বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরা – দাবি পরিচিতির নিরাপত্তার


  • September 22, 2025
  • (0 Comments)
  • 1118 Views

জীবন-জীবিকা নিয়ে একদিকে চরম অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে নিজেদের ভাষা ও জাতিসত্তা নিয়ে পরিচিতির উপর নেমে আসা প্রাণঘাতী আক্রমণ ও বাংলাদেশে পুশ ব্যাক-এর আতঙ্কে অনেকেই স্পষ্টত দিশাহারা।

 

সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট

 

উৎসবের মরশুম শুরু হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরছেন প্রবাসে কাজেকর্মে, পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকা মানুষজন। কিন্তু সব ফেরা এক হয় না। যেমন হয় না, হচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরা। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে চলতি বছর এখনও পর্যন্ত স্রেফ বাংলাভাষী হওয়ার কারণে এবং সেইসঙ্গে যদি জুড়ে যায় বাংলাভাষী মুসলমান পরিচয়ের তকমা, তাহলে আরও বেশি করে তাঁদের উপর নেমে এসেছে আক্রমণ। হিন্দি বলয় শুধু নয়, এমনকি দক্ষিণ ভার‍তের বিভিন্ন রাজ্যেও পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকেরা লাগাতার হেনস্থা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, গণপিটুনিতে হত্যা ও সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বৈধ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশি সন্দেহে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করার মতো অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছেন, বৈধ আধার-ভোটার-প্যান কার্ড, জমির দলিল সব থাকা স্বত্ত্বেও লম্বা সময় ভেরিফিকেশন ক্যাম্পে খাবার, জল না দিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রেখে দেওয়া হয়েছে। ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, দিল্লিতে তাঁরা চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। পরিযায়ী শ্রমিকেরা ও তাঁদের পরিবার-পরিজন দিন কাটাচ্ছেন নিদারুণ আতঙ্ক ও মানসিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে।

 

সম্প্রতি কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর পক্ষ থেকে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে এক জমায়েত ও রাজভবন পর্যন্ত মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে ছিল বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্মলিত স্মারকনামাও।

 

এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধা ও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তৈরি করেছে ওয়েলফেয়ার বোর্ড, পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেওয়া ও দেশের যেকোনও রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা বিপদে পরলে তাঁদের সাহায্য করার কাজ করছে, রয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের সিটু সমর্থিত ইউনিয়ন, পরিযায়ী শ্রমিকেরা যাতে নিজের রাজ্যে কাজে ফিরতে পারেন, সেইজন্য রাজ্য সরকার শ্রমশ্রী নামের ভাতা চালু করেছে, যেখানে তাঁরা রাজ্যে ফিরে আসলে তাঁদের এককালীন মাসিক ৫০০০ টাকা ও নতুন কাজ না পাওয়া পর্যন্ত এক বছর এই টাকা দেওয়া হবে, এরজন্য শ্রমশ্রী পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করতে হবে।

 

তবে এই সমস্ত প্রকল্প, সুযোগ-সুবিধা এই বিষয়গুলি নিয়ে যথেষ্ঠ তথ্যের অভাব রয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যেই, অনেকেই এগুলিকে সরকারের আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রচার কৌশল বলে মনে করছেন, বিরোধীদের প্রতিও যথেষ্ঠ আস্থা নেই কারওরই। নিজের রাজ্যে কাজ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের উপরেই ভরসা রাখছেন তাঁরা।

   

কোচবিহার জেলার বাঙালি শ্রমিকেরা গিয়েছিলেন দিল্লিতে, তাঁদেরই একজন আজিজুল মিঞা, বললেন, “দিল্লিতে ওরা বাঙালিদের দেখতে পারে না। আমরা তো ভাবছিলাম, ওখান থেকে আর ফিরতেই পারব না। অনেক কষ্টে ফিরেছি। এখন বাংলায় কাজ পেতে হবে। আমরা তো ছোটবেলা থেকে কাজ করে খাচ্ছি, জমি-জায়গা তো কিছুই নেই আমাদের।”

 

জীবন-জীবিকা নিয়ে একদিকে এই চরম অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে নিজেদের ভাষা ও জাতিসত্তা নিয়ে পরিচিতির উপর নেমে আসা প্রাণঘাতী আক্রমণ ও বাংলাদেশে পুশ ব্যাক-এর আতঙ্কে অনেকেই স্পষ্টত দিশাহারা।

 

মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছিলেন নুকু শেখ, শফিক শেখ-রা। চেন্নাই, ঝাড়খন্ড, বোকারো ইত্যাদি জায়গায় রাজমিস্ত্রি, জোগাড়ে ইত্যাদি নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা। ২৬/২৭ বছর, ৩২ বছর, ১০/১২ বছর – পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, “মোদী সরকার আসার পর থেকেই বাঙালিদের উপর এই অত্যাচার শুরু হয়েছে। এখন তো আমাদের উপর হচ্ছে, সেগুলো জানতে পারা যাচ্ছে। তারও আগে থেকেই যে বাঙালি পরিযায়ীরা ফেরিওলার কাজ করত, তাদের মারধোর, অপমানের প্রচুর ঘটনা ঘটত আমরা জানি।” খুব ভালোভাবেই জানেন, কাজে না গেলে জীবন চালানো মুশকিল হয়ে যাবে। তাই ভয় করলেও কাজে ফিরতে হবে। সেইজন্যই রাজ্য সরকারের কাছে তাঁদের দাবি এমন কিছু নথিপত্রের যা তাঁদের পরিচিতি সুনিশ্চিত ও সুরক্ষিত করে, “যতদিন পারব ততদিন বাইরে কাজ করে খেতে হবে, জমি-জায়গা তো নেই।” তাঁদের আয় দৈনিক ৬০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে থাকে। রোজ কাজ থাকে না। তাছাড়া নিজেদের থাকা-খাওয়ার খরচও সামলাতে হয়। মাসে ১৫০০০ থেকে ১৮০০০ টাকা রোজগার করতে পারেন কাজ বিশেষে।

 

এই পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকের ছেলেরাও ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবেই কাজ করছেন। বাবা হিসাবে দুশ্চিন্তায় থাকেন তাঁদের নিয়েও। ঠিক যেমন চিন্তায় থাকেন লালমুন বিবি, রাবিনা বিবি। তাঁদের দু’জনের স্বামীই বিহারে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অত্যাচারের খবরে যারপরনাই আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটছে তাঁদের। কী চান তাঁরা স্বামীরা ফিরে আসুন না কি বাইরেই কাজ করতে যেতে থাকুন? এই প্রশ্নের উত্তরে পরিষ্কার জানালেন, “এখানে আসলে খাবে কি? ভয় তো করেই। উপায় কী!” বাড়িতে সন্তানদের মধ্যে পুত্র সন্তানেরা রয়েছে, কাজের বয়স হলে, তাদেরও বাবাদের মতোই পরিযায়ী হতে হবে এমনটাই ধরে নিয়েছেন। একটাই দাবি তাঁদের ভিন রাজ্যে স্বামীদের নিরাপত্তার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেন একটা পরিচয়ের ‘কার্ড’ করে দেন।

   

জমায়েতে উপস্থিত পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে থেকে উঠে আসে এমন বক্তব্য যে, আগেও তাঁরা বাইরের রাজ্যে কাজে যেতেন, কাজ করতেন, কাজের জায়গায় নিজের মতো থাকতে পারতেন, কিন্তু কখনোই বাঙালি বলে হেনস্থা বা আক্রান্ত হতে হয়নি। কথা হচ্ছিল কোচবিহারের পরিযায়ী শ্রমিক শঙ্করের সঙ্গে। রাজমিস্ত্রির কাজ করে দৈনিক ৮০০ টাকা ও ওভারটাইম করলে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা আয়ের হিসাবে মাসে ২২০০০-২৩০০০ টাকা রোজগার করেন। “আগে কোনো অসুবিধা হত না। কিন্তু এখন যেন বাংলা ভাষা বললেই একটা আক্রমণ চলে আসছে,” বলছিলেন উপস্থিত এক শ্রমিক। ঠিক কাদের উসকানিতে ঘটছে এই ধরনের ঘটনা বলে মনে করছেন তাঁরা? “এইটা আমার যেটা মনে হয় মূলত রাজনীতির বিষয় যদি বলা যায়। যারা রাজনীতি করেন এটা তাদের বিষয় বলেই মনে হচ্ছে, আমার ধারণা,” বললেন কোচবিহারের পরিযায়ী শ্রমিক আজিজুল। ভেতরে ভয় কাজ করছে কি না জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন, “অটোম্যাটিক ভয়। ভয়ে অনেক জন চলে আসতাসে। কেউ যাইতে পারতেসে না। সাহস পাইতেসে না। আমি যে আবার কাজে যাব, দেখেন, আমার মধ্যেও ভয় কাজ করতাসে। কী হবে পরিস্থিতি? যদিও আমার সঙ্গে ঘটে নাই। কিন্তু আমার সঙ্গে ঘটবে না কী গ্যারান্টি আছে? এখন তো প্রায় সব জায়গায় ঘটতেসে।”

কোচবিহার থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিক

অল ইন্ডিয়া মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর পক্ষ থেকে যে দাবিগুলি তুলে ধরা হয়েছিল, তার মধ্যে ছিলঃ-

 

  • রাজ্যের সকল পরিযায়ী শ্রমিককে দ্রুততার সঙ্গে নাম নথিভুক্ত সাপেক্ষে সরকারী পরিচয়পত্র দিতে হবে

 

  • রাজ্যে ইতিমধ্যে নথিভুক্ত সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে ও প্রত্যেক ব্লক অফিসে ব্লকভিত্তিক পরিযায়ী শ্রমিকদের নামের তালিকা টাঙিয়ে রাখতে হবে এবং তাদের সবাইকে পরিচয় পত্র দিতে হবে

 

  • পরিযায়ী শ্রমিকদের আপডেট রেকর্ড ও লগবুক সিস্টেম সুনিশ্চিত করতে হবে

 

  • বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোজগারহীন সকল পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্ম সংস্থান ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে

 

  • কোনো মতেই এ রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের স্থায়ী ঠিকানার ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া যাবে না।

 

বীরভূম জেলা থেকে এসেছিলেন আসিবুল ইসলাম। তিনি খুবই অল্প বয়স থেকে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করার পর এখন আর পরিযায়ী হিসাবে কাজ করেন না। বর্তমানে পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার দাবিতে লড়াইয়ে অ্যাসোসিয়েশন-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাংলাদেশী তকমা লাগিয়ে তাকে মারধোর করা হচ্ছে, প্রচন্ড টর্চার করছে। বিজেপি শাষিত যে রাজ্যগুলি সেখানে তাদের উপর দারুণ অত্যাচার করা হচ্ছে। টিভি মিডিয়া, পত্রিকা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে যেভাবে খবর পাচ্ছি যে, বিজেপি সরকারকে ভোট পেতে হবে, হিন্দুদের ভোটকে গোছাতে হবে, হিন্দুরাষ্ট্র বলে একবার রাম মন্দির করল, তারপর ২০০ করে চাকরি দেব প্রতি বছর, তারপর জিরো ব্যালেন্স অ্যাকাউন্ট-এ টাকা ভরে দেব – নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ভোটব্যাঙ্ক কোরে। এটাও একটা ইস্যু – মুসলিম বাঙালি, বাঙালি হিন্দু, হিন্দিভাষী, বাংলাভাষী বলে উসকানিমূলকভাবে, রাজনৈতিকভাবে প্রেশারাইজ করে। ফলে সমাজে অভাব-অনটন আছে, চাকরি-বাকরি দরকার, শিক্ষা দরকার, হাসপাতালে চিকিৎসা দরকার। মানুষ যাতে বুঝতে না পারে কেন আমরা চিকিৎসা পাচ্ছি না, কেন আমরা চাকরি পাচ্ছি না। সেই মোড়টাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে। এ ওকে দোষারোপ করছে।”

বীরভূম জেলা থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিক

পরিযায়ী শ্রমিকেরা আতঙ্কিত অবস্থায় কোনো না কোনোভাবে এ রাজ্যে ফিরে আসছেন। কিন্তু কাজের ভবিষ্যত পশ্চিমবঙ্গেও আশাপ্রদ নয়। আসিবুল মনে করেন, “এ রাজ্যে ফিরে এসে, এ রাজ্যেও কাজ নেই। এ রাজ্যে কল-কারখানাগুলো বন্ধই হয়ে আছে। কল-কারখানাগুলো খোলার তো চেষ্টা করছেন না। এখানে তো কল-কারখানা খোলার কোনো স্কোপ-ই নেই। এখাবে কাজের ভয়ংকর সংকট।”

 

রাজ্যে রয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ওয়েলফেয়ার বোর্ড, পরিযায়ী শ্রমিকেরা ফিরলে তাঁদের শ্রমশ্রী প্রকল্পে ভাতাও দেওয়া হবে। এইসব ব্যবস্থায় তাঁরা কি খুশি? “ভাতা যদি উনি দেন,খুশি তো আমরা হবই। মুখে বলছেন। কার্যকরীভাবে কতটা কী করছেন, তা তো দেখা যাছে। আমাদের ডিম্যান্ড এই বেকার ছেলেদের কাজ দিতে হবে পার্মানেন্টলি। আর না হলে তাঁদের প্রত্যেক মাসে ৫০০০ টাকা ভাতা দিতে হবে,” বললেন তিনি। যদিও উপস্থিত সকলেরই বক্তব্য ৫০০০ টাকায় কিছুই হইয় না, প্রয়োজন রোজগারের।

 

এই অ্যাসোসিয়েশন-এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলার লেবার কমিশন-এর কাছে স্থানীয়ভাবে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে ঠিকাদারদের লেবার কমিশনারকে জানিয়ে শ্রমিকদের নিয়ে যেতে হবে এবং কোনো শ্রমিক যদি টাকা-পয়সা না পায়, হেনস্থা তার দায়-দায়িত্ব উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে, শ্রমিকদের পরিচয়পত্র দিতে হবে এবং তাঁদের সংসার যাতে স্বছলভাবে চলে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এই জমায়েতে কথা বলতে গিয়েই এই প্রতিবেদক দেখেন যে ওয়েলফেয়ার বোর্ড, যেখানে নাম নথিভুক্ত না থাকলে ভিন রাজ্যে কোনো শ্রমিকের কোনো কারণে মৃত্যু ঘটলে ক্ষতিপূরণের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা পাওয়া যায় না, এ বিষয়ে তাঁদের  অধিকাংশের কাছেই কোনো তথ্য নেই বা তাঁরা সদ্য জানছেন।

 

দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা থেকে এসেছিলেন সুজিত সরকার, সাগর মাইতি, ইলিয়াস মাজি, নীরেন্দ্রনাথ মন্ডল। আন্দামান, অন্ধ্রপ্রদেশ, চেন্নাই, কেরালা বিভিন্ন রাজ্যে ধান রোঁয়া থেকে মিস্ত্রির কাজ সব ধরনের অসংগঠিত পেশার সঙ্গেই যুক্ত তাঁরা। কাজ করছেন ১৫ থেকে ২৫ বছর। বরিষ্ঠ শ্রমিক নীরেন্দ্রনাথ মন্ডল বললেন, “বিজেপি ওঠার পর এই পরিস্থিতি হইসে। আগে এমন ছিল না।“ এমনটা মনে হওয়ার কারণ কী? “আমরা তো বাইরে থেকে কাজ করি। বিজেপি সরকার আসার পর থেকে মারধোর, খুন, দাঙ্গা হচ্ছে দেশ জুড়ে,” বিনা দ্বিধায় বললেন তিনি। 

 

ইলিয়াস মাজি যেমন মনে করেন, “এই যে সামনে ইলেকশন ২০২৬-এ। সরকারে তাই কথা উঠেছে যেহেতু মুসলিম ভোট বেশি আছে, তাই বিজেপি সরকার এই বাংলাদেশী ইস্যু নিয়ে ভোট-টাকে বিভক্ত করতে চাইছে।” তাঁরা মনে করেন আগামী ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে বিজেপি বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর বাংলাদেশী ইস্যুটিকে নিয়েই আক্রমণ চালাচ্ছে বেশি। সাগর মাইতি যেমন বললেন, “পরিযায়ী শ্রমিকেরা প্রতারণার শিকার বহুদিন ধরেই হচ্ছি, কিন্তু এইভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, এই যে বাঙালি দেখে দেখে আক্রমণ এটা ভোটের লক্ষ্য করেই আরম্ভ করেছে। সবটা বাংলাকে লক্ষ্য করেই। বিজেপি এই বাংলাকে বহুদিন ধরে টার্গেট করেছে।”

 

এ রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি-র বিরূদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেওয়ার পরে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের ভূমিকাতেও বীতশ্রদ্ধ তাঁরা। “রাজ্য সরকার কিছু করবে না তো। সবটাই সেটিং-এর উপর নির্ভর করে। আমরা এখানে আলাদা করে কাওকে দেখতে পাচ্ছি না,” বললেন সাগর।

 

শ্রমশ্রী প্রকল্পে ঘোষণা করা ৫০০০ টাকা প্রসঙ্গে সুজিত সরকার বললেন, “এগুলো কী! এতে কী হয়? ৫০০০ টাকায় কিছু হয়? আমরা তার চাইতে তো বাইরে গেলে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারি। আমাদের অপমান করছেন এটা দিয়ে। ছেলেখেলা মনে করছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের উনি পুতুল মনে করেছেন।”

 

সাগর মাইতি বলছিলেন, “রাজ্য সরকারের যে বিভিন্ন দপ্তর রয়েছে, সেখানে আমাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে যেতে পায়ের চামড়া খুলে যায়। আমরা অতি সাধারণ মানুষ। আমাদের জন্য এত প্রকল্প, ভাতা যেঁ করছেন, কিচ্ছু করতে হবে না। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, সাইকেল দেওয়া কত কী! আমাদের ন্যূনতম একটা চাকরি দিন, তাহলে সবুজ সাথী, স্বাস্থ্য সাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সব হয়ে যাবে। পাঁচ জনের পরিবারে তিন জনের কাজ থাকলেই যথেষ্ঠ। এখন তো এমন অবস্থা বাইরে গেলে মার খেয়ে মরতে হবে বাঙালি বলে আর নিজের রাজ্যে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।”

 

রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল তথা কেন্দ্র সরকার কারোর উপরেই আস্থা নেই আক্রান্ত, আতঙ্কিত পরিযায়ী শ্রমিকদের। মনে করছেন, তাঁদের নিজেদের সংগঠিত হতে হবে। এই মুহূর্তে নির্বাচনী ভাবনা মাথায় রেখে রাজনৈতিক রং দিতে চান না নিজেদের এই সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে। তাঁদের দাবি শুধু পরিযায়ী শ্রমিকেরা নন, যাঁরা এই আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক শোষনের শিকার সেই মধ্যবিত্ত ও পরিযায়ী শ্রমিকদের একজোট হতে হবে। সাগর, সুজিত, ইলিয়াস, নীরেন্দ্রনাথ – সকলেই মিলিতভাবে জানালেন,”রাজনৈতিক দল মানেই তো পুঁজিপতিদের কথায় চলে। বিজেপি বলো, টিএমসি বলো সব তো মালিকের টাকা খেয়েই আমাদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। তাই আমাদের মানুষের লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে।”  

              

Share this
Leave a Comment