গণহত্যা প্রায় সম্পূর্ণ। যখন এটি শেষ হবে তখন এটি কেবল ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করবে না, বরং পশ্চিমা সভ্যতার নৈতিক দেউলিয়াত্বও প্রকাশ করবে।
ক্রিস হেজেস
৯ জুন, ২০২৫
এই তবে শেষ। গণহত্যার রক্তাক্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি। খুব শীঘ্রই সব মিটে যাবে। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই, বড়জোর, দু’সপ্তাহ। বিশ লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বা খোলা আকাশের নীচে। ইজরায়েলের গোলা, মিসাইল, ড্রোন, বোমা আর গুলিতে প্রতিদিন ডজনখানেক মানুষ মারা যাচ্ছে, আহত হচ্ছে। তাদের কাছে পরিষ্কার জল নেই, ওষুধ নেই, খাবার নেই। তারা ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে গেছে। অসুস্থ। আহত। আতঙ্কিত। লাঞ্ছিত। পরিত্যক্ত। নিঃস্ব। ক্ষুধার্ত। আশাহীন।
এই বিভীষিকাময় গল্পের শেষ পাতাগুলোতে দেখছি, ইজরায়েল ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের মিশরের সীমান্ত-সংলগ্ন নয় মাইল ব্যাপী ছোট্ট এক সরু ভূখণ্ডে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে খাবারের লোভ দেখিয়ে— ঠিক যেমন নাৎসিরা ওয়ারশ ঘেটোর ক্ষুধার্ত ইহুদিদের প্রলোভন দেখিয়ে ডেথক্যাম্পের ট্রেনে তুলত। লক্ষ্য, অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের খেতে দেওয়া নয়, কেউ বিশ্বাস করে না যে সেখানে পর্যাপ্ত খাবার বা সাহায্য পৌঁছাবে। লক্ষ্য হল, তাদের ঘেরাটোপে আটকে রেখে বিতাড়ন করা।
এরপর কী হবে? ভবিষ্যৎ অনুমান করা আমি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু গাজার এই কসাইখানায় একটা চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় আসন্ন। আমরা ইতিমধ্যেই তা দেখতে পাচ্ছি—খাবারের প্যাকেটের জন্য হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে ইজরায়েলী ও মার্কিন কন্ট্রাক্টরদের গুলিতে অন্তত ১৩০ জন নিহত এবং সাতশোর বেশি আহত হয়েছে, মাত্র আট দিনের মধ্যে। নেতানিয়াহু গাজায় আইএস-সমর্থিত গ্যাংগুলিকে অস্ত্র দিচ্ছে যারা খাদ্য সরবরাহ লুট করছে। ইজরায়েল ইতিমধ্যেই ইউএনআরডব্লিউ-এর কর্মী, ডাক্তার, সাংবাদিক, সরকারি কর্মচারী ও পুলিশদের টার্গেট করে হত্যা করেছে — এক কথায় পুরো নাগরিক সমাজকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
আমার ধারণা, ইজরায়েল মিশর সীমান্তের বেড়া লঙ্ঘন করতে ঘুরিয়ে সাহায্য করবে। হতাশ ফিলিস্তিনিরা সিনাইয়ের দিকে ছুটে পালাবে। হয়ত পালাটা অন্য কোনোভাবে শেষ হবে। কিন্তু খুব শীঘ্রই শেষ হবে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সহ্যের সীমা শেষ হয়ে গেছে।
আমরা — এই গণহত্যার পূর্ণ সহযোগীরা — বিকৃতমনস্কের মত আমরা আমাদের উন্মত্ত লক্ষ্য অর্জন করব: গাজাকে খালি করে “গ্রেটার ইজরায়েল” সম্প্রসারণ করা। গণহত্যার ক্রম-সম্প্রচারে পর্দা নামবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যেসব ‘হলোকস্ট স্টাডিজ’-এর কোর্স চালু আছে, সেগুলো আসলে ইজরায়েলকে “চিরকালের শিকার” বানিয়ে তাদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার হাতিয়ার মাত্র। “আর কখনও না”-এই মন্ত্র এখন ঠাট্টামাত্র। যাদের গণহত্যা বন্ধ করার ক্ষমতা আছে অথচ করে না, তারা দোষী — এই নীতিটা আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। গণহত্যা এখন রাষ্ট্রীয় নীতি। দুই দলই এর পৃষ্ঠপোষক।
আর বলার কিছু নেই। হয়তো এটাই উদ্দেশ্য — আমাদের বাকরুদ্ধ করে দেওয়া। আমাদের যেন পক্ষাঘাত হয়েছে। হ্যাঁ, সেটাই উদ্দেশ্য, আমাদের বিকল, পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেওয়া। কে না দুঃখে-ভয়ে শিউরে উঠছে? সেটাও হয়ত পরিকল্পিত। মানুষ নির্বিচারে খুন হয়ে যাচ্ছে, আমরা কিছুই করতে পারছি না। আমরা শুধু অসহায়ের মত আক্রমণ দেখে যাচ্ছি। গণহত্যা এখন দৃশ্যের অবতারণা করে শুধু।
আমি আর ছবিগুলো দেখি না। কাপড়ে জড়ানো শিশুদের লাশের সারি। মুণ্ডহীন নারী-পুরুষের ধড়। তাঁবুর মধ্যে পুড়ে মরা পরিবার। হাত-পা হারানো বা অসাড় হয়ে যাওয়া শিশুরা। ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে বার করা লাশের মুখে সাদা ধুলোর মুখোশ। শোকের কান্না। ক্ষুধায় শুকনো মুখ। আমি আর দেখতে পারি না।
এই গণহত্যা আমাদের বারেবারে তাড়া করে ফিরবে। সুনামির মত শক্তি নিয়ে সে ইতিহাসের দরজায় দরজায় আঘাত হানবে। চিরদিনের মত সে ভাগ করে দিল আমাদের। ফিরে যাওয়ার আর পথ নেই।
এই গণহত্যাকে আমরা কীভাবে স্মরণ করব? সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে।
একবার এই পর্ব শেষ হলে, যারা এই গণহত্যাকে সমর্থন করেছে, যারা মুখ ঘুরিয়ে থেকেছে, যারা কিছুই করে নি, তারাই ইতিহাস লিখবে, তাদের ব্যক্তিগত জীবনকথাও লিখবে। যুদ্ধের পর জার্মানিতে কেউই নিজেকে নাৎসি বলে স্বীকার করত না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বর্ণবিদ্বেষী ‘সেগ্রিগেশন’ যখন বন্ধ হয়ে গেল, তখন আর ক্লু ক্লাক্স ক্ল্যানের কোন সদস্যকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সবাই নির্দোষ! এমনকি তারাই অত্যাচারের শিকার ! এবারও তাই হবে। আমরা ভাবি, আমরা হলে অ্যানা ফ্র্যাঙ্ককে বাঁচাতাম। কিন্তু সত্যি কথা হল, ভয়ে জড়সড় হয়ে প্রায় সবাই শুধু নিজেকেই বাঁচাই, অন্যকে বলি দিয়েও। হলোকস্টের আসল শিক্ষা এটাই। কিন্তু এ সত্য মানতে কষ্ট হয়। তাই এটা মুছে ফেলা ভালো।
ওমর এল আক্কাদ তাঁর বইতে (One Day, Everyone Will Have Always Been Against This) লিখেছেন:
“পৃথিবীর অন্য প্রান্তে যদি কোনো ড্রোন একজন নিরীিহ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়, আমরা কে-ই বা প্রতিবাদ করব? কী হবে যদি সে সত্যিই সন্ত্রাসী হয়? যদি তাকে ‘বাই ডিফল্ট’ সন্ত্রাসী বলে ধরেই নেওয়া হয়, আর আমরা যদি ‘সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থক’ বলে চিহ্নিত হই, গালি খাই, সমাজচ্যুত হই? মানুষ সাধারণত সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ ঘটনার ভয়েই নিশ্চুপ থাকে। কারও কাছে সবচেয়ে খারাপ হলো মিসাইল আক্রমণে তার বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, তার সমস্ত জীবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া, আর, এই সবকিছুই “ন্যায্য” হিসেবে পার পেয়ে যাওয়া কারণ, কিছু না করা সত্ত্বেও, আক্রমণে যারা মারা গেছে, তারা মারা গেছে বলেই ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আবার, কারও কাছে সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনা হল — গালি খাওয়া।”
মানুষকে ধ্বংস করে দাও, ২০ মাস ধরে বোমা বর্ষণ করে তার বাড়ি-গ্রাম-শহর উড়িয়ে দাও, লক্ষাধিক নিরপরাধ মানুষ হত্যা করো, অবরুদ্ধ করে ক্ষুধার্ত করো, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাস করা ভূমি থেকে তাড়িয়ে দাও — আর প্রতিশোধের আশা করবে না? গণহত্যা শেষ হবে। কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জবাব শুরু হবে। ইতিহাস আর মানুষের স্বভাব সম্পর্কে যার কিছুমাত্র ধারণা আছে, সে-ই একথা বুঝতে পারবে। ওয়াশিংটনে দুই ইজরায়েলি কূটনীতিকের হত্যা আর কলোরাডোতে ইজরায়েল সমর্থকদের ওপর হামলা শুধু শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
নাৎসিদের সোবেবর ডেথ ক্যাম্পে যখন বিদ্রোহ হয়, চাইম এঙ্গেল এক গার্ডকে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করেছিলেন। বহু বছর পরে তিনি বলেছিলেন:
“এটা কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। আমি ভেবেছিলাম, ‘যাই হোক, করেই ফেলি।’ আমি গেলাম আর ওই জার্মানকে হত্যা করলাম। প্রতি ছুরির খোঁচায় আমি বললাম, ‘এটা আমার বাবার জন্য, এটা আমার মায়ের জন্য, এটা তুমি যেসব ইহুদিকে হত্যা করেছ তাদের জন্য।'”
ফিলিস্তিনিরা কি আলাদা হবে? যারা তাদের বাবা-মা, সন্তান, সম্প্রদায়কে হত্যা করল, ভূমি দখল করল, শহর ধ্বংস করল — তাদের প্রতি ঘৃণা না জন্মে থাকবে কীভাবে?
এই গণহত্যা ফিলিস্তিনিদের কী বার্তা দিল? গোটা দক্ষিণ বিশ্বকে কী শিখাল?
স্পষ্ট বার্তা: তোমাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। মানবাধিকার আইন তোমাদের জন্য নয়। তোমার কষ্ট, তোমার শিশুর মৃত্যু — কিছুই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমরা কীটাণুকীট। তোমরা নগণ্য। তোমাদের মরতে হবে, ক্ষুধার্ত হতে হবে, ভিটেমাটি ছাড়তে হবে। পৃথিবী থেকে মুছে যাওয়াই তোমাদের ভাগ্য।
ওমর এল আক্কাদ লিখেছেন:
“সভ্য বিশ্বের মূল্যবোধ রক্ষা করতে হলে লাইব্রেরি পোড়াতে হবে। মসজিদ উড়িয়ে দিতে হবে। জলপাই গাছ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পালিয়ে যাওয়া নারীদের অন্তর্বাস পরে ছবি তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করতে হবে। গয়না, শিল্পকলা, খাদ্য—লুট করতে হবে। শিশুদের শাকসবজি তোলার জন্য গ্রেফতার করতে হবে। পাথর ছোঁড়ার জন্য গুলি করতে হবে। বন্দীদের শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরিয়ে রাস্তায় ঘোরাতে হবে। একজনের দাঁত ভেঙে টয়লেট ব্রাশ মুখে গুঁজে দিতে হবে। ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত একজনের উপর কুকুর ছেড়ে দিয়ে তাকে মরতে দিতে হবে। নইলে অসভ্য বিশ্ব জিতে যাবে।”
আমার বহু বছরের পরিচিত অনেকের সঙ্গে আমি আর কোনদিন কথা বলব না। তারা জানে কী হচ্ছে। কে না জানে? কিন্তু তারা সহকর্মীদের বিরাগভাজন হতে চায় না, “ইহুদিবিদ্বেষী” তকমা খেতে চায় না, চাকরি বা সামাজিক মর্যাদা হারাতে চায় না। তারা ফিলিস্তিনিদের মতো মৃত্যুর ঝুঁকি তারা কেন নেবে? তারা ঝুঁকি নেয় তাদের গড়ে তোলা মিথ্যা প্রতিপত্তি আর সম্পদের। এগুলোই তাদের ঠাকুরদেবতা। তারা এই প্রতিমার সামনে মাথা নোয়ায়। পূজা করে। তারা এই ঠাকুরের দাস।
সেই মূর্তির পায়ের নীচে পড়ে আছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মানুষের লাশ।
_______________
ক্রিস হেজেস পুলিৎজার পুরস্কার–বিজয়ী সাংবাদিক ও লেখক যিনি পনেরো বছর ধরে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিদেশী সংবাদদাতা ছিলেন।
মূল ইংরেজি লেখা এখানে পড়ুন।
অনুবাদ : অগ্নিশ্বর
এইরকম একটি রাষ্ট্র দ্বারা নারকীয় হত্যালীলা র কোন ব্যাখ্যা ই খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আমরা অসহায় এর মতো তাকিয়ে দেখবো । একটা দেশ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। সত্যি ই লজ্জা।