৬ ডিসেম্বর ১৯৯২: স্বাধীন ভারতের বুকে ফ্যাসিস্ত পদধ্বনি।


  • December 6, 2018
  • (0 Comments)
  • 2076 Views

৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২-তে সেই সুরুয়াত। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৬তম দিবস। অন্যদিকে, প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি টিম ঘোষণা করেছেন যে, খননকার্য থেকে প্রাপ্ত প্রমান থেকে অবশ্যপ্রমাণিত যে মসজিদের নীচে কোনো মন্দির কখনো ছিল না। কিন্তু, তাতে কি যায় আসে! কিন্তু, আজ ৬ই ডিসেম্বর। হিন্দু দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদ আর বৃহৎ পুঁজির একচেটিয়া আধিপত্যের আজ যে বাস্তবতা আমরা দেখতে পাচ্ছি , সেই প্রক্রিয়ার শুরুয়াৎ। লিখেছেন দেবাশিষ আইচ

 

Fascism is “the openly terrorist dictatorship of the most reactionary, most chauvinistic and most lmperialist elements of finance capital.”

Dimitrov Formulation, 1935.

 

বাবরি মসজিদ শুধু মাত্র একটি ধর্মীয় স্থান কিংবা ঐতিহাসিক সৌধ ছিল না। কয়েক হাজার ধর্মোন্মাদ এক বিশেষ দিনে, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২, শাবল-গাঁইতি দিয়ে মসজিদ ধ্বংস করে দিল স্রেফ ভারতের বুকে হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাকে সুপ্রতিষ্ঠা দিতে, তাও নয়। ৬ ডিসেম্বর এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এই যে, এই বিশেষ দিনটিতে স্বাধীন ভারতের বুকেহিন্দু দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিজম এই প্রথম তার পদচিহ্ন এঁকে দিল। ২৫ মে ২০১৪ সংসদে নরেন্দ্র মোদীর শপথ নিলেন। আবারও এই প্রথম, ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানে সরকারি ভাবে আমন্ত্রিত হল আরএসএস, এ-দেশের এক ও একমাত্র ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদী সংগঠন। কেননা, এই তো প্রথমবার আরএসএসের এক প্রচারক বা সর্বসময়ের কর্মী প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত অটলবিহারী বাজপেয়ী কোনোদিনই প্রচারক ছিলেন না, ছিলেন একজন স্বয়ংসেবক বা সদস্য। এই প্রথম ২৮২টি আসন পেয়ে লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বিজেপি। এবং স্বাধীনতার পর এর আগে ফিন্যান্স পুঁজি প্রধানমন্ত্রীর পদে এমন ‘সফল ও যোগ্য সিইও’ কখনও পায়নি। আজ চার বছর বাদে ফ্যাসিজমের প্রায় যাবতীয় চরিত্রলক্ষ্মণ দেশের শরীরে দগদগে ঘায়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

 

২০১৪ সালে আরএসএস দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে তুলে ধরে। বিজেপি দল হিসেবে তখনও তার সিদ্ধান্ত নেয়নি। তার আগেই, মুকেশ আম্বানি, অনিল আম্বানি, রতন টাটা, আদি গোদরেজ, গৌতম আদানিরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদী ছাড়া তাঁরা আর কাউকে দেখতে চায় না। কেননা মোদীর নেতৃত্বেই তো ফ্যাসিবাদী শক্তি এবং পুঁজির — -বিজেপি-আরএসএস এবং আম্বানি-আদানি শক্তির — এমন আশ্চর্য মেলবন্ধন ও সাফল্য পূর্বে কখনও দেখা যায়নি। সেই রসায়নাগার মোদীর গুজরাত। যা মোদীর নেতৃত্বে ফ্যাসিজমের আঁতুরঘর থেকে পুঁজির অবাধ চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়। অতএব সেই ‘গুজরাত মডেল’কে সামনে রেখে ‘হিন্দুত্ব’ নয় ‘উন্নয়ন’-এর স্লোগান তুলে ধরল পুঁজিপতিরা। বিজেপি তো বটেই আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতও পুঁজিপতিদের সিদ্ধান্তকে আরএসএসের সিদ্ধান্ত হিসেবেই মেনে নিলেন।

 

পুঁজির চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক সম্পদের নিঃশেষ লুণ্ঠন, সস্তা শ্রমিকের অবিরল যোগান এবং পুঁজির ফুলেফেঁপে ওঠার স্বার্থে শ্রমজীবী বিরোধী নীতি প্রয়োগ আমাদের মতো দেশে উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি প্রনয়ণের জন্য অতীব জরুরি। গণতন্ত্র যতক্ষণ পর্যন্ত যতদূর পর্যন্ত এই পুঁজিবাদকে সেবা করে যেতে পারবে, ততক্ষণ ও ততদূর পর্যন্ত পুঁজিবাদ গণতান্ত্রিক কাঠামো ও কর্মপদ্ধতিকে মানিয়ে চলে। এইখানে কোথাও যদি দুর্বলতা দেখা দেয় তবে পুঁজিবাদ তার সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে স্থিতিশীল স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাকেই বেছে নেয়।

 

ভারতীয় পুঁজিপতিরাও এবং অবশ্যই আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির প্রভুরা আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সঙ্কট, বিকৃত ও অসম উন্নয়নের দিনে তাই মোদীকেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছিল। অন্যদিকে,ইউপিএ ১ ও ২ আমলে কৃষিতে চরম সঙ্কট, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেসরকারিকরণ, বেকারত্ব, অভূতপূর্ব দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি শ্রমিক-কৃষক এবং অন্যান্য খেটেখাওয়া মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। উন্নয়নের স্লোগান এবং মিডিয়া থেকে প্রশাসনের প্রচার এই শ্রমজীবী এবং মধ্যবিত্ত মানুষের এক বড় অংশকে প্রভাবিত করে ফেলে। এ কথা সত্যি রাজীব গান্ধীর স্বল্পকালীন প্রধানমন্ত্রীত্বের দিন থেকে নরসিমা রাও থেকে মনমোহন সিং — উদারনৈতিক অর্থনীতির দরজা হাট করেই খোলা ছিল। কিন্তু, যে অর্থনৈতিক সংস্কার পুঁজিপতিরা চাইছিলেন, সেই দ্রুততার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কংগ্রেস নামক গান্ধী-নেহরু’র দলটির পক্ষে সম্ভব হয়নি। একমাত্র ১৯৯৮ সালের বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার কিছুটা হলেও প্রমাণ করতে পেরেছিল পুঁজিপতিদের এজেন্ডা বিজেপি’ই অপেক্ষাকৃত দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করতে পারে। কিন্তু, অতি দ্রুততা দ্রতহারেই ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। অন্যদিকে ইউপিএ আমলে একে তো সংস্কারের কাম্য গতি স্লথ হয়ে পড়ায় পুঁজিপতিরা অখুশি ছিলই, তার উপর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট, খাদ্য সুরক্ষা আইন কিংবা বনাধিকার আইন তাদের আরও হতাশ করে তোলে। স্বাভাবিক ভাবেই মতামত যারা নির্মাণ করে তাদের উপর বাড়তি দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। গ্রামীণ এবং শহরের গরিব মানুষের কর্মসংস্থান, দু’বেলা পেট ভরে খাবার, আদিবাসী এবং বনবাসীদের বনের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আইনি আয়োজন আসলে যে অর্থের জলাঞ্জলি, সে কথা প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে পুঁজিপতিদের পেটোয়া সংবাদমাধ্যম এবং অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ। এমত পরিস্থিতিতে স্বৈরতান্ত্রিক দল এবং ফ্যাসিস্ত সংগঠনের শরণাপন্ন হওয়াই পুঁজিপতি শ্রেণির কাছে কাম্য হয়ে ওঠে।

 

ব্রিটিশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. লরেন্স ব্রিট বিভিন্ন ফ্যাসিস্ত জমানাকে অধ্যয়ন করে —যেমন, মুসোলিনি, হিটলার, ফ্রাঙ্কো, সুহার্তো, পিনোচেত — দেখিয়েছিলেন যে, ফ্যাসিজমের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি দিয়ে প্রাথমিক ভাবে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে চিহ্নিত করা সম্ভব। এই ১৪টি বৈশিষ্ট হল:

# শক্তিশালী ও ধারাবাহিক জাতীয়তাবাদ
# মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা
# উদ্দেশ্যমূলক ভাবে একত্রিত করার জন্য শত্রু/নন্দ ঘোষ (স্কেপগোট) চিহ্নিত করা
# সামরিক বাহিনীর সার্বিক কর্তৃত্ব — সেনা বা সামরিক পেশাকে আকর্ষণীয় করে তোলা
# ব্যাপক পুরুষ-প্রাধান্যবাদ — সরকারে প্রায় একচেটিয়া পুরুষ সদস্যের উপস্থিতি
# নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম
# জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আচ্ছন্ন থাকা — আক্রান্ত হওয়ার ভয়কে উদ্দেশ্যসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে জনগণের উপর ব্যবহার করা
# ধর্ম ও সরকার বিজড়িত
# কর্পোরেট শক্তিকে নিরাপত্তা দান
# শ্রমশক্তিকে দমিত রাখা
# বুদ্ধিজীবী ও শিল্পের প্রতি ঘৃণা — ফ্যাসিস্ত দেশ সারস্বত প্রতিষ্ঠান এবং উচ্চশিক্ষার বিরোধী খোলামেলা শত্রুতাকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এটা খুবই সাধারণ বিষয় যে এ জাতীয় জমানায় অধ্যাপক কিংবা সারস্বত সমাজের কোনও ব্যক্তিকে নানাভাবে নিগৃহীত হতে হচ্ছে
# অপরাধ ও শাস্তি বিষয়ে অতিরিক্ত উৎসাহ — সাধারণ মানুষ দেশপ্রেম কিংবা নিরাপত্তার নামে পুলিশি বাড়াবাড়িকে লক্ষই করে না, এমনকি নাগরিক অধিকারকেও ভুলে বসে
# ব্যাপক দালালি ও দুর্নীতি — ফ্যাসিস্ত জমানায় জাতীয় সম্পদ এমনকি জাতীয় তহবিল তছরূপ, লুঠ কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়
# নির্বাচনে জালিয়াতি, জোচ্চুরি।

এবার আমরা যদি বিগত চার বছরের মোদী জমানার দিকে চোখ মেলে তাকাই তবে খুব সহজেই এই চোদ্দটি চারিত্রিক লক্ষ্মণের প্রায় সবকটিকেই চিহ্নিত করতে পারব।

 

আশার কথা, ভরসার কথা এই যে, ভারত নামক বিশাল বৈচিত্র্যময় দেশটিকে কখনও, কোনও কালে কোনও একক শক্তি — এক আদর্শ, এক অর্থনীতি, এক সমাজনীতি, একই রাজনীতিতে সম্পূর্ণ ভাবে করায়ত্ব করতে পারেনি। এক্ষেত্রে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ একটি সীমান্ত মানচিত্র গড়ে তুলতে পারলেও, তা তাদেরই হাতযশে দু’ভাগে ভেঙে যায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যও এ দেশকে পিন্ডবদ্ধ করে তুলতে পারেনি। “কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা —ভারত এক” জরুরি অবস্থাকালীন সেই স্লোগান নেহাতই অতিকথা। সাম্প্রতিক নানা সাধারণ নির্বাচন, উপনির্বাচন, পুরসভা, পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলির ফলাফল জানান দিচ্ছে, আরএসএস-বিজেপি-কর্পোরেট ত্রিফলার অতি আগ্রাসী আস্ফালনে সাধারণ মানুষ ক্রুদ্ধ। কৃষক সমাজ কখনও রাজস্থান, কখনও মধ্যপ্রদেশ, কখনও রাজস্থান, মহারাষ্ট্র আর অতি সম্প্রতি রাজধানীর রাজপথের দখল নিতে শুরু করেছে।

 

আর এখানেই মরিয়া হয়ে উঠেছে সঙ্ঘ পরিবার। ফের রাম মন্দির নির্মাণের দাবি জোরদার করে তুলছে। ভারতীয় পুঁজিপতি, আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির এখনও মোদীকে বড় প্রয়োজন। প্রয়োজন আরএসএস-কে। তাদের হিন্দুত্ববাদকে। কেননা, উন্নয়ন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, মিনিমাম গভর্নমেন্ট ম্যাক্সিমাম গভর্নেন্স — ২০১৪’র এই তিন কর্পোরেট প্রণোদিত এজেন্ডা মুখ থুবড়ে পড়েছে। অতঃপর একটা দেশব্যাপী দাঙ্গা চাই, প্রয়োজনে যুদ্ধ চাই — অন্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদ, হিন্দু সন্ত্রাসবাদের জোয়ারে শ্রমজীবী মানুষকে ভাসিয়ে দেওয়া এবং এককাট্টা করাই এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির এক ও একমাত্র প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠছে।

 

৬ ডিসেম্বর ভারতের বুকে ফ্যাসিবাদের পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার দিন। ৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ফ্যাসিবিরোধী মরণপণ সংগ্রামের জন্য শপথ নেওয়ার দিনও বটে। ৬ ডিসেম্বর শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলমান সংহতি দিবস নয়। ফ্যাসিবিরোধী সমস্ত বাম ও গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষের সংহতি উদযাপন দিবসও।

 

৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন গণসংগঠনের উদ্দ্যোগে কলকাতাতে প্রতিবাদ মিছিল।

 

 

 

 

ফটোগ্রাফার: সৌরভ  কুমার  বসু

Share this
Leave a Comment