অ্যডোলেসেন্স পাঠ করে যেটুকু বুঝলাম


  • April 19, 2025
  • (1 Comments)
  • 951 Views

নেটফ্লিক্সের “অ্যাডোলেসেন্স” যুক্তরাজ্যের সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় সিরিজে পরিণত হয়েছে। এই লোমহর্ষক সিরিজটি স্কুল গেট থেকে শুরু করে লন্ডনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত জাতীয় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। “অ্যডোলেসেন্স” সিরিজ দেখে নিজের প্রতিক্রিয়া লিখলেন দেবারতি গুপ্ত

 

 

অ্যাডোলেসেন্স সিরিজটি নিয়ে যুক্তরাজ্যের দুই বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে তর্ক শুরু হয়েছে। কনজার্ভেটিভ-এর বরিস জনসন জানিয়েছেন এটি ইউ কে’র কিশোর প্রজন্ম সম্মন্ধে একটি আদ্যন্ত রঙ চড়ানো ধারণা তৈরি করেছে। টিন ক্রাইমে বিচ্ছিন্ন একটি দুটি ঘটনা হতে পারে কিন্তু এই সিরিজটি যেন বলছে এরকম হামেশাই হয়ে থাকে। তাই এই মিনি সিরিজটি ‘সকলের দেখা উচিত’ গোছের প্রশংসা করে হইচই ফেলে দেওয়ার মতো আদৌ নয়। বরং এই সিরিজটি দেখানো হলে সাধারণের কাছে পাবলিক স্কুল ও ব্রিটেনের সমাজ সম্মন্ধে ভুল বার্তা যাবে। উল্টোদিকে লেবার পার্টির নেতা তথা ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার সিরিজটিকে দেশের পার্লামেন্টে দেখাতে বলেছেন। তাঁর মতো বহু লোকের মতে বর্তমান ব্রিটেনের টিন এজ অপরাধ যেরকম লাগামহীন তা গুরুজনদের মরমে পোষণ করাতে এই অ‍্যাডোলেসেন্স পাঠ করানো আশু কর্তব্য।

 

এই অপরাধের ধরণটি কিরকম? ব্রিটেনের কুখ‍্যাত নাইফ ক্রাইম না অ‍্যান্ড্রু টেট দ্বারা মান‍্যতা পাওয়া মিসোজিনি? ক্রাইম ড্রামা হলেও যেহেতু হু-ডান-ইট জাতীয় থ্রিলার নয় তাই গল্পের আভাস দিলে কিছু ক্ষতি নেই। তাই দেখা যাক একটু বিস্তারে গিয়ে…

 

১৩ বছরের জেমি মিলার-এর (আওয়েন কুপার) ওপর অভিযোগ সে তার সহপাঠিনী কেটিকে কিচেন নাইফ দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে। ডিটেকটিভ ইনস্পেক্টর ল‍্যুক ব‍্যাসকোমব (অ‍্যাশলে ওয়ালটার) খুনের সিসি টিভি ফুটেজ দেখালে জেমির বাবা এডি (স্টিফেন গ্রাহাম) স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে পড়ে। কিন্তু তারপর জেমির পরিবার থেকে শুরু করে পুলিশ এমনকি জেমির সাইকোলজিস্ট ব্রিয়নি (এরিন ডোহার্টি) প্রত‍্যেককেই এই প্রশ্ন তাড়া করে বেড়ায় যে কি হয়েছিল যার জন‍্য জেমি এত ভয়ানক পদক্ষেপ নিতে বাধ‍্য হল?

 

স্টিফেন গ্রাহাম আর জ্যাক থোর্নের বানানো চার এপিসোডের এই মিনি সিরিজের এক একটি পর্ব কম বেশি এক ঘন্টা করে। এক একটি পর্ব এই ঘটনা পরবর্তী সময়ের এক একটি বিচ্ছিন্ন টুকরো। জেমিকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাবার ৩ দিন পর, সাত মাস পর এবং শেষ পর্যন্ত ১৩ মাস পর তার স্কুল – পরিবার ইত্যাদি থেকে বিভিন্ন ‘স্লাইস অফ লাইফ’ তুলে এনে চারটে এপিসোড।

 

প্রথম পর্বে জেমি গ্রেফতার হয়। সিসি টিভি ফুটেজে তাকে খুনি হিসেবে শনাক্ত করা হলেও সে অস্বীকার করে যায়। দ্বিতীয় টুকরোতে আমরা দেখি ডি আই ব্যাসকোমব আর সহকারী ডি এস মিশা ফ্র্যাংক (ফায় মার্সে) জেমির স্কুলে এসেছে। সেই কিচেন নাইফ যেটি কি না মার্ডার ওয়েপন তার খোঁজ করতে। তাদের তদন্ত বলছে, জেমির কাছের বন্ধু রায়ান খুনের কারণ বিষয় কিছু হদিস নিশ্চই দিতে পারে। ব্যাসকোমবদের এই স্কুল পরিদর্শন পশ্চিমী দর্শকদের অবাক করেছে কি না বলতে পারবো না তবে আমার মতো মধ্যবিত্ত বাঙালিকে রীতিমতো শক দিয়েছে। ১৩-১৪ বছরের ছাত্রছাত্রী টিচারের নিষেধাজ্ঞা শুনে মুখের ওপর তাকে ‘ফাক অফ’ বলে দিচ্ছে, ক্লাসে টিচার থাকা অবস্থায় সহপাঠীকে নিরুত্তাপে বুলি করে যাচ্ছে – আর এসবের প্রতিক্রিয়ায় দিশেহারা শিক্ষক শিক্ষিকারা মৃদু আপত্তি জানিয়ে চুপ করে যাচ্ছেন। তাদের চোখে মুখে অসহায়তা আর ‘বলে কোন লাভ নেই’ গোছের অভিব্যক্তি। তদন্তকারী অফিসার ব্যাসকোমব-এর ছেলে অ্যাডাম এই স্কুলেই পড়ে। জেমিদের থেকে এক-দু বছরের বড়ো। ব্যাসকোমব-এর সামনেই অ্যাডাম-এর সহপাঠী ফ্রেডো তাকে নিয়ে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করতে কুন্ঠা করে না। এই অপমান কি ব‍্যাসকোমব কৃষ্ণাঙ্গ বলে না অন‍্য কারণে তা অবশ‍্য পরিষ্কার হয় না। যাই হোক, ভাবটা এমন ওটাই অ্যাডাম-এর পরিচয়, তার পুলিশ বাবারও সেটা জানা উচিত। খুন হয়ে যাওয়া কেটির খুব কাছের বান্ধবী জেড পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিতিবিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ঘর থেকে উঠে বেরিয়ে যায়। অথচ ব্যাসকোমব আর ফ্র্যাঙ্ক খুব শান্ত ও সুষ্ঠুভাবেই ওকে প্রশ্ন করেছিল। আগাগোড়া জেড-এর ভাবটা এমন যে এই পুলিশগুলো তাদের বয়সীদের সমস্যা সম্মন্ধে ওয়াকিবহাল না হয়েই তদন্ত করতে চলে এসেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে পুলিশ – সব বড়োরাই অর্থহীন তার কাছে। তার শিক্ষিকা জেডকে ভদ্র ব্যবহার করতে বললে সে সপাটে উত্তর দেয় – ‘আই অ্যাম নট ফিলিং পোলাইট ট্যুডে’… এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ শিক্ষক সকলের সামনে জেমির বন্ধু রায়ানকে জেড আক্রমণ করে নাক ফাটিয়ে দেয় – জেড-এর অভিযোগ, তার বন্ধু কেটিকে খুনের পেছনে জেমি ছাড়াও রায়ানের হাত আছে। জেড-এর লাথির ঘায় ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া রায়ানের যখন নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে তখন তার এক সহপাঠী ছেলে এসে তাকে টিটকিরি দিয়ে পালায় – ‘শেষে একটা মেয়ের কাছে মার খেয়ে গেলি!’

 

মোটামোটি এই অবধি দেখে আমার মাথা গোলাতে শুরু করে। মনে হতে থাকে এরকম স্কুলের ছেলে মেয়েরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরবে – খুন হবে – জেলে যাবে – সে আর আশ্চর্য কি! তার সঙ্গে এও মনে হতে থাকে আমাদের মতো দেশে স্কুলের বাচ্চারা বোধহয় এত অবাধ্য হবে না। যা করবে মাস্টার, দিদিমণিদের আড়ালে করবে। তাদের মুখের সামনে এই খুলে আম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন আমার কাছে ভিনদেশী না, ভিনগ্রহের মতো ঠেকতে লাগলো!

 

আবার মাথার মধ্যে প্রশ্ন খোঁচা দিতে লাগলো, জেমির অপরাধের ধরণ কি রকম? শুধুই কি ম্যানোস্ফিয়ার-এ ভাসতে থাকা টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি? সাইবার বুলিতে আক্রান্ত ইনসেল (ইনভলান্টারি সেলিবেসি) হতাশা? না আরো স্তর আছে?

 

কিন্তু ভিনগ্রহ দূরে থাক, ভিনদেশ এক্ষেত্রে ব্রিটেনের পাবলিক স্কুল সম্মন্ধে আমার কোন ধারণা নেই। তাই এবিষয় জিজ্ঞাসা করতে ওদেশে বাসকারী ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শুভাশিস দে-কে ফোন করেছিলাম। তিনি জানালেন সে দেশে বেশ কিছু পাবলিক স্কুলের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের এই আচরণ চরম বাস্তব। গ্রামার স্কুলের মতো কিছু স্কুল যেখানে যথার্থ পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করে ছাত্র ভর্তি নেওয়া হয় সেগুলো বাদ দিলে সাধারণ পাবলিক স্কুলের চেহারা অনেকটাই আলাদা। সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আর পারিবারিক গঠন এদের বেড়ে ওঠায় স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব ফেলে। উদাহরণ দিতে গিয়ে শুভাশিস বলেছিল ওর বাড়িতে এক শ্বেতাঙ্গ মেয়ে ঘরের কাজে সাহায্যের জন্যে আসতো। ২৯ বছরের সেই মেয়েটির পাঁচটি সন্তান আছে এবং প্রত্যেকটিই বিবাহ বহির্ভূত। সে সারাদিনের কাজের শেষে শ্রমের গ্লানি লাঘবের জন্যে পাবে গিয়ে বিয়ার খেয়ে রাতে বাড়ি ঢুকতো। তাহলে তার বাচ্চাগুলো সারাদিন কার কাছে থাকে আর কিভাবেই বা মানুষ হয়? কিছু সময় এই ধরণের পাবলিক স্কুলে, বাকি কিছুক্ষণ ক্রেশ-এ। এছাড়া বয়সে বড়ো দাদা বা দিদির ওপর ছোটগুলির দেখাশোনার ভার বর্তায়। আর এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ব্রিটেনের ওয়ার্কিং ক্লাসের মধ্যে একটা বড়ো অংশের শিশু-কিশোর এই রকম নড়বড়ে থেকেও না থাকার মতো পরিবার (ডিসফাংশনাল ফ্যামিলি) তথা সমাজ কাঠামোর মধ্যে বেড়ে উঠছে।

 

ফলে কিশোর-অপরাধের হার উত্তরোত্তর বাড়ছে। কোভিড পরবর্তী সময়ে ওয়ার্কিং ক্লাসের  অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। সরকারের তরফে ইউথ সার্ভিস কমেছে এবং অভিবাসন বাড়ার ফলে মাথাপিছু ছাত্রছাত্রীদের ওপর সরকারী অনুদানের হার বিপুল পরিমাণে কমেছে। ওয়ার্কিং ক্লাস কমিউনিটির মধ্যে এই অকার্যকর পরিবার বিষয়টি নজরে পড়ার মতো। ২০২১-এর একটি জনস্বাস্থ্য রিপোর্ট (ইংল্যান্ড) অনুযায়ী এই ধরণের পরিবারগুলি থেকে আসা প্রায় ৪৭ শতাংশ শিশু ও কিশোর অন্তত এক ধরণের ‘অ্যাডভার্স চাইল্ডহুড এক্সপিরিয়েন্স’ (ACE) এর  শিকার। এর মধ্যে বাবা মায়ের সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউস থেকে শুরু করে পারিবারিক হিংসা (ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স) পড়ে। কিশোর মনোজগত তৈরিতে এই এসিই-র প্রভাব বিরাট। এধরণের শিশুর মধ্যে প্রতি ৫ জনের একজন কিশোর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। এই শিশুরা যখন কৈশোরে পৌঁছায় তখন তাদের মধ্যে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের মাত্রা (সেলফ কনট্রোল স্কোর) অন্যান্য শিশু-কিশোরদের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। ২০২৩-এর ইউথ এনডাওমেন্ট ফান্ডের একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে যেসব এলাকায় স্কুল অনুদান কমিয়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে প্রায় ১৫ শতাংশ কিশোর অপরাধ (জুভেনাইল ডেলিংকোয়েন্সি) বেড়েছে।

 

সে দেশের একটি পাবলিক স্কুল-এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষিকার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়ো হওয়া এই শিক্ষিকা গত তিন বছর হল এরকমই একটি পাবলিক স্কুলে পড়াচ্ছেন। তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা জানালেন। “হ্যাঁ এখানকার কিছু কিছু পাবলিক স্কুলের ছেলেমেয়েরা একদম জেমি, ফ্রেডি, রায়ান আর জেডদের মতোই। আমরা দিশেহারা হয়ে যাই এদের সামলাতে। “ঠিক অ্যাডোলেসেন্স-এর ক্লাস টিচার মিঃ মালিক যেমন বলেছিলেন ব্যাসকোমব-এর কথায়, “দিস কিডস আর ফাকিং ইমপসিবল। হোয়াট আই অ্যাম সাপোসড টু ডু?”

 

সিরিজের তৃতীয় খন্ড বা এপিসোডটি সবচেয়ে বেশি চর্চিত। জেমি সাত মাস হল জেলবন্দি। এখনো ফাইনাল ট্রায়াল হয় নি। ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ব্রিয়নি অ্যারিস্টন (এরিন ডোহার্টি) এসেছেন জেমির মনস্তাত্ত্বিক রিপোর্ট তৈরি করতে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন প্রচুর মার্শমেলো দিয়ে  এক কাপ হট চকোলেট। জেমির প্রিয় সেকথা তাঁর মনে আছে দেখে জেলবন্দি কিশোরের চোখ ঝলমলিয়ে ওঠে। কিন্তু কিছুদূর কথাবার্তা চলার পরেই জেমি ঠাট্টার সুরে ব্রিয়নিকে জানায় যে তার শব্দ চয়ন বলে দেয় সে জেমির তুলনায় অনেক বেশি ‘পশ’। ব্রিয়নি হেসে এড়িয়ে গিয়ে বলে, পশ নয় একটু আলাদা জীবন যাপনে অভ্যস্ত। এরপর আরো শুনে মজা লাগে, যখন মনস্তত্ত্বে টনটনে জ্ঞান নিয়ে ব্রিয়নি জেমিকে জিজ্ঞাসা করে যে তার বাবা কি তার কর্মজগতে খুশি? ১৩ বছরের জেমি চোখ পাকিয়ে পালটা প্রশ্ন করে, “আপনার কি মনে হয়? আমার বাবা তো একজন টয়লেট ক্লিনার!” প্রায় এক ঘন্টা ঘরে বন্দী দুটি চরিত্রকে নিয়ে এই এপিসোডটিতে যত্ন সহকারে ক্লস্ট্রোফোবিয়া তৈরি করা হয়েছে। যা জেমির মানসিক গঠন, স্কুলে মেয়েদের কাছে বিশেষ পাত্তা না পাওয়ার হীনমন্যতা, কেটির কাছে সাইবার বুলির ভিক্টিম হবার আক্রোশ আর সর্বোপরি কিশোর মনে জন্ম নেওয়া জটিল মিসোজিনির সঙ্গে দিব্য খাপ খেয়ে যায়। আমরা টের পেতে থাকি কেমন অতি কষ্টে স্থির হয়ে বসে থাকা জেমি ভিতরে ছটফট করছে।

 

কিন্তু তারপরেও ব্রিয়নির দৃঢ় অনুজ্ঞাবাচক কথার পিঠে ফুঁসে উঠে জেমি যখন বলে ব্রিয়নির কথা শুনতে সে বাধ্য নয়, তখন আমার আবার গুলিয়ে যায়। এটা কি শুধু মিসোজিনি? না কি গ্র্যান্ড ড্যাডকে ‘পপ’, ‘পপ’ বলা ‘পশ’ ব্রিয়নির বিরুদ্ধে টয়লেট ক্লিনার-এর ছেলে ১৩ বছরের জেমির রাগ। এই শ্রেণী বিদ্বেষের পরতে পৌরুষ মিশে আছে ঐতিহাসিক নিয়মে, যা বহু যুগ ধরেও আলাদা করা যাচ্ছে না।

 

আর যদি লিঙ্গ রাজনীতি নিয়েই কথা বলতে হয় তাহলে জেমির মেল গেজ-এর সঙ্গে কেটির মতো মেয়েদের ফিমেল গেজ নিয়েও কথা হওয়া উচিত। যা মেল গেজ-এরই পরিপূরক হয়ে পুরুষতন্ত্রের হাত শক্ত করে তোলে। জেমির আদর্শ পুরুষ হয়ে ওঠার রাস্তায় অনেক বাধা! তার মতে সে বেঁটে, তাই কুৎসিত। বাবার পছন্দ মতো ফুটবল খেলায় তার আগ্রহ নেই বরং ছবি আঁকতে বেশি ভালবাসে। তাই তো কেটির মতো মেয়েদের কাঙ্খিত সে কোনদিন হবে না। তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় – কত রাগ আর ঘৃণা জমা হলে একটি কিশোর বার বার ছুরি বসিয়ে যেতে পারে তার সহপাঠীর শরীরে?! যৌন ঈর্ষা থেকে জন্ম নেওয়া হিংস্রতাই কি একটি কিশোরকে পূর্ণাঙ্গ পুরুষ  হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে দেয়?

 

আবার অর্থনীতিবিদ শুভাশিস দে-র কথায় ফিরে আসি। তার মতে জেমির মতো টিন এজাররা সিস্টেমেটিক বঞ্চনার স্বীকার। যা সিস্টেম মেনে নেবে না কোনদিন। ২০১১ এর পর থেকে ইউ কে-তে নন-ইউরোপীয় অভিবাসন অনেক বেড়ে গেছে। এদের নাগরিকত্ব জুটেছে, কিন্তু সরকারি অনুদান সীমিত। এখানে উল্লেখ্য যে বেম (BAME – Black Asian Minority Ethnic community) গোষ্ঠীকে যেমন মূলধারার সঙ্গে মিশতে দেওয়া হয়নি, ঘেটোবন্দী করে রাখা হয়েছে তেমনি তাঁদের জন্য অনুদানে ভাগ কমে যাওয়ায় শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবীরা অসন্তুষ্ট। তাঁরা নিজেদের ভাগ বাড়াতে এক অনন্য উপায় বের করেছেন। যিনি যত সন্তান উৎপাদন করবে্ন তিনি সেই অনুপাতে মাথাপিছু সাবসিডি পাবেন। আবার এদিকে পারিবারিক শৃঙ্খল শিথিল হবে। তা আমাদের ভারতীয় লিবারালদের কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো শোনাবে ঠিকই কিন্তু যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমরা জীবন কাটাই সেখানে তার সর্বকনিষ্ঠ কিন্তু মজবুত ইউনিট স্বরূপ পরিবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। ফলে জেমিদের মতো সন্তানদের জন্ম হয়, কিন্তু না রাষ্ট্র, না পরিবার, তাদের পালন করার জন্য যথেষ্ট দায়িত্ব কেউ নেয় না।

 

সিরিজের শেষ এপিসোডে জেমির পরিবারের একটি দিনের স্লাইস দেখানো হয়। সেদিনটা জেমির বাবা এডির জন্মদিন। ততদিনে ১৩ মাস হয়ে গেছে জেমি জেলে রয়েছে। এডিদের এলাকার ছেলেছোকরা থেকে বয়স্কা প্রতিবেশী ওদের পরিবারের দিকে নানান টিটকিরি, লাঞ্ছনা ছুঁড়ে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে জেমির বাবা হিসেবে এডির মুখটাও পরিচিত হয়ে গেছে আপাত অপরিচিত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের দোকানি ছেলেটার কাছেও। এসব নিয়েও জেমির বাবা, মা আর দিদি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখার। জন্মদিনের সকালে জেল থেকে ফোন আসে। জেমি ফোন করেছে তার বাবাকে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ জানাতে। ফোন রাখার আগে জেমি জানায় যে সে তার অপরাধ স্বীকার করে নিতে চায়।

 

জেমির জীবনের এই তের মাসের চারটে টুকরো চারটে মাত্র লং টেকে ফিল্মায়িত করেছেন পরিচালক। প্রথম এপিসোডের প্রথম শট – ল‍্যুক পেছন ঘুরে আপেল খাচ্ছে থেকে ক্যামেরা চালু হয়েছে। তারপর থেকে টানা এক ঘন্টা ক্যামেরা চালু থেকেছে। সেই জেমিকে বাড়ি থেকে তুলে আনা থেকে লক আপের ইন্টারোগেশন রুমে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে পাওয়া– একটি ঘন্টা ক্যামেরা কোন কাট করেনি। কাজটা টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে অভিনেতা সকলের পক্ষেই রীতিমতো কঠিন ছিল। এই হ্যান্ড-হেল্ড লং টেক দর্শককে উদ্দীপিত রাখে আবার চরিত্র ঘনিষ্ঠও করে রাখে। পর পর চারটি এপিসোডেই এই নিরবচ্ছিন্ন হাতে ধরা ক্যামেরা অ্যডোলেসেন্স-এর চরিত্রদের আর তার আবহাওয়াকে কখনো নিছক পিছু করে আবার কখনো তাড়া করে বেড়ায়। আর এও অনস্বীকার্য যে অভিনেতা অ্যাশলে ওয়ালটার বা আওয়েন কুপাররা সিরিজ ক্রিয়েটরের এই অভিনব ডিজাইনে বেশ যোগ্যতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন।

 

আরেক বার ফিরে দেখা যাক কনজার্ভেটিভ আর লেবার পার্টির দুই নেতার তর্কের কথা। বরিস জনসন-এর কথা না হয় লিবারালদের গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। বেম কম্যুনিটির বাইরে হোয়াইট ওয়ার্কিং ক্লাসের একটি ছেলে এরকম ক্রাইম করেছে এটা কনজার্ভেটিভদের হয়তো সবচেয়ে বেশি অস্বস্তির কারণ, মুখে যাই বলুক। কিন্তু সিরিজটি নিয়ে লেবার পার্টির নেতার উচ্ছ্বাসও প্রণিধান যোগ্য। কেমন শ্রেণীর প্রশ্নকে আলগোছে ছুঁয়ে কিশোরের মনস্তত্ত্ব, সাইবার বুলি ইত্যাদিকে দুষিয়ে গল্প খাড়া করা গেছে। সিরিজ ক্রিয়েটরদের থেকেও আরো অনেক বড়ো আর জটিল ডিজাইন-এর অংশ হয়ে চলেছে জেমির মতো কিশোররা সকলের অজান্তে।

 

অবশ্য এসব কথা লোকে জানতে পারলে বিপদ আছে।

 

________________

দেবারতি গুপ্ত ফিল্মমেকার, প্রাবন্ধিক ও গ্যেস্ট লেকচারার।

 

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Subhasish Dey on April 20, 2025

    হসপিটালের বেডে শুয়েই দেবারতির লেখাটা পড়ে ফেললাম। চমৎকার

Leave a Comment