার প্রশ্নটিকে। দুপুরে আমাদের সঙ্গে দেখা হয় রাজকুমারের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সইদুল ইসলামের। এই অকুতোভয় মানুষটি জানান কেন তারা এই মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলছেন। তার জবানিতে উঠে আসে রাজকুমারের নিখোঁজ হওয়ার সময় প্রশাসনের হৃদয়হীন আচরণ ও পরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তার কথা। সইদুলবাবু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাকে হুমকি ও প্রলোভন দেখানো হচ্ছে, কিন্তু তিনি কোন চাপের কাছে মাথা নোয়াবেন না। সেদিন ধৃত আন্দোলনকারী শিক্ষকদের জামিনের পক্ষে রায়গঞ্জ আদালতে সওয়াল করেন রাজ্যের বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। আদালতের আদেশে জামিন হয় তিনজন শিক্ষক মহাশয়ের। ঐদিন বিকেলে উপচে পড়া রায়গঞ্জ ইন্সটিটিউট হলে আন্দোলনের সমর্থনে আয়োজিত গণকনভেনশনে এই লড়াইকে চালিয়ে যাবার শপথ নেওয়া হয়, যার সঙ্গী ছিলাম আমরাও। আন্দোলনের অভিমুখকে নির্দিষ্ট করা হয় প্রধান দুই দাবি’কে কেন্দ্র করে – প্রথমত রাজকুমার রায়ের হত্যার সিবিআই তদন্ত, এবং যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং অর্পিতা রায় বর্মণের (রাজকুমারের স্ত্রী) চাকরি। কনভেনশন শেষে কলকাতা ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম পঞ্চায়েত ভোটের দিন গণতন্ত্রের যে প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শিক্ষকদের রাস্তায় নেমে গণআন্দোলনই তো জীবন্ত গণতন্ত্রের ফলিত প্রয়োগ, তাকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় আছে?! তবে আন্দোলনের স্থায়িত্ব নিয়েও মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি মারছিল। সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখেছি পার্কস্ট্রীট, কামদুনি বা নোনাডাঙার মতো সামাজিক আন্দোলন বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, প্রার্থিত লক্ষ্যে পৌঁছনোর আগেই তার অকালমৃত্যু ঘটেছে।

 

ইতিমধ্যে প্রায় একবছর অতিক্রান্ত। জীবন্ত যোগাযোগ না থাকলেও রায়গঞ্জের আন্দোলনের খবর বন্ধুদের কাছ থেকে ইতিউতি পেতে থাকি। যেমন স্টিয়ারিং কমিটির সভায় পুলিশি হয়রানি বন্ধ করতে এবং পুলিশের দায়ের করা মামলা খারিজ করতে হাইকোর্টে যাবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একইসাথে প্রয়াত রাজকুমার রায়ের মা শ্রীমতী অন্নদা রায় পুত্রের মৃত্যুর সিবিআই তদন্ত, পুনরায় পোস্টমর্টেম ইত্যাদি দাবি করে মামলা করেন কলকাতা হাইকোর্টে। আন্দোলনের চাপে প্রশাসন তড়িঘড়ি রাজকুমার বাবুর স্ত্রী’কে চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আন্দোলনও ইতিমধ্যে রায়গঞ্জের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে রাজ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে যার অন্যতম প্রমাণ ২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিগুণা সেন হলে অনুষ্ঠিত রাজ্য কনভেনশন। আবার ভারতীয় বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মামলার গতি যে মাঝেমধ্যে শ্লথ হয়ে পড়ছে, সে খবরও অজানা ছিল না।

 

কিন্তু রাজকুমার রায়ের নৃশংস হত্যা ও তার বিরুদ্ধে রায়গঞ্জের শিক্ষকদের ঐতিহাসিক লড়াই জনমানসে কতটা গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে রয়েছে তা উপলব্ধি করলাম এবারের লোকসভা নির্বাচনের সময়। লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার সময় থেকেই শিক্ষক তথা ভোটকর্মীদের যথাযথ নিরাপত্তার দাবিতে অভূতপূর্ব আন্দোলন। ‘আগে নিরাপত্তা পরে ভোট’, ‘সেন্ট্রাল ফোর্স পাচ্ছি না, ভোট নিতে যাচ্ছি না’ ইত্যাদি শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো ভোট প্রশিক্ষণের প্রাঙ্গণ। নিরাপত্তার দাবি প্রধান হলেও অন্তর্লীনভাবে অবশ্যই ছিল গণতন্ত্রের প্রতি আবেগ ও দায়বদ্ধতা যা নিশ্চিত করতে চায় এক স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা। এই আন্দোলনকে সংহত করতে অবশ্যই অনুঘটকের ভূমিকা পালন করলো ‘শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চ’। অবশ্যই সব জেলায় আন্দোলন একইরকম জোরালো ছিল না কিন্তু রাজ্যের জনমানসে এই আন্দোলনের এক সদর্থক প্রভাব পড়েছিল; তা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনের দিনগুলিতে ভোটকর্মীরা যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একে অপরকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। আর এখানেই রাজকুমারের জয়।

 

আসানসোলে লোকসভা নির্বাচনের ডিউটি সেরে ফিরে আসার পরেই ডাক এলো রায়গঞ্জের ‘রাজকুমার রায় হত্যার বিচার চাই’ মঞ্চের পক্ষ থেকে। উদ্যোক্তারা এক আলোচনাসভার আয়োজন করেছেন – ‘আমাদের দেশে নির্বাচন গণতন্ত্রের উৎসব না প্রহসন’। রাজকুমারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আলোচনার যোগ্য বিষয় এর চেয়ে আর কি বা হতে পারতো? অধ্যাপক মৈদুল ইসলাম এবং আমাকে বলতে হবে আলোচ্য বিষয় নিয়ে। মঞ্চের পক্ষ থেকে অবশ্য ১৫ই মে তে রায়গঞ্জের পথে প্রকাশ্য সভার মধ্যে দিয়েই মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের কাজ শুরু হয়ে যায়। ১৬ই মে অনুষ্ঠান স্থানীয় একটি হলে। সেই বিষাদঘন অনুষ্ঠানে মঞ্চের সদস্যরা ফুলে, কবিতায়, গানে রাজকুমারকে স্মরণ করলেন। রাজকুমারের পরিবারবর্গের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধা রাণী কর, যিনি স্বচ্ছ ও নিরাপদভাবে ভোট দেওয়ার দাবিতে রায়গঞ্জ শহরে মানববন্ধন কর্মসূচী সংগঠিত করে সারা রাজ্যের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, মিডিয়া, প্রাইম টাইম পণ্ডিত, নিরাপত্তাবাহিনী সর্বোপরি নির্বাচন কমিশন দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের তামাশার উপাদান যুগিয়ে চলেছেন তা নিয়ে যেমন আলোচনা হয়েছে, তেমনি হয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থার কাঠামোগত অসঙ্গতির কথা, সমাজের নিম্নবিত্ত তথা প্রান্তিক মানুষদের গণতন্ত্রের যূপকাষ্ঠে বলি হওয়ার কথা। সইদুলবাবুর বক্তব্যে উঠে আসে সারা দেশ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের কীভাবে দুর্বৃত্তায়ন ঘটলো তার কথা, এলো পুঁজি দ্বারা মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের কথা, কীভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংশোধন সম্ভব তার কথা। এই আলোচনা শ্রোতাদের কেমন লেগেছে তা জানার সুযোগ হয়নি কিন্তু এবার রায়গঞ্জে গিয়ে একটা কথা আরেকবার উপলব্ধি করলাম।

 

ইভিএম ও ব্যালট বাক্সের জটিল পাটিগণিত আর ক্ষমতার নির্লজ্জ হুংকারে নয় – গণতন্ত্র লুকিয়ে আছে সাথীদের চোয়াল শক্ত করা লড়াইয়ে, প্রকাশ্য রাজপথে বর্ণময় মিছিলে, রাজকুমারের হত্যার বিচার চাওয়ার দৃপ্ত শপথে। সইদুলবাবু, ভাস্কর দা, গৌতম দা, শুভ্র, মৃত্যুঞ্জয়, সঞ্জিৎ সহ মঞ্চের সমস্ত মানুষদের তাই আবারও আমার কুর্নিশ, সশ্রদ্ধ অভিবাদন।

 

রায়গঞ্জ লোকসভা নির্বাচনে এই আন্দোলনের কোনও প্রভাব পড়েনি। কারণ আন্দোলন শহরের বাম মনস্ক বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

 

 

লেখক  সুমন কল্যাণ মৌলিক একজন স্কুল শিক্ষক   গনতান্ত্রিক অধিকার  আন্দোলনের কর্মী 

 

 

Share this
Leave a Comment