স্বাধীনতা-‘হীনতা’য়


  • August 15, 2025
  • (0 Comments)
  • 467 Views

যেদিন ছত্তিশগড়ের জনজাতির মানুষের আর পুরুলিয়ার আদিবাসী মানুষের অধিকার স্বর মিলে যাবে, যেদিন কাশ্মীরের সংখ্যালঘু মানুষদের কেবলই উগ্রপন্থী বলে দেগে দেওয়ার প্রতিবাদে শামিল হবেন উত্তর-পূর্বের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার মানুষেরা, যেদিন আসমুদ্র হিমাচলের নারীরা জোট বাঁধবেন হিংসার বিরূদ্ধে, যেদিন জাতপাতের রাজনীতি আর শুধু সংরক্ষণ ঠিক না ভুলের বিতর্কে আটকে না থেকে রোহিথ ভেমুলার চিঠির প্রতিটি শব্দকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে দেশের রাজপথগুলি বন্ধ করে দিতে পারবে অধিকার আদায়ের দাবিতে – সেদিনই ফাদার স্ট্যান স্বামী, প্রফেসর জে এন সাইবাবা-র মৃত্যু পরবর্তী ‘স্বাধীনতা’ উদযাপনের মুহূর্ত আসবে এই ভারতবর্ষে।

 

সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

বিহারের পূর্ণিয়ার সাংসদ পাপ্পু যাদব। বন্যা কবলিত সেই জেলায় পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। না, বন্যার অস্বাস্থ্যকর জলে পা নামাননি তিনি। নিজের কোটি টাকার গাড়িতে বসে ব্রিফকেসে রাখা টাকার বান্ডিল থেকে নোট বের করে বিলিয়ে দিচ্ছিলেন গাড়ির নামানো কাঁচের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দেওয়া বিধ্বস্ত, দরিদ্র, অসহায়, শীর্ণ মানুষগুলোর হাতে। ওই সময়টুকুর জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির কাঁচ নামাতে হয়েছিল, না জানি কত অসুবিধা হয়েছে সাংসদ সাহেবের। টাকা যে বিলোচ্ছেন, পাশে বসে তার ভিডিও করছিল কোনো সঙ্গী। মুখের অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দিচ্ছিল অধুনা বিলুপ্ত সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ এই দুর্ভাগা ভারতবর্ষে আজও রয়ে গেছে। রাগ, বিরক্তি, ক্ষমতার দম্ভ, নিয়ন্ত্রণকারী মানসিকতা সবটা ফুটে বেরচ্ছিল এই সাংসদের হাবেভাবে। যেভাবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বেছে বেছে টাকা দিচ্ছিলেন নিরুপায় মানুষগুলির হাতে সেই দৃশ্য যেকোনো মানুষের বিবমিষা উদ্রেক করবে। কিন্তু কীই বা করার আছে স্বাধীনতার ৭৯তম বছরে উন্নত ভারতের চিত্রটি বোধহয় এরকমই হওয়ার ছিল। ন্যূনতম সম্মান থেকে যেখানে দেশের নাগরিকদের বঞ্চিত করে রাখা হয় আর নির্বাচিত জন প্রতিনিধির আচরণ হয় সামন্ত প্রভুর মতো।

 

৭৯তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের দু-তিন দিন আগে সামাজিক মাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হয় একটি সিসিটিভি ফুটেজ। রাতের রাস্তায় প্রাণ ও সম্ভ্রব বাঁচাতে দৌড়চ্ছেন এক নারী। তাঁকে তাড়া করছেন দু’তিনটে মোটরবাইকে একাধিক পুরুষ। সেই মহিলার দৌড়টুকু সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে। পরের দিন খবর হয়, প্রতিবন্ধী সেই মহিলা গণ ধর্ষিতা হয়েছেন। উত্তর প্রদেশের ঘটনা। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এনকাউন্টার-এ বিশ্বাসী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যে রাজ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, সেই রাজ্যই নারী-নিগ্রহে প্রতিদিন একাধিক শিরোনাম তৈরি করতে থাকে। অথচ রাজ্য প্রশাসন তা বন্ধ করতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী ও উদ্যোগী হয় না। চরম আগ্রাসী পিতৃতান্ত্রিক নৃশংসতার নমুনা তৈরি হতে থাকে ৭৯তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের আগে, পরে।

 

মানুষের পরিচয়, লিঙ্গ পরিচয়, ধর্মের পরিচয়, যৌন পরিচয়, প্রতিবন্ধী পরিচয় সব কিছুর উপরেই নেমে আসছে নির্মম, অমানবিক আক্রমণ, যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। যাতে প্রতিরোধের বহুস্বর জোরদার না হয়, যাতে তা শাসককে প্রশ্ন না করতে পারে। অন্যদিকে ভাষার পরিচিতি, আঞ্চলিক পরিচিতি রক্ষা করার জন্য যে লড়াই সেখানেও দানা বাঁধছে শ্রেণীগত পরিচয়, জাত-বর্ণের পরিচয়। শহুরে যাপনের গায়ে আঁচ না লাগা পর্যন্ত কোনো কিছু নিয়েই তথাকথিত নাগরিক সমাজের মধ্যে বিশেষ আলোড়ন তৈরি হয় না। যেকোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আন্দোলনেই তাই কাজ করতে থাকে এক ধরনের উপর থেকে নীচের দিকে দেখার মানসিকতা ও যেন শহরের নাগরিক সমাজ পথে নেমে আওয়াজ না তুললে কোনো আন্দোলনই স্বীকৃতিযোগ্য নয়, এমন এক ভাবনার প্রকাশ। সেই কারণেই রাষ্ট্রের দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে নাগরিকদের প্রতিরোধ কাঙ্খিত মাত্রায় পৌঁছায় না। শাসককে নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো ভূমিকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। বিশেষত তা যদি ‘অরাজনৈতিক’ তকমা লাগিয়ে হয়।

 

নাগরিক পরিচয়ের উপর রাষ্ট্রীয় আঘাত হানা এখন সবচেয়ে সহজ কাজ। যেভাবে নাগরিকদের অধিকারকেই ধূলিস্মাত করে দেওয়া এখন সবচেয়ে সহজ কাজ। তা তথ্য গোপন করা থেকে কোনো রকম তথ্য না রাখা সব ক্ষেত্রেই হতে পারে। আর সেই সব কিছু ভুলিয়ে দেওয়া যায় অতি সক্রিয় দেশপ্রেমের উদযাপনে। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়কে এক করে দিয়ে, জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মকে এক করে দিয়ে। ‘সিঁদুর’-এর নাম দিয়ে যত সহজে দেশভক্তির বুলি আউড়ানো যায়, ঠিক ততটা সহজে প্রতিনিয়ত নারীর প্রতি বাড়তে থাকা সহিংসতার সরকারি তথ্যেও ফাঁক রেখে দেওয়া যায়। কোনো রকম আইনি বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয় না তা বন্ধ করতে। আসলে সবকিছুই বড় জটিল করে তোলা হয়। তা সে রাজনীতির নামেই হোক বা অ-রাজনীতির। যে মুহূর্তে তা দিশাহীন হয়ে ওঠে বা দিশাহীন করে দেওয়া হয়, সেই মুহূর্তেই তা গুরুত্ব ও গভীরতা দুই-ই হারায় এবং স্বাধীনতা দিবসও নিছক উদযাপন ছাড়া আর কিছুই হয় না।

 

৭০ থেকে ৭৫ থেকে ৭৯ এবং এভাবেই শততম বছরেও পৌঁছে যাবে, কিন্তু ক্ষুধাসূচক, লিঙভিত্তিক বৈষম্য, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা – বিশ্ব জুড়ে যে সূচকগুলিতে বিভিন্ন দেশের মান দেখা হয় প্রতি বছর, সেগুলিতে ক্রমশ পিছু হঠতে থাকা এই দেশের অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে কথা হবে না। রাষ্ট্র ও সরকারকে দায়ী করা হবে না। এবং তা রাজনৈতিক দলের রং নির্ভর নয়, তা নিরপেক্ষ না হলে ‘স্বাধীনতা’ স্রেফ শব্দ হয়েই রয়ে যাবে, তা মর্মে পৌঁছাবে না। স্বাধীনতা ‘মহোৎসব’ হয়ে পালন হবে, মুক্তি হবে না। দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তাই গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে পারেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের মতো একটি সংগঠনের শতবর্ষ উদযাপনের, যার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দেশ জোড়া সাম্প্রতিক উত্থানের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি এই ভাষণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক ভাবে বিশ্বের মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা তৈরির কথা বলেন না, শক্তিশালী হাতিয়ার ভারতের হাতে রাখার জন্য ঘোষণা করেন, ‘মিশন সুদর্শন চক্র’। যখন বিশ্বের কাছে ভারত ক্রমশই রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব হারাচ্ছে তখন, দেশের প্রধানমন্ত্রীর এইসব ঘোষণা, দেশের ভেতরে ‘ভক্ত’দের মধ্যে আলোড়ন ফেলতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতার ৭৯ বছর পরেও এগুলি যে আদপে কাজের কথা নয় এবং সরকারের ব্যর্থতা থেকে চোখ ফেরানোর কৌশল মাত্র, তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও যে কবে বুঝবেন তা বলা যায় না।

 

সুতরাং ৭৯তম স্বাধীনতা দিবস পালন মধ্যরাতে পতাকা উত্তোলন আর সারা দিন হিন্দি দেশাত্মবোধক গান বাজানোর মধ্যেই আটকে থাকে বছরের পর বছর। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, জল-জঙ্গল-জমির অধিকার, মানুষের রুটি-রুজির অধিকার, নিজের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার সব কিছুই আড়ালে চলে যায়। রয়ে যায় শুধু ধর্মীয় মৌলবাদী আস্ফালন। যেকোনো ধর্মের নামেই তাই সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক পরিচিতির দেশের নাগরিকদের অধিকার বঞ্চিত করতে পারে রাষ্ট্র ও তার ক্ষমতার প্রচারকেরা।

 

যেদিন ছত্তিশগড়ের জনজাতির মানুষের আর পুরুলিয়ার আদিবাসী মানুষের অধিকার স্বর মিলে যাবে, যেদিন কাশ্মীরের সংখ্যালঘু মানুষদের কেবলই উগ্রপন্থী বলে দেগে দেওয়ার প্রতিবাদে শামিল হবেন উত্তর-পূর্বের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার মানুষেরা, যেদিন আসমুদ্র হিমাচলের নারীরা জোট বাঁধবেন হিংসার বিরূদ্ধে, যেদিন জাতপাতের রাজনীতি আর শুধু সংরক্ষণ ঠিক না ভুলের বিতর্কে আটকে না থেকে রোহিথ ভেমুলার চিঠির প্রতিটি শব্দকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে দেশের রাজপথগুলি বন্ধ করে দিতে পারবে অধিকার আদায়ের দাবিতে – সেদিনই ফাদার স্ট্যান স্বামী, প্রফেসর জে এন সাইবাবা-র মৃত্যু পরবর্তী ‘স্বাধীনতা’ উদযাপনের মুহূর্ত আসবে এই ভারতবর্ষে।

 

Share this
Leave a Comment