এক চিকিৎসকের আত্মহত্যা ও অসমাপ্ত প্রশ্নেরা 


  • September 9, 2021
  • (2 Comments)
  • 1281 Views

১০ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা সচেতনতা দিবস। সম্প্রতি একটি আত্মহত্যা আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অনেকগুলি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রশ্নের মুখোমুখি। ডাঃ অবন্তিকা ভট্টাচার্য যিনি একজন চিকিৎসক ও একজন অটিস্টিক সন্তানের মা। অটিস্টিক সন্তানের মা হওয়ার কারণে কেন্দ্র সরকারের নির্দেশিকা অনুসারে যাঁর সুবিধাজনক পোস্টিং পাওয়ার অধিকার ছিল। রাজ্য সরকার বছরের পর বছর তা উপেক্ষা করে গেছে। মানসিক চাপ নিতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন অবন্তিকা। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় ওঠা প্রশ্ন, রাজ্য সরকারের উদাসীনতা এই সবকিছুই আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে প্রতিবন্ধকতা, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লিঙ্গ রাজনীতি, রাষ্ট্রের ভূমিকা এই প্রতিটি বিষয় নিয়েই। বিশ্লেষণে দীর্ঘদিনের প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মী শম্পা সেনগুপ্ত 

 

 

ডাক্তার অবন্তিকা ভট্টাচার্যের আত্মহত্যা আমাদের অনেকগুলি প্রশ্নের সম্মুখীন করে। অবন্তিকা একজন কন্যা সন্তানের মা, তাঁর সন্তানের অটিজম আছে। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী এই ধরনের সন্তান যাদের থাকে সেই বাবা-মায়েদের প্রেফারেনশিয়াল পোস্টিং বা ট্রান্সফার দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে সরকারের নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। যদিও আমাদের রাজ্যে এখনও এরকম কোন আলাদা নির্দেশিকা নেই। এখানে বলে রাখা ভালো যে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকাকে মান্যতা দিয়ে রেল বা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই একই নির্দেশিকা তাদের কর্মচারীদের জন্য প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য দপ্তরের বদলির অন্যান্য নিয়মকানুনের বা অনিয়মের মধ্যে যাচ্ছি না কিন্তু শুধুমাত্র শিশু কন্যার অটিজম আছে এই কারণেও কি অবন্তিকার ট্রানস্ফার হওয়া উচিত ছিল না তাঁর পছন্দের জায়গায়? রাজ্য সরকার কি অমানবিক কাজ করেনি তার এই আবেদন অস্বীকার করে?

 

আমরা জানি যে অটিজম বা অন্যান্য ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে এমন শিশুদের বিশেষ কিছু শিক্ষা বা থেরাপির প্রয়োজন হয়। এবং আমাদের দেশের সরকার ওয়াকিবহাল যে এই থেরাপি দেশের সব জায়গায় পাওয়া যায় না। সাধারণভাবে আমরা দেখতে পাই যে কলকাতার মত বড় শহর যেগুলো সেখানেই স্পেশাল স্কুল গড়ে উঠেছে, থেরাপি সেন্টার তৈরি হয়েছে। দুঃখের বিষয় সরকার থেকে এই ধরনের বিশেষ শিক্ষা বা থেরাপি প্রত্যন্ত এলাকায় বা ছোট শহরে পৌঁছে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। এই ধরনের সেন্টার বা স্পেশাল স্কুল বেশিরভাগ সময়ই এনজিও-রা চালায়। এনজিও-রা কিন্তু তাদের কাজকর্ম সাধারণভাবে কলকাতা বা অনান্য মহানগরীতেই আবদ্ধ রাখে। অবন্তিকা চাকরি করতেন স্বাস্থ্য দপ্তরের অধীনে এবং স্বাস্থ্য দপ্তর খুব ভালভাবেই জানত, মেদিনীপুরের যে অঞ্চলে অবন্তিকাকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল সেখানে তার মেয়ের উপযুক্ত কোনরকম থেরাপি সেন্টার বা স্পেশাল স্কুল নেই। আসলে প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়াশোনা বা রিহ্যাবিলিটেশন-এর দায়িত্ব যে সরকারের সেটা বোধহয় আমরা ভুলে যেতে বসেছি। এত বেশি এনজিও-রা এই ধরনের কাজ করে যে সরকারের তাতে একটু সুবিধা হয়। সরকার খাতায়-কলমে দেখায় যে এই কাজগুলিতে তাদেরও অবদান আছে। হয়তো সামান্য কিছু গ্রান্ট ইন এইড-এর টাকা সারা বছরে দিয়েছে কিন্তু সেটাও তারা খাতায়-কলমে দেখায় সরকারি কাজ হিসাবে। এমনকি রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছেও যখন ভারত সরকার প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে কোন রিপোর্ট পাঠায় তারা লেখে আমাদের দেশে কতগুলি প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল রয়েছে; সেখানে যে তাদের অবদান খুবই কম সে কথা তারা কিন্তু উল্লেখ করে না। আমাদের সরকারি ব্যবস্থা কোথাও একটা প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে মিথ্যাচারের জগতেই বাস করে বলে মনে হয়।

 

থেরাপি বা স্পেশাল স্কুলের অপ্রতুলতা ছাড়াও কিন্তু একজন মা যার সন্তানের অটিজম আছে তার ওপর নানা রকম মানসিক চাপ থাকে। সেই বিষয়ে এবার একটু কথা বলি। অবন্তিকার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই লিখেছেন তিনি হেরে গেলেন। কেন তিনি তাঁর সন্তানের কথা ভেবে থেকে গেলেন না? আসলে যখনই কোনও মানুষ আত্মহত্যা করেন তার আশেপাশের মানুষেরা বিচারকের ভূমিকায় বসে যান। যারা বেঁচে আছেন কষ্ট করে তারা মনে করেন জাজমেন্টাল হওয়ার অধিকার তার আছে। একজন প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মকে এখনও আমাদের দেশে একটি পরিবারের ওপর অভিশাপ হিসেবে দেখা হয়। এবং অবশ্যই আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করে তার মায়ের উপর। অবন্তিকার মানসিক স্বাস্থ্য কিরকম ছিল, তিনি আত্মহত্যার পথে কেন যেতে বাধ্য হলেন এই প্রশ্নগুলো কিন্তু আমরা খুব কম পেলাম। আশ্চর্য লাগে যখন আমরা দেখি অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিশুর মা ফেসবুকে লিখছেন “আমি তো সব শখ আহ্লাদ ছেড়ে দিয়েছি, অবন্তিকা কেন তার চাকরি ছাড়তে পারল না?” এই যে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা যে, তার শিশুর যখন অটিজম আছে তখন একজন মহিলার চাকরি বা অন্য কোন কাজেরই দরকার কী? তিনি শুধুমাত্র এই শিশুর মায়ের পরিচয় বেঁচে থাকুন – এটাই সমাজে মান্যতা পায়। কোনও শখ-আহ্লাদ চাকরির তাদের দরকার নেই, অবশ্যই চাকরি তিনি করতে পারেন যদি তার পরিবারের রোজগারের খুব দরকার হয় বা শিশুটির ভালোর জন্য যদি দরকার হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অবন্তিকার পারিবারিক আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল না। আমরা কিন্তু একটা পোস্ট দেখিনি যেখানে কেউ বলছেন যে শিশুটির বাবা কেন চাকরি ছেড়ে দেননি। অর্থাৎ মা হিসাবে এই মহিলার উপরেই সব দায়িত্ব।

 

অবন্তিকা একা নন। সাধারণ ভাবে যদি আমাদের দেশের প্রতিবন্ধকতা আছে এমন শিশুদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলি, দেখা যায় যে অনেক ক্ষেত্রেই, যে মা প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তার ওপর শারীরিক ও মানসিক দুরকম অত্যাচারই হয়, করেন পরিবারের অন্যান্যরা। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে মা চাকরি বা বাকি শখ আহ্লাদ ছেড়ে দিয়েছেন। এমনকি আমাদের দেশের অনেকগুলি বিশেষ স্কুল (স্পেশাল স্কুল) চালু করেছেন প্রতিবন্ধী শিশুদের মায়েরা। তার কারণ সরকার দায়িত্ব নেয়নি। যদি সরকার থেকে এই শিশুদের আলাদা করে স্পেশাল স্কুল এর ব্যবস্থা করতো তাহলে কি এতগুলি স্পেশাল স্কুল চালু করার দায়িত্ব মায়েরা নিতেন? এক্ষেত্রে আমরা খুব কম বাবাকে দেখি যারা নিজ দায়িত্বে এই ধরনের স্কুল চালাচ্ছেন বা প্রশাসনিক স্তরে জানাচ্ছেন। একেবারে নেই তা বলব না কিন্তু সংখ্যাটা খুব কম।

 

বিদেশে কয়েকটি জায়গায় আমরা শুনেছি যে বাড়িতে প্রতিবন্ধী শিশু থাকলে মায়েদের জন্য সুবিধাজনক সময় বা ফ্লেক্সিবেল টাইম বা বিশেষ কিছু চাকরির/গবেষণার ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া হয়। আমাদের দেশের সরকার সেরকম কিছু অবশ্যই এখনো ভেবে উঠতে পারেনি। আমাদের যে গার্হস্থ্য হিংসা আইন আছে সেখানে বলা আছে যে পুত্র সন্তান জন্ম না দিলে কোনো মহিলাকে যদি কোন কথা শোনানো হয় সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রতিবন্ধী আন্দোলন ও নারী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে আমরা মনে করি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম দিলেও একজন মাকে যে গঞ্জনা সহ্য করতে হয় সেটাকেও গার্হস্থ্য হিংসা বলে গণ্য করা উচিত। প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আমরা অনেক সময়ই প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলি কিন্তু তার আশেপাশে যারা থাকেন তাদের ওপর যে মানসিক, শারীরিক চাপ সৃষ্টি হয় সেই নিয়ে কথাটা হয়তো একটু কমই বলি। ডাঃ অবন্তিকা ভট্টাচার্যর মৃত্যু আমাদের আরেকবার মনে করাল একটি শিশুকে বড় করার দায়িত্ব শুধু মায়ের নয়, শুধু বাবা-মায়েদেরও নয়; পারিপার্শ্বিক সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব থাকে। অবন্তিকা চলে গেলেন। রাষ্ট্র তার ভূমিকা পালনে অপারগ ছিলে বলে। আজকে আমরা যারা আত্মহত্যা নিয়ে সচেতনতার কথা বলছি, আসুন কথা বলি সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যা মানুষকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য করে।

 

(শম্পা সেনগুপ্ত প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের কর্মী ও ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অফ দ্য ডিসএবেলড-এর যুগ্ম সম্পাদক। ) 

 

পড়ুন: প্রতিবন্ধী শিশুকন্যাকে হত্যা করলেন মা – আঙুল উঠুক সরকার, সমাজ, আন্দোলনের দিকে

 

Share this
Recent Comments
2
  • comments
    By: Tarun Dasgupta on September 10, 2021

    শম্পা দি এইরকম বলিষ্ঠ লেখা আরো চাই।সমাজ কে সচেতন করতে আমৃত্যু লড়াই করতে হবে।

  • comments
    By: Asim Bhattacharjee on November 30, 2021

    Not only a faministic problem. It’s a socio political general issue.

Leave a Comment