এনআরসি, জাতীয়তাবাদ ও গণবিপন্নতা। প্রথম পর্ব : বাদ পড়ল চল্লিশ লক্ষ


  • September 19, 2018
  • (0 Comments)
  • 3437 Views

এপিডিআর, চন্দননগর-এর আহ্বানে ১৬ জুলাই, ২০১৮ ভূপেন সেন স্মারক বক্তৃতা। ‘এনআরসি, জাতীয়তাবাদ ও গণবিপন্নতা’ শীর্ষক সেই বক্তৃতাটির এটি পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপ, যা কয়েকটি ভাগে গ্রাউন্ডজিরোতে প্রকাশিত হবে। এটি প্রথম পর্ব। লিখছেন বক্তা দেবাশিস আইচ:

যে বিষয় নিয়ে লিখছি, তা এককথায় অত্যন্ত জটিল এক রাজনৈতিক, আইনি ও মানবিক বিষয়। এমন একটি বিষয়ের প্রতি আপনাদের যে আগ্রহ তার সঠিক মূল্য দিতে পারব কি না, সে ব্যাপারে আমার সংশয় রয়েছে। সংশয় এই জন্য আরও যে, বিষয়টি শুধু জটিল তা নয় অত্যন্ত সংবেদনশীল। অসম সমস্যা -কখনো বহিরাগত বনাম খিলঞ্জিয়া (স্থানীয়), কখনো ভাষাবিবাদ, বা বিদেশি খেদাও এবং অসম আন্দোলন – নানা ভয়ংকর রূপ ধরে আমাদের সামনে এসেছে। তার হাত ধরে এসেছে একের পর এক দাঙ্গা, এমনকি গণহত্যা। পরিস্থিতি এখন প্রকৃতই অগ্নিগর্ভ, যার আঁচ পশ্চিমবঙ্গে বসে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। এই সময় এ বিষয়ে যে কোনো আলোচনায় গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সুবেদিতা কাম্য। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার কাজটি এটাই যে, আমি আপনাদের সামনে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরব। সঙ্গে কিছু বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য। স্বল্প পরিসরে এবং নির্দিষ্ট সময়ে যতটুকু সম্ভবপর।

 

এনআরসি বা ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেন যা বাংলা করলে দাঁড়ায় জাতীয় নাগরিক পঞ্জি। আমরা এখানে বহুল ব্যবহৃত এনআরসি যেমন বলব, তেমনি সংক্ষেপে নাগরিক পঞ্জি বা পঞ্জি বলব। ১৯৫১ সালে জণগণনার পাশাপাশি এই নাগরিক পঞ্জি তৈরি হয়। আর এই নাগরিক পঞ্জি নবীকরণের অর্থ হচ্ছে, আপনি যে দেশের নাগরিক তা প্রমাণ করার জন্য ১৫ ধরণের প্রামাণ্য তথ্য দিতে হবে। যদিও, এর মধ্যে অত্যন্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি নথি গ্রহণযোগ্য হবে না বলে সম্প্রতি প্রতীক হাজেলা ঘোষণা করেছেন। যা নিয়ে বিতর্ক বেঁধেছে। এনআরসি’র ক্ষেত্রে আপনাকে বংশানুক্রমিক তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে আপনার পূর্ব পুরুষ এ দেশের নাগরিক ছিলেন, ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জিতে থাকা পূর্বসূরির সঙ্গে যুক্ততা তৈরি করতে হবে। যাকে লিগ্যাসি ডেটা বলা হচ্ছে। পিতা-মাতার স্থায়ী বাসস্থানের নথি, জন্মের নথি, বিবাহের নথি, ভোটার তালিকা, সরকারি চাকরি কিংবা পেশাদারি কাজে যুক্ত থাকার নথি এবং অন্যান্য তথ্যের সাহায্যে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি ১৯৭১ সালের আগে এ দেশের নাগরিক বা আপনার রক্তসম্পর্কের আত্মীয়রা নাগরিক ছিলেন। অবশ্য ১৯৫১ সালের পঞ্জি আদৌ প্রামাণ্য তথ্য হওয়ার যোগ্য কি না সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ২০১৮’র ৭ আগস্ট সমাজতত্ত্ববিদ এবং “দ্য বিলিগার্ড নেশন: মেকিং এন্ড আনমেকিং অব দি আসামিজ ন্যাশনালিটি” গ্রন্থের লেখক, সজল নাগ আনন্দবাজার পত্রিকায়, এক উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে সরাসরি এই প্রশ্ন তুলেছেন, “১৯৫১ সালের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি হয়েছিল খুব গোপনে, জনশুমারির জন্য জমা দেওয়া স্লিপের ভিত্তিতে। সেই প্রক্রিয়ায় নজরদারির সুযোগ ছিল না, এই পঞ্জি প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে গণ্য হওয়ারও যোগ্য ছিল না। আক্ষেপের কথা, নাগরিকত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি কোনও প্রামাণ্য তথ্য হতে পারে না – এই মর্মে কোনও প্রতিবাদী আবেদন সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়েনি।”

হঠাৎ কেন অসম রাজ্য জুড়ে সেখানে বসবাসকারীদের উপর ভারতের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ দেওয়ার দায় চাপিয়ে দেওয়া হল? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে অসম আন্দোলন এবং ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তির মধ্যে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ আসু বা অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক দল অসম গণ পরিষদের ‘বিদেশি তাড়াও’ আন্দোলনের কথা আমরা জানি। এই আন্দোলনের পিছনেও আরো এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সে কথায় পরে আসব। অর্থাৎ, বলতে চাইছি, অসম আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। কিন্তু, তা ছিল সুপ্ত। সে বারুদের স্তূপে স্ফূলিঙ্গ হিসেবে কাজ করল মঙ্গলদৈ লোকসভার উপনির্বাচন। ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে এই কেন্দ্রে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হয়। এই সময় নির্বাচনী অফিসে একের পর এক অভিযোগ এই মর্মে জমা পড়তে থাকল যে, বহু বাংলাদেশি ভোটার তালিকায় রয়েছে। এমন প্রায় ৭০ হাজার অভিযোগ জমা হয়। সরকার অভিযোগ পত্র খতিয়ে দেখতে ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে। ট্রাইব্যুনাল ৪৫ হাজার অভিযোগ অনুমোদন করে। যা হল মোট ৬ লক্ষ ভোটারের ৬৪ শতাংশ। অভিযোগের এমন ধারাবর্ষার পিছনে অত্যন্ত সংগঠিত শক্তি কাজ করছিল বলেই মনে হয়। এ কথা মনে করার কারণ আছে এই জন্য যে, ১৯৭৮ সালে দিল্লিতে তৎকালীন চিফ ইলেকশন কমিশনার শ্যামলাল শাকধের মন্তব্য করেন, “In one state (অসম), the population in 1971 recorded an increase as high as 34.98 per cent over the 1961 figures and this increase was attributed to the influx of a very large number of persons from the neighbouring countries.”

অর্থাৎ, ১৯৭৯ সালের অভিবাসী বিরোধী ঝোঁক বলুন, প্রবণতা বা পক্ষপাত বলুন তার সুরটি বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। এই সাংবাদিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তা মান্যতাও পেল। একটি কথা মনে রাখতে হবে এই সময় কী কেন্দ্রে কী রাজ্যে কংগ্রেস হীনবল। বিমলা প্রসাদ চালিহা বা ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের মতো নেতারা প্রয়াত। দেবকান্ত বরুয়া’র মতো নেতাও জরুরি অবস্থা ও জনতা পার্টির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে অস্তাচলে। যদিও ১৯৭৯ সালের মধ্যে জনতা পার্টি ত্রিধা বিভক্ত হবে। ২২ অগস্ট ১৯৭৯ চরণ সিং সরকারের পতনের ফলে লোকসভার মেয়াদ শেষ হয়। ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ অসমের গোলাপ বরবরা মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ১৪ জানুয়ারি ১৯৮০ ইন্দিরা গান্ধী ফের ক্ষমতায় আসীন হবেন। মঙ্গলদৈ-এ ফিরি। লোকসভা আসনটিতে ভোটার তালিকা সংশোধন করতে গিয়ে এই যে বাড়তি ভোটারের সন্ধান পাওয়া গেল, অভিযোগ উঠল, এর এক বড় অংশ বাঙালি মুসলমান। এরা কি আদৌ বিদেশি বা কতজন বিদেশি – এই খোঁজের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াল, আশু ইস্যু হয়ে দাঁড়াল বিদেশি ও অনুপ্রবেশ সমস্যা। প্রফুল্লকুমার মহন্ত, ভৃগু ফুকনের নেতৃত্বাধীন আসু শুধু মঙ্গলদৈ নয়, অসম থেকে বিদেশি বিতাড়নের জোরালো আওয়াজ ওঠাল। ‘সেভ আসাম টু সেভ ইন্ডিয়া’ হয়ে উঠল প্রধান স্লোগান। পাশে দাঁড়াল ‘অসম সাহিত্য সভা’র মতো বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত অসমিয়াদের মধ্যে সাহিত্য সভার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব অসীম। এছাড়াও যুক্ত হল ‘পূর্বঞ্চলীয় লোক পরিষদ’, ‘অসম জাতীয় দল’-এর মতো সংগঠন। এই আন্দোলনের এক মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি মুসলমান এবং হিন্দু নেপালিরা। কিন্তু, বাঙালি হিন্দু থেকে বিহারি হিন্দুরাও ক্রমে লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। বিদেশি বলতে কাদের বোঝায় তা এই বাক্য থেকে স্পষ্ট, ‘আলি কুলি বাঙালি, নাক চ্যাপ্টা নেপালি’। এঁরা হলেন টার্গেট। আলি বলতে মুসলমান, কুলি অর্থে বিহারি বা হিন্দিভাষী, বাঙালি হল হিন্দু বাঙালি। আন্দোলন যখন ভয়াবহ আকার নেয় তখন দলবদ্ধ মিছিল থেকে আওয়াজ উঠেছে – ‘আহ ও আহ / উলাই আ / খেদ অহ খেদ / বিদেখিক খেদ।’ এ ছিল ওয়ার ক্রাই। যার বাংলা করলে দাঁড়াবে, ‘আয় আয় / বেরিয়ে আয় / খেদাও খেদাও / বিদেশিদের খেদাও।’ আর প্রিয় জয়ধ্বনি ছিল ‘জয় আই অসম’। ‘আই’ অর্থে ‘মা’। ছাত্রদের এই আন্দোলনের প্রথম পর্বে পাশে দাঁড়িয়েছিল অসমিয়া জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশ। ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রের রাজীব গান্ধী সরকার এবং আসুর মধ্যে অসম চুক্তি সম্পন্ন হয়। সে চুক্তিতে অবশ্য এনআরসি’র কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু এ কথা স্মরণ রাখতে হবে, আন্দোলনের প্রথম পর্বেই আসু ১৯৫১ সালের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির ভিত্তিতে ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবি তুলে ছিল। মোদ্দা লক্ষ্যটি বোঝা যাবে তিনটি শব্দ দিয়ে – থ্রি ডি’স – ডিটেকশন, ডিলিশন, ডিপোর্টেশন। এই মূহুর্তে অসমের জাতীয়তাবাদী সংগঠন এবং ভারতীয় জনতা পার্টি কিন্তু বার বার এই লক্ষ্যের কথাই জোরের সঙ্গে বলে চলেছে। নাগরিকপঞ্জি নবীকরণের দাবি কিন্তু বিজেপি’র অসম নির্বাচনের ম্যানিফেস্টোতেই পাওয়া যাবে। এখন কথা হল, তা কি আদৌ সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব।

অসম চুক্তির মূল দুটি ধারা যা এখানে জরুরি, সে প্রসঙ্গে আসার আগে আর একটি কথা বলে নিই। একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। সাংবাদিক, অসম ও উত্তর-পূর্ব বিশেষজ্ঞ এবং বর্তমানে কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ-এর ডিরেক্টর সঞ্জয় হাজরিকা’র বিখ্যাত “স্ট্রেঞ্জার অব দ্য মিস্ট / টেলস অব ওয়ার এন্ড পিস ফ্রম ইন্ডিয়া’স নর্থইস্ট”-এ জানাচ্ছেন, অসম আন্দোলনের সময় বিদেশি বা আসু’র চোখে বাংলাদেশির যে সংখ্যা আসু তুলে ধরেছিল তা হল ফোর মিলিয়ন বা ৪০ লক্ষ। এনআরসি সেই সংখ্যাটাই কি খুঁজে পেল? না কি তাকে খুঁজে পেতেই হবে?

অসম চুক্তি’র মূল সূত্র দু’টি হল, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে যাঁরা অসমে এসেছেন তাঁরা টানা দশ বছর ভারতে বসবাস করার পরই নাগরিকত্ব পাবেন। এবং ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর যাঁরা এসেছেন তাঁদের চিহ্নিত করে বিতাড়িত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার আসু’র কিন্তু মূল দাবি ছিল ১৯৬৬ সালের পর থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সকলকেই বিতাড়িত করতে হবে। কেন্দ্র এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি তার একটি প্রধান কারণ, সাতচল্লিশ পরবর্তী কালে এই সময়ই বিপুল পরিমাণ হিন্দু ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়। সরকারি হিসেব বাংলাদেশের তৎকালীন শাসকদের মদতে সংখ্যালঘু বিরোধী দাঙ্গার প্রভাবে ১০ লক্ষ মানুষ পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। যার মধ্যে ছিল ৯ লক্ষ ২০ হাজার হিন্দু। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশ যুদ্ধের শুরু। ওই একাত্তরেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৮৫ সালে অসম গণ পরিষদ ক্ষমতায় আসে। মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্ল মহন্ত। তার আগেই আসু’র দাবি মতো হিতেশ্বর শইকিয়া মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আসু নেতৃত্ব বা অগপ ১৯৭১-এর ভোটার তালিকা মোতাবেক ১৯৮৪ সালে যে ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছিল – সেই তালিকাকে মান্য করেই নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছিল। অর্থাৎ, তারা নিজেদের দাবির সঙ্গে সমঝোতা করে নিয়েছিল। যে ভোটারদের পত্রপাঠ ঘাড়ধাক্কা দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছিল, তা শিকেয় তোলা হল। আর আগেই বলেছি ১৯৭১-এর আগে ভারতে আসা মানুষদের বিষয়টি আসু চুক্তিতেই মেনে নেয়।

আর এখানেই আমরা নেলি গণহত্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করব। আসু’র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রশাসন নেই বললেই চলে। ডিগবয় অবরুদ্ধ হচ্ছে বার বার। সামরিক বাহিনীকে ডাকতে হচ্ছে। এই সময় ইন্দিরা গান্ধী ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেও দু’পক্ষই স্ব স্ব দাবিতে নাছোড়। ইন্দিরা ঠিক করলেন বিধানসভা নির্বাচন করবেন। আসু পরিষ্কার জানিয়ে দিল, ‘নো ডিটেকশন, নো রিভিশন, নো ইলেকশন’। ভোট বন্ধ করতে বুথে বুথে গণ প্রতিরোধ, জনতা কার্ফু জারি হল। সেতু পুড়ল, গ্রাম আক্রান্ত হল, রাস্তা কাটা পড়ল, বহু ভোটকর্মী ভোট পরিচালনা করতে চাইলেন না। তবু ভোট হল। এক কথায় ভোটের নামে প্রহসন হল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য যে, ভোট যতটুকু হল তা বাঙালি প্রধান বরাক উপত্যকা, জনজাতি ও মুসলমান প্রধান কেন্দ্রগুলিতে। ভোটের পক্ষে ছিল নেলি। অর্থাৎ বোঝা যায়, আসু আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্তরা নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের মনোভাব প্রকাশ করে।

তিরাশি’র ১৮ ফেব্রুয়ারির এক সকাল। নেলি ও তার আশেপাশের ১৪টি গ্রাম তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়। এক একটি দিকে প্রায় দু’হাজার সশস্ত্র জনতা। আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, তবে বেশি করে ছিল বড়ো বড়ো দাও, চওড়া ভারী ছুরি, বর্শা, তির-ধনুক। ছ’ঘণ্টার অপারেশন। সরকারি হিসেব মতো মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ২২০০ মানুষের। সিংহভাগ নারী, কিশোরী, শিশু,বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। যাঁরা দৌড়ে নিরাপদ স্থানে পালাতে পারেনি। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ঘরবাড়ি, ফসল। আহত অসংখ্য। নিশ্চিন্তে গণহত্যা চালিয়ে প্রায় হাজার ছয়েক হত্যাকারী। ফিরে যাওয়ার ঢের পরে এসেছিল পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী। অভিযোগ, হত্যাকারীরা মূলত ছিল তিওয়া জনজাতির মানুষ। আসু সমর্থক অসমিয়ারাও ছিল বলেও অভিযোগ। ঘটনার কারণ হিসেবে একটি তত্ত্ব হাজির করা হল যে, এই মুসলমানরা নানা ভাবে তিওয়াদের জমি গ্রাস করে বসতি স্থাপন করেছে। সেই রাগ-ক্ষোভই ১৮ ফেব্রুয়ারি ফেটে পড়ে। যে কথা বলা হল না, নেলির মুসলমানরা ১৯৩০ সাল থেকে সেখানে বসবাস ও চাষাবাদ করছে। সরকারি তথ্য, জমির রেকর্ড তাই বলে। তিওয়াদের জমি যেমন ছিল, সরকারি খাসজমিও ছিল। জমি নিয়ে আদিবাসী-অভিবাসী বিবাদ নতুন নয়। কিন্তু, হঠাৎ ৫০ বছর বাদে শত শত তিওয়া এই গণহত্যায় মেতে উঠবে কেন? যদি না কোনো কায়েমি স্বার্থের মদত থাকে। আর শুধু তো নেলি নয়, আরো কয়েকটি গণহত্যার ঘটনা এই সময় ঘটে। দরং জেলার চাউলখোয়া ও খয়রাবাড়িতে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানরা আক্রান্ত হন। শোণিতপুর জেলায় অসমিয়াদের হাতে আক্রান্ত হন বোড়ো জনজাতির মানুষ। বোড়োদের তাড়া করে অরুণাচল সীমান্তে পাঠানো হয়। নেলি থেকে গোহপুর প্রায় তিন থেকে চার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হন সাড়ে তিন লাখ। টি পি তেওয়ারি কমিশন গঠন করেন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া। সে রিপোর্ট দিনের আলোর মুখ দেখেনি। নেলি হত্যাকাণ্ডে একজন দোষীরও শাস্তি হয়নি। নিহতদের পরিবার, আহতরা কিংবা যাঁরা বাসস্থান, ফসল হারিয়েছেন তাঁরা কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি। নেলি কিংবা গোহপুর কোনো ছায়া ফেলেনি অসম চুক্তিতে। এখানে এ কথাও উল্লেখ থাক, ১৯৮৩ সালে গুয়াহাটির মালিগাঁও রেল ময়দানে অটলবিহারী বাজপেয়ী এক নির্বাচনী জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘খুন কা নদীয়া বহেঙ্গি’ যদি সরকার নির্বাচন করে। নেলি হত্যাকাণ্ডের পর এই অভিযোগও উঠেছিল এর পিছনে আরএসএস-এর মদত রয়েছে।

নির্বাচন পরবর্তী একের পর এক হত্যাকাণ্ডে আসু’র সক্রিয় ভূমিকার কথা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। পাশাপাশি, আরএসএস ও আসু নেতৃত্বের একাংশের ভূমিকাও সংবাদমাধ্যমের নেকনজরে পড়ে। ‘অনলুকার’, ‘সানডে’, ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকায় ‘আসু ভল্যান্টিয়ার ফোর্স’-এর তৎকালীন সর্বাধিনায়ক জয়নাথ শর্মার সঙ্গে আরএসএস-এর সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগ উঠে আসে। ১৯৮৩ সালের ১১-১২ এপ্রিল গুয়াহাটির জে বি কলেজে আসু’র তৎকালীন সহ সভাপতি নুরুল ইসলাম-এর সভাপতিত্বে এক সভায় জয়নাথ শর্মা ও আরএসএস-এর ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হয়। এবং সভার তৃতীয় প্রস্তাবটি ছিল জয়নাথ শর্মার বহিষ্কার বিষয়ক। এছাড়াও আসু’র ধর্মীয় সংখ্যালঘু নেতৃত্বের ১১ জন নেতা নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু বিরোধী হত্যাকাণ্ড-সহ আন্দোলন বিষয়ে ১৫ দফা প্রস্তাব পেশ করে। (হু ইজ রেসপনসিবল ফর নেলি ম্যাসাকার? আঞ্জুমান আরা বেগম ও দিগন্ত শর্মা, টুসার্কেল.নেট)

২০০৫ সালে কেন্দ্রের মনমোহন সিংহ সরকার এবং রাজ্যের তরুণ গগৈ সরকারের সঙ্গে আসুর ফের এক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়। এই আলোচনায় স্থির হয়, ১৯৫১ সালে হওয়া জাতীয় নাগরিক পঞ্জির সংশোধন করা হবে। বিদেশি চিহ্নিতকরণের নানা প্রক্রিয়া চলতে থাকলেও, এনআরসি প্রক্রিয়া সে ভাবে চালু করেনি পূর্ববর্তী সরকারগুলি। বা বলা ভালো নানা আপত্তি, বিশেষ করে আমসু বা অল মুসলিম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন-এর আন্দোলনের ফলে। বরপেটা জেলায় এই সময় পুলিশের গুলিতে চারজন আমসু সদস্যের মৃত্যু হয়। এছাড়াও অসম চুক্তি অনুযায়ী, যেখানে বলা হচ্ছে ‘অসমিয়া’ জনগণকে রাজনৈতিক সাংবিধানিক রক্ষাকবচের মাধ্যমে রাজনৈতিক নিরাপত্তার যথোচিত ব্যবস্থা করার কথা – তাও এক প্রশ্নচিহ্ন হয়ে অনঅসমিয়াদের সামনে হাজির হয়েছিল। কেননা, অসম চুক্তি হয়েছে, সবর্ণ অসমিয়া নেতৃত্বাধীন আসু/অগপ এবং কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে। সেই চুক্তিতে কোথাও নেই বাঙালি, মুসলমান, বোড়ো, কার্বি, ডিমাসা, তিয়া, মিসিং, কিংবা ঝাড়খণ্ডীরা। যেন, তাঁরা অসমের কেউ নন, অংশী নন। ফলত, অসমিয়া’র সংজ্ঞা ঠিক কী হবে, তা নিয়ে আজো মতের মিল ঘটেনি। অসম চুক্তি হওয়ার পর মূলত বোড়ো/কাছারিদের মুখপাত্র ‘দি প্লেনস ট্রাইবাল কাউন্সিল অভ আসাম’ বা পিটিসিএ অসম চুক্তির অংশ না-হওয়ার জন্য খুবই বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। “Once again it has been proved beyond doubt that the movement leaders are concerned with the security of the Assamese linguistic minority only, and they are neither concerned about nor do they represent the indigenous linguistic and ethnic groups of Assam.” বিরূপ বোড়োরা পিটিসিএ’র মাধ্যমে ১৯৭০ সাল থেকেই অসমের মধ্যে স্বশাসিত অঞ্চল ‘উদয়াচল’-এর দাবি জানিয়ে এসেছে। পরবর্তীতে এই দাবি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে স্বাধীন ‘বোড়োল্যান্ড’ রাজ্য পর্যন্ত পৌঁছায়। অবশেষে, তারা স্বশাসিত বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল’-এ সন্তুষ্ট হয়। এই বোড়ো জনজাতিকে একটি স্বতন্ত্র জনজাতি হিসেবে মানতে রাজি হননি স্বয়ং গোপীনাথ বরদলৈ। তিনি মনে করতেন বোড়োরা বৃহৎ অসমিয়া জাতির অংশ। ১৯৪৮ সালে গঠিত উত্তর-পূর্বের জনজাতি নীতি বিষয়ক বিশেষ সাংবিধানিক সাব কমিটি’র চেয়ারম্যান গোপীনাথ বরদলৈ ও তাঁর সহকর্মীদের মত ছিল প্লেইন ট্রাইবস বা সমতলে বসবাসকারী জনজাতিরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রধান সম্প্রদায়ের (পড়ুন অসমিয়া) অঙ্গীভূত হয়ে যাবে। সুতরাং, নাগা বা অন্যান্য পাহাড়িয়া জনজাতিদের মতো সমতলের জনজাতিদের বিশেষ অধিকার বা সুবিধা এমনকি ভাষা-সংস্কৃতি-আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য আইনি নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই।

এই দ্বন্দ্ব এবং এনআরসি, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সন্দেহের পরিবেশ তৈরি করেছিল। অবশেষে, ২০১৪ সালে আসু প্রভাবিত এনজিও ‘আসাম পাবলিক ওয়ার্কস’ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়ে বলে অসম চুক্তির প্রধান ধারা – বিদেশি শনাক্তকরণ, আটক এবং ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া – বলবৎ করা হোক। বিচারক রোহিন্টন নরিম্যান ও বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর ডিভিশন বেঞ্চ শনাক্তকরণের জন্য এনআরসি নবীকরণের নির্দেশ দেন। তাঁরা এও জানিয়ে দেন পুরো প্রক্রিয়াটি আদালতের তত্ত্বাবধানে হবে। রাজ্যে বিজেপি-আসু সরকার প্রতিষ্ঠার পরই অতি দ্রুততার সঙ্গে এই কাজ শুরু হয় এবং অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এবং সর্বোচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে। ৩০ জুলাই এনআরসি’র খসড়া তালিকা প্রকাশিত করে জানানো হয়, অসমে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ৪০,০০,৭০৭।

 

দ্বিতীয় পর্বটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

 

ছবি সৌজন্যে – এপিডিআর, চন্দননগর

লেখক স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।

Share this
Leave a Comment