দুর্গাপুরে গোরু ব্যবসায়ীদের উপর বিজেপি যুব মোর্চার তান্ডব: তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট


  • August 6, 2025
  • (0 Comments)
  • 1191 Views

আমাদের মনে হয়েছে গোরু বা এই ধরণের গবাদি পশুর কেনা বেচা করা যে দেশের আইন অনুযায়ী একটি বৈধ ব্যবসা – এই সম্পর্কে ধারণার অভাব। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে এই গোরক্ষক নামক মুখোশধারীরা গোরু ব্যবসায়ীদের গোরু পাচারকারী বলে সাব্যস্ত করেছে। দুর্গাপুরের ঘটনায় প্রথম থেকেই চোর চোর ধ্বনি তুলে পরিকল্পিত ভাবে এই গণ পিটুনিকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে।

 

তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট

 

প্রতিবেদক: সুমন কল্যাণ মৌলিক, মানিক সমাদ্দার, সুনীল মন্ডল ও নাড়ু নন্দী।

 

৩১ জুলাই, ২০২৫। এই দিনটি পশ্চিম বর্ধমান তথা শিল্পনগরী দুর্গাপুরের ইতিহাসে এক কালো দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ঐ দিন বাঁকুড়া জেলার বড়জোড়ার নিকটস্থ আসুরিয়া হাট থেকে গরু কিনে ফেরার সময় ছজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে দুর্গাপুরের গ্যামন ব্রিজের কাছে বিজেপি যুব মোর্চার প্রধান পারিজাত গাঙ্গুলির নেতৃত্বে গো-রক্ষার ধুয়ো তুলে একদল দুষ্কৃতিকারী যেভাবে মারধর করে, তাদের দড়ি বেঁধে হাটায় এবং গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগাবার হুমকি দেয় তা শুধু অমানবিক নয়, একই সঙ্গে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মাপকাঠিতে চরম লজ্জা। এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে তখন ছ জন অভিযুক্ত ধরা পড়লেও ঘটনার মাস্টারমাইন্ড পারিজাত গাঙ্গুলি ফেরার। এই সময়ে গোপন ডেরা থেকে সোসাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ভিডিওতে তিনি শুধু নিজের কাজের সাফাই দেন নি, একই সঙ্গে পুনরায় করার হুমকি দিয়েছেন। ঘটনা ঘটার পর আমরা চারজনের মানবাধিকার তথা সমাজকর্মীদের দল আক্রান্তদের গ্রাম জেমুয়াতে যাই, আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলি। একই সঙ্গে দুর্গাপুর স্টিল টাউনে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সঙ্গে আমরা কথা বলি। এমনকি বাঁকুড়া জেলার যে হাটটি থেকে গরু কেনা বেচা হয়, সেখান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আমরা অত্যন্ত কৃতঞ্জ স্থানীয় মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের প্রতি, তাদের প্রেরিত রিপোর্টগুলো পরিস্থিতি বুঝতে আমাদের সাহায্য করেছে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আমরা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করতে চাই যে শিল্প তথা খনি অঞ্চলে এই ধরণের নির্মম ঘটনা কখনো ঘটে নি, এই ধরণের প্রচার সত্য নয়। কিছুদিন আগেই বাঁশকোপাতে (পানাগড় ও দুর্গাপুরের মধ্যিখানে অবস্থিত টোল প্লাজা) একটি গাড়ি থেকে এই তথাকথিত গোরক্ষক বাহিনী হামলা করে ও বেশ কিছু গরু নামিয়ে নেয়। স্থানীয় মানুষ এটাও আমাদের জানিয়েছেন বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় পানাগড়ে বিজেপি নেতা রমন সিং এর নেতৃত্বে একটি পশু বাহী গাড়ি থেকে গোটা কুড়ি গরু নামিয়ে নেওয়া হয়। সে সময় সেটার বিরুদ্ধে পানাগড়ে এক বিক্ষোভ সভাও হয় কিন্তু সেই ঘটনার কোন সুরাহা হয় নি।

মানবাধিকার তথা সমাজকর্মীদের তথ্যানুসন্ধান দল

 

গ্রামের নাম জেমুয়া

 

শতাধিক বছরের পুরানো গ্রাম জেমুয়া। শিল্পনগরী দুর্গাপুর গড়ে ওঠার আগে থেকেই এই গ্রামের অস্তিত্ব। জেমুয়া পান্ডবেশ্বর বিধানসভার অন্তর্গত হলেও এর ভৌগোলিক নৈকট্য দুর্গাপুর শহরের সঙ্গে। দুর্গাপুরের ফুলঝোড় মোড় থেকে, বি সি রায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে ডাইনে রেখে ও পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মু আবাসিক বিদ্যালয়কে বাঁপাশে রেখে যে সোজা রাস্তাটা এগিয়ে গেছে তা ধরে এগোলেই জেমুয়া গ্রামে পৌঁছানো যাবে। আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের আশে পাশে অবস্থিত বিভিন্ন গ্রামে আমরা যেমন তপশিলি জাতি, উপজাতি, ওবিসি ও সংখ্যালঘুদের সহাবস্থান লক্ষ্য করি, জেমুয়া তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে প্রায় ১২০০ মুসলমান পরিবারের বাস, এছাড়া অন্যান্য ধর্মের মানুষের বসতি আছে এবং তারা বহু যুগ ধরে শান্তিতে বসবাস করছেন। গ্রামের মুসলমান মানুষেরা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে চাষ যেমন আছে তেমনি গোরুর হাট থেকে পাইকারি হারে গরু কেনাবেচার ব্যবসা আছে। এছাড়া ছোটখাটো ব্যবসা, দুর্গাপুরের বিভিন্ন ছোট কারখানায় কাজ করা মানুষজন আছেন। জেমুয়া পঞ্চায়েত এলাকা যা দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের অধীন।

 

হাটের নাম আসুরিয়া

 

আক্রান্ত মানুষেরা যে হাট থেকে গোরু কিনে ফিরছিলেন তার নাম আসুরিয়া। বাঁকুড়া জেলার বড়জোড়ার কাছে এই হাট চালু হয় ১৯৪৫ সালে। সরকারের ঘরে রেজিস্ট্রিকৃত এই হাটে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া বিক্রি হয়। যিনি কিনলেন তাকে যথাবিহিত রসিদ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে একটা কথা আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে চাষ আবাদ ও অন্যান্য কাজের জন্য গরু কেনাবেচা একটা বহু প্রাচীন ব্যবসা। এজন্য যেমন পশ্চিমবঙ্গ তেমনি গোটা ভারতে অসংখ্য গোরুর হাট বসে। যদি শুধু এ অঞ্চলের কথা বলা হয় তবে দেখা যায় পুরুলিয়ার কাশিপুরের পশু হাট সারা দেশে পরিচিত। এছাড়া বীরভূমের রাজনগর, আসানসোলের সন্নিকটে লালগঞ্জ, চাতরা সহ একাধিক হাট রয়েছে আসুরিয়া হাটের পরিচালকরা আমাদের জানিয়েছেন যে তাদের হাটে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম ও পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও নদীয়া থেকে ক্রেতা বিক্রেতারা আসেন। জেমুয়া গ্রামের যে দলটি আক্রান্ত হয়েছেন, তারা আমাদের জানিয়েছেন যে তাদের বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে তাদের এই ব্যবসা চলছে।

গোরুর হাটের রসিদ

আক্রান্তদের বয়ান

 

আমাদের প্রতিনিধি দল আক্রান্ত শেখ সাজমল খান, শেখ জাহিরুলের সঙ্গে কথা বলে। এছাড়া সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া রক্তাক্ত বৃদ্ধ মানুষটি, যার নাম শেখ লখাই, যিনি গুরুতর আহত হয়েছেন, তার খোঁজখবর করেন। এই দলে শেখ লখাই সহ আরেকজন আদপে বীরভূমের বাসিন্দা। আমরা এই প্রতিবেদনে আক্রান্তদের সাক্ষ্য পয়েন্ট আকারে উপস্থিত করছি:

 

  • আমরা চোদ্দটা গরু নিয়ে একটা ম্যাটাডোর গাড়িতে আসুরিয়া হাট থেকে ফিরছিলাম। দুর্গাপুর গ্যামন ব্রিজের কাছে (৪১ নম্বর ওয়ার্ড, ডিপিএল কলোনি) একদল মানুষ আমাদের ট্রাক থামায়। মানুষগুলো সংখ্যায় ছিল ৩৫-৪০ জন। প্রথমে গরুগুলোকে তারা খুলে দিতে বলে, আমরা তাদের মারমুখী মূর্তি দেখে ভয়ে গরুগুলোর দড়ি খুলে দিই। এই দলটার নেতা ছিল একজন গোলাপী পাঞ্জাবী গায়ে দেওয়া লোক, মুখে অনবরত গালি, বাকিদের সেই নির্দেশ দিচ্ছিল। (এই নেতার নাম পারিজাত গাঙ্গুলি, বিজেপি যুব মোর্চার নেতা, এর বিরুদ্ধে আগেও সংখ্যালঘুদের প্রতি অবমাননাকর আচরণ ও বিভিন্ন মারধরের ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে)।

 

ঘটনায় মূল অভিযুক্ত পারিজাত গাঙ্গুলি, বিজেপি যুব মোর্চার নেতা, এখনও নিখোঁজ।

 

এরপর শুরু হয় মার। প্রথমে চড়-থাপ্পড়, তারপর ঘন্টা দুই ধরে চলে কিল, ঘুষি, পাজরে লাথি। দুজনের মুখ মেরে ফাটিয়ে দেওয়া হয়। গায়ে থুতু ছেটানো হয়। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যে বৃদ্ধ মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে, তার দাঁড়ি ওপরানোর চেষ্টা করা হয়। ওই গুন্ডা বাহিনী থেকে এক দুজন বলে আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে গাড়িসুদ্ধ জ্বালিয়ে দেওয়ার।

 

  • প্রথম থেকে আমাদের গরু চোর, গরু পাচারকারী হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। এই মার যখন চলছিল তখন তখন আশে পাশের লোকেরা দাঁড়িয়ে দেখছিল কিন্তু কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসে নি। একটি বাচ্চা মেয়ে জলের বোতল নিয়ে এগিয়ে আসে কিন্তু তাকে হামলাকারীরা তাড়িয়ে দেয়। মারের শেষে তাদের দড়ি বেঁধে গ্যামন ব্রিজ পর্যন্ত হাঁটিয়ে আনা হয়।

 

  • ঘটনাস্থল থেকে দু কিলোমিটারের মধ্যে কোকওভেন থানা কিন্তু সেখান থেকে কোনো সাহায্য মেলে নি। পুলিশ ঘটনার বহু পরে আসে। অথচ পুলিশ আমাদের কাছে এই গরুর ট্রাক নিয়ে আসার সময় টাকা নেয়। বাঁকুড়ার বড়জোড়া থেকে দুর্গাপুরের জেমুয়া গ্রাম পর্যন্ত রাস্তায় যত থানা পরে, প্রত্যেকে টাকা নেয়। কোক ওভেন থানা প্রতি ট্রিপে ১২০০ টাকা নেয়। সব মিলিয়ে পুলিশ সেটিংএর জন্য ৬,০০০ টাকা খরচ হয়। এছাড়া দুর্গাপুরের তিনটে ক্লাবকে দুর্গা পুজোর সময় ২,০০০ টাকা করে মোট ৬,০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া বছরভর বিভিন্ন উৎসবে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা নেওয়া তো আছেই। আজ শহরের মাঝে আমাদের এইভাবে মারা হল। এই ঘটনায় আমরা শুনেছি দু-চারজন ধরা পড়েছে, কিন্তু পারিজাত গাঙ্গুলিকে ধরা হচ্ছে না কেন? কি সেটিং আছে ওর? আমরা শুনেছি পারিজাতের স্টিল টাউনশিপের চন্ডীদাস কলোনির বাড়িতে পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে যে আমরা রক্তাক্ত অবস্থায় নিজেরা দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে যাই, পুলিশ আমাদের নিয়ে যায় নি। পরের দিন গ্রামের লোকেরা স্থানীয় থানায় গেলে, সেখানে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয় নি।

 

  • এলাকায় প্রথমে আমাদের নিয়ে ডেপুটেশন দেয় সিপিআই (এম) পার্টি। পরে আমাদের এমএলএ সাহেব (পান্ডবেশ্বরের তৃনমূল বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) সবাইকে নিয়ে থানায় যান। কিন্তু তারপর ৭২ ঘন্টা পার হওয়া সত্বেও এবং বিধায়কের প্রতিশ্রুতি সত্বেও মূল অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হয় নি। আমরা আশা করেছিলাম, বিধায়ক আমাদের গ্রামে আসবেন কিন্তু তিনি এখনো আসেন নি। তবে বিভিন্ন লোক, দল আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছে, গ্রামে আসছে, এটা আমাদের ভালো লেগেছে।

 

অতিরিক্ত তথ্য

 

আক্রান্ত মানুষেরা ছাড়াও আমরা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলি। জেমুয়া পঞ্চায়েতের তৃনমূল কংগ্রেসের অঞ্চল সভাপতি আমির হুসেনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি। তিনি তীব্র ভাষায় এই ঘটনার নিন্দা করেন এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির জন্য সরকারের দায়বদ্ধতার কথা বলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যেদিন আমরা গ্রামে যাই তিনি মিটিং থাকার কারণে বাইরে যান। আমরা কথা বলি সিপিআই(এম) দলের কর্মী শিস মহম্মদের সঙ্গে। তিনি জানান দলের পক্ষ থেকে থানায় বিক্ষোভ ও দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন এই বিষয়ে সবচেয়ে আশ্চর্যের হল পুলিশ তথা প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তা। তিনি অবিলম্বে পারিজাত গাঙ্গুলির গ্রেফতারের দাবি জানান। আমরা গ্রামের বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলি। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য গোরু ব্যবসায়ী শেখ লুকমাল। তিনি ঐদিনের ঘটনায় না থাকলেও আসুরিয়া হাটে নিয়মিত যান। তিনি আমাদের বাঁশকোপার ঘটনাটি জানান। তিনি বলেন এই ধরণের ঘটনার পর এই হামলাকারীরা কিছু গরু নামিয়ে নেয় ও পরে বিক্রি করে দেয়। গ্রামের লোকেরা জানায় এবার চোদ্দটা গরু ছিল, বিষয়টি নিয়ে এত হৈচৈ হওয়ার পর বারোটা গরু পাওয়া গেল। তাহলে বাকি দুটো গরুর কি হল? লুকমাল বলেন সেদিনের ঘটনায় আক্রান্তদের টাকা পয়সাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। গ্যামন ব্রিজের ঘটনায় এখনো পর্যন্ত ছজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদের নাম দীপক দাস, অনিস ভট্টাচার্য, কিরণ মাল, বাসুদেব বাদ্যকর, সুরজ সিং ও রাহুল বার্নওয়াল। এদের বাড়ির ঠিকানা দুর্গাপুরের বিভিন্ন থানা এলাকার যা স্পষ্ট করে রীতিমতো পরিকল্পনা করে বিভিন্ন এলাকার এই সব সমর্থকদের একত্রিত করা হয়েছিল হামলার জন্য।

 

আমাদের পর্যবেক্ষণ:

 

প্রথমত দুর্গাপুরের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ও স্থানীয় প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। ঘটনার অবব্যহিত পরে মাস্টারমাইন্ড পারিজাত গাঙ্গুলি সোসাল মিডিয়ায় যে পোস্ট করেন তাতে পরিষ্কার এই ঘটনা পরিকল্পিত। মুসলমানদের জেহাদি, বহিরাগত, গণশত্রু বানাবার সংঘ পরিবারের যে চলমান প্রকল্প, তারই অংশ এই ঘটনা। এক্ষেত্রে লাভ জেহাদ, ধর্মীয় শোভাযাত্রায় হিংসার মত ঘটনা যেমন রয়েছে, তেমনি গোরুকে ঘিরে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করাটাও এই পরিকল্পনার অংশ। দীর্ঘ সময় ধরে এরাজ্যে যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় পরিচিতির বিভেদমূলক রাজনীতির চাষ, তার পরিণাম এই ঘটনা। নির্দিষ্ট করে যদি আসানসোল -রানিগঞ্জ -দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের কথা বলা হয়, তাহলে পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সংখ্যালঘুদের আক্রমণের নিশানা করার ঘটনা এই জেলায় বিগত বছরে একাধিক বার ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ করে যে সমস্ত জায়গায় বিভিন্ন ধর্ম ও ভাষাভাষীর মানুষ রয়েছেন, সেখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা জিইয়ে রাখার একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টা রয়েছে। এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক, বিভেদকামী শক্তিগুলো সুকৌশলে সোসাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে পরিস্থিতি আরো খারাপ করছে।

 

দ্বিতীয়ত দুর্গাপুরের ঘটনাটির সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতটিও আমাদের আরেকবার মনে করা দরকার। গোরুকে ঘিরে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শাসকদলের বৃহত্তর রাজনীতির অংশ। ‘আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা’ শীর্ষক স্ট্যাটিসটিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ২০১৪ সালের পর থেকে গো রক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের ঘটনা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সারা দেশে গোরক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের শারীরিক ভাবে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে ৬৩ টি। এর মধ্যে ৮০% ঘটেছে ২০১৪ সালের পর। এই ঘটনাগুলোতে ২৪ জনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, গুরুতর আহত হয়েছেন ১২৪ জন। আবার অবজারভার ফাউন্ডেশনের রিপোর্টে অনুযায়ী ২০১১ সালে দেশে যত গণ পিটুনির ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ৫% ছিল গো ব্যবসায়ীদের উপর আক্রমণ, ২০১৭ সালে এই শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২০%। ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট তেহশিন পুনাওয়ালা মামলায় সংখ্যালঘু মানুষদের পিটিয়ে মারার ঘটনাকে ‘horrendous acts of mobocracy’ আখ্যা দিয়ে দেশের সংসদকে এইসব ঘটনা রোধের জন্য কঠোর আইন প্রণয়নের অনুরোধ জানায়। এই তথাকথিত গোরক্ষকদের তান্ডবের বিষয়টি দেখার জন্য রাজ্যগুলিকে বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠনের নির্দেশ দেয়। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ২৩ জুলাই তাদের পূর্ববর্তী নির্দেশ কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, সে বিষয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু সমস্যা হল এ বিষয়গুলো বন্ধ তো হয়ই নি বরং সারা দেশে বিস্তার লাভ করেছে।

 

তৃতীয়ত দুর্গাপুরের ঘটনায় রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা চূড়ান্ত হতাশাজনক। একাধিক থানা সত্বেও ঘটনা আটকানো যায় নি, এমনকি এই রিপোর্ট চূড়ান্ত করার সময় পর্যন্ত মূল অভিযুক্ত ধরা পরে নি। এছাড়া আক্রান্তরা অভিযোগ করেছেন যে ‘পুলিশ সেটিং’ এর জন্য প্রতি সপ্তাহে তাদের পয়সা দিতে হয়। একটা আইনি ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিবহনের সময় সুরক্ষা দেবার দায়িত্ব সরকারের। এক্ষেত্রে পুলিশ দায়িত্ব পালনে চূড়ান্ত ব্যর্থ।

 

চতুর্থত আমাদের মনে হয়েছে গোরু বা এই ধরণের গবাদি পশুর কেনা বেচা করা যে দেশের আইন অনুযায়ী একটি বৈধ ব্যবসা-এই সম্পর্কে ধারণার অভাব। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে এই গোরক্ষক নামক মুখোশধারীরা গোরু ব্যবসায়ীদের গোরু পাচারকারী বলে সাব্যস্ত করেছে। দুর্গাপুরের ঘটনায় প্রথম থেকেই চোর চোর ধ্বনি তুলে পরিকল্পিত ভাবে এই গণ পিটুনিকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে। এই বিষয়টাতে জন সচেতনতা তৈরি করতে সব পক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে।

 

পঞ্চমত এই কয়েকদিনে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। মেরুকরণ ও ঘৃণার আবহাওয়া আজ এতটাই বিস্তৃত যে এই অমানবিক, পৈশাচিক ঘটনাকে অনেকে নানান কুযুক্তির মোড়কে সমর্থন করছেন। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমরা বিভিন্ন সোসাল মিডিয়া পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে একটা প্যাটার্ণ লক্ষ্য করেছি। ঘটনার পর এর স্বপক্ষে ন্যায্যতা তৈরির চেষ্টা সেখানে স্পষ্ট। আজ যদি দুর্গাপুরের মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা এড়াতে চাই তাহলে রাজ্যের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোকে পরিস্থিতি বদলের জন্য যথাযথ কার্যক্রম গ্রহন করতে হবে।

 

 

Share this
Tags :
Leave a Comment