৭৫তম সংবিধান দিবস উপলক্ষে গত ২৬ নভেম্বরের আগের সন্ধ্যায় এক অনলাইন আলোচনায় সমাজকর্মী তুষার গান্ধী বলেন ভেদাভেদ, বৈষম্যের সীমা পেরিয়ে সকল নাগরিকের অধিকার, সকলের জন্য ন্যায় সুনিশ্চিত করতে যে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা প্রস্তাবনায় রয়েছে তার পরিবর্তন করতে চাইছে বর্তমান কেন্দ্র সরকার। সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।
পেরিয়ে এলাম আরও একটা ২৬ নভেম্বর। ২০২৪-এর ২৬ নভেম্বর ভারতে সংবিধান কার্যকর হওয়ার ৭৫তম বছর। তবে আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে সংবিধানে লেখা এ দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার বিষয়টিই যেন সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪-এর শেষ লোকসভা নির্বাচনে তাই সারা দেশের নাগরিক সমাজের এক বড় অংশ মিলিতভাবে দাবি তুলেছিল সংবিধান রক্ষার জন্যই বিজেপিকে পরাজিত করতে হবে, কারণ ক্ষমতা দখলের জন্য, নিজেদের হিন্দু রাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডা পূরণ করার জন্য তাঁরা সংবিধানে লেখা অধিকারের কথাগুলিকেই আক্রমণের লক্ষ্যবিন্দু করে নিচ্ছে। দলিত, প্রান্তিক মানুষদের কা্ছে সংবিধানের গুরুত্ব নিয়ে তাই প্রচার চালিয়েছিল নাগরিক সমাজ এবং সংবিধান সংশোধন করে বিজেপি যে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ কব্জা করতে চাইছে তার বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যার প্রতিফলন দেখা যায় লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে।
২৬ নভেম্বরের আগের সন্ধ্যায় মহারাষ্ট্রের সংগঠন ‘মুভমেন্ট ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস ফর ওয়েলফেয়ার’ আয়োজিত ‘ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড জাস্টিস: দ্য পিলারস অফ ফ্রেটারনিটি’ (সমতা ও ন্যায়: সৌভ্রাতৃত্বের স্তম্ভ) শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনায় বক্তব্য রাখেন সমাজকর্মী তুষার গান্ধী।
বক্তব্যের শুরুতেই তিনি উল্লেখ করেন, ভারতে বিভিন্ন ধরনের ‘ইজম’ রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রচলিত ও জনপ্রিয় থাকলেও এই মুহূর্তে এ দেশের প্রয়োজন ‘কনস্টিটিউশনালিজম’ – অর্থাৎ সংবিধানকে ভিত্তি করেই নতুন করে নাগরিকদের অধিকার নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা শুরু করতে হবে। তিনি বলেন, ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা (প্রিঅ্যাম্বেল) পড়লেই এই দেশের যে মূল সুর তা বুঝতে পারা যায়। ভেদাভেদ, বৈষম্যের সীমা পেরিয়ে সকল নাগরিকের অধিকার, সকলের জন্য ন্যায় সুনিশ্চিত করতে যে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা প্রস্তাবনায় রয়েছে তার পরিবর্তন করতে চাইছে বর্তমান কেন্দ্র সরকার। তিনি মনে করিয়ে দেন এক বিরাট বৈচিত্র্যপূর্ণ নাগরিক সম্প্রদায়ের জন্য তৈরি হয়েছিল এই সংবিধান, লোকতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সর্ব অর্থে স্বাধীন হয়েছিলাম আমরা।
তুষার গান্ধী বলেন, এই সংবিধান আমাদের শুধু নাগরিক হিসাবে অধিকারসমূহ দিয়েছে তাই নয়, নাগরিকদের যে দায়িত্বও থাকে তাও বুঝতে সাহায্য করেছে। বর্তমান হিংসা-দ্বেষে ভরা সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হতে পারে না, যদি না তাঁদের নিজেদের জীবনে ন্যায়ের পথে চলার আদর্শ থাকে, যা আজ ক্রমশই কমে আসছে। ন্যায় বিষয়তি কেবলমাত্র বিচারব্যবস্থার সঙ্গেই জড়িত নয়, তার যে একটি দার্শনিক, আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে তারই উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, “নিজেদের মধ্যে, মনে সমতার চেতনা থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের চেতনায় তা না থাকলে আইনের মাধ্যমে যা আসে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিছক বাধ্যতামূল হয়ে দাঁড়ায়।”
যাকে হাতিয়ার করে বিজেপি দেশে বিভেদের রাজনীতি চালাতে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে সেই জাত-বর্ণ-ধর্মের রাজনীতি আদপে আমাদের মধ্যেই প্রত্যক্ষে, পরোক্ষে রয়ে গেছে। জাত-বর্ণের ‘হায়ারার্কি’ থেকে যে বেরোতে পারিনি আমরা, তা সামাজিক, সাংস্কৃতিক আচরণ, নিয়ম-কানুনেই স্পষ্ট হয়ে যায় আর যাকে ভিত্তি করে চলতে থাকে সংবিধানে যে ভেদাভেদহীন সমাজের কথা বলা হয়েছে তাকে নস্যাৎ করার সরকারের কর্মসূচী।
আম্বেদকর বলেছিলেন শ্রমের মর্যাদার কথা, তা না থাকলে সমাজের বৈষম্য ঘুচবে না। গান্ধীজী সামাজিক অসাম্য দূর করার জন্য বলেছিলেন, সকলের জন্য সমান সম্মান ও সমতার কথা। এই দু’জনের উল্লেখ করে তুষার গান্ধী বলেন, এখনও আমরা শ্রমের অবমূল্যায়ন ও অসম্মান করে চলি, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বৈষম্য তৈরি করতে থাকে, “আমরা এখনও ছোটদের বলি, পড়াশোনা না করলে মোট বইতে হবে। এ কথা বলে আমরা মোট বওয়ার কাজ ও যিনি সেই কাজ করেন তাঁকে যে অসম্মান করছি আর পরবর্তী প্রজন্মও তাই শিখছে, সে কথা ভেবে দেখি না।”
বিজেপি শাষিত কেন্দ্র সরকার যে বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করে চলেছে এবং ন্যায় পাওয়ার প্রক্রিয়া ক্রমাগত বিলম্বিত করে দিয়ে ন্যায় তথা দেশের বিচারব্যবস্থা যে সংবিধান অনুসরণ করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে পারে – সেই ভাবনাকেই নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সে কথা মনে করিয়ে দেন তিনি। তিনি এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বন্দীদের উদাহরণ দেন।
তিনি বলেন কীভাবে গত দশ বছরে ভারতবর্ষের ধারণাটিকেই বিজেপি-আরএসএস সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে। এবং এক্ষেত্রে সংবিধান পরিবর্তনের তাঁদের চেষ্টাটি সবচেয়ে বিপজ্জনক নয়, বিপজ্জনক হল তাঁরা যেভাবে সংবিধানের গুরুত্ব ভারতের নাগরিকদের জীবনে কমিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এবং এক্ষেত্রে প্রতিরোধ হিসাবে নিজেদের প্রতিদিনের জীবনে সংবিধানের আদর্শকে আত্মস্থ করা ছাড়া উপায়ান্তর নেই, বিশেষত ছোটদের মধ্যে তা চারিত করে দেওয়াই সময়ের দাবি।
সংবিধানে বর্ণিত বিভিন্ন অধিকার যেভাবে বিরোধীদের আপত্তি না মেনে বা বিরোধীশূন্য সংসদে নতুন আইন পাশ করে খন্ডন করা হচ্ছে তা বিশেষ উদ্বেগজনক। কেন্দ্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সংশোধনের মধ্যে দিয়ে সংবিধানের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়ার, নাগরিকদের জীবনের সঙ্গে তার সংযোগ কমিয়ে দেওয়ার। সাধারণ নাগরিকরদের সংবিধানের গুরুত্ব দৈনন্দিন জীবনে বুঝিয়ে তা রক্ষা করার নাগরিক সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচী আরও বেশি করে নেওয়া প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন।
সদ্য কার্যকর হওয়া ভারতীয় ন্যায় সংহিতাকে হাতিয়ার করে বর্তমান কেন্দ্র সরকার যেভাবে নাগরিকদের অধিকার খর্ব করতে তৎপর হয়েছে তাতে সংবিধান কি আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে না? এই প্রশ্নের উত্তরে তুষার গান্ধী বলেন, “বর্তমান কেন্দ্র সরকার গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটিকে স্বৈরাচারী করার চেষ্টা করছে। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে বদল এনে তাঁরা নাগরিকদের আরও বেশি বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সংবিধান রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানুষকেই রাস্তায় নেমে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই আন্দোলনকে দীর্ঘমেয়াদী করার দায়িত্ব কোনও রাজনৈতিক দলই নেবে না। ইস্যুটিকেই এত বড় করে তুলতে হবে যাতে তা নিজেই নেতৃত্বমূলক হয়ে উঠে, সেখানে থাকে নাগরিকদের সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ আর তা তখনই সম্ভব হবে যখন তাঁরা নিজেদের জীবনের সঙ্গে সংবিধানের গভীর সংযোগটি বুঝতে পারবেন।”
তুষার গান্ধী এদিনের বক্তব্য শেষ করেন মহাত্মা গান্ধীর এক বক্তব্য দিয়ে, যেখানে তিনি বলেছিলেন – রাষ্ট্রদ্রোহ দেশবিরোধী কোনও বিষয় হতে পারে না যদি রাষ্ট্র নাগরিক বিরোধী হয়। কিন্তু তারজন্য রাষ্ট্রের দ্বারা পীড়িত হওয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে, যখনই নাগরিকেরা আন্দোলনের পথে হাঁটবেন।