সাকেত গোখলে : ‘বিজেপি-আরএসএস যেদিন আমার পুলিশ অফিসার জ্যাঠার মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করতে (ও দাঙ্গা বাধাতে) চেয়েছিল’


  • February 20, 2019
  • (3 Comments)
  • 3456 Views

সাধারণ মানুষকে রাজনীতির বোড়ে বানায় রাজনীতিকরা। তার জন্য সেই সাধারণ মানুষকেই মেরেধরে অপমান করে ভয় দেখিয়ে হল্লা করবার জন্য আবার একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষকে ব্যবহার করা হয়। কারা ব্যবহার করে? কারা দাঙ্গার পরিকল্পনা করে? তারা হল সেই উঁচু মহলের রাজনীতিকদের ধামাধরা কিছু ব্যক্তি, যারা এই ‘ব্যবহার করার রাজনীতি’র ফায়দা লোটে। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে এই হিংসার কুচক্রে ঢুকে পড়ার ভুল কলকাতার মানুষ এত সহজে করবেন না, নোংরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আর জওয়ানদের মৃত্যুকে তাঁরা এক চশমায় দেখবেন না – এই আশা এখনও অনেকের মনে রয়ে গেছে।

 

অল্প হলেও, সঙ্ঘী হিংসা বিস্তারের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী মানবিক গলা উঠে আসতে শোনা যাচ্ছে পুলিশ-মিলিটারির ভিতর থেকেই। যেমন মেজর প্রিয়দর্শীর নিউজক্লিক ইন্টারভিউতে, যা আমাদের প্রত্যেকের শোনা উচিত। এমনই আরেকটি কণ্ঠ – সিনিয়র পুলিশ ইন্সপেক্টর সুহাস গোখলের ছেলে সাকেত গোখলের লেখায়, যা সবরং পত্রিকায় প্রকাশিত। লেখাটিতে এমন একটি বাক্য উঠে আসে, যেটি এ-সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ – “আপনাদের মতো কাপুরুষদের যদি এতটুকুও সাহস থাকে, যান তাঁকে যারা সত্যি সত্যি খুন করেছে, তাঁদের মারুন। যাঁরা নিরপরাধ, যাঁরা তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানেন না, তাঁদের না মেরে।” ‘সাহস’ বলতে স্বাভাবিক ভাবেই এখানে রাজনৈতিক স্বার্থে দল বেঁধে কোণঠাসা করে মারধোর করার কথা বলা হচ্ছে না। সাকেতের লেখায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে, তা হল দাঙ্গায় বা যুদ্ধে মূলত যারা শহিদ হন, তাঁরা নিচুতলার অফিসার বা সৈন্য। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সাধারণ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। রাজনৈতিক চালে বোড়ে করা ছাড়া বিজেপি/আরএসএস আর তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের কাছে তাঁদের বাঁচামরার আর কোনো গুরুত্ব আসলে নেই।

 

গ্রাউন্ডজিরো থেকে লেখাটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হল।

 

সাকেত গোখলে (সূত্র – এশিয়ান এজ)

 

আজ অবধি অনেক কথাই আমি জনসমক্ষে বলিনি। এটাও তার মধ্যে একটা। কিন্তু পুলোয়ামায় ৪০ জন সিআরপিএফ পার্সোনেলের মৃত্যু নিয়ে বিজেপি’র আইটি সেল হোওয়াটসঅ্যাপ এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় যে নোংরা রাজনীতির খেলা খেলছে, তাতে আমার মনে হয়েছে, এবার এটা বলা প্রয়োজন।

 

আমার জ্যাঠা সাবইন্সপেক্টর নন্দকুমার গোখলে মুম্বইতে ডিউটি চলাকালীন খুন হওয়া প্রথম অফিসার ছিলেন। ১৯৮৪-র মে মাসে নগপড়াতে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ভিওয়ান্ডির দাঙ্গার পরে যখন কার্ফু চলছিল, সেসময়, কোনো পাঠান গ্যাং-এর কিছু সদস্য নাকি তাঁকে খুন করেছিল। কিন্তু হত্যাকারীদের কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাই এর সত্যমিথ্যা বলা সম্ভব নয়। প্রায় ৫০ জনের একটা দল তাঁকে উর্দি পরিহিত অবস্থায় পিটিয়ে মারে। তাঁকে একটা বাড়ির ছাদে নিয়ে গিয়ে তাঁর দেহকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় এবং সেখান থেকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলা হয়। সারা রাত, ওই উর্দি পরা অবস্থাতেই তাঁর দেহটি ওখানে পড়ে থাকে – দেহটি দেখে তাঁকে চেনার প্রায় কোনো উপায় ছিল না। ভোরবেলা এসআরপিএফ দেহটি উদ্ধার করে।

 

পরদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুম্বই পুলিশ কমিশনার জুলিও রিবেরিওর (তাঁকে পাঞ্জাব থেকে মুম্বাইতে নিয়ে আসা হয়েছিল) সাথে জায়গাটি দেখতে যান। যেহেতু শহরে কার্ফু চলছিল, নন্দকুমারের পরিবারকে বলা হয়, তাঁরা তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তাঁদের সিদ্ধান্ত মতো হয় সসম্মানে মুম্বাইতেই – যেখানে তিনি থাকতেন এবং চাকরি করতেন – করতে পারেন, নয় নাসিকে – যেখানে তাঁর জন্ম হয় এবং যেখানে আমার ঠাকুর্দা-ঠাকুমা থাকতেন। যেহেতু নন্দকুমার মুম্বইতেই মারা যান এবং যেহেতু তিনি এই শহরটাকে ভালবাসতেন, তাঁর সরকারি অন্ত্যেষ্টি শেষ পর্যন্ত এই শহরেই করা হয়। তাঁকে ২১টি গান-স্যালুট এবং বীরত্বের জন্য মরণোত্তর রাষ্ট্রপতি পুলিশ মেডেল দেওয়া হয়।

 

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরে, নাসিকে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে একটি শোকসভার আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আরএসএস প্রচারক (বিজেপি তখন সবে তৈরি হয়েছে এবং তিনি সেসময় থেকেই বিজেপির সাথে ছিলেন) এসে উপস্থিত হন। এই মুহূর্তেও তিনি বিজেপিতেই রয়েছেন এবং বেশ ক্ষমতাসম্পন্ন নেতা হিসেবে রয়েছেন, তাই তাঁর নাম না করাটাই আমি ভালো মনে করছি।

 

এই আরএসএস প্রচারক আমার বাবার কাছে এসে বলেন, “আপনারা ওঁর দেহটা মুম্বইতে ফেলে এলেন কেন? নাসিকে নিয়ে আসা উচিত ছিল।” (তিনি বাস্তবিক ‘ফেলে এলেন’ কথাটাই ব্যবহার করেছিলেন।) আমার বাবা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “আমরা ওঁর দেহ নিয়ে শহর জুড়ে একটা মিছিল করব বলে ঠিক করেছিলাম। আর মিছিল হয়ে গেলে দ্বারকা চকের মুসলমান বস্তিটাও জ্বালিয়ে দিতাম।” (দ্বারকা চক নাসিকের একটি মুসলমান-প্রধান অঞ্চল।) এক মুহূর্তের জন্য বাবা কথা খুঁজে পাননি, তিনি এতটাই চমকে গেছিলেন। শেষে বলেন, “আর দ্বারকা চকের মুসলমান বস্তি জ্বালিয়ে দেবেন কেন?” তাতে প্রচারক বলেন, “কেন, ওঁকে তো মুসলমানরাই মেরেছে। ওঁর উর্দি পরা রক্তাক্ত দেহটা দেখলে আমাদের ক্যাডারদের রক্ত গরম হয়ে উঠত, আর ওরা তখন এই লোকগুলোকে শিক্ষা দিয়েই ছাড়ত।”

 

বাবা আর ক্ষোভ চেপে রাখতে না পেরে বলেন, “আমার দাদাকে মারা হয় কারণ তিনি পুলিশের উর্দি পরে ছিলেন। দাদার ধর্ম ছিল পুলিশ অফিসারের ধর্ম আর তাঁর খুনিদের ধর্ম অপরাধীর ধর্ম। আপনাদের মতো কাপুরুষদের যদি এতটুকুও সাহস থাকে, যান তাঁকে যারা সত্যি সত্যি খুন করেছে, তাঁদের মারুন। যাঁরা নিরপরাধ, যাঁরা তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানেন না, তাঁদের না মেরে। আপনি এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। নয়তো আমাকে বাধ্য হয়ে আপনাকে জোর করে বার করে দিতে হবে।”

 

প্রচারক এটা আশা করেননি। অপমানে তাঁর মুখ সাদা হয়ে যায় এবং তিনি তৎক্ষণাৎ আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ওই একই বছরে আমার বাবা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেন এবং পুলিশে যোগ দেন। ১৯৮৫-তে তিনি উর্দি পরে ‘সোর্ড অফ অনার’ নিয়ে আমার জ্যাঠার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে মার্চ করেন। ত্রিশ বছর তিনি সসম্মানে এই চাকরি করেন। তাঁর অবসর গ্রহণের দিন, ২০১৫ সালে, বিজেপি সরকার তাঁকে একটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসায়। ওই বিজেপি প্রচারক ইতিমধ্যে বেশ উঁচু পদে উঠেছেন, কিন্তু আমার বাবার সাথে এখনও তিনি চোখে চোখে রেখে কথা বলতে পারেন না।

 

আজ একথা এতদিন পরে লিখছি কেন? বিজেপি-আরএসএস কীভাবে পুলিশ-মিলিটারির মৃত্যুকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে, সেটা সবাইকে জানাবার জন্য। এই জওয়ানদের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিজেপি/আরএসএস/ভিএইচপি ‘জম্মু বন্ধ’ ডেকে দিল, যেখানে তারা পুলিশের বিরুদ্ধে দাঙ্গা করল এবং মুসলমান নাগরিকদের উপর আক্রমণ চালাবার চেষ্টা করল। ১৯৮৪-তে আমার জ্যাঠার দেহ নিয়ে তারা যা করতে চেয়েছিল, আজ তারা সেটাই করেছে – জম্মুতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে, যাতে ওখানে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম থাকে।

 

একথা লিখছি, যাতে আপনারা জানেন, যে ওরা আসলে কতটা হিংস্র। যাতে আপনারা বুঝতে পারেন, যে এই স্বঘোষিত দেশপ্রেমীদের কাছে একজন মৃত জওয়ান বা পুলিশ অফিসারের রক্ত আসলে ঘৃণার রাজনীতি চাগিয়ে তোলার অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই না।

 

তাই বলছি, নির্বাচিত সরকারের ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বলে আপনাকে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলে দাগিয়ে দেবার সুযোগ ওদের দেবেন না। ওরা সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ‘হেট স্পিচ’-গুলো প্রচার করছে, তাতে কান দেবেন না।

 

সৈন্য ও নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষদের মৃত্যু নিয়ে ওদের এইভাবে অবাধে রাজনীতি করে যেতে দেবেন না। নয়তো ওদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য ওরা এইভাবেই উর্দি পরা মানুষগুলোকে বলিতে চড়িয়ে যাবে। যদি দেশকে ভালবাসেন, তাহলে দোহাই, এই মিথ্যুক দেশপ্রেমীদের মিথ্যে মুখোশটা খুলে দিন। এরা সেই ভিতুর দল, যারা কখনো স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাগ নেয়নি, যারা দেশের ভালোর জন্য কোনোদিন কিচ্ছু করেনি, যারা দেশের মানুষের গলায় ছুরি বসাবার আগে দু’বার ভাববে না, যারা দেশের সংবিধানকে অস্বীকার করে। এই অ্যান্টি-ন্যাশনালরা বীরত্বের সার্টিফিকেটও দেয় এই মতলব নিয়ে, যে সেই বীরত্বকে ওরা নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছাতে ব্যবহার করবে।

 

ফীচার ছবি (মূল সূত্র) – ফার্স্টপোস্ট

Share this
Recent Comments
3
  • comments
    By: Chandan on February 28, 2019

    Will you give me the permission to publish this as it is in a bengali little magazine?

  • comments
    By: groundxero on March 2, 2019

    Sure. Thanks.

  • comments
    By: Chandan on March 11, 2019

    সাদেককে অবশেষে কলম ধরতে হল। এমন একটা সময়ে সাদেক মুখ খুললেন, যখন সদ্য চুয়াল্লিশ জন আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ান উগ্রবাদী হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন এবং সামনেই লোকসভা নির্বাচন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কফিনে কাঁধ দিচ্ছেন, বিরোধী নেতাদের অশ্রু ক্ষরণ টিভিতে, পত্রিকায়। সৈনিক, আধা সৈনিক অথবা পুলিশের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের পুরনো অভ্যাস। মোমবাতি রাজনীতি। আর মোমবাতির নীচে যে অন্ধকার থাকে, ভুক্তভোগী সাদেক লিখছেন সেই আঁধারের গল্প। মৃত্যুবরণকারীর পরিবারকে কিভাবে রাজনীতির শিকার হতে হয়, সাদেক দেখেছেন। পুলিশের চাকরীতে মেরুদণ্ডী হলে, সততার দাম রাষ্ট্র কিভাবে চুকিয়ে দেয়, সাদেকের অভিজ্ঞতা আছে। সাদেক লিখছেন। অনেকেই লিখছেন না – ভয়ে অথবা উৎকোচে। সেইসব নৈঃশব্দ্যের হৃৎস্পন্দন অনুভব করার জন্যেও যেন আমাদের ইন্দ্রিয় টানটান থাকে।

Leave a Comment