বিহারনামা


  • September 12, 2025
  • (0 Comments)
  • 1210 Views

“দলিত ও ‘পিছড়ে বর্গ’-এর ‘বিহারী’রা ভোটাধিকারটা অর্জন করেছেন বহু প্রজন্মের ঘাম-রক্তের বিনিময়ে। ফলে সে অধিকার তাঁরা একটা কলমের খোঁচায় চলে যেতে দেবেন না। প্রবল প্রতিরোধ হবে। এবং সত্যি কথা বলতে কি বিহার সেই প্রতিরোধ করে দেখাচ্ছে।” পাটনায় গান্ধী ময়দানে ১ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়া জোটের ভোটার অধিকার যাত্রার পরিসমাপ্তি জমায়েত অংশ নওয়ার অভিজ্ঞতা লিখলেন মানস ঘোষ

 

রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটায় ৩১শে আগস্ট পাটনা পৌঁছে রাত ১১ টা নাগাদ গান্ধী ময়দানে উপস্থিত হতে পারলাম। বড় বড় তাঁবু, বহু মানুষের থাকার ব্যবস্থা, বিশেষ করে যারা দূর গ্রাম থেকে আসছেন। তাঁবুগুলিতে বিরোধী জোটের প্রায় সব দলের সমর্থকরাই রয়েছেন। কংগ্রেস, আরজেডি, বিহার ইনসান পার্টি, ভাকপা-মালে এবং সিপিআই সব দলের সদস্যদের উপস্থিতি দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে এটা খুব পরিষ্কার বোঝা গেল যে মানুষের মধ্যে একটা অসম্ভব স্পিরিট রয়েছে, যেটা সব সময় সব জায়গায় পাওয়া যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকগুলো দিক যেগুলো খুব ছোট হলেও চোখে পড়ল। অবশ্যই অত বড় ময়দানে অতগুলো অতিকায় তাঁবু এবং অত মানুষের থাকা-খাওয়া-জলের ব্যবস্থা করতে গেলে বিপুল অর্থ লাগে। বোঝাই যাচ্ছিল সেটা কংগ্রেস এবং আরজেডি-র আনুকূল্যে সম্ভব হয়েছে। তাদের নেতা-নেত্রীদের সেখানে ঘোরাঘুরি করতে এবং মানুষের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ নিতে দেখলাম। যেসব মানুষ ওই রাত্রে গান্ধী ময়দানের তাঁবুতে এসে তাদের দলের পতাকা নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, জমায়েত হয়েছিলেন তারা সমাজের নিচু স্তর থেকে আসা বা দূরবর্তী গ্রামাঞ্চল থেকে আসা মানুষ তাতে সন্দেহ নেই। আর্থিকভাবেও যে বেশিরভাগ মানুষ পিছিয়ে পড়া অংশের প্রতিনিধি তাতেও সন্দেহ নেই।

কিন্তু নেতাদের কথাবার্তা, চলাফেরা ও শরীরী ভাষা দেখে অনেকগুলো জিনিস চোখে পড়ল। যেমন কংগ্রেস নেতাদের প্রত্যেকেরই প্রায় বিরাট বিরাট গাড়ি। তাঁদের অনুচরবৃন্দদের দেখেও এইরকমটা বোধ হয় না যে তাঁরা জীবনে কখনো দরিদ্র বা পিছিয়ে পড়া মানুষের রাজনীতি করেছেন। যদিও আপাতদৃষ্টিতে সকলেই জোট-ধর্ম বজায় রাখছিলেন। আরজেডি-র নেতা-নেত্রীদেরও দেখে খুবই উদ্দীপ্ত মনে হলো, কিন্তু তাদেরও আচার-আচরণ, শরীরী ভাষায় একটা বাহুবলি ভাব গোপন থাকছিল না। এই জায়গাগুলোতে জোট রাজনীতি অন্তত কিভাবে কাজ করবে তাতে সামান্য হলেও সন্দেহ তৈরি হয়।

 

যে ই-রিক্সা চড়ে ঐদিন রাত এগারোটায় স্টেশন থেকে গান্ধী ময়দানে এলাম তার চালকের দেখলাম কংগ্রেস এবং আরজেডি-র খুচরো নেতাদের সম্পর্কে একটা সংশয়ের ভাব রয়েছে। তিনি পরিষ্কার বললেন, “লালু প্রসাদের জামানায় রাত এগারোটায় স্টেশনে নেমে আপনারা গান্ধী ময়দান পর্যন্ত নির্বিঘ্নে যেতে পারতেন কিনা সন্দেহ আছে! আমরা সাড়ে সাতটার পরে এই শহরে গাড়ি চালাতে সাহস পেতাম না।”

 

নীতিশ কুমারের শাসনে গত দশ বছর বিহারের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। বিহারের সামাজিক উন্নতি থেমে গেছে। কিন্তু শহুরে দরিদ্রদের এর মধ্যে একটা অংশ এখনো পর্যন্ত মনে করে নীতিশ কুমার বিহারে সুশাসনের প্রতীক। সত্যি কথা বলতে কি পরিসংখ্যান কিছুটা হলেও এ কথা বলে যে নীতিশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রথম দশ বছরে দলিতদের মধ্যে সাক্ষরতার হার যদি দেখা যায় তাহলে দেখতে পাওয়া যায় তা প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছিল এবং এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও মেয়েদের স্কুল যাওয়া নিশ্চিত করেছিলেন নীতিশ কুমার। এবং এটাও একই সঙ্গে কঠোর সত্য যে গত ১০ বছরে কেবল গদি বাঁচাতে ব্যস্ত নীতিশ বিজেপির সুবিধে করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উন্নয়নমূলক কাজ বিহারে করেননি। তবু বহু মানুষের মনে ইতিহাস একটা ধারণা, যা অনুসারে নীতিশ সুশাসনের প্রতীক।

 

একদল কংগ্রেস কর্মীকে পরদিন ১ সেপ্টেম্বর সকালে দেখলাম জমায়েতে আসছে। তাঁরা স্লোগান দিচ্ছিলেন – “পাপ্পু যাদব জিন্দাবাদ।” এখন পাপ্পু যতই কংগ্রেসে এসে পূর্ববর্তী অপরাধের চিহ্ন ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করুন না কেন এরা দলে দলে দস্যু রত্নাকর থেকে মহর্ষি বাল্মিকী হয়ে গেছেন, এরকমটা মনে করার কোনো কারণ মানুষের কাছে এখনো নেই। বিশেষত এই বিষয়ে শহুরে দরিদ্রদের সংশয় প্রবল।

 

আর এই সুযোগটা নেওয়ার চেষ্টা করছে প্রশান্ত কিশোরের জন-সুরজ পার্টি। তারা বুঝেছে বিগত এক দশকে নীতিশের শাসনে বিহার থমকে গেছে। আবার অন্যদিকে আরজেডি ও কংগ্রেস সম্পর্কেও এখনো মানুষের পূর্ণ ভরসা তৈরি হয়নি। এই ফাঁকা জায়গাটাতে ঢুকে পড়তে চাইছে প্রশান্ত কিশোরের পার্টি। যদিও নিন্দুকেরা বলছেন, তারা নাকি অনেক টাকা নিয়ে নেমেছে বিহারের নির্বাচনে বিজেপির সুবিধা করে দিতে।

 

পরদিন ফিরে আসার সময় দুপুরের রোদে যে প্রৌঢ মানুষটি প্রায় স্নান করার মত ঘেমে-নেয়ে রিকশা টেনে সাড়ে তিন কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিলেন তিনি যে খুব অর্থ পেয়ে জন-সুরজ পার্টির হয়ে কথা বলছেন এরকমটা ভাবার কোনো কারণ নেই। যদি কিছু পেতেন তাহলে মাথার উপরে ৩৮ ডিগ্রি সূর্যকে রেখে ওই রকম প্রাণান্তকর পরিশ্রম তাঁকে করতে হতো না। “রাহুল গান্ধীর র‍্যালি কেমন হচ্ছে?” জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, “ওটা আসল গান্ধী নয় নকল গান্ধী। আসল গান্ধী এই যে রয়েছেন আমার টুপিতে।” দেখলাম জন-সুরজ পার্টির প্রতীক আঁকা টুপিতে গান্ধীজীর মুখ। জন-সুরজ-এর প্রচারের মূল অঞ্চলগুলো যেখানে তারা সমর্থক পাবে ভাবছে (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। তারা প্রায় জনে জনে এই কথাটা বলে বেড়াচ্ছে যে রাহুল গান্ধীরা আসল গান্ধী নয়। আসল গান্ধী মহাত্মা গান্ধী। অতএব ‘নকলি গান্ধী’কে ভোট দেবার কোন কারণ নেই।

 

যদিও আমার মনে হয় প্রশান্ত কিশোরের এই ধরনের প্রচারের তেমন কোন প্রভাব পড়বে না কারণ রাহুল গান্ধী এই যাত্রায় তেজস্বী যাদব এবং দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সঙ্গে যেরকম স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পাচ্ছেন সেটা দেখার মত। কিন্তু প্রশ্নটা রাহুল গান্ধী সংক্রান্ত ততটা নয়। কারণ রাহুল গান্ধী একটা কথা খুব পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন যে, উত্তর ভারতে কংগ্রেসের পরিচয় মূলত ছিল উচ্চবর্ণ এবং উচ্চ আর্থিক সঙ্গতি-সম্পন্ন লোকের পার্টি হিসেবে। সেটা দিয়ে কোনভাবেই ভোটের রাজনীতি বা জনভিত্তি তৈরি করা যাবে না। ফলে তিনি সঠিক রাস্তাই নিয়েছেন। জাত গণনা ও ওবিসি সংরক্ষণ, পিছিয়ে পড়া মানুষের সাংবিধানিক অধিকারকে সামনে রেখে তিনি আন্দোলন করছেন। তার ফলও কিছুটা হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছে। উত্তর প্রদেশে এর ফলে কংগ্রেস তাদের জনভিত্তি কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। পিছিয়ে পড়া মানু্‌ষ, নিম্নবিত্তের মানুষ কিছুটা হলেও তাদের কথা শুনছেন। কিন্তু বিহারে পরিস্থিতি অতটা সোজা নয়। যে জাত-গননার দাবি রাহুল গান্ধী ও তার দল তুলেছে তা আগেই বিহারে নীতিশ কুমার করে দেখিয়ে দিয়েছেন, বরং কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলিতেই এখনো তা সফলভাবে হয়নি। অতএব, এই রাস্তাতে কতটা সুবিধা কংগ্রেসের হবে তাতে সন্দেহ আছে।

 

যাইহোক, টানা ১৪ দিন ধরে যে ভোটার অধিকার যাত্রা বিহারে ইন্ডিয়া জোটের নেতারা সফলভাবে করলেন তার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল পাটনায় গান্ধী ময়দানে। সেখানে যে অভূতপূর্ব জনজাগরণের চিত্র, এত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তার একটা বড় কারণ আছে। এটা বিহারের দলিত-মহাদলিত মানুষরা বরাবরই জানেন যে এক একটা ভোটের জন্য, ভোটদানের অধিকারের জন্য তাঁদের দীর্ঘ রক্ত-ঘাম ঝরানো রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের পথে হাঁটতে হয়েছে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি ভোটের অধিকারের জন্য যে লড়াই সে লড়াইটা বিহারবাসীর কাছে কোনো নতুন লড়াই নয়। কারণ একটা সময় ছিল যখন দলিতদের, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের ভোটগ্রহণ কেন্দ্র পর্যন্ত যাওয়ার সাহস ছিল না। কেবলমাত্র ভোট দিতে চাইছেন এই অপরাধেই দলিত গ্রামে একের পর এক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ফলে ভোটের অধিকার তাঁদের কাছে স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়ায় এসে পৌঁছয়নি। ওই আইনি অধিকারটুকু আদায় করতে তাঁদের বহু সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক লড়াই করতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এসআইআর অন্য রাজ্যে সফল হতেই পারে, যদিও আমি বলছি না সফল হবেই, কিন্তু যাঁরা বিহারে ৬৫ লক্ষ ভোটারের  ভোটাধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছেন, এটা তাঁদের হিসাবের ভুল ছিল। ভুলটা এখানেই যে এটা বোঝা উচিত ছিল যে দলিত ও ‘পিছড়ে বর্গ’-এর ‘বিহারী’রা এই ভোটাধিকারটা অর্জন করেছেন বহু প্রজন্মের ঘাম-রক্তের বিনিময়ে। ফলে সে অধিকার তাঁরা একটা কলমের খোঁচায় চলে যেতে দেবেন না। প্রবল প্রতিরোধ হবে। এবং সত্যি কথা বলতে কি বিহার সেই প্রতিরোধ করে দেখাচ্ছে। বিহার বলেই এইরকম ব্যাপক আকার নিচ্ছে প্রতিরোধ।

 

আসলে এটাই প্রধান কারণ যে পাটনায় ভোটার অধিকার যাত্রার অন্তিম সভাটিতে এবং জমায়েতে হাজির থাকতে চেয়েছিলাম। অনেকগুলো আনুসাঙ্গিক কারণও ছিল। বিহার রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিক থেকেও আমাকে খুবই আকর্ষণ করে। তার কারণ হলো, এমনকি সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রের দাবী দাওয়াগুলি নিয়ে বিহার যখন আন্দোলন করে তখন সেই আন্দোলনকে মানুষ একটা সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত করে তুলতে পারে। সেটা কেবল পতাকার বাহারে বা স্লোগানে আটকে থাকে না। বিহারের মানুষের স্লোগান যদিও অসম্ভব কাব্যিক ছন্দময়। তারই সঙ্গে, এটা আগেও লক্ষ্য করে দেখেছি যে, মানুষ যখন এটাকে একটা উৎসবের মত করে তোলে, তখন তা ব্যক্তির অংশগ্রহণকে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত হতে সাহায্য করে। আসলে রাজনীতি এবং সামাজিকতার এই সমষ্টিগত জায়গাটা বিহারের আন্দোলনের একটা ব্যতিক্রমী দিক।

 

সাম্প্রতিক অতীতেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে ভোটার তালিকা থেকে ভোটদাতাদের সংখ্যার সন্দেহজনক হেরফের ঘটছে। এটা বোঝা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যগুলিতে বিরোধীরা কিন্তু তেমন কোনও বড় আন্দোলন এর বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে পারেননি। তার কারণ খুব পরিষ্কার, বিহার ছাড়া অন্য রাজ্যগুলিতে বাম এবং সমাজবাদী শক্তির ঐতিহাসিকভাবে দৃঢ় ভিত্তি নেই।

 

সেদিক থেকে দেখলে বিহারের মাটি অন্য মাটি। সেখানে এই ৮৫% জাত-পাত এবং সম্পদের নিরিখে পিছিয়ে থাকা মানুষের দৈনন্দিন সামাজিক লড়াইয়ের সঙ্গে বাম এবং সমাজবাদী দলগুলির রাজনৈতিক লড়াই একসঙ্গে হাতে হাত রেখে চলেছে। আসলে এইভাবে ভারতবর্ষের আর কোনো রাজ্য যেখানে সামাজিক লড়াই এবং রাজনৈতিক লড়াই পরস্পরের সঙ্গে হাতে হাত ধরে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে চলেছে এমনটা দেখা যায়নি। বেশ কয়েক দশক ধরে বিহারে যা ঘটেছে অন্য কোথাও তার মতো করে `সামাজিক` ও `রাজনৈতিক`-এর মেলবন্ধন সম্ভব হয়নি।

 

ফলে বিহারে পিছিয়ে পড়া সাধারণ মানুষের অধিকার আন্দোলনে মানুষকে একজোট করা, সুসংবদ্ধ করার তেমন অভাব হয় না। কারণ সেখানে ‘রাজনৈতিক’ ও ‘সামাজিক’-এর একটা বোঝাপড়া ও মেলবন্ধন ঐতিহাসিকভাবে রয়েছে। এক্ষেত্রেও এসআইআর-এ যাঁরা বাদ পড়ছেন তাঁরা কিন্তু বেশিরভাগই মহিলা, পুরুষ পরিযায়ী শ্রমিক এবং একেবারে পিছিয়ে পড়া, শিক্ষার আলোক না পাওয়া মানুষ। ফলে এসআইআর-এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা সামাজিক মান্যতা সেখানে রয়েছে। যা বিরোধী রাজনীতিকদের সাহায্য করেছে এই বিরাট সংহতকরণ ঘটাতে। কিন্তু এ তো গেল সুবিধা বা অনুকূল পরিবেশের দিক। আবার বিরোধী জোট-রাজনীতির দিক থেকে কিছু সুবিধা বাঁ প্রতিকূলতাও রয়ে গেছে। আসলে সেই জায়গাগুলো বুঝতে গেলে কেবল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বা ‘লিটারেচার’ পড়ে সম্ভব হয় না। একটু নিজের চোখে দেখা এবং মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা, অনেক মানুষের জমায়েতে উপস্থিত থাকাটা দরকার হয়।

 

বিহারের একটা বিশেষ রাজনৈতিক চরিত্র বহু যুগ ধরে গড়ে উঠেছে। ঔপনিবেশিক ভারতের চম্পারন কৃষক আন্দোলন থেকে শুরু করে জয়প্রকাশ নারায়ণের সত্তরের দশকের গণ-আন্দোলন। অথবা তার পরবর্তীকালে দলিত এবং মহা দলিতদের আত্মপরিচয় এবং জমির লড়াই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিহার অনন্য। বিশেষত জমির লড়াইয়ের কথা বিহারের ক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন। তার কারণ বিহারের জনসংখ্যার মাত্র ১৫% উচ্চবর্ণ কিন্তু তাদের হাতেই বেশিরভাগ জমির মালিকানা। ভুমিহার এবং রাজপুতদের বাহুবলী বাহিনীর দাপটে দলিত এবং মহা দলিতদের অবর্ণনীয় দুরবস্থা বিহারের কৃষি অর্থনীতি এবং সামাজিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা।

 

আমরা দেখেছি, বারবার সেখানে দলিত জনগোষ্ঠীর উপর নেমে এসেছে ভয়াবহ অত্যাচার, গণহত্যা। এবং তারই সঙ্গে এটাও দেখেছি যে সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি এবং লাগাতার আন্দোলনের ইতিহাস বিহারেই তৈরি হয়েছে। যেটা বিহারে মূলত সিপিআইএমএল লিবারেশন (ভাকপা-মালে) এবং একদা কিছুটা সিপিআই-এর বিকাশের প্রধান কারণ। খনিজ সম্পদ বিহারের যেসব জায়গায় অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ছিল, (যদিও তার বড় অংশ এখন ঝাড়খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত), সেই অঞ্চলগুলিতে অরুণ রায়ের মার্কসিস্ট কো-অর্ডিনেশন সেন্টার বঞ্চিত শ্রমিকদের জন্য আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল একসময়। ফলে আজকের বিহারে সামাজিক রাজনীতি এবং নির্বাচনী রাজনীতি উভয়ক্ষেত্রেই বাম শক্তির যে গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি তার প্রেক্ষাপট ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এবং লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে রয়ে গেছে। ফলে কেউ চাইলেও বিহারের রাজনীতিতে বাম শক্তিগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে পারেনি। কারণ দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন তাদের যে জনভিত্তি তৈরি করেছে তার ভিত শক্তপোক্ত। তা সামান্য ইস্যুভিত্তিক বা ওয়েলফেয়ার স্টেটের অনুদান ভিত্তিক নয়। সরাসরি জীবন-জীবিকা, শিক্ষা ও কাজের অধিকার আন্দোলনে সিপিআইএম লিবারেশন-এর মতো বাম শক্তিগুলির লেগে-পড়ে থেকে কাজ করার যে ফল তা আজকের বিহারের নির্বাচনী রাজনীতির মানচিত্রেও অনেকখানি অংশকে লাল পতাকায় রঙীন করে রেখেছে।

 

যা সবচেয়ে বড় কথা তা হলো, এই বঞ্চিত দলিত, মহা-দলিত বা অতি পিছিয়ে পড়া অংশের যে আন্দোলন তার একটা বহুমুখী চরিত্র আমরা অতীতে বিহারে দেখতে পেয়েছি। সেখানে এক সময়কার সশস্ত্র প্রতিরোধ থেকে সামাজিক ন্যায় বিচারের জন্য আইনি সংস্কার এবং বিধানসভার মধ্যে দাঁড়িয়ে অর্থাৎ সংসদীয় পরিসরে ‘পিছড়ে বর্গ’-এর জন্য কথা বলা – এই সবগুলোই আছে। বিপ্লবী রাজনীতি, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সংস্কার আন্দোলন এবং সংশোধনীয় রাজনীতি – আন্দোলনের এই তিনটে বিভিন্ন স্তরেই বিহারের ৮৫% এর উপর দলিত, আদিবাসী, মহা-দলিত, পশ্চাদপদ শ্রেণী এবং অতি পশ্চাৎপদ শ্রেণীর সামাজিক উত্তরণের লড়াই চলেছে।

 

সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে যদি দেখা যায় তাহলে এই বাম রাজনীতির লড়াইটা মোটামুটি আটকে থেকেছে অপারেশন বর্গা আন্দোলনের মধ্যে। মহারাষ্ট্রে এই আন্দোলন আটকে থেকেছে দলিত পরিচয় নির্মাণের মধ্যে, তামিলনাড়ুতে তার চরিত্র দ্রাবিড় আত্মপরিচয় ও দলিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলন। একমাত্র বিহারের ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি যে আন্দোলনের বিভিন্ন স্তর এবং বিভিন্ন আঙ্গিকের সবক’টি ক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট এবং সমাজবাদীদের পরিষ্কার উপস্থিতি। ফলে বিহারের রাজনীতিতে বরাবরই বিপ্লবী বাম থেকে সংস্কারপন্থী সমাজবাদীদের উপস্থিতি উজ্জ্বল। কোনও পরিস্থিতিতেই এই উপস্থিতি হারিয়ে যায় না সেখানে।

 

এখনো পর্যন্ত কথাবার্তা বলে যা অনুভব করলাম তাতে কংগ্রেসের মধ্যবর্তী পদের এবং তৃণমূল স্তরের নেতারা, যাঁরা আসলে ভোটটা করাবেন তাঁরা বামপন্থীদের, বিশেষত অতি বামপন্থীদের সঙ্গে যাওয়া, ‘পিছড়ে বর্গ’-এর কথা বলা এবং আরজেডি অখিলেশের সঙ্গে রাহুল গান্ধীদের এতটা একাত্মকরণ মেনে নিতে পারছেন না, তাঁদের শ্রেণী চরিত্রের কারণে। গত নির্বাচনগুলিতে পাওয়া খবর অনুসারে দেখা যাচ্ছে অনেক সময় কংগ্রেসের ভোট ভাকপা-মালে বা আরজেডির প্রার্থীদের পক্ষে পুরোপুরি যাচ্ছে না। অন্যদিকে ভাকপা-মালে ও আরজেডি কিন্তু জোটধর্ম রক্ষায় উপর থেকে নীচ পর্যন্ত অনেক বেশি রেজিমেন্টেড এবং তারা জোটের প্রার্থীকে জেতাবার জন্য তৃণমূল স্তরে প্রবল লড়াই করছেন। তাদের ভোটাররাও জোট প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন।

 

এখানে আর একটা কথা বলা দরকার একটা সময় বিহারে প্রথমে কংগ্রেস এবং পরে আর জে ডি-র সঙ্গে ভাকপা-মালের সমর্থক নেতৃবৃন্দের প্রবল রক্তাক্ত সংঘাত হয়েছে। তাদের অনেক কমরেড কংগ্রেস ও আরজেডি-র হাতে প্রাণ দিয়ে শহীদ হয়েছেন। তা সত্ত্বেও মালের সমর্থকরা যে তাদের পূর্ণ শক্তি দিয়ে জোটপ্রার্থীকে জোটে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, এমনকি আরজেডি বা কংগ্রেসের প্রার্থীর পক্ষেও জোরালো প্রচার চালাচ্ছেন তার কারণ সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল।

 

প্রত্যেকেই খুব সচেতনভাবে বিশ্বাস করছেন যে বিজেপি এবং ফ্যাসিবাদীদের আটকাতে এই জোট তৈরি হয়েছে। ফলে সেখানে আারজেডি বা কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাতের পূর্ব ইতিহাসটাকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং ফ্যাসিবাদ-বিরোধী জোটকে শক্তিশালী করা দরকার ও তাকেই প্রাথমিক কর্তব্য ভাবা উচিত। কিন্তু অ-বাম দলগুলির দিক থেকে তাদের সমর্থকরা এতটা স্বচ্ছতা নিয়ে বিষয়টা ভাবছেন কিনা সেটার উপর অনেকাংশে নির্ভর করছে বিহারের আগামী নির্বাচনের ফলাফল।

 

বিশেষত কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্বকে আসন বন্টনের ক্ষেত্রে তাঁদের শিশু-সুলভ আবদারগুলো ছাড়তে হবে। তাঁরা সামর্থ্যের থেকে অনেক বেশি আসনে প্রার্থী দিয়ে, গত কয়েক বার বেশিরভাগ আসনে গোহারা হেরে বিরোধীদের সমস্ত আশায় জল ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছেন। এবারের বিহার নির্বাচনে আর একটা নতুন দিক যুক্ত হয়েছে, জন-সুরজ পার্টি। বিজেপির মতই তাদেরও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু কংগ্রেস। কংগ্রেস যত বেশি আসনে প্রার্থী দেবে তত বেশি করে জন-সুরজ পার্টির সুবিধা হবে কংগ্রেসকে আক্রমণ করে মহাজোটের বিরূদ্ধতা করতে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো কৌশল হবে বিরোধী জোটে কংগ্রেসের প্রার্থীর সংখ্যা কম দেওয়া। যাতে এই মহাজোটকে কংগ্রেস-নিয়ন্ত্রিত জোট বলে কোনোভাবেই প্রশান্ত কিশোররা প্রচার করতে না পারে। সেদিক থেকে দেখলে তেজস্বী যাদব বিরোধী মঞ্চ থেকে নিজেকে মুখ্যমন্ত্রী পদের মুখ বলে ঘোষণা করে দিয়ে কৌশলগতভাবে ভালোই করেছেন।

 

গান্ধী ময়দানে ১ সেপ্টেম্বরের প্রাথমিক জমায়েতে লাল পতাকার ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো, ভাকপা-মালের সমর্থকদের সংখ্যা অনেকটাই ছিল, পাশাপাশি সিপিআই-এর সমর্থকরাও ছিলেন ভালো সংখ্যায়। সিপিএম-এর সমর্থকরা এসেছিলেন দু-একটি অঞ্চল থেকে। মহাজোটের উচিত হবে আগামী নির্বাচনে বামদলগুলিকে আরো বেশি আসনে সুযোগ দেওয়া। কারণ বিহারের বামদলগুলির, বিশেষত ভাকপা-মালের, বেশ কিছু জেলায় দীর্ঘদিনের জনভিত্তি আছে। আর সেই জনভিত্তির উৎস অর্থ বা বাহুবল নয়, দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম।

 

সত্যি কথা বলতে কি, বিহারের মহাজোটে বামপন্থী দলগুলির উপস্থিতি ও তাদের লড়াকু ভাবমূর্তি, সার্বিকভাবে জোটের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। এই বিষয়টিকে সম্মান করে বামদলগুলিকে একটু বেশি আসনে লড়ার সুযোগ দিলে জোটের লাভ হবে। বাস্তবে কিন্তু এখনো তা ঘটছে না। কাটিহার-সহ অনেক জায়গায় খবর পেলাম ভাকপা-মালে ও অন্যান্য বামদলগুলির জনপ্রিয় জেলা নেতাদের মঞ্চে উঠতেই দেওয়া হয়নি। বিহারের জনগণ যেহেতু সপ্তপদী দেখেনি, তাই বাইক চড়ার ভিডিও বা রিলস বাজারে ছেড়ে বাজিমাত হবে না।

 

বুথ পর্যায়ে ভোটার তালিকায় বাদ পড়া ৬৫ লাখ মানুষের বেশিভাগের ফের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য বুথ পর্যায়রে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতে হবে। ভূয়ো ভোটার ও বিকেল ৫.৩০ এর পর লাইনে দাঁড়ানো ভুতুড়ে ভোটার আটকাতে জান-কবুল বুথ এজেন্ট দিতে হবে। বেশ কয়েকজন ভাকপা-মালে ও জনা-দুয়েক আরজেডির অঞ্চল-স্তরের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানলাম তাঁরা তাঁদের গ্রাম বা মহল্লার ভোটার তালিকা সংশোধনের ফলে বাদ পড়া ভোটারদের পুনরায় তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা হয় পাকা করে ফেলেছেন বা পরিযায়ী শ্রমিক আবার ভিন-রাজ্যে কাজে যাবার আগে করে ফেলতে পারবেন বলে আত্মবিশ্বাসী।

 

সেক্ষেত্রে কংগ্রেসের হাতে রয়েছে কেবল রিলস আর শর্ট ভিডিও, কার্যকরী জনসংযোগ বলতে কিছু নেই। বুথ পর্যায়ে আরজেডি ও ভাকপা-মালে কর্মীদেরই কাজ করতে হবে – শুনলাম এই সরল সত্যটা দীপংকর ভট্টাচার্য কংগ্রেসের দূত দিগ্বিজয় সিংকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে বিজেপির চালাকিকে বিহারের মহাজোট রুখে দিতে পেরেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেখেশুনে মনে হল, মহাজোট কৌশলগত ভুল না করলে এবং নির্বাচনের সময় যথেষ্ট সংখ্যায় বুথ এজেন্ট দিতে পারলে এবার নীতিশ কুমার ও বিজেপির নৌকা বিহারে ডুববে।

 

লেখক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক কর্মী, মতামত ব্যক্তিগত

 

Share this
Leave a Comment