মানবাধিকার দিবসের দিন সাংবাদিক রূপেশ কুমার সিং-সহ ছ’জন রাজনৈতিক বন্দীর জেলের অব্যবস্থা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতীকী অনশন।
সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন
১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস। এই দিনেই বিহারের পাটনায় আদর্শ কেন্দ্রীয় কারা, বেউর-এ ছয় দফা দাবি নিয়ে হাই সিকিউরিটি সেল-এর ছ’জন রাজনৈতিক বন্দী এক দিনের প্রতীকী অনশনের ডাক দিয়েছিলেন। এই ছয় বন্দীর মধ্যে একজন সাংবাদিক রূপেশ কুমার সিং, ৭৩ বছর বয়সী প্রমোদ মিশ্র, সুধীর ভগত, অভ্যাস ভুঁইঞা, অনিল যাদব ও রাজেশ গুপ্তা। এই বিষয়ে গত ৮ ডিসেম্বর জেল প্রশাসনের কাছে বন্দীরা লিখিতভাবে আবেদন পত্র জমা করেন। যদিও জেল প্রশাসনের তরফ থেকে তাঁদের আলাদাভাবে কিছুই জানানো হয়নি।
নির্ধারিত ভিডিও কনফারেন্স-এ কথাবার্তা বলার সময়ে গত ৯ ডিসেম্বর হাই সিকিউরিটি সেল-এ বন্দী সাংবাদিক রূপেশ কুমার সিং ছয় দফা দাবিগুলি জানানোর আগে জেলের প্রাথমিক অব্যবস্থা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিষয়গুলি সামনে নিয়ে আসেন। যেমন ঘুলঘুলি না থাকার কারণে কুঠুরিতে হাওয়া চলাচল হচ্ছে না। যারজন্য কুঠুরির ভেতরেই থাকা ল্যাট্রিন-এর দুর্গন্ধ ও অন্যান্য গ্যাস-ও বাইরে বেরোতে পারছে না। ফলে বন্দীদের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। এই কুঠুরিগুলিতে কোনোও জানালা থাকে না, সামনে থাকে কেবল লোহার বড় দরজা। জেলে বন্দী রয়েছেন আনুমানিক ৫০০০ জন, অথচ তাঁদের কথা বলার জন্য রয়েছে মাত্র তিনটি এসটিডি বুথ, যার মধ্যে একটি খারাপ। এছাড়া ১০০ জন বন্দীর জন্য রয়েছে একটি করে নল। যে কারণে অনেক বন্দীই ল্যাট্রিন-এর বসার জায়গাতে (সিট) বসেই সেখানে লাগানো নল দিয়েই স্নান করতে বাধ্য হন।
এই বিষয়গুলিকে সামনে আনতেই যে ছ’দফা দাবি নিয়ে ১০ তারিখ তাঁরা অনশন করেন সেগুলি হলঃ-
১) বন্দীদের জেল ম্যানুয়েল-এ যেমন ডায়েট প্রস্তাবিত রয়েছে, সেই অনুযায়ী জলখাবার ও অন্যান্য খাবার দেওয়া হোক, খাবারের পরিমাণ যেন কমানো না হয় এবং তেল, সাবান সহ দাঁত পরিস্কারের জন্য দাঁতন বা টুথপেস্ট দেওয়া হোক।
২) বন্দীদের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা জেল হাসপাতালে করা হোক। সেখানে যদি চিকিৎসা না করার মতো পরিস্থিতি হয়, তাহলে যথাশীঘ্র জেলের বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক, দেরি যেন না করা হয়।
৩) গোলঘর ২ (হাই সিকিউরিটি সেল)-এ সমস্ত ডিগ্রি অর্থাৎ কামরায় স্নানের জন্য আলাদা কলের ব্যবস্থা করা হোক।
৪) বন্দীদের নিজেদের পরিবার-পরিজন, উকিল ও অন্য জেলে বন্দী মামলার সঙ্গীদের সঙ্গে চিঠিপ্ত্র আদান-প্রদানের সুবিধা প্রশাসনের খরচে করার ব্যবস্থা করা হোক।
৫) নিজেদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত বন্দীদের প্রশাসনিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর করা যেন না হয়।
৬) জেলে এসটিডি-র যথেষ্ঠ ব্যবস্থা নেই, সেইজন্য এসটিডি বুথের সংখ্যা বাড়ানো হোক এবং প্রতিদিন এসটিডি বুথে ১০ মিনিট কথা বলার ব্যবস্থা করা হোক।
মানবাধিকার দিবসের দিন অনশনের আগে সাংবাদিক রূপেশ কুমার সিং গত ৬ ডিসেম্বর গণমাধ্যম ও মানবাধিকার আন্দোলন কর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি বার্তা নির্ধারিত এসটিডি কল-এর সময়ে দূরাভাষে পড়ে শোনান। সেখানে তিনি বলেনঃ-
“সাথী,
আগামী ১০ ডিসেম্বর সারা পৃথিবীতে এমন সময়ে মানবাধিকার দিবস পালন করা হবে, যখন সারা পৃথিবীতে মানবাধিকারের উপর হামলা চারদিক থেকে বেড়ে গেছে। ফিলিস্তিনে রোজ আমেরিকার সাহায্যে ইজরায়েল দ্বারা মানবাধিকার ছিন্নভিন্ন করা হচ্ছে, ইউক্রেনেও রাশিয়ার দ্বারা একই জিনিস করা হচ্ছে। আমরা বলতে পারি যে, আজ পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে মানবাধিকারের হত্যা হচ্ছে না। এবং মানবাধিকারের হত্যার বিরূদ্ধে সংঘর্ষ চলছে না এমন দেশও নেই।
আমাদের দেশ ভারতে প্রতিদিন মানবাধিকার হত্যার হাজার হাজার ঘটনা ঘটছে। এবং মানবাধিকারের পক্ষে আওয়াজ তুলছেন যাঁরা তাঁদের জেলে পোরা হচ্ছে বা সাজানো সংঘর্ষে মেরে ফেলা হচ্ছে যাতে আর কেউ মানবাধিকারের পক্ষে আওয়াজ তোলার সাহস না দেখান।
যেমন আপনারা জানেন, ১৭ জুলাই ২০২২ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে আমি ১৮ জুলাই ২০২২ থেকেই জেলে আছি। সেইজন্য নিজের দীর্ঘ জেল জীবনের উপর ভিত্তি করে আমি বলতে পারি যে, আজ সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার হত্যার ঘটনা জেলে ঘটছে। আমি বিহার ঝাড়খণ্ডের ছ’টি জেলে এখনো পর্যন্ত থেকেছি, যেখানে আমি দেখেছি না তো বন্দীদের জেল ম্যানুয়াল অনুযায়ী খাবার দেওয়া হয়, না অন্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। জেলের ভেতরে খারাপ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে অনেক বন্দীর অকালমৃত্যু হয়, আবার অনেকে প্রতিবন্ধী হয়ে যান। জেলের যা ক্ষমতা তারচেয়ে দ্বিগুণ বন্দী রাখার কারণে থাকা, শোয়া-বসা, শৌচকর্ম, স্নান ইত্যাদিতে খুবই সমস্যায় পড়তে হয়। জেলে বন্দীদের উপর লাঠি দিয়ে প্রহার, জেল আধিকারিকদের বন্দীদের সঙ্গে তুই-তোকারি করে কথা বলা, বন্দীদের গালাগালি দেওয়া তো জেল আধিকারিকেরা নিজেদের জন্মগত অধিকার বলে মনে করেন। দুর্নীতি ও ঘুষ খাওয়া তো জেল প্রশাসনের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে জেলের এই নারকীয় পরিস্থিতির বিরূদ্ধে যদি কোনোও বন্দী আওয়াজ তোলেন তাহলে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তাঁকে অন্য জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। যেখানে পৌঁছানো মাত্রই জেল গেটেই তাঁর উপরে অসংখ্য লাঠির বাড়ি নেমে আসে।
সেইজন্য একজন বন্দী হওয়ার কারণে আগামী ১০ ডিসেম্বর পালন করছেন যে সাথীরা তাঁদের কাছে আপিল করছি যে আপনারা আপনাদের কার্যক্রমে আমাদের জেল বন্দীদের জন্যও আওয়াজ তুলুন।
রূপেশ কুমার সিং (সাংবাদিক)
বিচারাধীন বন্দী, হাই সিকিউরিটি সেল
আদর্শ সেন্ট্রাল জেল বেউর, পাটনা।
রাজনৈতিক বন্দীদের অধিকার নিয়ে পৃথক আন্দোলন চললেও, তা নিয়ে এখনও বৃহত্তর পরিসরে সে অর্থে আলোচনার অভাব রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলে বন্দী রাজনৈতিক বন্দীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে এবং কারাবাসকালীন সময়ে তাঁদের মৌলিক বন্দীদের প্রাপ্য অধিকারগুলি নিয়ে যে ধরনের আন্দোলন ও আলোচনা রাজনৈতিকভাবে হওয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে সময়ে, সময়ে কথাবার্তা ও জাতীয় স্তরে মঞ্চ তৈরি করে আলোচনা চললেও, ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংলাপ আদান-প্রদানের অভাব রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নির্দিষ্টভাবে মানবাধিকার দিবসের দিন রাজনৈতিক বন্দীদের এই প্রতীকী অনশন যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।


