গত প্রায় বছর কুড়ি ধরে উত্তরবঙ্গের চা-বলয়ের সর্বত্র একের পর এক বড় বাগান বন্ধ হচ্ছে, বন্ধ থাকছে, কখনোসখনো খুলছেও। শোনা যায়, চা-শিল্পে নাকি সংকট। এই সংকটের স্বরূপ কি? পুঁজিবৃদ্ধির সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কি উত্তরবঙ্গের চা বাগানে মুখ থুবড়ে পড়েছে, নাকি প্রক্রিয়ার চরিত্র বদলেছে—যে কায়দায় পুঁজি বাড়ে বাড়তো পুনরুৎপাদিত হতো বদলাচ্ছে সেই কায়দাটাই শ্রমিক আন্দোলনের ওপর এই বদলের প্রভাব পড়ছে কিভাবে ট্রেড-ইউনিয়ান আন্দোলন অর্থাৎ ইউনিয়ানের নেতৃত্বে মধ্যস্থতায় ও প্রায়শই রাষ্ট্রের মাধ্যমে পুঁজির পুঁজিমালিকের সঙ্গে দরকষাকষি আন্দোলনের এই চেনা চেহারাটা আজকের বদলে যাওয়া সময়ে কতটা উপযোগী টেঁকসই সব প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর নেই, কিন্তু এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ।
উত্তরবঙ্গের চা–শ্রমিকেরা এই মুহূর্তে আন্দোলনে। ন্যূনতম মজুরি ও অন্যান্য দাবীতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে প্রধান ট্রেড–ইউনিয়ানগুলির বেশির ভাগ (সরকারি দলের প্রতি অনুগত ইউনিয়ান ভিন্ন বাকিরা) সামিল, ফলত সামিল বড় চা–বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের গরিষ্ঠ অংশও। গত বছর পাঁচেক ধরে নানান টালবাহানার পর অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন, এমন শোনা যাচ্ছে, আন্দোলনরত শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের একাধিক বৈঠকও হয়েছে। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে সরকারের প্রস্তাব শ্রমিক সংগঠনগুলি মানেননি, আন্দোলনের তীব্রতা বাড়াতে বাগানে বাগানে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে সরকার কি করবে শেষমেশ, তা অনিশ্চিত। শ্রমিক সংগঠনগুলির দাবী মেনে নেওয়া হবে, না অন্য কোন রফাসূত্র বেরোবে, এখনই বলা যায় না। এ লেখার পিছনে অন্য একটি, সম্ভবত আরো গুরুতর এক খটকা কাজ করছে। ধরা যাক আন্দোলনের দাবীমতো সরকার মজুরিবৃদ্ধির প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনামা হাজির করলো। বাগানমালিকেরা সে নির্দেশ মানবেন তো? সরকারের ক্ষমতা আছে আদৌ বাগানমালিকদের ন্যূনতম মজুরি দিতে বাধ্য করায়? শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো মানে মালিকদের মুনাফা কমা। কম মুনাফায় বাগান চালাতে রাজি হবেন ঠিক ক‘জন বাগানমালিক? সরকার অর্থে রাষ্ট্র। মুনাফা/মজুরি–র যে খেলা উৎসে ও স্বভাবে পুঁজি–সম্ভূত ও নিয়ন্ত্রিত, আজকের পৃথিবীতে রাষ্ট্র তার ওপর খবরদারি করতে পারে কি? গত প্রায় বছর কুড়ি ধরে উত্তরবঙ্গের চা–বলয়ের সর্বত্র একের পর এক বড় বাগান বন্ধ হচ্ছে, বন্ধ থাকছে, কখনো–সখনো খুলছেও। শোনা যায়, চা–শিল্পে নাকি সংকট। এই সংকটের স্বরূপ কি? পুঁজিবৃদ্ধির সামাজিক–রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কি উত্তরবঙ্গের চা–বাগানে মুখ থুবড়ে পড়েছে? নাকি প্রক্রিয়ার চরিত্র বদলেছে—যে কায়দায় পুঁজি বাড়ে/বাড়তো, পুনরুৎপাদিত হতো, বদলাচ্ছে সেই কায়দাটাই? শ্রমিক–আন্দোলনের ওপর এই বদলের প্রভাব পড়ছে কিভাবে? ট্রেড–ইউনিয়ান আন্দোলন অর্থাৎ ইউনিয়ানের নেতৃত্বে/মধ্যস্থতায় ও প্রায়শই রাষ্ট্রের মাধ্যমে পুঁজির/পুঁজিমালিকের সঙ্গে দরকষাকষি, আন্দোলনের এই চেনা চেহারাটা আজকের বদলে যাওয়া সময়ে কতটা উপযোগী, টেঁকসই? সব প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর নেই, কিন্তু এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়।
চা–শিল্পের সংকট
উত্তরবঙ্গের চা–শিল্পে আবার একটা তথাকথিত সংকট তৈরি হয়েছে। একের পর এক বাগান বন্ধ হচ্ছে, কখনো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই। ডানকান গোষ্ঠীর হাতে থাকা ১৬–১৭টা বাগান একসঙ্গে এই অবস্থায় আছে; বন্ধ, কিন্তু বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নয়। এর আগে পরে অন্যান্য বাগান বন্ধ হয়েছে।
চাহিদা থাকলে, চা উৎপাদন লাভজনক হলে, সংকট কোথায়? বাগান বন্ধ হচ্ছে কেন? যে বাগান বন্ধ হচ্ছে, বন্ধ থাকছে, তা কি আবার চালু করা সম্ভব? সম্ভব হলে, বাগান চালাবেন কে বা কারা?
চা–শিল্পে যে সংকট তা যে আদৌ কোন সংকট নয়, সংকটটা যে তৈরি করা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশীয় বাজারে চায়ের চাহিদা বাড়ছে, রপ্তানিতেও এইমুহূর্তেই যে নতুন কোন ফেরবদল ঘটছে, তাও নয়। বড় চা–নির্মাতা শিল্পগোষ্ঠীদের অনেকেরই মুনাফা ঊর্ধ্বগামী, যথা গুডরিক বা টাটাগোষ্ঠী। অন্যপ্রান্তে, ছোট চা–বাগানের সংখ্যা ও মোট এলাকা বাড়ছে।
চাহিদা থাকলে, চা উৎপাদন লাভজনক হলে, সংকট কোথায়? বাগান বন্ধ হচ্ছে কেন? যে বাগান বন্ধ হচ্ছে, বন্ধ থাকছে, তা কি আবার চালু করা সম্ভব? সম্ভব হলে, বাগান চালাবেন কে বা কারা? যে মালিক/ মালিকদের আমলে বাগান ‘রুগ্ন’ হয়ে বন্ধ হয়ে গ্যালো, তাদের পক্ষে কি বাগান চালানো সম্ভব? তারা কি বাগান চালু রাখতে ইচ্ছুক? মালিক বদল করে কি বাগানের হাল ফেরানো যায়? সরকার/রাষ্ট্র যদি বাগান অধিগ্রহণ করেন, বাগান কি চালু রাখা যায়?
এই প্রশ্নগুচ্ছের উত্তর খোঁজাটা দরকার। না হলে বাগানবন্ধের ফলে সবচাইতে বিপন্ন যাঁরা, সেই শ্রমিকেরা হয় অনাহারে অর্ধাহারে মরতে থাকবেন, নয় অন্য কাজের সন্ধানে বাগান ছেড়ে চলে যাবেন। বাগানের চা-গাছ অযত্নে শুকোবে, আগাছার জঙ্গলে ঢেকে যাবে। শেড ট্রি কেটে বেচে দেওয়া হবে। কারখানা, হাসপাতাল, স্কুল, বাবুদের কোয়ার্টার, শ্রমিকলাইন, সব পরিণত হবে ধ্বংসস্তূপে। দু‘তিন বছর বা তার বেশী সময় ধরে বন্ধ এমন বাগানে এ ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটছে। বাগান চালু না থাকলে, বাগান কেন্দ্র করে যে জনপদ গড়ে উঠেছে, তা–ও টিঁকে থাকবে না।
সংকট মোকাবিলায় যা চলছে ইদানীং
গত আঠেরো–কুড়ি বছরের মধ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও অন্যান্যদের (যার ভিতরে সরকারও আছেন) তরফে চা–শিল্পের সংকট নিরসনে ও বিশেষত চা–শ্রমিকদের দুর্দশা দূরীকরণে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কাজ হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ান উদ্যোগে কিছু বন্ধ বাগান খুলেছে, বা খোলা/বন্ধ অবস্থায় আছে। রাজ্য সরকারের ফাউলেই (Financial Assistance for Workers of Locked Out Industries) প্রকল্পে বন্ধ বাগানশ্রমিকেরা ভাতা পাচ্ছেন। ট্রেড ইউনিয়ান ও সরকার ছাড়া, বৃহত্তর নাগরিক সমাজের পক্ষে নানা সময় বন্ধ বাগানে খাদ্য/ওষুধ ইত্যাদি ত্রাণবিলি হয়েছে, এখনো হচ্ছে। নাগরিক সংগঠন ও খাদ্যের অধিকার অভিযানের তরফে শ্রমিকদের খাদ্য সুরক্ষার দাবীতে যে মামলা করা হয় ও তার ফলে সুপ্রীমকোর্ট যে আদেশ দ্যান, তার পরবর্তী সময়ে বন্ধ বাগানে একাধিক সরকারী প্রকল্প চালু হয়েছে।
২০১২ থেকে ২০১৫–র গোড়া পর্যন্ত চা–বাগানে ন্যূনতম মজুরি চালু করার দাবীতে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। প্রায় সবকটি ট্রেড ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধভাবে যৌথ মঞ্চ গড়ে তোলে ২০১৪–য়। ২০১৫–য় রাজ্যসরকার ‘নীতিগতভাবে’ বাগানশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির দাবী মেনে নেন, যদিও যৌথমঞ্চের সঙ্গে যে চুক্তি সরকারের হয়, তাতে সর্বাধিক মাত্র ১৭ টাকা মজুরি বৃদ্ধির কথা ছিলো।
আসল অবস্থাটা কি?
উত্তরবঙ্গের, বিশেষত, ডুয়ার্স-তরাইয়ের চা-বাগিচার ক্ষেত্রে, উৎপাদন-বিক্রী-মুনাফা-মজুরি-লগ্নি-উৎপাদন এই বুনিয়াদি সম্পর্ক শেকলে দুটি ঐতিহাসিক বিশেষতা রয়েছে। এক, নামমাত্র খাজনায় বাগানের জমি বন্দোবস্ত পাওয়া, দুই, দাস-শ্রম।
সংকটের মোকাবিলায় যা করা গ্যাছে, বা যা করার কথা ভাবা হয়েছে, এক কথায় তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য, অপ্রতুল। সমস্যার ভিতরে সেভাবে ঢোকা হয়ইনি। উৎপাদনশীল একটি শিল্প কেন ‘সংকটগ্রস্ত’ হচ্ছে, সমস্যার উৎসে শিল্প ও শ্রমসম্পর্কের কি টানাপোড়েন রয়েছে, বোঝা হয়নি। ফলত যা আসলে শিল্প ও শ্রমসম্পর্কের বিষয়, তাকে মূলত এক সামাজিক পরিসরে সীমিত করে রাখা হয়েছে। চায়ের উৎপাদন–বিক্রী–মুনাফা–মজুরি–লগ্নি–উৎপাদন এই বুনিয়াদি সম্পর্কটি ঠিক কি ভাবে ও কেন বেশীরভাগ বাগানে বিপর্যস্ত হয়ে গ্যাছে, তা তলিয়ে বোঝা যায়নি। ত্রাণ দিয়ে বা শ্রমিকদের এক জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে বাগানগুলিকে যে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়, বাগানকে বাঁচতে হলে যে উৎপাদনশীল শিল্প হিসেবেই বাঁচতে হবে, এই নির্মম সত্যকে মানুষের সামনে সেভাবে নিয়ে আসার চেষ্টাও হয়নি। সরকার/রাষ্ট্র এই কাজ করবে না। কিন্তু যে শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকস্বার্থে কাজ করছেন, যে নাগরিক সংগঠনেরা শ্রমিকদের পাশে সদর্থে দাঁড়াতে চাইছেন, তাঁদের এই মুহূর্তে এইটি অন্যতম মূল কাজ হওয়ার কথা।
উত্তরবঙ্গের, বিশেষত, ডুয়ার্স–তরাইয়ের চা–বাগিচার ক্ষেত্রে, উৎপাদন–বিক্রি–মুনাফা–মজুরি–লগ্নি–উৎপাদন এই বুনিয়াদি সম্পর্ক শেকলে দুটি ঐতিহাসিক বিশেষতা রয়েছে। এক, নামমাত্র খাজনায় বাগানের জমি বন্দোবস্ত পাওয়া, দুই, দাস–শ্রম। এই এলাকায় চা বাগিচা গড়ে ওঠার পিছনে জমি ও শ্রমের সহজলভ্যতা কাজ করে, যেভাবে ভারতের ও পৃথিবীর অন্যত্র আদি উপনিবেশগুলির অনেকগুলিতেই ঘটেছে। কমবেশী একশো পঞ্চাশ বছরের মধ্যে, খাজনা সে ভাবে না বাড়ুক, মূল্যহীন শ্রমের দাম বেড়েছে বহুগুণ। নগদ মজুরিতে না হোক, সামাজিক নিরাপত্তার দায় চোকাতে শ্রমিকপিছু বিনিয়োগ বেড়েছে। বাগিচাশিল্পের আদিকালে, শ্রমিকেরা নিজেদের খাদ্য উৎপাদন নিজেরা করতেন বাগানের জমিতে, নগদ মজুরি নামমাত্র। স্বাধীনতা–উত্তরকালে, ট্রেড ইউনিয়ান আন্দোলনের অভিঘাতে ও প্ল্যান্টেশান লেবর য়্যাক্টের ধাক্কায়, শ্রমিকদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা বাবদ বিনিয়োগ আইনত বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে, ফলত একদিকে যেমন নগদ মজুরি সেভাবে বাড়েনা, অন্যদিকে বাগানের যাবতীয় ফাঁকা জমিতে বাগিচা বিস্তৃত হয়, শ্রমিকদের চাষের জমিতেও থাবা পড়ে। অর্থাৎ মুনাফা একমাত্রায় রাখা ও বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন বাড়ানো ও শ্রমিকদের মজুরি যথাসাধ্য না বাড়ানো এই দুই প্রক্রিয়া যুগপৎ চালু থাকে। যেহেতু চায়ের বাজারে ভাঁটা সেভাবে আসেনি বললেই হয়, এই প্রক্রিয়া মুনাফা নিশ্চিত করার পক্ষে যথেষ্ট। উদাহরণ, টাটা বা গুডরিক গোষ্ঠীর লাগাতার মুনাফাবৃদ্ধি।
তাহলে বাগান বন্ধ হয় কেন?
উত্তরবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে এর দুটি প্রধান কারণ আছে। প্রথমটি স্থানীয়, কমবেশী অনেকেই জানেন। টাটা, গুডরিক বা এ জাতীয় বড় চা–কর গোষ্ঠীর হাতে যা বাগান আছে, তার চাইতে বেশী সংখ্যক বাগান আছে ব্যাপারি ও মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়েদের মালিকানায়। বাগান ঠিক ভাবে চালানোর প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা, পুঁজি বা ইচ্ছা কোনটাই এদের নেই। যতদিন বাগান হাতে থাকে, পুঁজির যোগান হয় তিন প্রকারে। এক, টি বোর্ডের দেওয়া অনুদান, ও সরকারী ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ। দুই, শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য প্রাপ্য বাকি রাখা, না দেওয়া। তিন, উৎপাদন স্থিতিশীল রাখা ও বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি বাগানে লগ্নি না করা। উৎপাদনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যতদিন জারি থাকে, অর্থাৎ যতদিন গাছে স্বাভাবিক নিয়মে (বা যতটুকু কাজ না করলে নয় সেটুকু করে) পাতা আসে, বাগান চালু থাকে ততদিন। শ্রমিকদের বকেয়া ও বাইরের ঋণ যখন মেটানোর সময় আসে, তখন পাতা থাকলেও চলে না, বাগান বন্ধ করতেই হয়। অর্থাৎ দায়হীন নির্বাধ লুঠ, উৎপাদনশীল শিল্প পরিচালনার পরিবর্তে শিল্প থেকে পুঁজি বার করে আরো দ্রুত/অধিক লাভজনক ক্ষেত্রে লগ্নি করা। ফাটকাবাজ ও ফড়ে শিল্পমালিকদের খপ্পরে পড়ে এই একই কায়দায় পশ্চিমবঙ্গের পাটশিল্পে সংকট তৈরি হয়েছে, একের পর এক পুরোনো পাটকল বন্ধ হয়েছে বা রুগ্ন হয়ে পড়েছে। অন্য শিল্পেও কম–বেশি ফাটকাবাজদের থাবা, ফলে শিল্পে চিরমন্দার আবহ, উপায়হীন রুগ্নতা।
পুঁজির মূল বিনিয়োগের জায়গা এখন অর্থ-বাজার বা ফিনান্স মার্কেট, ও তার পরেই দ্রুত বেড়ে চলা বিচিত্র পরিষেবাক্ষেত্র বা সার্ভিস সেক্টার। এই দুই ক্ষেত্রেই অনেক কম সময়ে বেশী মুনাফা করা সম্ভব। ফলে শ্রমনিবিড়, প্রাচীনধর্মী নির্মাণক্ষেত্রে পুঁজি আর আটকা থাকতে চাইছেনা।
দ্বিতীয় কারণটি পুঁজির বিশ্বজনীন চলনের সঙ্গে যুক্ত। সারা পৃথিবীতে আশির দশক থেকে পুঁজি ক্রমশ উৎপাদনশীল নির্মাণক্ষেত্র বা ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টার থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। নির্মাণক্ষেত্রে শ্রমের প্রয়োজনও কমছে, যে নির্মাণশিল্পে কায়িক শ্রম প্রয়োজন সেখানে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়তে বাড়তে এমন স্তরে পৌঁছেছে যে শ্রম উদ্বৃত্ত ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে।
পুঁজির মূল বিনিয়োগের জায়গা এখন অর্থ–বাজার বা ফিনান্স মার্কেট, ও তার পরেই দ্রুত বেড়ে চলা বিচিত্র পরিষেবাক্ষেত্র বা সার্ভিস সেক্টার। এই দুই ক্ষেত্রেই অনেক কম সময়ে বেশী মুনাফা করা সম্ভব। ফলে শ্রমনিবিড়, প্রাচীনধর্মী নির্মাণক্ষেত্রে পুঁজি আর আটকা থাকতে চাইছেনা। চা–বাগান বা বাগিচাশিল্প প্রাচীনধর্মী ও শ্রমনিবিড়, যন্ত্রায়নের সুযোগ এখানে সীমিত। এক্ষেত্রে পুঁজি চাইবে উৎপাদনের বিকেন্দ্রীভবন, বড় সংগঠিত বাগিচার জায়গায় ছোট অসংগঠিত বাগান, যেখানে উৎপাদনের খরচা কম, পুঁজি সেদিকেই যাবে। পৃথিবীর সর্বত্র নির্মাণক্ষেত্র ভাঙছে, বিকেন্দ্রিত হচ্ছে, যন্ত্রায়িত হচ্ছে।
![](http://www.groundxero.in/wp-content/uploads/2018/08/FB_IMG_1533827204182-1024x706.jpg)
ডানকান কোম্পানির বন্ধ চা বাগান ডিমডিমা। মালিকপক্ষ থেকে বন্ধ করে দেওয়া বাগান জিইয়ে রেখেছেন বাগানের শ্রমিকরা, সেল্ফ হেল্প গ্রুপ গঠন করে।
চা–বাগানে অন্যরকম কিছু ঘটার কথা নয়। কিছু পুরোনো শিল্পগোষ্ঠী যাদের চায়ে লগ্নি প্রচুর এবং সে লগ্নিকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তারা ছাড়া বাগিচাকেন্দ্রিক উৎপাদনসম্পর্ক আঁকড়ে শেষ পর্যন্ত বিশেষ কেউ থাকবে, মনে হয়না।
অর্থাৎ, স্থানীয় অবস্থাটি এক্ষেত্রে বিশ্বজনীন অবস্থার অনুবর্তী, পরিপূরক। ফলত, পুরোনো বাগিচাগুলি নষ্ট হচ্ছে, ভাঙছে। উৎপাদন প্রক্রিয়া ও সমগ্র শিল্পসম্পর্ক উথালপাথাল বদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শ্রম ও শ্রমিক সেখানে বাতিল, ফালতু। মজুরি বাড়ানো হয় সম্ভব নয় (পুঁজি নেই), নয় অপ্রয়োজনীয় (পুঁজি অন্যত্র লগ্নি করলে অনেক বেশী লাভজনক)। এই অবস্থায় মজুরিবৃদ্ধির পুরোনো আন্দোলন নিতান্ত বাহ্যিক হতে বাধ্য। সরকার/রাষ্ট্র এই অবস্থার মূলগত পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না, যে পুঁজি বাগিচা ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাকে ফিরিয়ে আনা তার সাধ্যাতীত। সরকারের কাছে সামাজিক নিরাপত্তার দাবী করা যায়, করাটা যৌক্তিক। কিন্তু যে সমস্যা মূলত পরিবর্তিত শিল্পসম্পর্কের, পুঁজির বদলে যাওয়া চলনের, সামাজিক নিরাপত্তা (খাদ্যসুরক্ষা, মনরেগায় কাজ) দিয়ে তার স্থায়ী মীমাংসা করা সম্ভব নয়।
কি করা যায়? আন্দোলন কোন পথে?
পুরোনো ধাঁচের ট্রেড ইউনিয়ান আন্দোলন মোটামুটি অচল। রাষ্ট্র শিল্পসম্পর্কের মৌলিক সমস্যা মেটাতে চায়না, সক্ষমও নয়। এছাড়াও ভিন্ন প্রশ্ন আছে। চা–শ্রমিকেরা প্রাণপণ লড়াইতে, আন্দোলন চলছে, এ সময়ে সে সব অপ্রীতিকর প্রশ্নের বিশদ আলোচনায় না যাওয়াটাই বোধহয় ভালো। কিন্তু বাগানগুলোকে দীর্ঘ সময় ধরে যখন তথাকথিত মালিকেরা ছিবড়ে বানিয়েছে, ট্রেড ইউনিয়ান নেতারা সেটা জানতেন না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। যে পুঁজি–সম্পর্কে বাগান থেকে পুঁজি বার করে নেওয়া হয়, শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা লুঠ হয়, ইউনিয়ানগুলো সেই সম্পর্কে ঠিক কোথায় অবস্থান করেন, সেই প্রশ্নটা অন্ততঃ তোলা দরকার। ভবিষ্যতে চা–বাগানে ও অন্যত্র শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র কি হবে, ট্রেড ইউনিয়ানের ভূমিকা সেখানে কি হবে, মজুরিবৃদ্ধির দাবি তোলা ছাড়া ইউনিয়ানের আদৌ কোন দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ভাবনা আছে কিনা, এহেন কূট প্রশ্নাবলির মীমাংসার দিকে যেতে গেলে এই মূল প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
![](http://www.groundxero.in/wp-content/uploads/2018/08/IMG-20180810-WA0009.jpg)
স্ট্রাইক চলছে। তিঙলিং চা বাগান।
ট্রেড ইউনিয়ানের কথা থাক। বড় চা–বাগান বা এস্টেট/বাগিচা হিসাবে চলে যে বাগানগুলো, উত্তরবঙ্গের গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে, সেগুলোতে কাঙ্খিত স্থিতিশীলতা আর ফিরবে না। পুঁজি নিয়ন্ত্রণহীন, সরকার অক্ষম, নিয়মবদ্ধ শ্রমিক সংগঠন হয় অপারগ নয় অনিচ্ছুক। শ্রমিকেরা কি করবেন তাহলে? কি করবেন বৃহত্তর নাগরিক সমাজ যাঁরা চাইছেন বাগান খুলুক, চা–শ্রমিকেরা মর্যাদা নিয়ে বাঁচুন?
পুঁজির এই বেইমানীর যোগ্য জবাব, উৎপাদন প্রক্রিয়াকে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দখল করা। বাগিচার জমি, বাগিচার চাগাছ, শেডট্রি, কারখানা, কোয়ার্টার, বাংলো সবকিছু শ্রমিকদের অধিকারে যাক। যে জমিতে চা চাষ করা যায়, চাষ হোক, বাকিতে শ্রমিক পরিবারেরা যৌথচাষ করুন, খাদ্যশস্য বা অন্যশস্য ফলান। চাষ করা চা কারখানায় তৈরী হোক, বিক্রী হোক যৌথভাবে, শ্রমিক আন্দোলনের, সমবায়ের মাধ্যমে। কোন শ্রমিক পরিবারকে না খেয়ে মরতে হবেনা, ত্রাণের জন্য বসে থাকতে হবে না।
প্রথাসিদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ান গন্ডির বাইরে বেরিয়ে ভাবতে পারলে, শ্রমিকদের সামনে, সহযোগী নাগরিকদের সামনে আজকের এই অবস্থা সমস্যার এবং সম্ভাবনার। সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করতে, না খেতে পেয়ে মরতে মরতে ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন আন্দোলনের ডাক দিতে একমাত্র শ্রমিকেরাই পারেন। চা বাগান তাঁদের কাছে পুঁজিলগ্নি ও মুনাফা করার জায়গা নয়, তা তাঁদের বাস্তুভিটে, সংষ্কৃতির আধারও। পুরুষানুক্রমে তাঁদের শ্রম অন্যের পুঁজি হয়ে বাজারে ঘুরেছে, এখনো ঘুরছে। পুঁজির নিজস্ব কায়দায় সেই পুঁজি এখন তাঁদের বাতিল পরিত্যক্ত ঘোষণা করছে। যে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাকেও পরিত্যাগ করছে পুঁজি। পুঁজির এই বেইমানির যোগ্য জবাব, উৎপাদন প্রক্রিয়াকে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দখল করা। বাগিচার জমি, বাগিচার চাগাছ, শেডট্রি, কারখানা, কোয়ার্টার, বাংলো সবকিছু শ্রমিকদের অধিকারে যাক। যে জমিতে চা চাষ করা যায়, চাষ হোক, বাকিতে শ্রমিক পরিবারেরা যৌথচাষ করুন, খাদ্যশস্য বা অন্যশস্য ফলান। চাষ করা চা কারখানায় তৈরী হোক, বিক্রি হোক যৌথভাবে, শ্রমিক আন্দোলনের, সমবায়ের মাধ্যমে। কোন শ্রমিক পরিবারকে না খেয়ে মরতে হবেনা, ত্রাণের জন্য বসে থাকতে হবে না। চা বিক্রির টাকায় বাগানের জনপদ বাঁচবে।
এই কথাগুলো ইচ্ছাপূরণের, কষ্টকল্পনার মতো শোনাতে পারে। ট্রেড ইউনিয়ান নেতারা বলতে পারেন শ্রমিকেরা বাগান চালানোর জন্য তৈরি নন, এছাড়া চা–বাগানে শ্রমিক সমবায় সম্ভব নয় – কে সমবায়কে পুঁজি দেবে? পুঁজি ছাড়া বাগানে নতুন চা চারা পোঁতা যাবে না, ভাঙা/পরিত্যক্ত কারখানা সারানো যাবে না, শ্রমিকদের মাইনে দেওয়া যাবে না। যে বিপুল পরিমাণ দেনা এক একটা বাগানের কাঁধে, তা শোধ হবে কিভাবে? এসব প্রশ্ন উঠবেই, সবগুলোর উত্তর একসঙ্গে দেওয়াও যাবে না। কিন্তু পুরোনো কায়দায় বাগান যে চলবে না বেশীদিন, পুরোনো আন্দোলনেরও প্রাসঙ্গিকতা দ্রুত ক্ষীয়মান, এ বিষয়েও তো সন্দেহের অবকাশ নেই। নতুন রাজনৈতিক প্রকল্প তো ভাবতেই হবে, নতুন বাস্তবতাও তৈরি করতে হবে। অনেক কিছু করা যায়, অনেক কিছু তো হচ্ছেও। বড় বাগানের সবটা যদি একসঙ্গে চালানো না যায়, বাগান ভাগ করা হোক শ্রমিক লাইনে লাইনে, কিম্বা ডিভিশানে ডিভিশানে। বন্ধ বা আধা–বন্ধ বাগানে স্বনির্ভর দল কি ওএমসি বা অপারেটিং ম্যানেজমেন্ট কমিটি বানিয়ে শ্রমিকেরা তো ডুয়ার্সের বহু বাগানে, এমনকি পাহাড়েরও কোথাও কোথাও, এভাবে বাগান চালু রাখছেন বছরের পর বছর। একাধিক বাগানে সমবায় গড়ার চেষ্টাও হয়েছে। যেহেতু এই চেষ্টার পিছনে কোন সামগ্রিক রাজনৈতিক ভাবনা ছিল না, এখনো নেই, না শ্রমিক সংগঠন না সরকার কোন তরফেই শ্রমিকদের হাতে বাগান তুলে দেবার ব্যাপারে কোন পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত বা চিন্তা দানা বাঁধেনি, শ্রমিক–পরিচালিত বাগানের বিষয়টা অবাস্তব ঠেকছে।
ট্রেড ইউনিয়নেরা না পারেন, সহযোগী নাগরিক বন্ধুরা এগিয়ে আসুন। নতুন শ্রমিক উদ্যোগ তৈরি হোক। সরকারকে সবাই মিলে বলা হোক বাগানের পুরোনো দেনার দায় নিতে, পুরোনো মালিকদের বাধ্য করতে শ্রমিকদের বকেয়া মেটাতে। শ্রমিকদের বকেয়া বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ইতিমধ্যেই সুনির্দিষ্ট আদেশ দিয়েছেন। এছাড়াও বাগানে হাসপাতাল, স্কুল এসব চালু করতে, চালাতে সরকার এগিয়ে আসুক। যে জমি বাগান–মালিকদের ইজারা দেওয়া হত, তা কম খাজনায় শ্রমিক সমবায়কে, শ্রমিক দলদের হাতে একলপ্তে বা খন্ডে খন্ডে আইনমাফিক তুলে দেওয়া হোক। অসংখ্য ছোট বাগান রমরমিয়ে চলছে, বড় বাগান চালানোর মতো পুঁজির যোগান না থাকলে বড় ভেঙে একাধিক ছোট বাগান হোক। শ্রমিক সমবায়ের মালিকানায় চা–কারখানা হোক, সেখানে নতুন ছোট বাগানের চা বিক্রি হোক। যা পুঁজিমালিকের, পুঁজির ছিলো, তা সমাজের হোক। শ্রম শ্রমিকের হোক।
নতুন রাজনৈতিক দাবিতে নতুন আন্দোলনের সময় এসেছে।