ব্যাকবেঞ্চারদের নিয়ে ভাবনা: পরিবর্তন আনতে কেরালা মডেলেই ভরসা


  • July 23, 2025
  • (0 Comments)
  • 606 Views

ব্যাকবেঞ্চারদের প্রতি এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ভারতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা, শিক্ষাবিদদের নতুন চিন্তা এবং সমাজের সামগ্রিক সচেতনতা।

 

দেবাশিস মিথিয়া

 

২০২৪ সালে মুক্তি পাওয়া মালয়ালম ছবি স্থানার্থী শ্রীকুট্টান শিক্ষাজগতে এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই ছবিতে একজন ব্যাকবেঞ্চার শ্রীকুট্টানকে দেখা যায়, যে স্কুলের নির্বাচনে একজন ফ্রন্টবেঞ্চারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ছবিতে একটি অর্ধবৃত্তাকার বসার ব্যবস্থা তুলে ধরা হয়েছে, যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে। ছবিটি এতটাই সাড়া ফেলেছে যে, কেরালার বেশ কিছু স্কুল এই ধারণাটি বাস্তবেও প্রয়োগ করেছে।

 

কেরালা মডেল: স্থানার্থী শ্রীকুট্টান থেকে অনুপ্রেরণা 

 

শ্রেণিকক্ষে U-আকৃতিতে ছাত্রছাত্রীদের বসানোর এই কেরালা মডেল, যেখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে ঘিরে বসে এবং পেছনের বেঞ্চ বলে কিছু থাকে না, তা আসলে স্থানার্থী শ্রীকুট্টান ছবি থেকেই অনুপ্রাণিত। এই ধারণাটি প্রথম শুরু হয়েছিল রামাবিলাসাম ভিএইচএসএস, ভলাকমে, রাজ্যের পরিবহন মন্ত্রী কে বি গণেশ কুমার ছবিটি দেখে মুগ্ধ হওয়ার পর। পরিচালক ভিনেশ বিশ্বনাথ জানিয়েছেন, এরপর থেকে কেরালার অন্তত আটটি স্কুল এবং পাঞ্জাবের একটি স্কুল এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর ফলে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা উৎসাহিত হচ্ছে এবং সেমি-সার্কুলার বসার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষের ভেদাভেদ দূর করার ছবির বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় এই পরিবর্তনের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে এই পদক্ষেপকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানিয়েছেন, কারণ এটি সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করবে এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শিক্ষার কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। অন্যদিকে, কিছুজনের মতে, এই পরিবর্তন পেছনের সারিতে বসে যে সৃজনশীল স্বাধীনতা এবং শান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাওয়া যেত, তা হয়তো হারাবে। এমনকি কয়েকজন U-আকৃতির বিন্যাসে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপের মতো শারীরিক অস্বস্তির কথাও বলেছেন। তবে, শিল্পপতি আনন্দ মাহিন্দ্রার মতো অনেকেই পেছনের বেঞ্চের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন, কিন্তু তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার প্রশংসাও করেছেন। ভারতীয় বিলিয়নেয়ার হর্ষ গোয়েঙ্কাও মজা করে বলেছেন যে তিনি খুশি যে তিনি কেরালার স্কুলে পড়েননি, যেখানে তার প্রিয় স্থায়ী জায়গা – পেছনের বেঞ্চ – আর নেই!

 

U-আকৃতির বসার ব্যবস্থা: সবার জন্য কি ঠিক? 

 

এই U-আকৃতির বসার ব্যবস্থা সব স্কুলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে, বিশেষ করে যেসব গ্রামীণ স্কুলের প্রতিটি ক্লাসে ১২৫ থেকে ১৩০ জন শিক্ষার্থী থাকে। এই মডেলটি তুলনামূলক ছোট ক্লাসের জন্য, যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম (যেমন ২৫-৩০ জন), সেখানে খুব কার্যকর হতে পারে। কারণ U-আকৃতির বিন্যাসে প্রতিটি শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছাকাছি থাকে এবং সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব হয়, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার জন্য জরুরি।

 

তবে, বড় ক্লাসের ক্ষেত্রে, যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি, সেখানে U-আকৃতির বিন্যাস তৈরি করা কঠিন। এত বেশি শিক্ষার্থীকে U-আকৃতির বেঞ্চে সাজাতে গেলে অনেক বেশি জায়গা লাগবে, যা সাধারণত গ্রামীণ স্কুলগুলির শ্রেণিকক্ষে থাকে না। 

 

এ বিষয়ে কলকাতার এক প্রবীণ শিক্ষক, শ্রী অরূপ চক্রবর্তী, তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, শ্রেণিকক্ষে প্রতিটি শিক্ষার্থীর দিকে নজর রাখা একজন শিক্ষকের মূল দায়িত্ব। U-আকৃতির ব্যবস্থা ছোট ক্লাসের জন্য নিঃসন্দেহে ভালো, কারণ এতে শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের ব্যক্তিগত যোগাযোগ বাড়ে। কিন্তু যখন একটি ক্লাসে ৬০-৭০ জনের বেশি শিক্ষার্থী থাকে, তখন এই বিন্যাস কার্যকর রাখা খুবই চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। পেছনে থাকা শিক্ষার্থীরা সহজে প্রশ্ন করতে বা শিক্ষকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না

 

এই প্রসঙ্গে, সম্প্রতি এই U-আকৃতির শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করা নবম শ্রেণির ছাত্র অর্কদীপ বলে, প্রথম প্রথম একটু অদ্ভুত লেগেছিল, কারণ এতদিন একরকমভাবে বসে ক্লাস করেছি। কিন্তু এখন মনে হয়, এতে ক্লাসে আর কেউ দূরে নেই। স্যার-ম্যাডামরা সবার দিকে সমানভাবে নজর দিতে পারেন। আগে পেছনের বেঞ্চে বসলে হয়তো একটু আড্ডা দেওয়া যেত, কিন্তু এখন সবার মনোযোগ ক্লাসের দিকেই থাকে, যা পড়াশোনায় বেশ সাহায্য করে

 

সুতরাং, U-আকৃতির শ্রেণিকক্ষ মডেল একটি নতুন ধারণা হলেও, এটি সব স্কুলের জন্য, বিশেষ করে অনেক বেশি শিক্ষার্থীযুক্ত গ্রামীণ স্কুলগুলির জন্য, উপযুক্ত নাও হতে পারে। শিক্ষক যাতে সহজে পড়াতে পারেন এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিক্ষার মান ভালো হয়, তা নিশ্চিত করতে স্কুলের আকার এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যার উপর ভিত্তি করে সঠিক বসার ব্যবস্থা বেছে নেওয়া জরুরি।

 

ব্যাকবেঞ্চার এবং ড্রপআউটদের লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনা 

 

শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাকবেঞ্চার শব্দটি সাধারণত এমন শিক্ষার্থীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যারা হয়তো ক্লাসের শেষ সারিতে বসে থাকে, পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগী নয় বা অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। আর ড্রপআউট বলতে বোঝায় যারা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষ না করেই বেরিয়ে আসে। এই দুটি ধারণাকে সমাজে নেতিবাচক চোখে দেখা হলেও, বর্তমান বিশ্বে এদের নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সারা পৃথিবীতেই এই ব্যাকবেঞ্চারড্রপআউটদের সুপ্ত প্রতিভা এবং নতুন চিন্তাভাবনাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ও কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে।

 

মার্ক জুকারবার্গ বা বিল গেটসের মতো অনেকেই আছেন যারা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার তথাকথিত ব্যাকবেঞ্চার বা ড্রপআউট ছিলেন, কিন্তু পরে নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি আর ভিন্ন চিন্তাভাবনার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রভাব ফেলেছেন। এই ধারণাটি খুবই শক্তিশালী এবং এর পেছনে কিছু গভীর কারণও রয়েছে। জুকারবার্গ নিজে হয়তো কোনোদিন নিজেকে ব্যাকবেঞ্চার বলেননি, তবে তাদের মতো মানুষরাই পৃথিবী কাঁপিয়েছেন, এটা সত্যি। তার জীবন এবং সাফল্যের গল্প থেকে তা পরিষ্কার। ফেসবুকের মতো একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার সময় তিনি প্রচলিত পড়াশোনার পথ অনুসরণ করেননি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি ফেসবুক নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং পরে পড়া ছেড়ে দেন। তিনি ছাড়াও এই তালিকায় রয়েছেন মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, যিনিও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপআউট। অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস, তিনিও রিড কলেজ থেকে ড্রপআউট ছিলেন। এ তালিকায় যুক্ত করা যায় ওরাকলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসনকেও, যিনি দুটি ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপআউট হয়েছিলেন। এঁরা কেউই প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার তথাকথিত সেরা ছাত্র বা ফ্রন্টবেঞ্চার ছিলেন না, বরং প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে বড় কিছু করার সাহস দেখিয়েছেন।

 

তবে, এই উদাহরণগুলো কিছু ব্যতিক্রম মাত্র। আমাদের ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক কাঠামোয়, জাত-পাত ও বর্ণ বৈষম্য সর্বোপরি আর্থিক অনটনের কারণে প্রচুর ছেলে-মেয়ে লেখা পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ ড্রপআউট হয়। তারা বেশিরভাগই প্রান্তিক পরিবারের সন্তান। প্রথাগত শিক্ষা থেকে ছিটকে গিয়ে এই সব দিকপালদের মতো অন্য কিছু করার সুযোগ তাদের থাকে না। সংসারের অভাবের তাড়নায় তারা হয় ইঁটভাটা, না হয় গ্যারেজে বা অন্য কোথাও শিশুশ্রমিক হিসেবে যুক্ত হয়। অনেকে মেয়ে গৃহসহায়িকার কাজ করতে বাধ্য হয়। অথচ এ দেশে শিশুশ্রম আইনত বন্ধ।

 

তাই, শুধু সফল ‘ড্রপআউট’দের উদাহরণ দিয়ে সমাজের সকল ‘ড্রপআউট’দের সম্ভাবনাকে এক করে দেখা ঠিক নয়। কারণ, পশ্চিমী দেশগুলোতে ‘ড্রপআউট’দের অনেকেই নিজেদের পছন্দ বা উদ্ভাবনী চিন্তার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেন, যেখানে তাঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সাধারণত নিশ্চিত থাকে। কিন্তু ভারতে এই বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

 

কেন ব্যাকবেঞ্চাররা অনেক সময় পৃথিবী কাঁপায়? 

 

ব্যাকবেঞ্চারদের এমন সাফল্যের পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা অনেক সময় শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট ছকে ফেলে দেয়, কিন্তু যারা ব্যাকবেঞ্চার হন, তারা প্রায়শই এই ছকের বাইরে চিন্তা করেন এবং নিয়ম ভাঙতে ভয় পান না। এই স্বাধীনচেতা মানসিকতা তাদের নতুন কিছু আবিষ্কার করতে বা নতুন পথ তৈরি করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, ব্যাকবেঞ্চাররা প্রায়শই বইয়ের জ্ঞানের চেয়ে বাস্তব কাজের দিকে বেশি আগ্রহী হন। তারা মুখস্থ করার পরিবর্তে বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে বেশি মনোযোগী, যা তাদের উদ্ভাবনী করে তোলে এবং সৃজনশীল সমাধান খুঁজে পেতে সাহায্য করে।

 

প্রথাগত সাফল্য না থাকায় তাদের নিজেদের পথ নিজেদেরই তৈরি করতে হয়। এতে তাদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ে এবং ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়, যা একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য অপরিহার্য। সমাজের মূলস্রোতের বাইরে থাকায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই ভিন্ন হয়। তারা এমন সমস্যাগুলো দেখতে পান, যেগুলো অন্যরা হয়তো উপেক্ষা করে যান, এবং সেগুলোর জন্য নতুন সমাধান নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে অনেক সময় গভীর সৃজনশীলতা থাকে যা প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে বিকশিত হতে পারে না। এই অপ্রচলিত চিন্তাভাবনা তাদের বড় কিছু করার অনুপ্রেরণা জোগায় এবং প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন কিছু তৈরি করতে উৎসাহিত করে।

 

সুতরাং, মার্ক জুকারবার্গ বা তার মতো সফল ব্যক্তিদের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা প্রচলিত সাফল্যের ধারণা সবসময় জীবনের চূড়ান্ত সাফল্যের মাপকাঠি নয়। বরং, ভিন্ন চিন্তাভাবনা, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস এবং নিজেদের প্রতিভার ওপর বিশ্বাসই অনেক সময় মানুষকে বিশ্ব বদলে দেওয়ার ক্ষমতা দেয়।

 

বিশ্বব্যাপী দৃষ্টিভঙ্গি: কেন ব্যাকবেঞ্চাররা গুরুত্বপূর্ণ?

 

বিশ্ব অনেক দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাকবেঞ্চারদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাবিদরা বুঝতে পারছেন যে, প্রথাগত কাঠামোর বাইরে থাকা এই শিক্ষার্থীরা প্রচলিত ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাগুলো দেখতে পায় এবং প্রায়শই এমন ধারণা নিয়ে আসে যা সামনের সারির শিক্ষার্থীরা হয়তো ভাবতেও পারে না। তাদের জন্য এখন বিশেষ কর্মশালা, প্রকল্প-ভিত্তিক শিক্ষা এবং মেন্টরশিপ প্রোগ্রামের আয়োজন করা হচ্ছে, যাতে তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত হতে পারে। এই ধারণার পেছনে এক গভীর সত্য লুকিয়ে আছে : জ্ঞান শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, তা বাস্তবের সঙ্গে মিশে থাকে। যারা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় তথাকথিত দুর্বল, তারা প্রায়শই বাস্তব সমস্যার প্রতি বেশি সংবেদনশীল হন এবং ভিন্নভাবে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন।

 

ভারতে কি এই পরিবর্তন সম্ভব? 

 

ভারতে এই ধারণা বাস্তবায়ন করাটা কিছুটা কঠিন হতে পারে, তবে অসম্ভব নয়। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও অনেকটাই নম্বর-ভিত্তিক এবং প্রতিযোগিতামূলক। এখানে সাফল্য মূলত বেশি নম্বর এবং ভালো র‍্যাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল। ফলে, অনেক সময়ই প্রথাগত শিক্ষাদান পদ্ধতির বাইরে যারা, তাদের প্রতি ততটা মনোযোগ দেওয়া হয় না। এর ফলে, অসংখ্য প্রতিভাবান শিক্ষার্থী, যাদের হয়তো প্রথাগত পড়াশোনায় আগ্রহ নেই বা যারা অন্যভাবে শিখতে পছন্দ করে, তারা অবহেলিত থেকে যায়।

 

তবে, আশার কথা হলো, ভারতেও কিছু নতুন ধারার স্কুল এবং কলেজ, বিশেষ করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা এবং স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করছে। সরকারও শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক বিকাশের ওপর জোর দেবার কথা বলছে, যা শিক্ষার্থীদের কেবল বইয়ের বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিভা খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।

 

ভারতের মতো বিশাল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে ব্যাকবেঞ্চারদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

 

  • শিক্ষকদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার যাতে তারা প্রতিটি শিক্ষার্থীর নিজস্ব ক্ষমতা এবং দুর্বলতা চিনতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী তাদের সাহায্য করতে পারেন।

 

  • শুধুমাত্র মুখস্থ করার পরিবর্তে ব্যবহারিক জ্ঞান এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। প্রকল্প-ভিত্তিক শিক্ষা, বিতর্ক, এবং দলগত কাজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে।

 

  • শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয় দূর করে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা যেখানে তারা প্রশ্ন করতে, ভুল করতে এবং নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে।

 

  • অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং ডিজিটাল টুল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে শেখার সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে, যা তাদের নিজেদের গতিতে শিখতে সাহায্য করবে।

 

ভারতে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা তাদের স্কুল জীবনে হয়তো তথাকথিত ব্যাকবেঞ্চার ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে শিল্প, বিজ্ঞান, ব্যবসা বা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। শরদ পাওয়ারের আত্মজীবনী লোক মাজা সাঙ্গাতি-তে উল্লেখ আছে, এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ স্কুল জীবনে দুষ্টুমি আর অমনোযোগিতার জন্য প্রায়শই শাস্তি পেতেন। তিনি ব্যাকবেঞ্চার ছিলেন। শিক্ষকরা তাকে নিয়ে চিন্তিত থাকলেও, তিনি পরবর্তীতে নিজের দূরদৃষ্টি আর নেতৃত্বগুণে দেশের একজন সফল রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। 

 

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে এই ধরনের প্রতিভাগুলি প্রাথমিক পর্যায় থেকেই চিহ্নিত হয় এবং তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।

 

পরিশেষে বলা যায়, ব্যাকবেঞ্চারদের প্রতি এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ভারতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা, শিক্ষাবিদদের নতুন চিন্তা এবং সমাজের সামগ্রিক সচেতনতা। যদি আমরা এই শিক্ষার্থীদের সঠিক প্ল্যাটফর্ম এবং সুযোগ দিতে পারি, তবে তারা কেবল নিজেদের নয়, দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

 

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।)

 

Share this
Leave a Comment