রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের সামনে গত ২০ এপ্রিল থেকে অবস্থানে বসেছিলেন রাজ্য সরকারের ‘প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি’র অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বাতিল হওয়া ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের যোগ্য প্রার্থীরা। শিক্ষকদের পক্ষে একটি রায় কিছুটা সাময়িক স্বস্তি তৈরি হয় যে তারা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে পড়াতে পারবেন ও বেতন পাবেন। কিন্তু এর থেকে বাদ পড়ে যান অ-শিক্ষক কর্মীরা। চাকরি হারানো গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি শিক্ষাকর্মীদের অনিশ্চিত জীবন নিয়ে সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।
ভাষাহীন চোখে অবস্থান আন্দোলনের এক কোণে বসেছিলেন ঈশানী কুন্ডু। “সত্যি কথা বলব চাকরিটা যে নেই এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এখানে বসে আছি মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। মনে হচ্ছে আবার স্কুলে যাব, চাকরিটা আবার অ্যাজ ইট ইজ করব। গত মার্চ মাসে এই ডিরোজিও ভবনে আমি স্কুলের কাজ নিয়ে এসেছি আর আজ তার সামনে অবস্থানে বসে আছি, মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি,” কথাগুলো বলতে বলতে ঈশানী কান্না চেপে রেখেছিলেন, মুখে যে বিষণ্ণ হাসিটা ছিল, তা ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তায় ম্লান।
সল্টলেক করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ডের বেশ অনেকটা আগে থেকেই পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। ডিরোজিও ভবন অর্থাৎ রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের সামনে গত ২০ এপ্রিল থেকে অবস্থানে বসেছিলেন রাজ্য সরকারের ‘প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি’র অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বাতিল হওয়া ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের যোগ্য প্রার্থীরা। গত ২৩ এপ্রিল বিকেলে অবস্থান স্থলের দিকে যাওয়ার সময়ে দু’জন অবস্থানকারীর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হওয়ায় যখন জানতে চাইলাম, “দাদা, আপনারা কী অ-শিক্ষক কর্মী?” হাসি মুখেই একজন উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ দিদি, ও দিকে আপার ক্লাস (শিক্ষকদের অবস্থানের দিকে দেখিয়ে), এদিকে আমরা লোয়ার ক্লাস।”
সরকারী দুর্নীতির কারণে যোগ্য প্রার্থীরা যখন নিজেদের যোগ্যতায় পাওয়া চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য আন্দোলনে শামিল হয়েছেন, বিভিন্ন সূত্রে যখন কিছুটা হলেও জানা-বোঝা গেছে যোগ্য শিক্ষকদের সংখ্যা, তখন ৩৩৯৩ জন গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি শিক্ষাকর্মীদের অবস্থা ও আন্দোলন অনেকটাই সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে।
গত ১৭ এপ্রিল এমএ ফাইলিং-এর মাধ্যমে রাজ্য সরকার শিক্ষকদের পক্ষে একটি রায় নিয়ে আসে ও কিছুটা সাময়িক স্বস্তি তৈরি হয় যে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে যেতে পারবেন ও বেতন পাবেন। কিন্তু এর থেকে বাদ পড়েছেন অ-শিক্ষক কর্মীরা, তাঁদের জন্য কোনো এমএ ফাইলিং করা হয়নি, তাঁদের কাজে যাওয়া বন্ধ, বেতন আগামী মাস থেকেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং চাকরি বহাল থাকার কোনো খবরও নেই। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতির সঙ্গে তাঁদের কথা বলার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়ার বিষয়েও চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা। সাত বছর চাকরি করে, দীর্ঘ পথ ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করা, কাজের ক্লান্তি, পড়াশোনা থেকে দূরে থাকা সব মিলে নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে সফল হওয়া নিয়ে প্রায় সকলেই অনিশ্চিত, তাছাড়া অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন যে সেই পরীক্ষাতেও যে দুর্নীতি হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়!
২৬ এপ্রিল দূরভাষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দিয়েছেন যতদিন না মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে ততদিন গ্রুপ সি কর্মীদের মাসে ২৫০০০ ও গ্রুপ ডি কর্মীদের মাসে ২০০০০ টাকা দেওয়া হবে সামাজিক সুরক্ষা খাতে। এই সাময়িক অর্থনৈতিক সুরাহাকে অনেকেই ভাতা হিসাবে দেখছেন যা আদৌ শিক্ষাকর্মীদের চাকরির বেতনের সম্মানের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তাছাড়া এক্ষেত্রে যোগ্য-অযোগ্যের ভাগ করা হয়নি এবং রিভিউ পিটিশনের পরে আবার এক অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরির সম্ভাবনাই থাকছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষাকর্মীরা জানালেন যে আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা নিজেদের দাবির পাশাপাশি তাঁদের দাবিরও পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরাও যাতে চাকরি ফিরে পান তারজন্য আন্দোলনকে একইসঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছেন। দেখা গেল শিক্ষকদের নেতৃত্ব এসে তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন, যে শিক্ষাকর্মীরা আন্দোলনে বসেছেন তাঁদের কারোর কারোর স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা/শিক্ষক এসে আন্দোলনে সমর্থন ও সংহতি জানাচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি-র যোগ্য কর্মীরা নিজেদের আলাদা ব্যানার তৈরি করে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। তাঁদের মোট আট জন কর্মী অনশন করছেন, যাঁর মধ্যে একজনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ২৩ তারিখ সকালে হাসপাতালে ভর্তিও করতে হয়।
অ-শিক্ষক কর্মীদের নির্দিষ্ট দাবি – শিক্ষকদের মতো তাঁদেরও ৩১ডিসেম্বর পর্যন্ত ইন্টারিম রিলিফ দেওয়া হোক ও তারপর রিভিউ পিটিশন-এর মাধ্যমে প্যানেল বাঁচিয়ে সসম্মানে তাঁদের নিজেদের কাজের জায়গা ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
২০-৩০ হাজারের মাসিক বেতন এই কর্মীদের, দায়িত্বে থাকে স্কুলের দৈনন্দিন যাবতীয় অফিশিয়াল কাজের। শিক্ষকদের এক থেকে দেড় ঘন্টা আগে যেমন তাঁদের স্কুলে ঢুকতে হয়, তেমনি সব কাজ শেষ করে বেরোতে হয় তাঁদের প্রায় এক ঘন্টা পরে। অবস্থান স্থলে শিক্ষাকর্মীদের সমর্থনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে একজন শিক্ষিকা যেমন বলছিলেন, “ক্লাস শুরু বা শেষের ঘন্টা কিন্তু কোনো টিচার গিয়ে দেবেন না। আপনাদের ছাড়া আমাদের একটা দিনও স্কুলে চলবে না।“
৩৪ বছরের কাকলি রায় উত্তর ২৪ পরগণা জেলা থেকে হুগলির চন্দ্রাহাটি বিশ্বনাথ স্মৃতি গার্লস হাইস্কুলে গ্রুপ সি পদে চাকরি করতে যেতেন। “স্কুলটাকে ভালবেসে চাকরি করেছি। আজ আমার স্কুলের এইচএমও এসেছেন, বললেন আমি না থাকায় কতটা অসুবিধা হচ্ছে। আমাকে বারবার ফোন করে কত কিছু জানতে হচ্ছে। আমরা কাজের জায়গায় এফিশিয়েন্ট প্রমাণিত কিন্তু সরকারের কাছে অযোগ্য, নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে! ৭ বছর চাকরি করে কোনো সিকিওরিটি পেলাম না। যদি জানতাম এটা ইন সিকিওর্ড চাকরি তাহলে ৭ বছরে অন্য চাকরির চেষ্টা করতাম। স্কুল, বিশেষত গার্লস স্কুল বলে পরিবারও অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকে। আজ সেই পছন্দের চাকরিটাই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে,” বললেন তিনি।
কাকলির বাবা মারা যান ক্লাস এইটে পড়তে, তিনি কোনো চাকরি করতেন না। তাঁর মা বহু কষ্টে তাঁকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করেন। আজ তাঁর মা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী, দু’বার স্ট্রোক হয়ে গেছে। “আমার মা কখনো চায়নি তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে, বরং চেয়েছে আমি যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াই। আমিও চাকরি করে মা-কে একটূ আনন্দের মুখ দেখাতে চেয়েছি। আমি এমএ পাশ করে মাধ্যমিক পাশের চাকরি করছি কারণ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকরি নেই। এত লড়াই করে ১৯ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে, অযোগ্যরা চাকরি পাওয়ার পরেও যখন আমরা চাকরি পেয়েছি তার মানে আমরা যোগ্যতম। আমাদের যে সামাজিক সম্মানহানি হল, আমাদের যে স্কুলে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হল তার মূল্য কে দেবে? আর যে প্রতিষ্ঠান নিজেই অযোগ্য সে আবার আমাদের যোগ্যতার পরীক্ষা নেবে? এই রাজপথে, খোলা আকাশের নীচে আমরা কেন রাত কাটাব? আমি অতি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে চাকরি পেয়েছি। টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার কলঙ্ক আমি কেন নেব? পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক হয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকরি করাটাই কি আমার অপরাধ? চোরেদের বাঁচানোর প্রচেষ্টাই এখনো চলছে। চোরেদের বাঁচাতে গিয়ে হাজার হাজার যোগ্য মানুষ পথে বসে আছি। একজন মুখ্যমন্ত্রী কী করে বলতে পারেন যোগ্য অযোগ্য জেনে কী করবেন! এটা জানতে চাওয়া আমাদের অধিকার। আমরা কেন অযোগ্যদের ভিড়ে মিশে থাকব? আমাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন কেন উঠবে? এরকম হলে তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্ম আর সত্যিই এ রাজ্যে লেখাপড়া করে কী করবে, সরকারি চাকরি যদি ইন্সিকিওর্ড হয়? তাহলে সবাই চপ-ই ভাজবে। আমরা জানতাম লেখাপড়া করলে চাকরি পাওয়া যায়, আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কীভাবে বলব, লেখাপড়া করো, চাকরি পাবে, সেই মুখটাই তো রইল না।“
তিনি দ্বিধায় আছেন আন্দোলন কতদিন চালানো যাবে তা নিয়েও। কারণ সকলকেই সংসার-পরিবার চালানোর জন্য উপায় খুঁজতে হবে। “পেট ভরলে তবেই তো লড়াই করতে পারব। কতজনের বাচ্চার খাবার জোগাড় করতে হবে, মা-বাবার ওষুধের জোগাড় করতে হবে। এখন এতদিন পর আবার রোজগারের জন্য পথে নামতে হবে আমাদের। কে আমাদের কাজ দেবে এখন? এত হাজার বেকারকে কে চাকরি দেবে?”একটানা বলে চলেন কাকলি।
হুগলির আরামবাগের মৈগ্রাম হাইস্কুলের গ্রুপ সি-র ক্লারিকাল স্টাফ অচিন্ত্য মল্লিক বললেন, “সরকার বুঝতে পারছেন না আমাদের গুরুত্ব। কিন্তু সরকার যদি অনুধাবন করেন, সরকারের মাথায় ইউনিসেফ-এর যে মুকুটটি রয়েছে, কন্যাশ্রী-র – সেটা কিন্তু আমরাই ফাইনালাইজ করি। স্কুলে প্রতিদিনের কাজ, সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া সবটা আমরা করি। আমরা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমাদের ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থা অচল। সরকারি ভাষা ও কোর্টের ভাষায় আমরা যোগ্য – ৩৩৯৩ জন গ্রুপ সি ও ডি স্টাফ। আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যালিগেশন নেই। দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই আমাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছেন, আমাদের ক্লিন চিট দিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্ট-এর রায়ের ৪৬ নম্বর পয়েন্টে লেখা আছে ‘নট স্পেসিফিকালি টেইন্টেড’, অথচ সরকারের আমাদের নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। আমরা কোনো ভাতা চাই না। আমরা চাই আমাদের যোগ্যতার সম্মান আপনারা আইনের মাধ্যমে ফিরিয়ে দিন।“
আন্দোলনকারী অ-শিক্ষক কর্মীদের কাছে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কোথাও না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কখন ও কীভাবে এই মামলার ‘পার্টি’ হলেন। হাইকোর্টের রায় বেরোনোর এক মাস আগে তাঁদের পার্টি বানানো হয়। এর আগে তাঁদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কী অভিযোগ তা তাঁরা জানতেন না। হাইকোর্টে প্যানেল বাতিল হওয়ার পর, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে পার্টি হন।
“সাত বছর চাকরি করে আমরা আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনাগুলো সেই মতো সাজিয়েছি। এখন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণে প্যানেল বাতিল হলে, আমরা কেন চাকরি খোয়াবো? একই চাকরির জন্য আমরা কেন আবার পরীক্ষা দেব? সরকার ব্যবস্থা করুক কীভাবে আমাদের সকলকে নেবে। সরকারের কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ, আমাদের কাছে ধোঁয়াশা। আমরা পরিষ্কারভাবে জানতে চাই আমাদের নিয়ে ওনাদের কী চিন্তা-ভাবনা। আমরা চাই মুখ্যমন্ত্রী আসুন, তিনি তো প্রশাসনিক অভিভাভক। উনি এসে আমাদের সমস্যার সমাধান করুন। ওনার মানবিক মুখ আমরা দেখতে চাই। আমরা তো আপনারই সিস্টেমের অংশ। আপনাদের প্রকল্পগুলোই তো আমরা বাস্তবায়ন করছি। তাহলে আমরা ডিভ্রাইভড হচ্ছি কেন?” স্পষ্ট বললেন অচিন্ত্য।
মিন্টু চৌধুরি, ডানকুনির গরালগাছা হাইস্কুলে মগরা থেকে যাতায়াত করে চাকরি করেন। বাড়িতে মা-বাবা, ভাই, কাকা-কাকিমা এবং পুরো পরিবার তাঁর আয়ের উপর নির্ভরশীল, রয়েছে হাউজ বিল্ডিং লোন। “গতকাল (২২ এপ্রিল) পুরো পরিস্থিতিটা স্পষ্ট হয় যে আমরা আর স্যালারি পাব না। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়েছে। এর থেকে মনে হচ্ছে মরে গেলে ভালো হত। যখনই এটা শুনলাম মনে হল পরের মাসে সার্ভাইভ কীভাবে করব? মা-বাবাকে কী করে খাওয়াব? লোনের ইএমআই কী করে দেব? কিচ্ছু সেভিংস নেই। আমরা হলাম ইকোনমিকালি উইকার সেকশন,” বললেন তিনি। তিনি আরো বললেন যে, সরকারের দোষে, তার দুর্নীতিতে যোগ্যতার নিরিখে পাওয়া চাকরি হারিয়ে তাঁরা রাস্তায় এসে বসতে বাধ্য হয়েছেন, বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন – এর দায় বর্তায় সরকারের উপরে, সুতরাং কীভাবে আইনি পথে সুরাহা বের করতে হবে সে দায়িত্বও সরকারের, তাঁদের যে বেতন তা তাঁদের দিয়ে যেতে হবে, যেখানে চাকরি করছিলেন সেখানে কাজে ফেরাতে হবে। তাঁদের আইনজীবির সঙ্গে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা অবস্থান-বিক্ষোভের কারণে কিছুটা থিতিয়ে গেলেও যেহেতু রিভিউ পিটিশন-এর কথা ভাবা হচ্ছে, তাই তা আবার পুরোদমে শুরু হবে বলেও জানা গেল।
শিক্ষাকর্মীদের চাকরি হারানো ও আন্দোলন বেশি করে সামনে আসছে না কেন? “সমাজে আমরা বরাবর ডিপ্রাইভড (বঞ্চিত)। গ্রুপ সি, ডি! এটা আবার কোনো পোস্ট হলো? কেরানি! পিওন! এটা কোনো পোস্ট! এদের কী ভ্যালু আছে? সেইজন্যই আমাদের খবর সামনে আসে না,” সাফ জানালেন মিন্টু। শিক্ষকেরা সংখ্যায় বেশি হওয়াটাও কি কারণ? তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন, “না, সংখ্যাটা অ্যাকচুয়ালি ম্যাটার নয়। তোমার ভেতরের ইনার পাওয়ারটা সংখ্যা দিয়ে হয় না। অল্প লোক দিয়েও অনেক বড় কাজ করা যায়। আমরা যে সংখ্যাটা আছি যথেষ্ঠ, তা দিয়ে আমরা অনেক কিছু করতে পারি।”\
এখন ৪৭ বছর বয়স ধনঞ্জয় দত্তর। বাড়িতে স্ত্রী, দুই বছর বয়সী ছেলে, মা, দাদা, ভাই। বাঁকুড়ার গঙ্গাজলহাটি হাইস্কুলের কর্মী। আবার পরীক্ষা দিয়ে চাকরি টিঁকিয়ে রাখা প্রসঙ্গে বললেন, “চাকরি করছি সাত বছর হয়ে গেল। যখন পরীক্ষা দিয়েছিলাম তখন বয়স ছিল ৩৮। তখন বিয়ে-থা হয়নি, সংসারের কোনো চাপ ছিল না। এখন সংসারের চাপ, মা অসুস্থ, আমার নিজের হার্টের একটু সমস্যা, সুগার ইত্যাদি। পরীক্ষা দেওয়ার মতো মানসিক পরিস্থিতি আছে? এখন আমি সংসার কী করে চালাবো? সব কেটেকুটে ১৪০০০ টাকা পেতাম, খুব মুশকিল করে সংসার চালাতাম। এখন সেটাও বন্ধ করে দিচ্ছে।“মানসিক চাপ সামলাচ্ছেন কী করে? “প্রচন্ড মানসিক চাপ দিদি। যেদিন চাকরি চলে যায়, আমার হাত-পা পুরো কাঁপছে। আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে পারছিলাম না। বাড়ির লোক এসে ফেরত নিয়ে যায়,” জানালেন তিনি।
হাওড়ার জোরহাট ফকিরচাঁদ হাইস্কুলের কর্মী অর্পণ বাগানি শিক্ষাকর্মীদের প্রতি সরকারের অনীহার কারণ হিসাবে বললেন, “আমার মনে হয় এক্ষেত্রে সরকার ওদের বাঁচিয়ে দিয়ে দেখাতে চাইবে যে বেশিটাকেই আমরা বাঁচিয়ে দিলাম। আমরা তুলনায় সংখ্যায় কম। শিক্ষকেরা ১৫০০০+, আমরা ৩০০০+, আমরা অনেক বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থীর মধ্যে দিয়ে পাশ করে নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছি। অথচ সরকার বলছে আমাদের ক্ষেত্রে না কি দুর্নীতির হার বেশি। তার দায় কি আমাদের? আমরা শুধু যোগ্য নয়, যোগ্যতম। আমাদের জলাঞ্জলি দিলে আর কী! আমাদের তো লোকবল নেই, গলার জোর নেই। শক্তি আছে। কিন্তু লোকসংখ্যা তো সত্যিই কম, কী করব। এখানে অবস্থানে তো সবাই এসে পৌঁছাতে পারছে না।“অর্পণের বাড়িতে মা-বাবা আর স্ত্রী। অকপটে বললেন, “বাড়িতে থাকলে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমার মা, স্ত্রী-র মুখটা দেখলে চিন্তা হয় যে কী করব পরের দিন, অসহায় লাগে। এই মাস যাহোক করে চলে গেল। পরের মাসে তো টাকাটা পাব না, কী করে চালাব? (গলা বুজে আসে অর্পণের) ২৬ বছরে চাকরি পেয়েছি, এখন ৩৪ বছর বয়স। ৭ বছর পড়াশোনার সঙ্গে টাচে নেই। যখন ছিলাম, যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চাকরি পেয়েছি। এখন ছ’মাসে, তিন মাসে প্রিপারেশন নিয়ে আবার পরীক্ষা দিয়ে একই চাকরি পাওয়া সম্ভব? (একটানা বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন তিনি)। আমি অনেকগুলো কম্পেটেটিভ পরীক্ষায় পাস করে শেষ মুহূর্তে সফল হতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত এই চাকরিটি পাই। সরকারি চাকরি! নিশ্চিন্ত যে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত ভালোভাবে চাকরি করব। আমার মা-বাবা আমাকে নিয়ে গর্ব করত যে একটা পয়সা দিতে হয়নি, আমাদের ছেলে নিজের যোগ্যতায় চাকরিটা পেয়েছে। আজ সেই গর্বটা চলে গেল।“ তাঁর বাবার মাস দুয়েক আগেই হার্ট অপারেশন হয়েছে, খরচ হয়েছে ছ’ লক্ষ টাকা, “ঘটনা শোনার পর বাবা বলছেন আমার বুকে যন্ত্রণা করছে, আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে যে আমি কী করব! আমার মুখ দেখে বাড়ির সবাই চিন্তা করছে। সেইজন্যই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছি। শিক্ষামন্ত্রী যা নয়, তাই বলছেন, কথা বলতে তো ট্যাক্স লাগে না। স্কুলে আমাদের দায়িত্ব কম নয়, আমরাও একেকটা স্তম্ভ। শিক্ষক ছাত্রছাত্রী তৈরি করে, কিন্তু স্কুলে তালা দেওয়া, রেজিস্ট্রেশন করানো সেগুলোও কাজ। সেখানে আমাদের সঙ্গে দ্বিচারিতা করা হচ্ছে। এখন যেন আমাদের মনে হচ্ছে আমাদের এই ৩৩৯৩ জনের চাকরিটা চলে গেছে, বৃত্তটা ছোট হয়ে যাচ্ছে। এই কষ্টটাই উনি দিতে চাইছেন। উনি জানেন কোনো আন্দোলন কীভাবে ধ্বংস করতে হয়।“ জানালেন স্কুলের সিনিয়র ক্লার্ক, শিক্ষকেরা নিয়মিত খবর নিচ্ছেন, পাশে আছেন, “ওরা সবাই খুব ভালবাসেন, চিন্তা করছেন, কিনতু আমার চাকরিটা তো চলে গেল বলুন,” বুজে আসা গলায় বলেন অর্পণ।
সুরজিত নস্কর, পুরুলিয়ার ডরোডিহি এইচ জি কে বিদ্যাপীঠ-এর গ্রুপ সি কর্মী, বাড়িতে রয়েছেন মা-বাবা, স্ত্রী, সরাসরি বললেন, “সামনের দিনগুলো অন্ধকার দিদি। টিচারদের তবু একটা হিল্লে হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর অব্ধি মাইনে ঢুকবে, চাকরি আছে, তারপরে পরীক্ষায় যদি পাশ করেন, তাহলে তো রইলই চাকরি, কিন্তু গ্রুপ সি, ডি-র যারা যোগ্য আছি, তাদের কোনো রকম খবর হয়নি। নতুন যে এম এ ফাইলিং হয়েছিল, সেখানে শুধু শিক্ষকদের কাজে যোগ দেওয়ার কথাই বলা হয়েছে, আমাদের কোনো উল্লেখ নেই। নন-টিচিংদের কোনো গুরুত্বই নেই। উকিলরা কী যে করলেন, আমরা কিছু বুঝতেও পারলাম না। সরকারি চাকরি পেয়ে যে সাত বছর পর এমন হতে পারে আমরা ভাবতেই পারছি না। এখন আমাদের আরো চিন্তা যদি আমাদের পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেয়, আমাদের প্রভিডেন্ট ফান্ডটাও হয়তো ফেরত দেবে না। এখন চাকরি খুইয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, তখনো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। শুধু আন্দোলন করে যাওয়া।“জানালেন, বাড়িতে সকলেই ভেঙে পড়েছেন। গত বছর তাঁর বাবার স্ট্রোক হয়েছিল, স্বভাবতই দুশ্চিন্তায় আছেন, মায়ের সদ্য অপারেশন হয়েছে – ভবিষ্যত নিয়ে চূড়ান্ত অনিশ্চিত পরিস্থিতি।
তিনি বললেন, শুরু থেকেই শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলনে থাকলেও এবং দু’পক্ষের বোঝাপড়া থাকলেও আলাদা ব্যানারে আন্দোলন চালানো জরুরি নিজেদের চিনিয়ে দেওয়ার জন্য, “সমাজের অর্ধেক মানুষ জানেই না স্কুলে আমরা থাকি, কতটা জরুরি কাজ সামলাই। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সেই কথাই পৌঁছে দিতে চাই যে আমাদের সঙ্গে কতটা বঞ্চনা হয়েছে। আমাদের কষ্টটা কাদেরকে বোঝাবো?”
সামাজিক সম্মান যে প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকছে জানালেন সেকথাও। যেহেতু যোগ্য প্রার্থীদের কোনও তালিকা সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি তাই পাড়া-প্রতিবেশীরা চাকরি যাওয়ায় সন্দিহান হয়ে পড়েছেন ও নানা গুজবও ছড়াচ্ছে। সরকারি চাকরি এক নিমেষে চলে যাওয়ার এই সম্মানহানির ট্রমা চাকরি হারানো শিক্ষাকর্মী ও তাঁদের পরিবারের পক্ষে ক্রমশই অসহনীয় হয়ে উঠছে।
মালদার খাসখোল হাইস্কুল থেকে এসেছেন পারুল খাতুন, বাড়িতে রয়েছেন স্বামী, স্ত্রী, শাশুড়ি আর দুই ছেলে। পড়াশোনার জন্য দুই ছেলেকে রেখেছেন মিশনে। পারুল-ই সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী। কেমন এক ভীত-বিধ্বস্ত চোখ-মুখ, চাকরি হারানোর আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেননি যেন বা। কথা শুরু হতেই চোখের জল বাঁধ মানল না, “যেদিন শুনলাম মনে হল সব শেষ হয়ে গেল। আমি ছেলে দু’টোকে কী করে লেখাপড়া করাব? ১০ লাখ টাকা লোন নেওয়া আছে ব্যাঙ্ক থেকে, বাড়ি করার জন্য। কোনো সঞ্চয়ও নেই, মাইনে পেতাম ২৩৯২৮ টাকা, দু’টো ছেলেকে মিশনে রেখে পড়াই তো, কোনো সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। আমার স্বামী বলেছে, যতক্ষণ না সমাধান হচ্ছে আসবে না তুমি, ওখানেই থাকো। কিন্তু কিছু কি সমাধান হবে? কিছুই বুঝতে পারছি না। এখানে এসে মনে হচ্ছে, যতক্ষণ সমাধান না হচ্ছে, আমরা যাব না, এখানেই থাকব। জয়ের আশাতেই বসে আছি পথে।“
মৌসুমি খাতুন মালদার ফুলবাড়ি জুনিয়র হাইস্কুলের গ্রুপ ডি কর্মী, যেদিন চাকরি চলে যায় সেদিন নিজের ক্লাস টেনে পড়া মেয়েকে জানাতে পারেননি। পরের দিন যখন স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছেন না দেখে মেয়ে জিজ্ঞেস করে, তখন আর সামলাতে পারেননি, “মা, মেয়ে দু’জন গলা জড়িয়ে খুব কেঁদেছি। মেয়ে খালি জানতে চাইছিল, তোমার চাকরিটা কেন গেল মা? তুমি তো যোগ্য ছিলে মা। আমি বলছিলাম, জানি না বেটা,” চোখের জল আটকানোর চেষ্টা বৃথা হয়ে যাচ্ছিল মৌসুমির কথা বলতে গিয়ে। অসহায়তা, আশংকা, অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে শরীরী ভাষা, কথা বলা সবটাই স্নায়ুতে চাপ তৈরি করছে বোঝা যায়। “বাড়িতে ননদ আছে, করোনায় ওর স্বামী মারা গেছেন, আমাদের সঙ্গে থাকেন, স্বামী, মেয়ে আছে, বাবা-মা আছে আমার, আমাকেই দেখতে হয়। আমার হাজব্যান্ড অসুস্থ। প্রতি মাসে ওর ট্রিটমেন্টে ৩০০০ টাকা করে লাগে। আমি মাইনে পেতাম ২২৯০০ টাকা,” কথা বলতে গিয়ে কান্নায় গলা কেঁপে যায় তাঁর, “আমার উপরেই আমার পরিবার নির্ভর। খাব কী? সামনের মাসে স্যালারি না পেলে চলব কী করে? ৫ লক্ষ টাকার লোনের ইএমআই আছে। মেয়ে মাধ্যমিক দেবে, তার টিউশনের খরচ আছে। আমরা জানি না কী হবে, মাননীয়া কী করবেন। আমরা তো লেখাপড়া করে এই জায়গাটায় পৌঁছাতে পেরেছিলাম। ছোট থেকে না অন্য কিছু ভাবিনি। জানি একটা চাকরি করতে হবে। দিশাহারা লাগছে, কিচ্ছূ ভাবতে পারছি না। কতটা সম্মানে লাগছে বলুন তো। এই কলকাতায় আসছি, আবার ঘরে ঢুকে বসে থাকছি, বাইরে বেরোতেই পারছি না। পাড়া-প্রতিবেশী বলছে, “কী কয় লাখ গেছে?” মুখ দেখাতে পারছি না। প্রচন্ড ডিপ্রেসসড লাগছে। তিন রাত ঘুমাতে পারিনি। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ডাক্তার দেখিয়েছি। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হইয়েছে।“
কণিকা সরকার, খড়িগাছি হাইস্কুলের গ্রুপ ডি-র কর্মী জানালেন, বাড়িতে বয়স্ক শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী, দুই সন্তান ৬ ও ১৩ বছরের। স্বামী চাষের জমিতে কাজ করতেন। কণিকা চাকরি পাওয়ার পর বাড়ি সামলাতে তিনি সেই কাজ বন্ধ করে দেন। “গতকাল শুনলাম আমাদের স্যালারি বন্ধ হয়ে গেছে। সামনের মাস থেকে কী খাব? বাচ্ছাগুলোকে কী করে স্কুলে পাঠাব?” কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। অন্য সকলের মতো তাঁরও কোনো সঞ্চয় নেই, অথচ রয়েছে ছ’লাখ টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ। “সরকার তো আমাদের নিয়ে কোনো কথাই বলছে না। কোনো হস্তক্ষেপই করছে না। টিচারদের যতটা অধিকার ততটাই অধিকার আমাদেরও আছে”বললেন কণিকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহিলা অ-শিক্ষক গ্রুপ ডি-র আন্দোলনকারী, এমএ পাশ, জানালেন, “আমি আমার সংসারের মেইন রোজগারী, আমার চাকরি যাওয়ায় আজ আমার সংসার সম্পূর্ণ অন্ধকারে। আমার বাড়িতে স্বামী আর দুই বাচ্চা। থাকি ভাড়া বাড়িতে। টাউনে থেকে আমি ওই স্কুলে বাচ্চাদের আর পড়াতে পারব না। গ্রামে ফিরে গেলে ওরকম স্কুল আর পাব না। কী করব এবার? এরকম রায় কিছুতেই মানতে পারছি না। এই হাল কেন হবে আমাদের? আমাদের জন্য এক্কেবারে এক রায়ে সমস্ত কিছু শেষ। সরকারের উপর আস্থা নেই, কিন্তু কোথায় আস্থা রাখব? বিচারব্যবস্থায় সুবিচার, সমানাধিকার পাবার কথা? সংবিধানের সমানাধিকারের কথা কি আমাদের গ্রুপ সি, ডি-র জন্য নেই? আসলে অর্থনৈতিকভাবে যারা পিছিয়ে থাকে তাদের প্রতি সবারই অবজ্ঞা থাকে, বিচারে আমাদের প্রতিও তাই হল।“
শুরু করেছিলাম ঈশানীর কথা দিয়ে। ডানকুনির শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাশ্রম গার্লস হাইস্কুলের গ্রুপ ডি কর্মী। শান্ত স্বরে কথোপকথনে অংশ নিলেন তিনি। বাড়িতে রয়েছেন মা ও স্বামী। অনেক ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন, মা যথেষ্ঠ পরিশ্রম করে মানুষ করেছেন। ভূগোলে মাস্টার্স করা ঈশানীর বাড়ির পুরো অর্থনৈতিক দায়িত্ব তাঁর উপরে। “আমরা তো গ্রামে থাকি, বাইরে সবাই বলছে ওই যে ২৬০০০ ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছে, তাদের চাকরিগুলো গেছে। সেখানে যে যোগ্যরা আছে, সেটা আর হাইলাইটেড হচ্ছে না। ফলে আমার চাকরি চলে গেছে সেটা বলতেও দ্বিধা লাগছে, অচেনা কেউ মনে করবে তার মানে আমিও ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছি। যারা আমাকে চেনে তারা আজও আগের মতোই ভালবাসে, শ্রদ্ধা-সম্মান করে। আমার স্কুল, গ্রাম সবাই আমার পক্ষেই কথা বলবেন, জানেন আমি দুর্নীতি করতে পারি না। স্কুলের সকলে ভীষণভাবে মানসিক সাপোর্ট দিচ্ছেন,”জানালেন তিনি।
চাকরি পেয়ে লোন নিয়ে একটা বাড়ি করেছিলেন। নিজের গয়না বন্ধক রেখে সেই লোন শোধ করেছেন সদ্য। ম্লান হেসে বললেন, “এবার ওগুলো বিক্রিই করে দিতে হবে বোধহয়। “আমরা গ্রামে যে স্কুলে চাকরি করি সেখানে সবাই প্রথম প্রজন্মের পড়াশোনা করছে। আমরা বলতাম, বাবু পড়াশোনাটা কর মন দিয়ে, তাহলে চাকরি পাবি। মেয়েদের চাকরি পাওয়া, আর্থিক স্বাধীনতা পাওয়াটা খুব দরকার। কত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আমার স্বামীর সঙ্গে আমার বিয়েটা হতে পেরেছে আমার চাকরিটা দেখেই। আমি চাকরি করে বলেই ওর দায়িত্ব নিতে পেরেছি। আমাদের লাভ ম্যারেজ। ও সোশ্যাল ওয়ার্ক করে। আমি চাকরিটা করতাম বলেই ও বিয়েতে রাজি হয়েছে, আমিও বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছি,” নিঃশব্দে স্টিরিওটাইপ ভাঙা ঈশানী তুলে ধরলেন এক বাস্তব ছবি।
“দুর্নীতি হয়েছে বলেই আমি গ্রুপ ডি-র চাকরি পেয়েছি, নাহলে হয়তো গ্রুপ সি পেতাম, হয়তো বাড়ির কাছে পোস্টিং পেতাম। যে দুর্নীতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ আমরা যোগ্যরা কেন দেব? আমাদের যে চাকরি যে পদ ছিল তা সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়ে দিতে হবে। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি আন্দোলনও চলবে” শান্ত, স্থির অথচ ঋজু কন্ঠে বললেন ঈশানী, যা রাজপথে বসে থাকা যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষাকর্মীদের সকলের স্বর হয়ে উঠল যেন।