স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের মিছিল কলকাতার রাজপথে


  • September 13, 2025
  • (0 Comments)
  • 1272 Views

নানান জেলা থেকে প্রায় ২০০০ অস্থায়ী কর্মী এদিনের মিছিল ও জমায়েতে যোগদান করেন। মিছিলের মাঝপথে তুমুল বৃষ্টিতেও মিছিল আটকায়নি। স্থায়ীকরণের দাবিতে মুষল্ধারায় বৃষ্টি মাথায় নিয়েই কলকাতার রাজপথ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।

 

সুদর্শনা চক্রবর্তীর রির্পোট 

 

ব্যাঙ্কের শাখায় উপভোক্তা ও কাউন্টার-এর কর্মীর মধ্যে বাদানুবাদ প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছায়। রক্ষী এসে উপভোক্তাকে ব্যাঙ্ক থেকে বের কোরে দিতে বাধ্য হন। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ যখন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে বসেন, তখন প্রথমেই জানতে যান চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা কে কোথায় ছিলেন, দেখা যায় তাঁরা কেউই সেই কাউন্টারের কাছাকাছি ছিলেন না। “আসলে দেখতে চাইছিল যদি আমরা কেউ কাছাকাছি থাকতাম, আমাদের কারোর উপর দোষটা চাপিয়ে দিত। এমনই অবস্থা কোরে রাখে আমাদের,” জানালেন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার এক চুক্তিভিত্তিক কর্মী।

 

আরেক অস্থায়ী কর্মী জানালেন, “শুধু নিয়মের বাইরে গিয়ে আমাদের দিয়ে ব্যাঙ্কের নানা কাজ করানো নয়, এমনকি ব্যাঙ্কের অফিসার-রা আমাদের দিয়ে বাড়ির বাজার করার কাজও করান, আমরা ক্রীতদাসের মতো থাকি।”

 

“আমরা হাউজকিপিং-এর কাজে যোগ দিয়েছি। খাতা-পেন, চাবিতে হাত দেওয়ারই কথা নয় আমাদের। অথচ আমাদের দিয়ে সব কাজ করানো হয়। এর দায়িত্ব কে নেবে? এমনকি অনেক সময় চাবিও আমাদের কাছে দিয়ে রাখে, রাত্রে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। এটা কি নিয়ম?” প্রশ্ন অপর এক অস্থায়ী কর্মীর।

 

সারা পশ্চিমবঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের সংগঠন এসবি আই কনট্র্যাক্টচুয়াল ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেঙ্গল সার্কেল) ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁদের দাবি-দাওয়া নিয়ে এক মিছিল ও জমায়েত সংঘটিত করে। কলকাতার কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল করে যাওয়া হয় ধর্মতলার রাণী রাসমণি রোডে। কলকাতা, হুগলি, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম বর্ধমান, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা সহ নানান জেলা থেকে প্রায় ২০০০ অস্থায়ী কর্মী এদিনের মিছিল ও জমায়েতে যোগদান করেন। মিছিলের মাঝপথে তুমুল বৃষ্টিতেও মিছিল আটকায়নি। স্থায়ীকরণের দাবিতে মুষল্ধারায় বৃষ্টি মাথায় নিয়েই কলকাতার রাজপথ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।

 

হাউসকিপিং পদে নিযুক্ত হওয়ার পর, এই চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের দিয়ে ব্যাঙ্কের স্থায়ী কর্মীদের যাবতীয় কাজ করানো হয়। সারা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সমস্ত এসবিআই শাখায় মেসেঞ্জারদের কাজ থেকে শুরু করে উপভোক্তাদের পরিষেবা দেওয়া, এমনকি লকার, ক্যাশ, ভল্ট খোলা-বন্ধ, লকার ফর্ম ফিল আপ করা, লকার খাতা মেইন্টেইন করা ইত্যাদির দায়িত্বও নিতে হয় তাঁদের। এই কাজগুলি করার ক্ষেত্রে যেমন তাঁদের অনেকখানি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়, কারণ কোনো রকম সমস্যা হলে তাঁদেরই দায়ি করার ঝুঁকিও থাকে, তেমনি যদি তাঁরা এই কাজগুলি করতে রাজি না হন বা আপত্তি জানান তাহলে তাঁদের ভয় দেখানো হয় যে, কাজ থেকে বের করে দেওয়া হবে অথবা অনেক দূরে বদলি করিয়ে দেওয়া হবে।

 

এদিনের মিছিলে যে দাবিগুলি ব্যানার ও পোস্টারে লেখা ছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম কাজে সম বেতন এবং এই দাবি তাঁরা তুলেছেন লিঙ্গ নির্বিশেষে। প্রতিবাদ মিছিলে শামিল কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ও মহিলাদের উপস্থিতির হার থেকে জানা গেল এই চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের মধ্যে একটা বড় অংশ রয়েছেন মহিলারা। তাঁদের দাবি-দাওয়াকে যেমন আলাদাভাবে সামনে আনা হচ্ছে, তেমনি সামগ্রিকভাবে যেহেতু নারীর অধিকারের বিষয়টি যেকোনো আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত সেহেতু তাঁদের আন্দোলনেও এই বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে।

 

রুমা লাহিড়ি, মিতা চ্যাটার্জির মতো কর্মীরা এক দশকেরও বেশি সময় এসবিআই-তে কাজ করার পরেও নিজেদের দাবি আদায় করতে পারেননি, ফলে এই ইউনিয়ন ও আন্দোলনের উপর আস্থা রাখছেন তাঁরা। একজন অস্থায়ী কর্মী অনুসূয়া রায় বললেন, “আমরা সব কাজ করব, মাইনে পাব না! ম্যানেজমেন্টকে বললে, তারা বলবে এগুলো পার্মানেন্ট-এর ব্যাপার, দিল্লি থেকে হবে। ওই সময় ম্যানেজমেন্ট হাত তুলে দিচ্ছে আর কাজের সময় আমরা! আমাদের বোনাস বন্ধ হয়ে গেছে, মাইনে বাড়া নিয়ে কোনো হেলদোল নেই। যদিও নাকি সার্কুলার এসেছে কন্ট্র্যাক্টচুয়ালদের বোনাস দিতেই হবে। সেসব নিয়ে কোনো হেলদোল নেই। ম্যানেজমেন্ট একেক বছর টেন্ডার দিয়ে একেকটা কোম্পানিকে ঢোকাচ্ছে, তাদের দিয়েই রাজত্ব চালাচ্ছে। আমাদের কোনো ছুটি নেই। ছুটি নিলে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সমানে ফোন করে, ছবি তুলে দেখাতে হয় কেন ছুটি নিচ্ছি। আমাদের খেটে মরতে হবে। তাই আমাদের দাবি আমাদের সবাইকে পার্মানেন্ট করো আর তিনটে জোন তুলে দিয়ে, সবাইকে একটা ক্যাটেগরিতে নিয়ে এসে একই মাইনে দিতে হবে।”

 

দেশের শ্রম আইনকে লঙ্ঘন করে চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের বেতনও এমনকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে সব কন্ট্র্যাক্টচুয়াল কর্মীরা একই বেতন পেতেন। হঠাতই ২০১৭ সালে এ, বি ও সি তিনটি জোন বা ক্যাটেগরিতে এই কর্মীদের ভাগ করে দেওয়া হয়। এ – শহর, বি – আধা শহর, সি – গ্রামীণ বাংলা। শহরকেন্দ্রীক শাখার কর্মীদের বেতন বেশি, বাকিদের ক্রমান্বয়ে কমতে থেকেছে। এই মুহূর্তে তাই তাঁদের বেতন ১০ বা ১১ হাজার থেকে ২১ হাজারের মধ্যে থাকে, যা অবশ্যই তাঁদের কাজের পরিমাণের তুলনায় খুবই কম এবং বৈষম্যমূলক। তিনটি জোন-এর মধ্যে ২০০০, ৩০০০ থেকে ৭০০০ টাকা পর্যন্ত বেতনের পার্থক্যও থাকে। এর বিরূদ্ধেই তাঁদের প্রতিবাদ।

 

তাছাড়া যেহেতু ৫ বছর একই কোম্পানির অধীনে থাকলে চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের গ্র্যাচুইটি দিতে হয়, সেহেতু প্রতি দু’বছর অন্তর কোম্পানি বদলে চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের গ্র্যাচুইটি ফাঁকি দেওয়া হয়। যা অন্যায্য এবং অনৈতিক। দাবি তোলা হয়েছে এই প্রথা বন্ধের বিরূদ্ধেও।

 

২২ বছর ধরে কাজ করছেন হুগলি জেলার অলোক দাস। এত বছরেও দাবি-দাওয়া কেন মানছে না কর্তৃপক্ষ – প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট বললেন, “ম্যানেজমেন্ট-এর চক্রান্ত।“ ১৯৮৯ সাল থেকে ২০২৫ – দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কাজ করে চলেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার মগরাহাট শাখার স্বপনকুমার নস্কর, জানালেন, “নতুন নিয়োগও হচ্ছে হাউজকিপিং-এ এবং তাঁরাও একই রকম অনিয়মের শিকার। আর ওরা তো আমাদের গ্র্যাচুইটিটা চুরি করছে।”

 

হালিশহরের কার্তিক অধিকারী মনে করেন, চাকরি থেকে বের করে দেওয়া, বিনা কারণে কোম্পানির কাছে মিথ্যা অভিযোগ জানিয়ে চাকরি বাতিল করা, এবং সবচেয়ে বড় কথা বাড়ি থেকে অনেক দূরে বদলি কোরে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া ওভারটাইম-এর শোষন তো থাকেই। “ভাবুন একজন মহিলা কর্মীর সঙ্গেও এরকম করা হয়ে থাকে। তিনি যখন সময় পেরিয়ে কাজ থেকে বেরোন, বাড়ি ফেরার সময় সমস্যা হলে কী হবে? দূরে বদলি হলে তিনি সব কিছু সামলে কখন বাড়ি থেকে বেরোবেন, কখন ফিরবেন?” প্রশ্ন তাঁর।

 

লক্ষ্মীরাণী কুন্ডু চক্রবর্তী বললেন, “ব্রাঞ্চ ম্যানেজার আমাদের নানাভাবে অত্যাচার করে। যে কাজ আমাদের নয় প্রেশার দিয়ে সেই কাজ করতে বাধ্য করেন। একজন লেডিকে ওভারটাইম করতে বাধ্য করেন। মানা করলে বলেন, ওপর মহলে জানাও। মাইনেও তো বাড়ে না আমাদের।”

 

অস্থায়ী কর্মীদের সঙ্গেই মিছিলে হেঁটেছেন অনেক ক্যান্টিন কর্মী। যেমন পম্পা সরকার। “ ব্রাঞ্চ থেকে নিয়োগ হয়। আমাদের মাইনেও কোনো খাতায়-কলমে দেখানো নেই। ৫টা পর্যন্ত যেখানে কাজের টাইম, আমাদের ৭টা, ৮টা পর্যন্তও থাকতে হয়। টাকা বলতে একেক ব্রাঞ্চে একেক রকম। তাও ৪০০০-৫০০০ টাকাই মাত্র। আমাদের যেকোনো দিন কাজ চলে যেতে পারে।”

 

ব্রেইন স্ট্রোকে স্বামী মারা যাওয়ার পর, ছ’মাস হল কলকাতার মহাত্মা গান্ধী রোড শাখায়ে অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছেন হানিয়া বিবি। বাড়িতে দুই শিশু সন্তান। বললেন, “আমি না এখনো এত কিছূ জানি না।” কথা বলতে বলতে জানালেন, তাঁর শাখায় দু’জন অস্থায়ী কর্মী। দিন বদলে তাঁরা দু’জনে সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা ও সন্ধ্যা সাড়ে সাত’টা পর্যন্ত ডিউটি করেন, ম্যানেজার-এর অনুরোধে। তিনি কি জানেন এটা নিয়ম নয়? “জানি। কিন্তু কি করব! উনি বলেন। আমার স্বামীকেও এমনটাই করতে দেখেছি।”

 

বছর তিনেক আগে তৈরি হওয়া এসবি আই কনট্র্যাক্টচুয়াল ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেঙ্গল সার্কেল) সংগঠনে এই মুহূর্তে সদস্য সংখ্যা আনুমানিক ২৫০০। অস্থায়ী কর্মীদের যাবতীয় দাবি-দাওয়া নিয়ে তাঁদের ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে। এদিনের বিরাট মিছিল ও জমায়েতের পাশাপাশি, তাঁরা দাবি আদায়ের জন্য আইনি পথেও হাঁটছেন। কলকাতা হাইকোর্ট ও লেবার কোর্টে ইতিমধ্যেই মামলা চালাচ্ছেন তাঁরা। সেখানে কর্মীদের স্থায়ীকরণের পাশাপাশি তিন ভাগে (এ, বি ও সি) বিভক্ত কাজের জোন-কে একমাত্র এ জোন-এ নিয়ে আসার দাবিও রয়েছে। এবং অবশ্যই রয়েছে তাঁদের সঙ্গে অবিরাম হয়ে চলা শোষন ও বঞ্চনার বিরূদ্ধে প্রতিবাদ।

 

যে দাবিগুলি নিয়ে এদিন এই বিশাল সংখ্যক কর্মী পথে নেমেছিলেন তার মধ্যে ছিলঃ-

 

  • সমস্ত চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের দ্রুত স্থায়ীকরণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে

 

  • চুক্তি প্রথা অবশ্যই তুলে দিতে হবে, এবং ভবিষ্যতের সমস্ত নিয়োগ স্থায়ী ভিত্তিতে হতে হবে

 

  • চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের ওভারটাইম করতে বাধ্য করা যাবে না এবং যে কাজগুলির জন্য তাঁদের নিয়োগ করা হয়নি সেগুলি করতে তাঁদের বাধ্য করা যাবে না

 

  • ২০১৭ সালে এসবিআই যে বি ও সি জোন নিয়ে এসেছিল, তার দ্রুত বিলোপ ঘটাতে হবে এবং সমস্ত চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের এ জোন-এর ভিত্তিতে মজুরি দিতে হবে

 

  • অতি মুনাফা করার লক্ষে চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের শোষনমূলক নিয়োগ দ্রুত বন্ধ করতে হবে

 

 

Share this
Leave a Comment