কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের আশা কর্মীদের ঐতিহাসিক জমায়েত


  • August 24, 2025
  • (2 Comments)
  • 6088 Views

“পরিষেবা বন্ধ করতে আমরা কোনো পরিস্থিতিতেই চাই না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাবি পূরণ না হলে আমরা কাজ বন্ধ করার পথে হাঁটতে বাধ্য হব,” বললেন আশাকর্মী আন্দোলনের সর্বভারতীয় নেত্রী ইসমাত আরা খাতুন।

 

সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।

 

সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের আনুমানিক ৪০ হাজার আশাকর্মী গত ২২ অগাস্ট স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন কলকাতার রাজপথ। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমজীবী মহিলাদের এই মাপের বিশাল জমায়েত প্রত্যক্ষ করেনি কলকাতা তো বটেই এই রাজ্যও। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গের আশাকর্মীরা অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার (এআইইউটিইউসি)-এর অধিভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ আশা কর্মী সংগঠনের নেতৃত্বে তাঁদের বিভিন্ন ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে লড়াই-আন্দোলন কোরে চলেছেন। নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও আসছে।

 

২২ অগাস্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাজ্যের সমস্ত জেলা থেকে আশা কর্মীরা এই বিপুল জমায়েতে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের জমায়েতের পুলিশি অনুমতি দেওয়া হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী মোড়ে। তারপর তাঁরা কিছু সময় সেখানে অবস্থানের পরে মিছিল করে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। যদিও তারা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি বা মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে দেখা করেননি। মুখ্যমন্ত্রীর সচিবের হাতে তাঁরা স্মারকলিপি তুলে দেন।

 

স্মারকলিপিতে আশাকর্মীদের দাবি সমূহ –

 

১) ৫২৫০ টাকা নয়, রাজ্য সরকারের ঘাঘিত নূ্ন্যতম ভাতা (মিনিমাম ওেয়জ) আশা কর্মীদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে।

 

২) কর্মরত অবস্থায় মৃত আশা কর্মীর পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে।

 

৩) আশা কর্মীদের বেতন বছরে ৩% হারে ইনক্রিমেন্ট করতে হবে।

 

৪) পাহাড়ে আশা কর্মীদের ইন্সেন্টিভ ফিক্সড ভাতার সমপরিমাণ দিতে হবে।

 

৫) আশা কর্মীদের ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি সহ সরকার ঘোষিত সমস্ত প্রকার ছুটি দিতে হবে।

 

৬) মাসের পর মাস ইন্সেন্টিভের টাকা বাকি রাখা চলবে না। ভাগে ভাগে ইন্সেন্টিভ দেওয়া চলবে না।

 

৭) ইন্সেন্টিভের সমস্ত টাকা বিনা শর্তে দিতে হবে এবং প্রতিটি আইটেমে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করতে হবে।

 

৮) করোনা আক্রান্ত আশা কর্মীদের জন্য ঘোষিত এক লক্ষ টাকা অবিলম্বে দিতে হবে।

 

৯) আশা কর্মীদের সরকারি স্বাস্থ্য কর্মীর স্বীকৃতি দিতে হবে।

 

এই জমায়েত, মিছিল ও স্মারকলিপি জমা দেওয়ার পরের দিন গ্রাউন্ডজিরো কথা বলেছিল পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী সংগঠনের সম্পাদিকা ও আশাকর্মী আন্দোলনের সর্বভারতীয় নেত্রী ইসমাত আরা খাতুন-এর সঙ্গে।

 

জিএক্স: স্মারকলিপি জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া কেমন ছিল?

 

ইসমাত আরা খাতুন: এই প্রক্রিয়া খুব সহজ হয়নি। আশাকর্মীরা যাঁরা সারা পশ্চিমবঙ্গে থেকে এসেছিলেন তাঁদের ক্ষোভ এত বেশি ছিল যে তাঁরা রাসবিহারীতেই বেশ কিছু সময় অবস্থান করেন। তারপর আমরা মিছিল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে যাই। তিনি তো সব সময়ে দেখা করেন না। আমরা চিঠি দিয়ে জানিয়ে ছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম তিনি আমাদের স্মারকলিপিটি পড়ুন, বিবেচনা করুন, আমাদের সঙ্গে কথা বলুন। কিন্তু আমাদের তাঁর বাসভবনের নিকটস্থ অফিসে তাঁর ব্যক্তিগত সচিবের সঙ্গেই কথা বলতে হয় ও তাঁর হাতেই স্মারকলিপি তুলে দিতে হয়।

 

জিএক্স: মুখ্যমন্ত্রীর সচিবের সঙ্গে কী কথা হল, যদি একটু বলেন।

 

ইসমাত আরা খাতুন: তিনি আমাদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়েই শোনেন। আমাদের বেশ কিছু দাবি যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি, সাপ্তাহিক ছূটি, ন্যূনতম মজুরি ৫২৫০ টাকার বদলে অন্তত ১৩০০০ টাকা ইত্যাদিকে যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে করছেন বলে জানান। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেন যে এই স্মারকলিপি তিনি মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দেবেন। তিনি আমাদের কয়েক জনের যোগাযোগ নাম্বার রাখেন যাতে প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। তিনি জানান পুজোর পরে, আগামী এক মাসের মধ্যে আমাদের সঙ্গে যাতে আমাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারীভাবে বৈঠক করা যায় সেই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

 

জিএক্স: আমরা দেখছি, এ রাজ্যে নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আশাকর্মীরা লাগাতার আন্দোলন তো চালাচ্ছেনই, সেইসঙ্গে ধাপে ধাপে তার তীব্রতা বাড়ছে। আগামী এক মাসের মধ্যে আশ্বাস পূরণ না হলে আপনারা কীভাবে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবেন?

 

ইসমাত আরা খাতুন: এটা একদমই সঠিক বলেছেন যে, আমাদের আন্দোলনের তীব্রতা ধাপে ধাপে বাড়ছে। আমরা তো অবশ্যই চাইব আশ্বাস মতো আগামী এক মাসের মধ্যে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে। যদি দেখি তা নেহাতই কথার কথা ছিল বা আমাদের সেদিন তাড়াতাড়ি সরিয়ে দেওয়ার জন্য এই কথা বলা হয়েছিল, আমরা অবশ্যই আন্দোলন তীব্রতর করব। পরিষেবা বন্ধ করতে আমরা কোনো পরিস্থিতিতেই চাই না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাবি পূরণ না হলে আমরা কাজ বন্ধ করার পথে হাঁটতে বাধ্য হব। যদিও তা আমাদের জন্য ঝুঁকির, তবু কোনো উপায় থাকবে না।

 

একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই আমাদের আন্দোলন কিছু ক্ষেত্রে তো ফল্প্রসূ হয়েছে। আমরা প্যাকেজ নিতে অস্বীকার করেছিলাম। স্বাস্থ্যভবনের সামনে বিরাট জমায়েত, অবস্থান, ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছিল। স্বাস্থ্যভবন এরফলে আমাদের কিছু দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। আশাকর্মীরাও বুঝতে পারছেন একজোট হয়ে লাগাতার আন্দোলন করে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই এবং আন্দোলনই দাবি পূরণ করতে পারে, ন্যায্য অধিকার এনে দিতে পারে।

 

জিএক্স: স্বাস্থ্যভবনের সামনে বিরাট জমায়েত, বিভিন্ন জেলায় আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে চলছে। কিন্তু খাস কলকাতায় রাজপথ স্তব্ধ করে শ্রমজীবী মহিলাদের এমন বিশাল জমায়েত, মিছিল সাম্প্রতিক সময়ে হয়নি। নাগরিক সমাজ অনেক সময়েই আশা কর্মীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে উদাসীন। এদিনের পর কি ছবিটা বদলাবে?

 

ইসমাত আরা খাতুন: এদিন উত্তরবঙ্গ থেকে সুদূর সুন্দরবন পর্যন্ত সব জেলার আশাকর্মীরা উপস্থিত হয়েছিলেন, শুধুমাত্র তাঁরা বাদে, যাঁদের জরুরিকালীন পরিষেবা দেওয়ার ছিল। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্যই সাধারণ মানুষ অসুবিধায় পড়েছিলেন। আমরা তারজন্য দুঃখিত। কিন্তু আমরা বারেবারেই ঘোষণা করছিলাম যে, আপনারা এক দিনের জন্য অসুবিধায় পড়ছেন, কিন্তু সারা রাজ্যের আশাকর্মীরা প্রতিদিন অসংক্য অসুবিধার মধ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে চলেছেন। সত্যি কথা এদিন আমরা শহরের বিভিন্ন প্রান্ত যেখান থেকে গণ পরিবহনে আশাকর্মীরা এসেছেন, সেখানে, জমায়েত স্থল ও মিছিলের পথে মানুষের সমর্থনই পেয়েছি। কোনো অপ্রীতিকর মন্তব্য বা ঘটনা ঘটেনি। সামাজিক মাধ্যমে আমাদের ছবি দিয়ে অনেকেই লিখেছেন কীভাবে আমাদের দাবিগুলি ন্যায্য ও আমাদের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ। সাধারণ মানুষ যাঁদের একটা অংশ আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে হয়তো জানতেন না, এদিনের পর এই বিষয়ে অনেক বেশি সংখ্যক সে বিষয়ে জানতে পেরেছেন ও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের লড়াই আন্দোলন সমস্ত দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জারি থাকছে।

 

 

Share this
Recent Comments
2
  • comments
    By: Sourav Ghosh on August 25, 2025

    খুবই প্রয়োজনীয় সংবাদ। আশা কর্মীদের যন্ত্রণা কেউই তুলে ধরেন। আপনারা তুলে ধরলেন। প্রত্যাশা থাকবে এইভাবেই বঞ্চিত অবহেলিত অংশের কথা আপনারা জনসমক্ষে তুলে ধরবেন।

    সংবাদ পরিবেশনের নামে যখন সার্কাস চলছে তখন গ্রাউন্ড জিরো খুবই সাহসী এবং প্রশংসনীয় ভূমিকা নিচ্ছে।

  • আশা কর্মীদের বেতন ন্যূনতম মাসে ১৫ হাজার টাকা হওয়া উচিত এই মুহূর্তে। যারা ভাল কাজ করেন দিনরাত 24 ঘণ্টা পরিষেবা দেন তাদের দিকে সরকারের কোন দৃষ্টি থাকে না, এটা খুবই দুঃখজনক ।

Leave a Comment