পুলিসি হেফাজতে শারীরিক নির্যাতন, বাংলাদেশী বলতে চাপ – কোচবিহারের পরিযায়ী শ্রমিক মোমেন মিঁঞা আর ফিরতে চান না দিল্লী


  • August 29, 2025
  • (1 Comments)
  • 1446 Views

“যেভাবে আমার ভিডিও করছিল, আমি যদি স্বীকার করতাম আমি বাংলাদেশী, তাহলে আমাকেও উঠায়ে ফালায়ে দিত বাংলাদেশে,” শীতলকুচির ২২ বছর বয়সী পরিযায়ী শ্রমিক মোমেন মিঁঞা।

 

সুদর্শনা চক্রবর্তী 

 

“পাও দিয়ে, হাত দিয়ে, প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে মারছিল। হাতে, ঠ্যাং, পেটে ব্যথা ছিল। এখন মাথায়। ডাক্তার এখন তো ওষুধ দিয়েছে। শিলিগুড়িতে দেখাতে বলছে আরো। ব্লাডের জমাট যদি না ভাঙে তাহলে অপারেশন করতে বলছে।“

 

“ও ভিডিও চালু করছিল মোবাইল নিয়ে। আমাকে বলসে, ‘বল তুই বাংলাদেশি’। এই কথাটা আমি বলিনি দেখে আরো বেশি করে মারসে। বলছে, ‘তুমি বলো বাংলাদেশি ছেড়ে দেব’। আমি তো সোজা বলেছি – আমি বাংলাদেশি আমি কেন বলব? আমি ইন্ডিয়ান লোক, আমি বাংলাদেশি বলব, পরে, বাংলাদেশে পাঠায়ে দিবে? আমি বলব না।“

 

উপরের কথাগুলি কোচবিহার জেলার শীতলকুচির ২২ বছর বয়সী পরিযায়ী শ্রমিক মোমেন মিঁঞার। অগাস্ট মাসের এক সকালে আটটার কিছু পরে ঘর থেকে বেরিয়ে সাইটে কাজে যাচ্ছিলেন রাজমিস্ত্রীর কাজ করে দৈনিক ৭০০ টাকা রোজগার করা মোমেন। বাকিরা এগিয়ে গেছিলেন। তিনি সবার থেকে পিছিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎই একটি গাড়ি এসে থামে ও সেখান থেকে চার জন পুলিস নেমে তাঁর কাছে পরিচিতির নথিপত্র দেখার জন্য থানায় নিয়ে যেতে গাড়িতে তুলে নেন। “ওরা পুলিসই ছিল। উর্দি যদি নকলও হত, ব্যাজটা তো পেত না। আমি দেখে নিয়েছিলাম। ওরা পুলিসই ছিল,” জানালেন মোমেন।

 

দিল্লিতে কোচবিহার শীতলকুচির আরোও অন্যান্য পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে থাকতেন তিনি। গত চার-পাঁচ বছর ধরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবেই কাজ করেন। সেদিন তিনি প্রথমে ভয় পাননি, কারণ তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রই ছিল। কিন্তু অস্বস্তি হয় যখন এলাকার থানা পেরিয়ে গাড়িটি অন্য দিকে ঘুরে যায়। বলা হয় বড় থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোনো থানা-ই নয়, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি সোসাইটির মতো জায়গায়। সেখানে একটা আলোহীন ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। গাড়িতেই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল মোবাইল। কোন জায়গা কিছুই বুঝতে পারেননি তিনি বা তাঁকে আনতে যাওয়া সহকর্মী। মোমেনের আন্দাজ জায়গাটি দিল্লি ও গাজিয়াবাদের মাঝামাঝি কোথাও একটা হবে।

 

সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর আরো চার জন পুলিস কর্মী যোগ দেন। মোমেন জানান আরো প্রায় ৪-৫ জন সম্ভবত বিহার থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিককেও নিয়ে আসা হয়। আরো একজনকেও আনা হয়েছিল যিনি গোসাবার ছিলেন, পরে আর যাঁকে তিনি দেখতে পাননি এবং একজনকে তুলে এনে একটি আলাদা ঘরে রাখা হয়েছিল। সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত তাঁকে দাঁড় করিয়ে রেখে শারীরিক নির্যাতন ও ‘বাংলাদেশী’ বলার জন্য ক্রমাগত চাপ দেওয়া হয়। তিনি স্পষ্টই বললেন, “যেভাবে আমার ভিডিও করছিল, আমি যদি স্বীকার করতাম আমি বাংলাদেশী, তাহলে আমাকেও উঠায়ে ফালায়ে দিত বাংলাদেশে।”

 

শেষ পর্যন্ত বন্ধুর সাহায্যে কোনক্রমে বাসায় ফেরেন সেদিন মোমেন। “কিছু আমাকে পানির সাথে খাওয়ায় ছিল। ওই জিনিসটা খাবার পরে আমি যে কোথ থেকে এসেছি, কোথায় ছিলাম কিছুই মনে ছিল না। তিন দিন অমন ছিল,” জানালেন তিনি।

 

মোমেন-এর বাড়িতে রয়েছেন মা, স্ত্রী এবং ৬ বছর, ৩ বছর ও ১ বছর ৩ মাস বয়সী তিন ছেলে। কি বলছেন বাড়ির মানুষেরা তিনি ফিরে আসার পরে? “আমার বাড়িতে এমন অবস্থা নেই যে, এখানে থেকে খাব। বাড়ির মানুষ এখন কী বলবে? কোথা থেকে চিকিৎসা করাবে। না পয়সা আছে, না জমি আছে যে বিক্রি করে চিকিৎসা করাবে।”

 

প্রশ্ন করেছিলাম, কাজে ফিরে যাওয়ার কথা কি তিনি আদৌ ভাবছেন? দৃঢ় গলায় এক শব্দে উত্তর দিলেন ‘না’। নিজের রাজ্যে, নিজের জেলায় তবে কি কাজ করবেন? রোজগার তো করতে হবে। “রোজগার করতে হবে। রোজগার হলে করব, খাব। না হলে এমনিই থাকতে হবে,” কিছুটা যেন দিশাহারা শোনায় তাঁর গলা। কারণ ছোট থেকেই যে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে বড় হয়েছেন, গত চার-পাঁচ বছরের জীবনে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে ছাড়া আর কোনভাবে উপার্জনের উপায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের আরও অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিকের মতোই তাঁরও অজানা। একটু জোর করেই যখন জানতে চাই, তা বললে কী করে হবে, পরিবার রয়েছে, নিজে রয়েছেন, কী ভাবছেন ভবিষ্যতের কথা? মোমেন-এর উত্তরে যেন শোনা যায় তাঁরই মতো ভিন রাজ্য ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হওয়া আরও অন্য বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বর – “এখন তো আমার কাছে ভাবার মতো কিছুই নেই, যে ভাবব। না পয়সা আছে, না টাকা আছে, যে একটা কোনও নিয়ে চালাব যে রোজগার হবে, সে জিনিসটাই আমার কাছে নেই।”

পরিযায়ী শ্রমিকদের জমায়েতে প্ল্যকার্ড হাতে মোমেন মিঁঞা

মোমেন মিঁঞার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ২৮ অগাস্ট ২০২৫ অল ইন্ডিয়া মাইগ্রান্ট ওয়ার্কার্স অ্যসোসিয়েশন-এর কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার-এর সামনে-এর পরিযায়ী শ্রমিকদের জমায়েতে। সেদিনের কর্মসূচী ছিল রাজ্যপালের কাছে মিছিল করে গিয়ে নিজেদের দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি জমা দেওয়া। বাঙালি বলে এহেন হেনস্থার পর ঠিক কী দাবি তাঁর? “দাবি একটাই যে আমরা এখন এখানে এসেছি, আমাদের কাজ দিতে হবে। আমাদের চলতে তো হবে,” বললেন তিনি। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে পোর্টাল সেখানে নাম নথিভুক্ত করা নেই তাঁর, জানেন না প্রয়োজনীয় তথ্যও, “আমাদের ওদিকে বলেই না ওসব।” পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিযায়ী শ্রমিক ওয়েলফেয়ার বোর্ড বিষয়েও তিনি জানেন না এবং সেখান থেকে কেউও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বলেই জানালেন।

 

ঠিক কবে থেকে বাংলা ভাষাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটা শুরু হল? কোনও আগাম আন্দাজ কি করতে পেরেছিলেন? জানালেন, “না কোনো আগাম আন্দাজ নয়। শুনছিলাম গুরুগাঁওয়ে ওদিকে মারপিট চলছে। আমাকে একবার বন্ধুরা বলল, চল বাড়ি যাই, ওদিকে মারপিট চলছে। আমি বলেছিলাম, আমি যাব না। আমার পয়সা নেই, আমি যাব না। আমি বাড়ি যেয়ে কি খাব? আমি এও বললাম, ওদিকে হচ্ছে, এদিকে হবে না। এই কথা বলার তিন দিন কি চার দিন পর, আমাকে…।”

 

একজন ঠিকাদারের সঙ্গেই গত পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি ও শীতলকুচি থেকে যাওয়া আরও পরিযায়ী শ্রমিকেরা, যাঁরা একসঙ্গে কাজ করতেন, থাকতেন আর এখন একসঙ্গেই ফিরেও এসেছেন। ঠিকাদারের ভূমিকা কী ছিল এই ঘটনার পর? মোমেন জানালেন, “তিনি বললেন, গ্রামে ফিরে যাও। এখানে চিকিৎসা কে করবে? ঠিকাদার কোম্পানিকে বলেছিল যে পুলিস এমন টর্চার করল, কিছু করুন। কোম্পানি বলেছে – আমি এ রিস্ক নেব না।”

 

“ওখানে যদি একটা পুলিসের কাছে যাও আর বাংলায় কথা বলে ফেল, সে ডাইরেক্ট জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি বাংলাদেশী?’ এই কথাটাই বেশির ভাগেই জিজ্ঞেস করে,” বাস্তবটা দ্বিধাহীনভাবে বললেন তিনি।

 

“আমি সব ডকুমেন্টস দেখাচ্ছি, তবুও আমাকে অনেক মারসে,” কথা শেষ করলেন মোমেন মিঁঞা।

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Jayanta Saha on August 30, 2025

    বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহের ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সময়োপযোগী নাগরিক ভূমিকার আকুতি সৃষ্টি করানোই যথার্থ সাংবাদিকতার নিদর্শন।এই লক্ষ্যে যে এগিয়ে চলেছেন তা পরিলক্ষিত হচ্ছে

Leave a Comment