“সরকারের তো এ বিষয়ে কোনো সদিচ্ছা নেই। … একমাত্র আন্দোলনের চাপেই সরকারকে ন্যায্য দাবি-দাওয়া পূরণে বাধ্য করা যায়। এই ধরনের আন্দোলন তো রয়েইছে, সেইসঙ্গে আরো বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিতে হবে, একেবারে রান্না বন্ধ করে দেওয়ার মতো।”
সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।
২৬ অগাস্ট ২০২৫ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় চার হাজারেরও বেশি মিড-ডে মিল কর্মী কলকাতার হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে ধর্মতলায় জমায়েত হন। রাজ্যের তিনটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালিত মিড ডে মিল কর্মী সংগঠনের যৌথ মঞ্চ – পশ্চিমবঙ্গ মিড-ডে মিল যৌথ সংগ্রাম কমিটির ডাকে এদিন ছিল নবান্ন অভিযান কর্মসূচী। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল নবান্ন অভিযান করে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত ডেপুটেশন জমা দেওয়া। যদিও আগেই দেখা করতে চাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে ই-মেইল করা হয়েছিল, কিন্তু তার কোনও উত্তর তাঁরা পাননি। তাঁরা জানতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী বর্ধমান চলে গেছেন। ধর্মতলায় পুলিশ এই শান্তিপূর্ণ অভিযান আটকে দেয়। উপস্থিত মিড-ডে মিল কর্মীরা এরপর সেখানেই অবস্থান শুরু করেন। তারপর তাঁদের ৬ জন প্রতিনিধিকে নবান্ন-তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সচিব পর্যায়ের কেউ তাঁদের সঙ্গে দেখা করে ডেপুটেশন-এর কপি জমা নেন। আশ্বাস দেওয়া হয়, আগামী তিন-চার দিন পরে মন্ত্রকের তরফে তাঁদের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হবে।
এআইসিসিটিইউ পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধন কর্মী (মিড-ডে মিল) ইউনিয়ন, সিআইটিইউ পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন ও এআইইউটিইউসি পরিচালিত সারা বাংলা মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন সঙ্ঘবদ্ধভাবে গড়ে উঠেছে মিড ডে মিল যৌথ সংগ্রাম কমিটি। এই মুহূর্তে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পোষন নির্মাণ যোজনা বা মিড ডে মিল প্রকল্পে সরকারি নথিভুক্ত মিড ডে মিল কর্মীর সংখ্যা ২.৩৩ লাখ। এ রাজ্যে মিড-ডে মিল কর্মীরা এক বা একাধিক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে কাজ করেন, এক একটা স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিতে সদস্য সংখ্যা ৮-১০ জন, সুতরাং কর্মী সংখ্যাটি পৌঁছে যাবে প্রায় ৮ লক্ষে। মনে রাখতে হবে মিড ডে মিল প্রকল্পটি কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ প্রকল্প। ২০১১ সালে মাথা পিছু মাসে ১০০০ টাকা বরাদ্দ করে কেন্দ্র। স্থির হয় এর মধ্যে কেন্দ্র দেবে ৬০০ টাকা।
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম থেকেই মিড ডে মিল কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল নানা অনিয়ম ও বঞ্চনার অভিযোগে। তাঁদের কাজের কোনো রকম সরকারি স্বীকৃতি নেই, সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাঁরা পড়েন না, মজুরি কাঠামো শ্রম আইন মেনে আদপেই তৈরি নয়, তাঁদের নির্ধারিত কাজের বাইরেও অসংখ্য অতিরিক্ত কাজের চাপে রাখা হয়। এ রাজ্যে ছাত্রছাাত্রী পিছু রন্ধন কর্মী নিয়োগেও রয়েছে অনিয়ম। এক জন কর্মীকে সারা বছর ২৫ জন ছাত্রছাত্রী পিছু কাজ করতে বাধ্য করা হয়। সারা বছর অর্থাৎ ১২ মাস কাজ করে তাঁরা মজুরি পান ১০ মাসের। যেহেতু স্বনির্ভর গোষ্ঠী মূলত এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাই একজন রন্ধন কর্মীর প্রাপ্য পারিশ্রমিক একাধিক কর্মীকে ভাগ করে নিতে হয়। ফলে এক এক জন মাসিক পারিশ্রমিক পান ২৫০-৪০০ টাকা। এই পারিশ্রমিক ন্যূনতম মজুরির চেয়ে অনেক কম।
এর উপর থাকে, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় মিড ডে মিল-এর খাবারের নিম্ন গুণগত মান বা কম পরিমাণ নিয়ে প্রায়শই অভিভাবকদের রোষের শিকার হতে হওয়া, যার দায় কোনোভাবেই মিড ডে মিল কর্মীদের উপর বর্তায় না।
পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় মিড ডে মিল কর্মীদের ধারাবাহিক লড়াই-আন্দোলনের ফলে এ রাজ্যে ২০২৪ সাল থেকে মাথা পিছু বরাদ্দ ২০০০ টাকা হয়েছে, যার মধ্যে কেন্দ্র ৬০০ টাকা ও রাজ্য ১৪০০ টাকা দেবে। অন্যদিকে দেশের অন্যান্য বিভিন্ন রাজ্যে এই বরাদ্দ মাথা পিছু ৩০০০ থেকে ১২০০০ টাকা পর্যন্তও হয়েছে।
নিজেদের পেশার অধিকারের দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি তাঁরা প্রথম থেকেই সরব রয়েছেন অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত পড়ুয়াদের মিড ডে মিল-এ দৈনিক ‘পুষ্টি’র বরাদ্দ বাড়ানো ও খাবারের পরিমাণ ও গুণগত মান বাড়ানোর দাবি নিয়ে। এর পাশাপাশি তাঁদের দাবিতে যুক্ত হয়েছে রাজ্য জুড়ে সরকারি স্কুলগুলিকে বাঁচানোর দাবি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ৮০০০ প্রাথমিক স্কুল ও এস এস কে/এম এস কে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। একের পর এক সরকারি স্কুল বন্ধ হওয়ায় কাজ হারাচ্ছেন বহু মিড ডে মিল কর্মী। তাঁরা মনে করছেন, এর প্রভাব পরছে আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোয় এবং ক্রমাগত শিক্ষার বেসরকারীকরণের কারণে ক্রমশই ভেঙে পড়ছে সরকারি শিক্ষার পরিকাঠামো।
মিড ডে মিল কর্মীদের স্মারকলিপিতে যে দাবিগুলি উল্লিখিত হয়েছেঃ-
- অবিলম্বে উৎসবকালীন ভাতা দিতে হবে
- ১০ মাসের পরিবর্তে ১২ মাসের পারিশ্রমিক দিতে হবে
- মিড ডে মিল কর্মীদের মাসিক ২৬০০০ টাকা বেতন সাপেক্ষে রাজ্যের অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের ধার্য করা ন্যূনতম পারিশ্রমিক দিতে হবে
- মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ সমস্ত ধরনের সরকারি বিধিবদ্ধ ছুটি দিতে হবে
- অবসরকালীন ভাতা সহ সমস্ত ধরনের সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে
- রন্ধন কর্মীদের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি ও পরিচয় পত্র দিতে হবে
- বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টিকর রান্না করা খাবার নিশ্চিত করতে মাথা পিছু বরাদ্দ বাড়াতে হবে
- নিযুক্ত কর্মীদের কোনোভাবেই ছাঁটাই করা চলবে না
- ২৫ জন ছাত্রছাত্রী পিছু তিন জন রন্ধন কর্মী নিয়োগ করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গ মিড ডে মিল কর্মী যৌথ সংগ্রাম কমিটির সদস্য পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধন কর্মী (মিড ডে মিল) ইউনিয়ন-এর সদস্য জয়শ্রী দাস জানালেন, “তিন-চার দিন পরে আমাদের সঙ্গে মন্ত্রকের তরফে বৈঠক করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করব বৈঠকটি হবে। আমরা তো আজকে নবান্ন-র দিকে যাচ্ছিলাম, তার আগেই আমাদের আটকে দেওয়া হল ধর্মতলায়। ওনারা হয়তো ভয় পেয়েছেন। ভয় না পেলে তো আমাদের সকলকেই যেতে দিতেন। যাইহোক আমাদের প্রতিনিধিরা গেছেন, যা করণীয় ছিল করেছেন। আমাদের আন্দোলন বন্ধ হবে না। দাবি পূরণ না হলে আমরা কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হব।”
আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কল্পনা দত্ত জানান, “সরকারের তো এ বিষয়ে কোনো সদিচ্ছা নেই। থাকলে তো ওরা করতই। একমাত্র আন্দোলনের চাপেই সরকারকে ন্যায্য দাবি-দাওয়া পূরণে বাধ্য করা যায়। এই ধরনের আন্দোলন তো রয়েইছে, সেইসঙ্গে আরো বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিতে হবে, একেবারে রান্না বন্ধ করে দেওয়ার মতো। সরকারী তরফে কথা বলবেন বলে জানানো হলেও খুব আশাব্যঞ্জক কিছু জানানো হয়নি কিন্তু। আগামী বৈঠকেও আমরা নিশ্চিত মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন না। মা-মাটি-মানুষের সরকার বললেও তিনি কারোর সঙ্গেই দেখা করেন না। যা করেন প্রচারের জন্য। দেখা যাক, কোনো মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ের কেউ দেখা করেন কি না।”
ছবি : মলয় তিওয়ারি



