গত ৯ জুলাই দেশব্যাপী ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন-এর ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গেও। বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষেরা শামিল হয়েছিলেন ধর্মঘটে। ছিল বিপরীত চিত্রও। গ্রাউন্ডজিরো-র পক্ষ থেকে সুদর্শনা চক্রবর্তী কথা বলেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে।
কোলিয়ারি ঠিকা শ্রমিক
ইসিএল (আসানসোল-দূর্গাপুর) ঠিকা শ্রমিক অধিকার ইউনিয়ন দেশের ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন-এর ডাকা ৯ জুলাই-এর ডাকা সাধারণ ধর্মঘটে সম্পূর্ণভাবে সাড়া দিয়েছিলেন। প্রচার, লিফলেট ছড়ানো, পথসভা ইত্যাদি চলেছিল আগে থেকেই। এই ইউনিয়ন, বেসরকারিকরণ বিরোধী মঞ্চ ও অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে এই প্রচার চালিয়েছেন। প্রচারে যে বিষয়গুলি জায়গা পেয়েছিল সেগুলি হল –
- শ্রমকোড বাতিল
- সমস্ত রকম বেসরকারীকরণ নীতি বাতিল করতে হবে
- ঠিকা প্রথা বাতিল করে স্থায়ীকরণ করতে হবে
- ভারতবর্ষ জুড়ে খনিজ সম্পদের যে কর্পোরেট লুট চলছে ও তার জন্য সরকার যে পলিসি তৈরি করছে তা বাতিল করতে হবে
- বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের বিরুদ্ধেও প্রচার করা হয়। কারণ শ্রমিক শ্রেণীকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটা বড় ভূমিকা নিতে হবে।
- আদিবাসীদের উপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে বোমা বর্ষণ, অত্যাচার চলছে তা বন্ধ করতে হবে।
ইসিএল-এর সাতগ্রামে কালিদাসপুর কোলিয়ারি আর সোদপুর এলাকায় পাঁচমোহনা কোলিয়ারি – এই দু’টি জায়গায় এই সংগঠনের শক্ত জমি রয়েছে এবং পাঁচমোহনা ঠিকা শ্রমিকেরা পুরো বনধ করেন। তাঁদের উপর চাপ দিয়েও কর্তৃপক্ষ কাজে যোগ দেওয়াতে পারেননি। সেখানে স্থায়ি শ্রমিকেরাও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া প্রায় ৯০% শ্রমিক কাজে যোগ দেননি। অপরটিতে যৌথ প্রচার ছাড়াও ঠিকা শ্রমিকেরা নিজেরা গেট মিটিং করেন। তাঁরা ধর্মঘটে শামিল হন, যদিও স্থায়ি শ্রমিকদের কাজে যোগদান করানোর জন্য পুলিশ, কোলিয়ারি কর্তৃপক্ষ উপস্থিত ছিল। এলাকার বিভিন্ন কোলিয়ারিতেই স্বতঃস্ফূর্ত বনধ হয়েছে। একটি কোলিয়ারিতে ৫০০ জন শ্রমিকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ২৭ জন শ্রমিক।
“বিভিন্ন জায়গায় যেহেতু টিএমসি বনধের বিরোধিতা করেছে ও তাদের যথেষ্ঠ হুমকি ছিল, সেই ক্ষেত্রে বলতে হয়, সর্বাত্মক বনধ হয়েছে এরমটা নয়। যেসব ইউনিয়ন বনধ ডেকেছে তাদের যারা সদস্য তারাই ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন। কয়লাশিল্পে আমরা যেটা দেখেছি বনধ সর্বাত্মক হয়নি,” বললেন ইসিএল ঠিকা শ্রমিক অধিকার ইউনিয়নের সুদীপ্তা পাল।
শ্রমকোড বাতিল নিয়ে আরো ব্যাপক ও সংগঠিত প্রচার ও আন্দোলন লাগাতার কোরার দরকার ছিল কি না জানতে চাওয়ায় তিনি বলেন, “সমস্ত ইউনিয়ন, বিশেষত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমকোডের সমস্যাগুলো নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে যে প্রচারের কাজ করা দরকার ছিল সেটা তো হয়নি। কৃষি বিলের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছে শ্রমকোডের বিরুদ্ধে তো সেরকম আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বলা যায়, শ্রমকোড শুধু নামেই লাগু হয়নি, আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জানি, লেবার কমিশনার লেভেলে তারা যেন প্রায় শ্রমকোড লাগু হয়ে গেছে এরকভাবে বিষয়গুলোকে দেখছেন। পশ্চিমবঙ্গে তো বহু জায়গায় ১২ ঘন্টা কাজ করাচ্ছে। সেখানে কোনো বিরোধিতা নেই। অন্যান্য রাজ্যে তারা নিজেদের মতো করে ১২ ঘন্টা কাজের অর্ডিন্যান্স পাশ করে নিচ্ছে।“
সুদীপ্তা স্পষ্টতই জানান, “শ্রমিকদের এগিয়ে এসেই তাঁদের ভূমিকা নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন-এর উপর নির্ভর করলে তো হবে না। শ্রমিকেরা লড়াই করছেন, তাঁদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তুলতে হবে।“
পুলিশের অতি-সক্রিয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এটা তো আমরা আগেও দেখেছি। তৃণমূল এক সময়ে ধর্মঘট করেছে এবং ২০১১ সাল থেকে তারা বারবার ধর্মঘটে বাধা সৃষ্টি করেছেন, পুলিশ নামিয়ে জোর-জবরদস্তি ধর্মঘট ভাঙার চেষ্টা করেছে। জনবিরোধী অবস্থানে তারা তো চলেই গেছে।“
“আসলে একদিনের ধর্মঘট করে তো হবে না। লাগাতার শ্রমিক আন্দোলনের বিষয়। লাগাতারভাবে আমরা আন্দোলন করে চলছি। ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে কর্মসূচী নিয়েছি। লাগাতার আন্দোলন করে যেতে হবে। এর থেকে নতুন অভিমুখ তৈরি হবে কি না আগামী দিনে শ্রমিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতার উপর তা নির্ভর করবে,” এই ধর্মঘট-পরবর্তী পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি জানান।
আসানসোলের চিনাকুড়ি কোলিয়ারিতে ১০ জুলাই বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালীন পুলিশ সুদীপ্তা পাল সহ ৫ জন আন্দোলনকারীকে আটক করে। পরে ৪ জনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও সুদীপ্তা পালকে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আশা কর্মী
৯ জুলাই-এর সাধারণ ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন গ্রাম ও শহরের আশা কর্মীরা। জরুরিকালীন পরিষেবা দেন যে আশা কর্মীরা তাঁরা এর আওতার বাইরে ছিলেন। সারা রাজ্যের সমস্ত জেলা মিলিয়ে প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি আশা কর্মী এদিন তাঁদের রুটিন যে কাজ তা বন্ধ রেখে পথে নেমে এদিনের কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন। সব ব্লক, পৌরসভা, মহকুমা, কোথাও জেলাগত ভাবে বড় মিছিল, প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন তাঁরা।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল দিনটি ছিল বুধবার। এদিন রুটিন কাজের মধ্যে থাকে তথ্য তোলা, সাম্প্রতিকীকরণ করা – যে কাজের জন্য রাজ্যগতভাবে ২৪০ টাকা ইন্সেন্টিভ ধার্য করা আছে। ধর্মঘটে শামিল হওয়ার জন্য এই অতি গুরুত্বপূর্ণ টাকাটির ত্যাগস্বীকার স্বেচ্ছায় করেই আশা কর্মীরা কাজ বন্ধ রাখেন। “তাঁদের ইন্সেন্টিভ ৩-৫ মাস সাধারণভাবেই অনেক সময় বাকি থাকে, এমনকি এক বছরের টাকা বাকি আছে এমন উদাহরণও রয়েছে। তাই না পাওয়ার তালিকা এই দীর্ঘ, এই ২৪০ টাকা তাঁদের কাছে মামুলি ব্যাপার নয়। তা সত্ত্বেও তাঁরা স্বেচ্ছায় বলেছেন, প্রয়োজনে আমরা এ টাকাও নেব না। এই বনধের সামনের যে দাবিগুলি রয়েছে, সেই দাবি যাতে পূরণ হয় – নিয়মিত ভাতা দেওয়া, ভাতা বৃদ্ধি, সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীর স্বীকৃতি, যাঁরা কর্মরত অবস্থায় মারা গেছেন তাঁদের পরিবারকে এককালীন ৫ লক্ষ টাকা দেওয়া সেগুলি পূরণের জন্য আশা কর্মীরা ধর্মঘটে শামিল হন,” জানালেন আশা কর্মীদের পশ্চিমবঙ্গ তথা সর্বভারতীয় নেত্রী ইসমত আরা খাতুন।
তাছাড়া এটি একটি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প। অথচ দেখা যাচ্ছে কেন্দ্র সরকার এই প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে না বরং কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প সংক্রান্ত নানা ঘোষণা হলেও তা একেবারেই ‘নিষ্ফলা’। তাই কেন্দ্রের কাছে দাবি থাকছেই সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি দিয়ে এই কর্মীদের ন্যূনতম ২৮ হাজার টাকা বেতন দিতে হবে।
“আগামী দিনে শ্রমকোড বাতিল নিয়ে আরো ব্যাপক আলোচনা ও প্রচারের কথা যেমন ভাবা হচ্ছে, এদিন আশা কর্মীদের আন্দোলনেও শ্রম কোড বাতিলের জোরদার দাবি ছিল। সরকারি চাকরির যে ধারণা তাকেই তো এই শ্রম কোডের মধ্য দিয়ে একেবারে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিবাদের অধিকার, আন্দোলনের অধিকার, ইউনিয়ন করার অধিকার এগুলি ধীরে ধীরে, খুবই সূক্ষ্ম চক্রান্তের মধ্যে দিয়ে শ্রমিকের অধিকারগুলিকে খর্ব করা হচ্ছে। এখানে সরকারি বা কন্ট্র্যাকচুয়ালের প্রশ্ন নয়। আশা কর্মীরা কেন্দ্রের কর্মী। সরকারি পরিষেবার ক্ষেত্রে সে সরকারি কর্মীর ন্যায় কাজ করছে। এটা স্কিম কেন হবে? সে তো সরকারি কর্মীর ন্যায় সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। ফলে নানা ধরনের কর্মী পদ সৃষ্টি করে আসলে অধিকারগুলোকেই নস্যাৎ করতে চাইছে এই শ্রম কোড। এটা সরকারের একটা নীল নকশা। এর বিরোধিতা আমরা সব সময়েই করছি, আগামী দিনেও করব,” শ্রম কোড বিরোধী আন্দোলন ও আশা কর্মীদের আন্দোলনের একসঙ্গে চলা প্রসঙ্গে জানালেন তিনি।
গিগ কর্মী
সারা পশ্চিমবঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের একটা বড় অংশ ৯ জুলাই-এর সাধারণ ধর্মঘটে শামিল হন। কলকাতা শহরে শ্রমজীবী মানুষ বিশেষত ডেলিভারি শ্রমিকদের একটি বড় সংখ্যা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। দাবি ছিল তাঁদের একেবারেই নিজস্ব এবং সরকার যত শীঘ্র সম্ভব হস্তক্ষেপ করুক ও গিগ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সরকারি আইন তৈরি হোক এবং কেন্দ্র যে শ্রম কোড চালু করতে চাইছে তা যাতে কিছুতেই জারি করতে দেওয়া না হয় – এই ছিল মূল দাবি। “গিগ শ্রমিকেরা সবথেকে ভালো বুঝতে পারছেন। যাঁদের কোন অধিকার নেই, অন্য শ্রমজীবী মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হলে তাঁদের যে কোনোদিনও কোনো অধিকার পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে না – এটা তাঁরা খুবই ভালো বুঝতে পারছেন এবং সেই কারণেই তাঁরা, যাঁদের প্রতিদিনের রোজগারের উপর জীবন-জীবিকা নির্ভর করে তাঁরাও এই ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন,” বললেন অল ইন্ডিয়া গিগ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন-এর কলকাতার জেনারেল সেক্রেটারি সাগ্নিক সেনগুপ্ত। বিভিন্ন অ্যাপ নির্ভর পরিষেবা – ফুড ডেলিভারি, গ্রসারি ডেলিভারি, পরিবহন – ইত্যাদির একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ৯ জুলাই কাজ বন্ধ রাখেন। কাজে যোগ দেন পরের দিন সকালে।
এদিনের ধর্মঘটে যোগদানের যথেষ্ঠ নেতিবাচক প্রভাব তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে পড়ার আশংকা ছিল। কাজে যোগ না দিলে তাঁদের আইডি ব্লক করে দেওয়া হয়। “তাঁরা প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে বলেছেন, আমরা স্ট্রাইক করছি, স্ট্রাইকের জন্য আমরা আজকে কাজ করব না। এবার এরজন্য যদি তাঁদের আই ডি ব্লক করে আমরা নামব রাস্তায় আই ডি খোলার জন্য। এর আগেও তাই করেছি, এর পরেও তাই করব। ডেসপারেশন যাঁদের এই চূড়ান্ত জায়গায়, তাদের এই কোম্পানির দমন-পীড়নের মধ্যেই প্রত্যেক দিন বেঁচে থাকতে হচ্ছে। ফলে একদিন কাজ না করা তাঁদের জন্য সমস্যাজনক তো বটেই, কিন্তু তার থেকে কিছু যদি ফলপ্রসূ হয়, তাহলে অবশ্যই তাঁরা সেটার চেষ্টা করে দেখবেন। সেই চেষ্টা তাঁরা আজকে করে দেখেছেন। অধিকাংশের ক্ষেত্রেই যা বয়স, যতদিন তাঁরা কাজ করছেন, আজ বোধহয় প্রথম স্ট্রাইক তাঁদের জীবনের,” ধর্মঘটে শামিল হওয়ার ফলাফল প্রসঙ্গে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত উঠে আসে অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষেরাও গিগ কর্মীদের নিজেদের লড়াই-সংগ্রামের সম্পূর্ণ সাথী বলে মনে করছেন। মালিক পক্ষ ন্যূনতম বিনিয়োগে একটি অ্যাপ তৈরি করে অত্যন্ত কম মজুরিতে, কোনো রকম সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া, কোনোরকম দায়িত্ব ছাড়া এক বিপুল অংশের শ্রমজীবী মানুষকে কাজে নিয়োগ করছে ও সেই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। আশংকার জায়গা হল, শ্রম কোড জারি হয়ে গেলে স্থায়ি কাজের ঠিকাকরণ হয়ে যাবে। গিগ শ্রমিকেরা কোনো অধিকারেরই অন্তর্ভুক্ত নন। এ যেন পুঁজিবাদের সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য গিগ অর্থনীতির অস্ত্রকে পুরোপুরি ব্যবহার করা।
“গিগ শ্রমিকদের আন্দোলন হচ্ছে দৈনন্দিন যে সমস্যাগুলি থাকে – পে আউটের সমস্যা, পে আউট কমিয়ে দেওয়া, ইন্সেটিভ কমিয়ে দেওয়া, সেগুলিতে ইমিডিয়েট ইন্টারভেনশন। এর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সরকারকে এই বিপুল সংখ্যক কর্মীর দায় নিতে হবে। এই স্ট্রাইক আমাদের ইমপেটাস (উদ্দীপনা) দিচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিক যখন স্ট্রাইকে নামতে পারেন এত সমস্যার মধ্যে থেকেও, তাহলে যেঁ গিগ শ্রমিকেরা আছেন, তাঁরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন,” জানালেন তিনি।
বিএসএনএল কন্ট্র্যাক্টচুয়াল ওয়ার্কার্স
“বিএসএনএল-এর যাঁরা কন্ট্র্যাকচুয়াল লেবার ছিলেন, যাঁদের বিএসএনএল এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিতাড়িত করেছিল, তাঁরা এই বনধকে ভীষণভাবে সাপোর্ট করেছে এবং বিভিন্ন জায়গায় এর সমর্থনে দলে দলে রাস্তায় নেমেছিলেন,” বললেন শঙ্কর কুমার হালদার, কন্ট্র্যাকচুয়াল ওয়ার্কার্স অফ বিএসএনএল, সিটি, ক্যালকাটা টেলিফোনস-এর বর্তমান সেক্রেটারি। তাঁদের দাবি একটিই – শ্রমিকের পক্ষেই যেন সব সরকার কাজ করে। আইন যেন শ্রমিকের পক্ষে থাকে। সারা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৪৫০ জন বিএসএনএল-এর যাঁরা কন্ট্র্যাকচুয়াল লেবার এই ধর্মঘটে অংশ নিয়েছিলেন। উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি – এই জেলাগুলিতেই মূলত তাঁরা রয়েছেন। সেভাবেই এই ধর্মঘটের কর্মসূচী স্থির হয়।
শাসক শ্রেণীর ইউনিয়ন লিডারদের সঙ্গে যোগসাজশে শ্রমিকদের কাজ বাতিল করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। ২৫-৩০ বছর কাজের পর স্থায়িকরণের বদলে এই কর্মীদের চাকরিটিই চলে যায়। তাঁদের আইনি লড়াই চলছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাইবুনাল কোর্টে। এই কোর্টের পূর্বতন বিচারক ইস্তফা দেওয়ায় এই মুহূর্তে সেখানে কোনো বিচারক নেই। তবে পূর্বতন বিচারকের ইন্টারিম রায়ের ভিত্তিতে তাঁরা আশাবাদী এই মামলা তাঁরা জিতবেন। এই রায়ে বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি হার স্বীকার করে নিয়েছে, এমনই মনে করছেন তাঁরা। এমতাবস্থায় কর্তৃপক্ষ ইউনিয়ন-এর আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, যার সত্যতা নিয়ে ইতিমধ্যেই ইউনিয়ন যাবতীয় নথিপ্ত্র আদালতে জমা দিয়েছেন।
মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ
সেলস প্রমোশন কন্ডিশন অফ সার্ভিস অ্যাক্ট – শ্রম কোড পাশ হওয়াতে এই আইনটি উঠে গেল। ফলে প্রবল সমস্যার মুখে পড়তে চলেছেন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, সেলস প্রমোশন এমপ্লয়িজ। এই আইনের সীমাবদ্ধতা থাকলেও এর ফলে বেশ কিছু অধিকার সুরক্ষিত থাকত, যেগুলি আর রইল না। তাঁদের নিয়োগপত্র কী হবে তার একটা ফরম্যাট এই আইনে ছিল, যা উঠে গেল। যে সমস্ত ছুটি ছিল তা এক ধাক্কায় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। “এই কোড দিয়ে মালিকদের মাথায় ছাতা ধরা হয়েছে, শ্রমিকদের পায়ে আরো শক্ত বেড়ি পরানো হয়েছে,” বললেন, ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ সেলস রিপ্রেজেন্টিভ ইউনিয়ন-এর সম্পাদক আশিস কুসুম ঘোষ।
৯ জুলাইয়ের ধর্মঘটে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ-রা সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, প্রায় ৯৯% কর্মী অংশ নিয়েছেন। এই অংশগ্রহণ বোঝা গেছে উপস্থিতির হার দেখে। এই উপস্থিতি অ্যাপ নির্ভর। তিনি জানালেন, “যেহেতু নতুন প্রযুক্তি দিয়ে মালিক পক্ষ আটকানোর চেষ্টা করে, তাতে ধর্মঘট একটা নতুন আকার নিয়েছে। আমরা এতদিন জানতাম ধর্মঘট মানে ধুয়া বন্ধ, চাকা বন্ধ। এবার আমরা শ্লোগান তুলেছি অ্যাপ বন্ধ। কোনো অ্যাপ ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটারে খোলা হবে না। ফলে ধর্মঘট এন্ট্রি হয়ে গেল। এই ধর্মঘট শুধু শ্রম কোড বাতিলের জন্য নয়। আমরা বলছি যেভাবে প্রাণ-প্রকৃতিকে ধ্বস্ত করে, যেভাবে উন্নয়নের নামে মানুষকে পথে বসানো হচ্ছে, মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষের হাতে সম্পদ চলে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে এটা জেহাদ।”
পথ হকার
কলকাতার হকার্স সংগ্রাম কমিটির জয়েন্ট সেক্রেটারি মুরাদ হোসেন এই সাধারণ ধর্মঘট সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন সরকারি পরিসংখ্যান না থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ১৬ লক্ষ পথ হকার আছেন। ২০১৪ সালে তৈরি হয়েছে হকারদের আইন। “একটা বড় সংখ্যক হকারদের দেখা যায় যে যখন সরকারে থাকে, তখন তাদের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক রেখে চলেন। পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নয়। সংগঠিত ইউনিয়ন হলে চিত্রটা অন্য রকম হয়। তারা নিয়মিত ইউনিয়নের কাজে অংশগ্রহণের ফলে জানেন কখন কী করতে হবে না হবে,” বক্তব্য মুরাদ হোসেনের। সেই যুক্তি অনুযায়ী, তিনি জানালেন, শাসক দল তৃণমূল বনধকে সমর্থন না করায় একটা বড় অংশের হকার হকারি করেছেন। ইউনিয়ন-এ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন।
ব্যাঙ্ক (এসবিআই)
আশ্চর্যজনকভাবে ৯ জুলাই-এর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটে অংশগহণ করেনি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। অথচ মুনাফার দিক থেকে তাদের লাভ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এবং চুক্তিভিত্তিক কর্মী এসবিআই-তেই সবচেয়ে বেশি, যেকোনো ব্যাঙ্কের তুলনায়। এখানে সাংগঠনিক কারণে ধর্মঘটে শামিল হওয়ার কর্মসূচী নিতে পারেনি ইউনিয়ন, জানালেন কন্ট্র্যাকচুয়াল ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন, বেঙ্গল সার্কেল-এর সভাপতি অমিত মজুমদার। তাঁর মতে ইউনিয়ন-এর উপরতলার নেতৃত্বর হাতে আন্দোলন ও লড়াইয়ের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেই হবে না। সেই দায়িত্ব তুলে নিতে হবে তৃণমূল স্তরের কর্মী, শ্রমিকদের।
গৃহ শ্রমিক
গৃহ শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠন প্রয়াস-এর সঙ্গে যুক্ত গৃহ শ্রমিক রাণী বড়ুয়া। জানালেন, “আমাদের মধ্যে অনেকেই বৃষ্টি-বাদলের জন্য কাজেও যেতে পারেনি, ধর্মঘটেও শামিল হতে পারেনি। আবার অনেকে কাজে গেছেনও। তবে আমরা এই বনধের পক্ষে। এই যেঁ কোডের কথা বলছে এটা হলে তো আমাদের খুব বিপদ। এখনই কত বেশি কাজ করায়, এরপর ১২ ঘন্টা হয়ে গেলে কী হবে আমরা তো ওভারটাইম-ও পাব না। তাই এটা বাতিল করতে হবে।“
এক্সোডাস
কথা হয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগ্ণার সোনারপুরের রামচন্দ্রপুরে এক্সোডাস ফিউচার নিট প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি, যা গেঞ্জি কোম্পানি নামেই পরিচিত সেখানকার মহিলা শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আসুদা বিবির সঙ্গে। কয়েক মাস আগে তাঁদের নাছোড় লড়াই দাবি আদায় করিয়েছিল মালিক পক্ষের কাছ থেকে। ৯ জুলাই-এর সাধারণ ধর্মঘটে তাঁরা যোগ দেননি। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি বলেই শামিল হননি তাঁরা।

