এনআরসি, জাতীয়তাবাদ ও গণবিপন্নতা। তৃতীয় পর্ব : ঘটমান বর্তমান ও অসমে বিজেপি


  • September 21, 2018
  • (0 Comments)
  • 2082 Views

এপিডিআর, চন্দননগর-এর আহ্বানে ১৬ জুলাই, ২০১৮ ভূপেন সেন স্মারক বক্তৃতা। ‘এনআরসি, জাতীয়তাবাদ ও গণবিপন্নতা’ শীর্ষক সেই বক্তৃতাটির এটি পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপ, যা কয়েকটি ভাগে গ্রাউন্ডজিরোতে প্রকাশিত হবে। এটি তৃতীয় পর্ব। লিখছেন বক্তা দেবাশিস আইচ

অসমে বিজেপি সাফল্য পাচ্ছে কেন? অহমিয়া স্বাভিমান ও জাতি-মাটি-গৃহ স্লোগানের ‘মাস্টার মুভ’ কাজে লাগিয়ে, একদিকে অসমিয়াদের, অন্যদিকে বোড়ো, ডিমাসা, মিসিং, কার্বি, তিওয়া, ঝাড়খণ্ডি বাঙালি, খিলঞ্জিয়া মুসলমানদের বিভেদের রাজনীতিতে এককাট্টা করে। সুপরিকল্পিত ভাবে নেতৃত্বে রাখা হয়েছে সর্বা‌নন্দ সোনোওয়ালকে, যিনি ‘বিদেশি’ বিতাড়নের ক্ষেত্রে আইএমডিটি অ্যাক্টকে বাতিল করে ন্যায়ধর্ম-নির্ভর বিচার ব্যবস্থাবিরোধী ফরেনার্স‌ অ্যাক্টকে বলবৎ করে অসমে ‘জাতীয় নায়ক’ হয়ে দাঁড়ান।

প্রথম পর্বদ্বিতীয় পর্বের লিংক।

 

‘জাতি, মাটি ভেত্তি’

২০১৬ সালে অসমে ক্ষমতায় আসে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। এই জয় এককথায় ঐতিহাসিক। ১২৬টি আসনের মধ্যে একা বিজেপি পায় ৬০টি আসন। ২০১১ সালে যেখানে বিজেপি মাত্র ৫টি আসন পেয়েছিল। জোট সঙ্গী অগপ পায় ১৪টি এবং অন্য জোট সঙ্গী বোড়ো পিপলস ফ্রন্ট পেয়েছিল ১২টি। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসের জোটে মাত্র ২৬টি আসন। ২০১১ সালে কংগ্রেস পেয়েছিল ৭৮টি আসন। শতকরা ভোটের হিসেবে দেখা যাচ্ছে ২০১৬ সালে কংগ্রেস ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েছে। যেখানে ২০১১ সালে পেয়েছিল ৩৯.৩৯ শতাংশ ভোট। ২০১৬ সালে বিজেপি পেয়েছে ২৯.৫ শতাংশ। ২০১১ সালে যেখানে মাত্র ১১.৬৭ শতাংশ ভোট পায় বিজেপি। অসমের অন্যতম প্রধান দল এআইইউডিএফ পেয়েছিল ১৩টি আসন যা ২০১১’র তুলনায় পাঁচটি কম। ভোট প্রাপ্তির হার দু’টি ক্ষেত্রেই সমান ১৩ শতাংশ। বিজেপি’র এই সাফল্যের শুরু কিন্তু ২০১৪’র লোকসভা থেকে। ১৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি একাই পায় সাতটি আসন। এবং ৩৬.৮৬ শতাংশ ভোট।

কেন এই সাফল্য? নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ থেকে সমাজতত্ত্ববিদ এমনকি বিজেপি’র প্রবক্তাদের বিশ্লেষণের সুর প্রায় এক।

প্রথমত, নির্বাচনী স্লোগান। ‘জাতি মাটি ভেত্তি।’ বা নেশন ল্যান্ড হার্থ বা জাতি মাটি ও সুখী গৃহকোণ বা গৃহ। একেবারেই স্থানীয় যে সেন্টিমেন্ট, যে সামাজিক-রাজনৈতিক আবহ তাকেই তুলে ধরা। আমরা এতক্ষণ তো এই জমি, জাতি বিরোধ, উচ্ছেদ-দাঙ্গার সমস্যা নিয়েই কথা বললাম। অসমের সর্বস্তরের মানুষ এই সমস্যায় জর্জরিত। এই স্লোগানের উপর ভিত্তি করেই অসমিয়া ছাড়াও বোড়ো, ডিমাসা, মিসিং, কার্বি, তিওয়া, ঝাড়খণ্ডি বাঙালি, খিলঞ্জিয়া মুসলমানদের এককাট্টা করার প্রয়াস।

দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হল সোনোয়াল/কাছাড়ি জনজাতি গোষ্ঠীর সর্বানন্দ সোনোয়াল-এর নাম। সোনোয়াল ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন আসু’র সভাপতি। ২০১১ সালে যোগ দেন বিজেপি-তে। ২০১৪ সালে লোকসভায় জিতে হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত স্বাধীন মন্ত্রী। অসমের জাতীয়তাবাদীদের কাছে তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচয় তিনি ‘জাতীয় নায়ক’। সুপ্রিম কোর্টে তাঁর করা মামলার জন্যই ১৯৮৫ সালে ‘ইললিগ্যাল মাইগ্রেন্টস (ডিটারমিনেশন বাই ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট, ১৯৮৩’ বা ‘আইএমডিটি অ্যাক্ট’ বাতিল হয়। এ বিষয়ে আসব। এবং এই প্রথম জনজাতি গোষ্ঠীর কাউকে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হল। তৃতীয়ত, কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে দলে টানা এবং বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি মনোনীত করা। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে অগপ এবং বিপিএফ-এর সঙ্গে সার্থক জোট। অসম কেন্দ্রিক নির্বাচনী প্রচার, জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুকে মাথা চাড়া দিতে না-দেওয়া এবং সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অসম নির্বাচনে মুখ্য মুখ হিসেবে না তুলে ধরা। বলা হচ্ছে, নির্বাচনের এই লক্ষ্য এবং রণকৌশল বিজেপি’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবের মস্তিষ্কজাত। এর সঙ্গে টেনে আনা হয় ‘অহমিয়া স্বাভিমান’-এর প্রতীক মোঘল সেনাপতি মির জুমলার বিরুদ্ধে ১৬৭১ সালে সরাইঘাট যুদ্ধের বিজয়ী সেনানায়ক লাচিত বরফুকন-এর নাম। পাশাপাশি, অসম নির্বাচনের ঠিক ছ’ মাস আগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ঘোষণা করে, “‘পাসপোর্ট (এন্ট্রি ইনটু ইন্ডিয়া) রুলস ২০১৫’ অনুসারে হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও পার্সি ধর্মাবলম্বী মানুষ যদি ধর্মীয় কারণে হেনস্থা বা হয়রান হয়ে ভারতে সে দেশের পাসপোর্ট-সহ কিংবা পাসপোর্ট ছাড়াই আসেন তবে তিনি ঢুকতে পারবেন। থাকতেও পারবেন। তাঁদের বিতাড়ন করা যাবে না।” এই গেজেট নোটিফিকেশনই পরে সংসদে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল হিসেবে আনা হবে।

‘জাতি, মাটি ভেত্তি’ কী জাতীয় প্রভাব ফেলেছিল সে প্রসঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক উদয়ন মিশ্র ইপিডবলিউ-তে এক নিবন্ধে মন্তব্য করেন, “This had a strong political appeal amongst the indigenous Assamese and all the ethnic groups. … it was clearly the preservation of the land and the identity of the indigenous people that found greater resonance during the campaign. That is why the elections were referred to as the battle of Saraighat for the Assamese people and memories of the anti-foreigner agitation of the 1980’s were revived.” এছাড়াও বোড়োদের পাশাপাশি সমতলের জনজাতি তিওয়া ও রাভা এবং পাহাড়ি জনজাতি ডিমাসা ও কার্বি জনজাতিদের সংগঠনগুলিকেও বিজেপি তাদের জোটের আওতায় নিয়ে আসে। উদয়ন মিশ্র যাকে বলছেন ‘মাস্টার মুভ’।

বিদেশি বিতাড়ন আইন ও প্রক্রিয়া

বিংশ শতাব্দীতে অসমিয়া উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান অসমিয়া জাতীয়তাবাদকে এক নতুন মাত্রা দেয়। এঁরা রাজনৈতিক ভাবে যেমন ছিলেন বিচক্ষণ তেমনি ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নেও যথেষ্ট গর্বিত। উনবিংশ শতাব্দীতে নানা স্তরে বাঙালিদের আধিপত্য, ভাষা, জমির প্রশ্ন – প্রায় পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা ভুলে যেতে পারেননি। সুতরাং, বিদেশি ভীতির রাজনীতি, নিজ রাজ্যে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার অমূলক ভয় কোনোদিনই অসমের পিছু ছাড়ল না। বিদেশি শনাক্তকরণ, বিতাড়নের জন্য এত আইন বা সন্দেহজনক বিদেশিদের জন্য ডিটেনশন ক্যাম্প এ দেশের আর কোথাও নেই। এ প্রসঙ্গে আসার আগে বিদেশি শনাক্তকরণ ও বিতাড়নের এক কিস্যা বলে নেওয়া যাক। সঞ্জয় হাজরিকার ‘রাইটস অভ প্যাসেজ’ গ্রন্থে আপনি এই কাহিনি পাবেন।

কে পি এস গিল তখন নগাঁও-এর পুলিশ সুপার। ‘৬০- এর দশক। বেআইনি অনুপ্রবেশ নিয়ে তখন অসম বেশ সরগরম। অনুপ্রবেশ সমস্যা সমাধানে ‘প্রিভেনশন অভ ইনফিল্ট্রেশন ফ্রম পাকিস্তান বা পিআইপি স্কিম, ১৯৬৪ চালু হয়েছে। গিল চিরকালই ডাকাবুকো অফিসার। কিন্তু, তেমন সুবিধে করতে পারছেন না। এ সময় এক অধস্তন কর্মী পরামর্শ দিলেন, এ ভাবে হবে না। স্থায়ী বসবাসকারী মুসলমান নেতাদের ডাকুন, তাদের কাছে জানতে চান নতুন কারা কারা এসেছে। কাজ হবে। এর পর জেলার বিভিন্ন থানার পুলিশ অফিসাররা নেতাদের নরমে-গরমে বোঝালেন, তালিকা তৈরি হতে থাকল। এবার তাদের তুলে এনে নগাঁও জুবিলি ময়দানে রাখা হল। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তগামী ট্রেনে চড়িয়ে দিয়ে পার করা হতে থাকে। গিলের দাবি, এভাবে দু’বছরে তিনি এক লক্ষ পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালিকে সীমান্ত পার করিয়েছেন। আরো এক লক্ষ নাকি অসমের অন্য অঞ্চল থেকেও পার করা হয়েছে। গিল মনে করতেন ‘আত্মসমপর্ণ’ করিয়ে সীমান্ত পার করে দেওয়াটাই সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। আমরা জানি গিলরা এভাবেই ভাবেন।

পিআইপি, ১৯৬৪’র আগে ছিল ‘ইমিগ্র্যান্ট‌স (এক্সপালসন ফ্রম আসাম) অ্যাক্ট, ১৯৫০’। এই আইনে ছিল হিন্দু-মুসলমান বৈষম্য। মুসলমান মানে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। আর হিন্দুরা শরণার্থী। বিজেপি তখন থাকলে নিশ্চয় আহ্লাদে আটখানা হত। তবে, হিন্দুত্ববাদিতার শিকড় তো এ দেশে অনেক কালই অনেক গভীরেই চারানো। ১৯৫৭ সালে এই সংবিধান বিরোধী বৈষম্যমূলক আইন বাতিল হয়। অন্যদিকে অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার সুকৌশলে একটি প্রশাসনিক আদেশ জারি করে। সেখানে বলা হয় যদি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা কোনো হিন্দু ছ’মাস ভারতে বসবাস করেন তবে জেলাশাসকের কাছে আবেদনের ভিত্তিতে তিনি নাগরিকত্ব পাবেন। এই আদেশও পরবর্তীতে বাতিল হয়েছিল। এর পরেও রয়েছে, আইএমডিটি (বেআইনি অভিবাসী নির্ধারণ আইন) ১৯৮৩; সন্দেহজনক অনুপ্রবেশকারীদের উৎখাত বা আটক করার উদ্দেশ্যে ‘ডি’ বা ডাউটফুল ক্যাটেগরির ভোটার চিহ্নিতকরণ। ১৯৯৭ সালে ইলেকশন কমিশন এই ‘ডি’ ভোটার শ্রেণিবিভাগ তৈরি করে। ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় ইসি নিয়োজিত যে ব্যক্তিরা সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজনের দায়িত্বে থাকেন, তাঁদের সন্দেহ হলেই তালিকায় ‘ডি’ বা ডাউটফুল ভোটারের ঢ্যাঁড়া পড়ে যাবে। এর পর নির্বাচনী আধিকারিকের কাছে। আধিকারিক পাঠাবেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার (সীমান্ত)-কে, তিনি ‘ডি’ ভোটারকে নোটিশ দিয়ে কেস পাঠাবেন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। ১৯৬৪ সাল থেকেই এই ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে। সীমান্তে পুলিশের যদি আপনাকে বিদেশি বলে সন্দেহ হয় তবে সে একই ভাবে পুলিশ সুপারের জ্ঞাতার্থে এনে ট্রাইব্যুনালে পাঠাবে। ট্রাইব্যুনাল আপনাকে ডেকে পাঠাবে। প্রায় শ’খানেক এমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে অসমে। একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখছি ১.২৫ লক্ষ ভোটার ‘ডি’ তালিকাভুক্ত। আপনি যথাযথভাবে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ না করতে পারলে আপনার জন্য রয়েছে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’। এমন ছ’টি ক্যাম্প (আসলে জেলার জেলগুলিরই একাংশে ক্যাম্প করা হয়েছে।) রয়েছে অসমে। সেখানে অত্যন্ত অমানবিক পরিবেশে রয়েছেন হাজার খানেক অত্যন্ত অসহায় গরিব মানুষ। যাঁরা আইনি লড়াই করার ক্ষমতাই রাখেন না। একমাত্র অ্যাপিল আদালতটি গুয়াহাটি হাইকোর্টে। বিচারক একজন।

সংসদে আইন পাশ করে ‘আইএমডিটি অ্যাক্ট, ১৯৮৩’ চালু হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী সরকারের আমলে। এই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন সর্বানন্দ সোনোয়াল। তাঁর দাবি ছিল, এই আইন আদৌ কার্যকরী নয় এবং এই আইনের ফলে বিদেশি চিহ্নিতকরণ, বহিষ্কার কিংবা ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে। আরো একটি বিষয় হল, ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬ সারা দেশে বলবৎ হলেও অসমে তা বলবৎ নয়। সুতরাং আইনের চোখে তা বৈষম্যসূচক।  পাশাপাশি, অটলবিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ডিরেক্টর যতীন্দ্রবীর সিং আদালতে জানায়, “…since the enforcement of the IMDT Act only 1,494 illegal migrants had been deported from Assam up to 30th June 2001. In contrast 4,89,046 number of Bangladeshi nationals had been actually deported under the Foreigners Act, 1946 from the state of West Bengal between 1983 and November 1988. The IMDT Act failed to fulfill the objective for which it was enacted which is apparent from the poor result and it places Assam in a different position from rest of the country where the Foreigners Act, 1946 is applicable.” এখানে একটি তথ্য দেওয়া জরুরি যে, বিদেশি আইন বা ফরেনার্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬ অনুযায়ী আপনি বিদেশি বলে অভিযুক্ত হলে আপনাকেই প্রমাণ দিতে হবে আপনি বিদেশি নন। যা ন্যায়ধর্ম-নির্ভর বিচার ব্যবস্থা বা ন্যাচারাল জাস্টিসের বিরোধী। অন্যদিকে আইএমডিটি আইন অনুযায়ী প্রমাণের দায় ছিল অভিযোগকারীর। এছাড়াও আইএমডিটি-তে বিচার ব্যবস্থাই শেষ কথা বলে, অথচ ফরেনার্স অ্যাক্টে জোর পুলিশি ব্যবস্থার। এখন তো ‘ডাইনি’ খুঁজতে গিয়ে অসমের সব মানুষকেই নাগরিক পঞ্জির মাধ্যমে প্রমাণ করতে হচ্ছে তারা বিদেশি নয়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট আইএমডিটি অ্যাক্ট সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করে। এর পাশাপাশি, এই আইনের আওতাধীন যে আইএমডিটি ট্রাইব্যুনাল, অ্যাপিল ট্রাইব্যুনাল তৈরি হয়েছিল তাও বাতিল করে দেওয়া হয়। আদালত বলে, পাসপোর্ট (এন্ট্রি ইনটু ইন্ডিয়া) অ্যাক্ট, ১৯২০, ফরেনার্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬, পাসপোর্ট অ্যাক্ট, ১৯৬৭ অসমের ক্ষেত্রেও জারি হবে। আর ১৯৮৩’র ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলি পাঠিয়ে দিতে হবে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। এই রায়ের পর সোনোয়াল অসমিয়াদের কাছে ‘জাতীয় নায়ক’ এর মর্যাদা পান।

এত আইন আর আইনের মারপ্যাঁচের ফল হল, পর্বতের মূষিক প্রসব। ১৯৮৫ থেকে ২০০৫ যে সময়ে আইএমডিটি অ্যাক্ট ১৯৮৩ চালু ছিল এবং যে সময়ে অগপ দু’দুটি দফায় (১৯৮৫-‘৯০ এবং ১৯৯৬-‘০১) ক্ষমতায় ছিল, সেই সময় প্রায় কুড়ি বছরে মাত্র ৪২ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে এবং ২৮ হাজার বিদেশি বলে শনাক্ত হয়। ফেরত পাঠানো হয় মাত্র ৬৭৪ জনকে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরবর্তী ছ’বছরে ৬৫ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে এবং প্রায় ১৩ হাজার মানুষ বিদেশি বলে শনাক্ত হন যদিও মাত্র ২২১ জনকে ফেরত পাঠানো গিয়েছে। এই হল মোদ্দা হিসেব।

 

চতুর্থ (শেষ)পর্বটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

 

ছবি সৌজন্যে – এপিডিআর, চন্দননগর

লেখক স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।

Share this
Leave a Comment