সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ তৃণমূলের শাসক দলের দুর্বৃত্তায়নকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। শুধুই নারী সুরক্ষার প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের ও কীভাবে কারা সেই প্রতিরোধ তৈরি করে নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারছেন তারও। বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে এর কোনোটিকেই না দেখাটাই বাঞ্ছনীয়।
সুদর্শনা চক্রবর্তী
পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য মহিলা কমিশন নামক প্রতিষ্ঠানটি খাতায়-কলমে রয়েছে। রয়েছেন তার চেয়ারপার্সন-ও। কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, খাস কলকাতায় একের পর এক নারী নির্যাতন, নৃশংস ধর্ষণ, হত্যার ঘটনার পরেও সেই কমিশন ও তার চেয়ারপার্সন-এর হিরণ্ময় নীরবতা কোনো প্রশ্ন বা আন্দোলন তৈরি করে না কেন তা জানা যায় না। রাজ্য মহিলা কমিশন সরকারের প্রশাসনের অন্যতম শাখা। তার এই আদ্যোপান্ত হতাশাজনক ভূমিকা নিয়ে এ রাজ্যের নারী অধিকার সংগঠন, নারী অধিকার কর্মী, বিরোধী বাম দল – সকলেই নিশ্চুপ। কিছু বছর আগেও চিত্রটি এরকম ছিল না। তবে সিরিয়াল লেখক চেয়ার পার্সন-এর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তা আমূল বদলে গেছে এবং একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায় তা যথেষ্ঠ পরিকল্পিত। লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের বিনা যোগ্যতায় এই দায়িত্বপ্রাপ্তি, সিরিয়াল ও মূলস্রোতের মস্তিষ্কহীন বাংলা সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সরকারী অনুষ্ঠানে আলোর কেন্দ্রে আসা এবং মহিলাদের ভূমিকাকে কেবলই সাজগোজ, গ্ল্যামার সর্বস্ব করে তোলার মধ্যে দিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নারী সুরক্ষার প্রতি বরাবরের উপেক্ষা ও বিষয়টিকে গুরুত্বহীন প্রতিপন্ন করার মানসিকতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যতই দাবি করা হোক তৃণমূল কংগ্রেসে নেতৃত্বে থাকা মহিলা, সাংসদ, বিধায়কের সংখ্যা অন্যান্য দলের তুলনায় বেশি – তা যে আসলে নিছকই ভনিতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরজিকর-এ তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যা, ১০ বছরের তমান্না-র হত্যা, সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ-এ ছাত্রী ধর্ষণ ও তারই মাঝে রাজ্যের প্রায় সব জেলাতেই নির্বিচারে চলতে থাকা নারী নির্যাতনের ঘটনায় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী, রাজ্য মহিলা কমিশন-এর ভূমিকা ন্যক্কারজনক। কোথাওই তারা দলের বশংবদ হয়ে থাকা ছাড়া প্রশাসনিক ভূমিকা পালন করতে পারেননি। অপর দিকে, যেকোনো বিরোধী দলের কোনো সভা বা মিছিলে শিশু-কিশোরদের দেখা গেলে যেভাবে সঙ্গত কারণেই রাজ্যের শিশু অধিকার কমিশন-এর প্রাক্তন ও বর্তমান সদস্যরা সরব হন, শাসক দলের ছোঁড়া বোমার আঘাতে বালিকা তমান্না-র মৃত্যুতে তাদের সামান্যতম শোক প্রকাশটুকুও করতে দেখা যায়নি।
পশ্চিমবঙ্গে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, নারীর প্রতি নানাবিধ সহিংসতা বাড়ার ঘটনায় আপামর রাজ্যবাসী এই মুহূর্তে ক্ষিপ্ত। সাধারণ মানুষ যতই বলুন না কেন, ‘রাজনীতির কিছু বুঝি না’, আসলে তো প্রত্যেকেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। নির্বাচনের রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই অংশগ্রহণ করে থাকেন। ফলে বুঝে বা না বুঝে তাঁরা সকলেই হয় শাসক নয় বিরোধী পক্ষে নাম লিখিয়ে ফেলেন। পশ্চিমবঙ্গে গত চোদ্দ বছরে এই শাসক, বিরোধীর সমীকরণটা আশ্চর্যজনকভাবে বদলে যাওয়ায় এই রাজ্যের সামগ্রিক রাজনীতির চিত্রটাই বদলে গেছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে, যেমন যেকোনো রাজনীতির পট পরিবর্তনেই পড়ে থাকে মহিলাদের উপরেই। এমন এ রাজ্যে শাসক দলের সমর্থনে ক্রমশ বাড়তে থাকা দুর্নীতি, বাম দলগুলির বিরোধী রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যর্থতা বিজেপি-আরএসএস-এর জমি মজবুত হওয়া পুরোটাই মহিলাদের নিরাপত্তাহীনতায় পৃথক পৃথকভাবে মদত দিয়েছে।
২০২৪ সালের অগাস্ট মাসের শুরুতে আর জি কর হাসপাতালে রাত্রে ডিউটিরত অবস্থায় তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যা নারী-সুরক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতিকে সামনে নিয়ে আসে। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ঘটনার বীভৎসতা হয়তো তাকে অন্য ঘটনাপ্রবাহ থেকে আলাদা করেছে, কিন্তু গত চোদ্দ বছরে রাজ্য জুড়ে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ক্রমে বেড়েই চলেছে। ২০২৪ সালে ‘দ্য ওয়্যার’-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে ২০২৩ সালের অগাস্ট থেকে নভেম্বর-এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের উপর শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ ও গণ ধর্ষণের ৪২টি ঘটনার কথা জানতে পারা যায়। সরকারি সূত্রে যা জানা যায়, রিপোর্ট না হওয়া ঘটনার সংখ্যা তার তুলনায় অনেক বেশি। শাসক দলের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে যৌন নির্যাতকেরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে এবং নারী নির্যাতনের ঘটনা আড়াল করতে সরকার-প্রশাসনের চেষ্টা – এই দুইয়ের মধ্যের সমীকরণ সাদা চোখেও স্পষ্ট।
দলীয় রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে যদি দেখা যায় – জাতীয় মহিলা কমিশন আর জি কর হাসপাতালের ঘটনা ও সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ-এর ঘটনা দু’টি ক্ষেত্রেই তাদের দায়িত্ব পালনে পর্যবেক্ষণে এসেছে। এবং শাসক দলের আক্রমণের মুখে পড়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী এ আন আই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “মহিলা কমিশন কেন অন্যান্য জায়গায় যায় না? অন্য কোথাও কি কোনো দমন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটে না? যদি আপনাদের যেতে হয়, সব জায়গাতেই যান। আপনাদের মণিপুর, ওড়িশাতেও যাওয়া উচিৎ। এটি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, তার স্বাধীনই থাকা উচিৎ। কিন্তু তা সেভাবে কাজ করছে না।”
অন্যদিকে যে শরীরী ভাষা ও বক্তব্য নিয়ে রাজ্যের মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন, সেখানে যদিও তিনি এই ঘটনায় মর্মাহত হওয়ার কথা বলেন, ১২ ঘন্টার মধ্যে পুলিশি তৎপরতায় তিন জন মূল অভিযুক্তর গ্রেপ্তার হওয়ার কথা বলেন, সার্ভাইভার তরুণীর পাশে থাকার কথা বলেন, সেখানে সরকারের দায়বদ্ধতা নয়, সামনে আসে এক ধরনের ঔদ্ধত্য। এত বেশি কথা কি এই কারণেই যে এই ঘটনায় সরাসরি জড়িয়ে গেছে তৃণমূল কংগ্রেস-এর নাম? যতই মূল অভিযুক্ত মনোজিত মিশ্রার সঙ্গে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সম্পর্ক অস্বীকার করা হোক না কেন, দলীয় ক্ষমতাতেই যে প্রাক্তন ছাত্র হয়েও কলেজে তার শুধু অবাধ চলাচল নয়, গভর্নিং বডি-র নির্দেশে বিশেষ অস্থায়ী পদপ্রাপ্তি ও ক্ষমতার আস্ফালন তা শুরু থেকেই সামনে এসেছে। এই ক্ষমতার বেশিটাই প্রয়োগ করা হয়েছে কলেজের ছাত্রীদের সঙ্গে যৌন নিপীড়নমূলক আচরণে, যা কদর্যতম রূপ পায় সাম্প্রতিক ঘটনায়।
শশী পাঁজা এই সাংবাদিক সম্মেলন করছেন তৃণমূল কংগ্রেস-এর কার্যালয় থেকে। তাঁর মুখে দলের কথা। রাজ্যের মন্ত্রী হিসাবে তাঁর উচিৎ ছিল সরকারের প্রশাসনিক কার্যালয় থেকে বক্তব্য রাখা, মন্ত্রী হিসাবে দায় স্বীকার করা। দলের ধ্বজাধারী হিসাবে নয়। তিনি এই বক্তব্য রাখার সময়ে নাম উল্লেখ না করেও বারেবারে বিজেপি ও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে নারীদের উপর অত্যাচারের ঘটনাকে টেনে আনেন। এই ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটলে শাসক-বিরোধী চাপান-উতোর স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু শাসকের নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে কেবলই বিরোধীদের আক্রমণ প্রায় অভূতপূর্ব। আর জি কর-এর ঘটনার পর সরকারের ভূমিকা বলতে ছিল বিধানসভায় ‘অপরাজিতা বিল’ উত্থাপন, যা সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে যায়। কী ছিল সেই বিলে – ধর্ষণকারীর কঠোরতম শাস্তি, প্রয়োজনে ফাঁসি। এই সাংবাদিক সম্মেলনে শশী পাঁজা আবারও সেই বিল আইনে পরিণত করায় বিজেপি-র বাধাদানের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। যেন এই বিল পাশ হলেই রাজ্যে নারী নির্যাতন কমে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে। যেন রাজ্যে একের পর এক নৃশংস ঘটনা থামানোর সরকারের কাছে এটাই একমাত্র দাওয়াই। যেন রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলাতে, নারী-সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এই বিল পাশ করাই একমাত্র উপায়। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ধর্ষণের ঘটনায় এনকাউন্টার-এর সঙ্গে এর বিশেষ পার্থক্য রইল না। শশী পাঁজা, যাঁর বক্তব্য আর জি কর-এর ঘটনা বা রাজ্যের কোনো নারী নির্যাতনের ঘটনাতেই শুনতে পাওয়া দুর্লভ, তাঁর এই অতি সক্রিয় অবস্থান কি নির্যাতক ও নির্যাতিতা উভয়েই শাসক দলের সমর্থক ও সদস্য হওয়ার কারণে?
মদন মিত্র, কল্যাণ ব্যানার্জী, মানস ভুঁইঞা-র বক্তব্য নিয়ে মানুষ কথা বলছে। শাসক দল মদন মিত্রকে শো-কজ নোটিস পাঠিয়েছে। পুরোটাই লোক-দেখানো। দলের শীর্ষ নেত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বছরের পর বছর এ রাজ্যের নারী নির্যাতনের ঘটনাকে অবহেলা করে এসেছেন। কখনো তুচ্ছ ঘটনা, কখনো কিশোরীর প্রেমের সম্পর্ক, কখনো শুধুই নীরবতা দিয়ে তিনি একটার পর একটা ঘটনাকে সংবাদ মাধ্যমে নিছক উত্তেজনা তৈরির উপাদান করে তুলেছেন। আমরা নিশ্চয়ই সুজেট জর্ডনকে উদ্দেশ্য করে করা জঘন্য মন্তব্যগুলি ভুলে যাইনি। ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ এই শাসক দলের অন্যতম হাতিয়ার আর তার পথ দেখিয়েছেন শীর্ষ নেত্রী। এমনকি সার্ভাইভার-এর যিনি আইনজীবী তিনি টেলিভিশন-এর লাইভ আলোচনায় যেভাবে ঘটনার পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ দিচ্ছিলেন, তা অবাক করে দেয়। তিনিও শাসক দলের সমর্থক। অন্যদিকে, অভিযুক্তের আইনজীবী যেভাবে নিজের ক্লায়েন্টকে বাঁচাতে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সামনে, তাও শালীনতার মাত্রা ছাড়ায়। অভিযোগকারিনী ও অভিযুক্ত দুই পক্ষই একই দলের সমর্থক হওয়াতে এই ঘটনাগুলি ভিন্ন মাত্রা পাচ্ছে।
মহিলাদের উপর বাড়তে থাকা হিংসা, যৌন নির্যাতনের ঘটনায় এ রাজ্যে সাজাপ্রাপ্তর সংখ্যার দিকে তাকালেই বোঝা যায় আইন-শৃঙ্খলার বেহাল দশা কোন স্তরে পৌঁছেছে। টানা তিন বছর অ্যাসিড আক্রমণে এই রাজ্য শীর্ষে। মহিলা কমিশনের সে বিষয়ে একটিও বক্তব্য পাওয়া যায় না। মুখ্যমন্ত্রী, নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রীর বক্তব্যও অমিল। সুতরাং, সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ, আর জি কর – কোনোটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ঘটনাক্রম মাত্র।
রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় তৃণমূলের যে একাধিপত্য গত ১৪ বছরে তৈরি হয়েছে, তারই ফল সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ-এর ঘটনা। কলেজ থেকে ছাত্র নির্বাচন উঠে যাওয়া, ছাত্র রাজনীতির কলকাতা কেন্দ্রীকতা, কলেজে কলেজে শাসক দলের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরাট বিরাট ফ্লেক্স-এই ফুটে ওঠে। যেমনটা ছিল সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ-এও। যা ঘটনা সর্বসমক্ষে আসায় রাতারাতি খুলে ফেলা হয়। এই কারণেই প্রায় এলাকার অপর একটি কলেজে দীঘায় জগন্নাথ মন্দির তৈরির জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বড় ফ্লেক্স পড়ে। কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় নির্বাচিত জন প্রতিনিধিরা নিজেদের ভাগের কাজটুকু করলে তাই নিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে বড় বড় কাট-আউট, পোস্টার, ব্যানার, ফ্লেক্স পড়ে যায়। তা নিয়ে প্রশ্ন না তোলাই লাগামহীন ক্ষমতার আস্ফালনে পৌঁছায়। যার সবচেয়ে প্রথম আর সবচেয়ে সহজ লক্ষ্য নিঃসন্দেহে যে কোনো বয়সের নারী।
দশ বছরের তামান্না-র কাছে একটা গোটা রাজ্য অপরাধী হয়ে রইল। শাসক দলের দুষ্কৃতিদের ছোঁড়া বোমার আঘাতে রাজনীতির বিন্দুমাত্র কিছুই না বোঝা যে বালিকাটি স্রেফ একটি লাশ হয়ে গেল, তাঁর সামনে বিরোধী দলও কি আর মাথা নীচু না করে দাঁড়াতে পারবে? তাঁর পরিবার বাম দল, স্পষ্ট করে বললে সিপিআইএম দলের সমর্থক হওয়ার কারণে তামান্নার-র বাড়িতে উপনির্বাচনে জয়ের পরে বিজয়োল্লাসে বোমা ছোঁড়ে শাসক দলের সমর্থকেরা, মারা যায় তামান্না। তাঁর পরিবার জানাচ্ছে, আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে এবং তাঁরা ভয়ে ছিলেন সেদিনও ঘটতে পারে, তাই বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিলেন না। শাসকের লাগামছাড়া দুর্নীতি ও দুষ্কৃতিদের আশ্রয় দেওয়ার ঐতিহ্য থেকে এবারও তৃণমূল কংগ্রেস সরে আসেনি। তারসঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রশাসনের তরফ থেকে টাকা দিয়ে এই রকম একটি নৃশংস, মর্মান্তিক ঘটনায় হাত ধুয়ে ফেলতে চাওয়ার মানসিকতা। ডেবরা-র সাংদ হুমায়ুন কবীরকে এই কাজের জন্য শো-কজ করা হলেও, একজন সাংসদ যখন সদ্যমৃত বালিকার মা-কে জনসমক্ষে, সংবাদ মাধ্যমের সামনে টাকা দিতে চান, তখন বোঝা যায় নীতিহীনতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
তবে যা এরমধ্যেও রয়ে যায় তা হল পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-শহর-মফস্বলে এখনো একট বড় সংখ্যক মানুষের সামনে লাল পতাকার কোনো বিকল্প নেই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁরা মূলত সিপিআইএম-এর বিশ্বস্ত সমর্থক। এখনো শাসক তৃণমূলের সমস্ত চোখ রাঙানি, নিপীড়নের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে তাঁরা দলের প্রতি আস্থায় অবিচল। যে কারণে তামান্না-র মায়ের কথায় বোঝা যায় তাঁরা পারিবারিকভাবেই বাম সমর্থক ও সেই কারণেই বারেবারেই শাসক দলের আক্রমণের শিকার হতে হয় তাঁদের মতো পরিবারকে। শেষ পর্যন্ত যার দাম দিতে হল তামান্নাকে তাঁর প্রাণ দিয়ে। অথচ এই সব কিছুর মাঝে মেহনতী, শ্রমজীবী মানুষদের পাশে থাকার শপথ নেওয়া বাম দল, কেবলমাত্র ঘটনাভিত্তিক উপস্থিতি, সভা-সমিতি, জমায়েত, মিছিলে সীমাবদ্ধ। রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্ব জেলায়, গ্রামে-মফস্বলে হাজির হন, তাঁদের সভায় প্রচুর মানুষের ভিড় হয়। এই মানুষেরা সকলেই দলের সমর্থক। দিন বদলের স্বপ্ন দেখেন। ভাষণ, ভবিষ্যৎ কর্মসূচীর ঘোষণার বাইরে দলীয় নেতৃত্ব তারপরেও শুধুই শহর, মূলত কলকাতাকেন্দ্রীক রয়ে যায়। মফস্বল, গ্রামের মানুষদের পাশে যে জনবল নিয়ে, যতটা শক্তি নিয়ে দাঁড়ানোর কথা সে দৃশ্য দেখা যায় না। একেকটা হিংসাত্মক ঘটনার পর হয় নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে, নয়তো আহতদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় রাজ্যের নেতৃত্বকে। অথচ জেলাস্তরে নেতৃত্ব ও সমর্থকেরা কীভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করছেন, কীভাবে বারেবারে আক্রমণের মুখে পড়ছেন, সেখানে ক্রমশ বাড়তে থাকা শাসক দলের হাতে নারী নির্যাতনের ঘটনা কোনোটির প্রতিরোধেই রাজ্য নেতৃত্বের সক্রিয় ভূমিকা চোখে পড়ে না।
ফলত যা হওয়ার তাই হয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দলের জায়গা নিয়ে নেয় বিজেপি। ধর্মের রাজনীতিতে শাসক, বিরোধী দু’পক্ষই উসকানি দিতে থাকে। মানুষের অধিকার আর রাজ্যে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চাকরি-নারী সুরক্ষার মতো প্রাথমিক বিষয়গুলি আড়ালে চলে যায়। আর জি কর, তামান্না, সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ – কয়েক দিনের শিরোনাম তৈরি করে।
পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে বিরোধী রাজনীতি বলে আর কিছু নেই। আর জি কর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে রাত দখল আন্দোলন, (যা পরবর্তী সময়ে নানা ভাগে বিভক্ত) যেখানে অবশ্যই একাংশে নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান ছিল, তা কীভাবে যেন ‘অরাজনৈতিক’ ট্যাগ পেয়ে গেল। অথচ সেখানে বাম, অতি-বাম সকলেরই অংশগ্রহণ ছিল। যেন প্রতিবাদে ‘রাজনীতি’ থাকা খুব গর্হিত কোনো কাজ। তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্রে, নির্বাচনী রাজনীতিতে বিরোধীদের ভূমিকাটি ঠিক কি সে বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই ফাঁক গলেই, বিজেপি নিজেকে প্রধান বিরোধী দল বলে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। রাম-বাম, তৃণমূলের বি টিম – ইত্যাদি বিতর্ক উস্কে দিয়ে তারই মাঝে বিজেপি নিজের রাজনীতি চালাতে থাকে, শাসক ও বিরোধী দুইয়ের তুরুপের তাস হয় ধর্ম। অন্যদিকে, বিজেপি দেখলেই অতি উত্তেজনায় উন্নাও-হাথ্রাস-এর ঘটনা টেনে এনে স্লোগান দিলে নারীবাদী আন্দোলন কর্মীরা এই সময়ের রাজ্য সরকারের গাফিলতি থেকে সরে আসেন। সুযোগ নেয় বিজেপি। তাঁদের উপর চড়াও হয়। প্রতিবাদ আন্দোলনের সময়োচিত অভিমুখ ঠিক করাও রাজনীতি।
আবার বামেরা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, নারী-সুরক্ষা, ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা, পুঁজিবাদ প্রতিরোধ সব কিছুর বিষয়ে কথা বলতে থাকলেও তাদের সঙ্গে থাকা মানুষের সমর্থন কীভাবে ভোটে রূপান্তরিত হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট রূপরেখা চোখে পড়ে না। ভোটবাক্সে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে এর প্রভাব নিয়ে তাদের কতটা মাথাব্যথা আছে বোঝা মুশকিল। ঘটনাভিত্তিক প্রতিবাদ দীর্ঘস্থায়ী ফল দেয় না।
সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ-এর ঘটনার প্রতিবাদে দলীয় পতাকা নিয়ে বামেদের আগে পথে নেমে পড়ে বিজেপি। এমনকি তৃণমূলের এলাকায় পথসভাও করে। প্রতিবাদের প্রথম দিন এসএফআই-ডিওয়াইএফআই-আইডওয়া-র উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যা ছিল নেহাতই কম। বামেদের যৌথ মিছিলেও উপস্থিতির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। এরই মাঝে রাত দখল আন্দোলনের একাংশের উপর হামলা চালায় বিজেপি। দেখা যাচ্ছে যদি এই প্রতিবাদে বিরোধী ভূমিকা কেউ নিয়ে থাকে তাহলে তা অঙ্ক কষে বিজেপি-ই নিচ্ছে।
সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ তৃণমূলের শাসক দলের দুর্বৃত্তায়নকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। শুধুই নারী সুরক্ষার প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের ও কীভাবে কারা সেই প্রতিরোধ তৈরি করে নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারছেন তারও। বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে এর কোনোটিকেই না দেখাটাই বাঞ্ছনীয়।