কর্পোরেট কর্ম সংস্কৃতি অথবা আত্মহত্যার সাদামাটা গল্প


  • October 8, 2024
  • (1 Comments)
  • 655 Views

সেবাস্টিয়ানদের মৃত্যু আজ আবার কর্পোরেট কর্মীদের সামনে তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে কিছু গুরুতর প্রশ্ন সামনে এনেছে। সময়ের দাবি এগুলো নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা, শ্রেণি চেতনায় সংগঠিত হয়ে বাকি শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে হাজির হওয়া। লিখলেন সুমন কল্যাণ মৌলিক

 

এই ভয়ংকর ছুটে চলা জীবনে তরুন সাক্সেনা নামটি সম্ভবত অতীতের খাতায় চলে গেছে। কয়েকদিন আগে উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসিতে কর্মরত বাজাজ ফিনান্সের এই এরিয়া ম্যানেজার খবরের শিরোনামে এসেছিলেন আত্মহত্যার কারণে। তরুন তার সুইসাইড নোটে লিখে গেছেন টার্গেট পূরণ করতে না পারার জন্য সিনিয়ররা তাকে মানসিক নির্যাতন করত, এমনকি তার মাইনেও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঘটনার দিন সকালে বাজাজ ফিনান্সের ভূপাল স্থিত উচ্চ আধিকারিকদের সঙ্গে অনলাইন মিটিং শেষ হওয়ার পর তরুন নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই আত্মহত্যার পরেই স্থানীয় পুলিশ এক অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করে, বাজাজ কর্তৃপক্ষ যথারীতি সাংবাদিক সম্মেলন করে তাদের কোম্পানির ‘কর্মচারী বান্ধব ও স্বচ্ছ’ কর্ম সংস্কৃতির দোহাই দেয়, নিয়ম মাফিক তদন্তের কথাও বলে।

 

কর্পোরেট দুনিয়ায় এবং জনমানসেও একথা কারোর অজানা নয় যে তরুন সাক্সেনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিগত জুলাই মাসে (২০২৪) গ্লোবাল ব্র্যান্ড আর্নেস্ট ইয়ং এর ভারতীয় শাখার চার্টাড অ্যাকাউন্ট আন্না সেবাস্টিয়ান কাজের চাপ নিতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এই কোম্পানিতে আন্না চার মাস আগেই যুক্ত হয়েছিল। আন্নার মা অনিতা অগাস্টিয়ানের একটা চিঠি সে সময় সোসাল মিডিয়ায় খুব আলোচিত হয়েছিল যাতে তিনি লিখেছিলেন কিভাবে দীর্ঘ শ্রম ঘন্টা, এমনকি ছুটির দিনে কাজ করতে বাধ্য করার কারণে আন্না মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল। আত্মহত্যা হলে অন্তত খবর হয় কিন্তু কর্পোরেট কর্মসংস্কৃতির কারণে কিভাবে কর্মচারীরা প্রতি মুহূর্তে নির্যাতিত হন, তার বেশিরভাগ খবর বাইরেই আসে না। গত ৫ অক্টোবর (২০২৪) আনন্দবাজারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিবন্ধী কর্মচারীর খবর প্রকাশিত হয়। এই যুবক এক মাঝারি মাপের বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করতেন, ম্যানেজার তাকে একই বেতনে সপ্তাহে ২০ ঘন্টা অতিরিক্ত কাজ করার জন্য চাপ তৈরি করে। প্রতিবন্ধী যুবকটি অস্বীকার করলে তার কাজ চলে যায়।

 

এই অবস্থার কারণ কর্পোরেট কর্ম সংস্কৃতি যা পরিচিতদের কাছে ‘Hustle Culture’ নামে পরিচিত। কর্পোরেট জগত নিয়ে গবেষণা করছেন এমন এক মানুষ এই সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন “Fundamentally hustle culture is about work dominating your time in such an unnatural way that we have no time to live our lives”। এমন এক জীবনশৈলী যেখানে ক্যারিয়ারের জন্য পরিবার-পরিজন, শখ-আহ্লাদ সব কিছু বিসর্জন দিয়ে টার্গেট পূরণের লক্ষ্যে ছুটে চলতে হয়। আর এই ইঁদুর দৌড়ের পরিণতি আজ আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত। ২০২৩ সালে এডিপি রিসার্চ ইন্সটিটিউট “People at work 2023: A Global  workplace View”  শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে বলা হয় ভারতের ৭৬% কর্পোরেট কর্মী মনে করে অতিরিক্ত চাপ তাদের কাজের দক্ষতার উপর প্রভাব ফেলছে। ৪৯% মনে করছে কাজের চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে দুর্বল করছে। ভারতে প্রতি দশজনে ছয়জন কর্মী মনে করছে ম্যানেজার বা সহকর্মীদের কাছে নিজেদের সমস্যা বলার মত অবস্থাই নেই। ২০১৬ সালে Optum Study দেশের দু’লক্ষ কর্পোরেট কর্মীদের উপর এক সমীক্ষা চালায় যাতে দেখা যায় ৪৬% কর্মী স্ট্রেসের শিকার। এদের মধ্যে ৪৩% এর বডি মাস ইনডেক্স কমার, ৩০% ডায়াবেটিস ও ৩০% এর উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যার ঝুঁকি রয়েছে। এই টক্সিক কর্মসংস্কৃতির এই পরিণতি হওয়াই স্বাভাবিক।

 

এই কর্পোরেট সংস্কৃতির এক ইতিহাস রয়েছে যাকে অনুধাবন করা ছাড়া বিষয়টির আলোচনা সম্ভব নয়। নব্বই এর দশকে বিশ্বব্যাঙ্ক-আইএমএফ-এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক সহ আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকত্বে ভারতে ‘উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-ভুবনায়নের’ জমানা চালু হয় যা সংস্কার পর্ব নামে পরিচিত। এই নীতির মূলমন্ত্র ছিল যা কিছু ব্যক্তিগত তাই পবিত্র। এই নীতির ফলে যেমন দেশের জল-জমি-সম্পদের উপর কর্পোরেট দখলদারি প্রতিষ্ঠিত হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করা হয় তেমনি অর্থনীতির প্রধান শক্তি হিসাবে পরিষেবা ক্ষেত্রের উত্থান ঘটে। আই টি সেক্টর, ব্যাঙ্কিং, বিমা সহ এই বিশাল ক্ষেত্রটার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী জোগানের জন্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কয়েকশ গুন বৃদ্ধি পায়। এই অংশে যে সমস্ত দক্ষ মানুষ কাজ করে তারাই আজ কর্পোরেট কর্মী হিসাবে পরিচিত। এই নয়া অর্থনীতি এক নতুন মতাদর্শকেও সামনে নিয়ে আসে। তারা পুঁজি, শ্রম ও শ্রেণির প্রশ্নটিকে এমন ভাবে উপস্থিত করে যাতে ট্রেড ইউনিয়ন, অধিকার আদায়ের রাজনীতি এক ঘৃণ্য বস্তু হিসাবে পরিগণিত হয়। এই হোয়াইট কলার জবের কর্মীরা নিজেদের শ্রমিক হিসাবে মনে করে না। হাতে ল্যাপটপ, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে, জগৎ সংসার বিচ্ছিন্ন কিউবিকলে, বাৎসরিক প্যাকেজের আশ্বাসে তারা শুধু নিজেদের জন্য বাঁচে। তারা নিজেদের শ্রমিক হিসাবে না ভাবলেও বাস্তবে তারা অধিকার হীন কর্পোরেট মজুর যাদের প্রত্যেকটা মুহূর্তে মাথার উপর ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ারের’ অদৃশ্য তরবারি ঝুলতে থাকে। এই ভয়ংকর চাপকে যুঝতে হয় তাদেরকে কারণ তারা বিশ্বাস করে কর্পোরেট দুনিয়ায় কেউ কারোর নয়।

 

এই কর্পোরেট সংস্কৃতিকে চারিয়ে দেওয়ার জন্য বিজনেস স্কুলগুলো সব সময় সক্রিয়। বিশ্বায়িত অর্থনীতির সংকট যখন বাড়ে (এই মুহূর্তে এই সংকটই প্রধান) তখন স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য ক্ষেত্রের মত কর্পোরেট জগতেও ছাঁটাই এর কোপ পড়ে। কম লোকে বেশি কাজ করানোর লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠেন কর্পোরেট গুরুরা। ২০২৩ সালে ইনফোসিস প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি সপ্তাহে ৭০ ঘন্টা কাজের নিদান হেঁকেছিলেন। ২০২২ সালে আরেক কর্পোরেট কর্তা শান্তনু দেশপান্ডে দিনে ১২ ঘন্টা কাজ করার পরামর্শ দেন। আজ এগুলোকেই স্বাভাবিক বলে মনে করানো হচ্ছে কারণ নিউ নর্মালের যুগে আট ঘন্টা কাজ, অতিরিক্ত কাজের জন্য ওভারটাইম নেহাৎই ব্রাত্য শব্দ।

 

ইন্টারন্যাশানাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে পৃথিবীতে ভুটানের পর ভারতের শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি কাজ করতে বাধ্য হয়। অর্ধেকের বেশি দেশের শ্রমশক্তি সপ্তাহে ৪৯ ঘন্টা কাজ করে। আর যত সংকট বাড়ছে কর্পোরেট জগতের উন্নত কাজের পরিবেশের দাবির ফানুস চুপসে যাচ্ছে। গত বছর দুর্গাপুরের এক নামজাদা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কর্তৃপক্ষ তাদের ফ্যাকাল্টিদের নির্দেশ দেয় নতুন ছাত্র ভর্তি করার জন্য কলেজ ছেড়ে দুর্গাপুর স্টেশনে ক্যাম্প করে বসে থাকতে হবে। এবছরের শুরুতে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ও তার অধস্তন কর্মীদের অনলাইন মিটিং এর রেকর্ডিং সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। সেই ম্যানেজারের ‘সুবচনী’ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিল কর্মচারীদের মা-বাবা তুলে গালিগালাজ করাই উন্নততর কর্পোরেট কর্ম সংস্কৃতি। তরুন সাক্সেনা, আন্না সেবাস্টিয়ানদের মৃত্যু আজ আবার কর্পোরেট কর্মীদের সামনে তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে কিছু গুরুতর প্রশ্ন সামনে এনেছে। সময়ের দাবি এগুলো নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা, শ্রেণি চেতনায় সংগঠিত হয়ে বাকি শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে হাজির হওয়া।

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: পীযূষ গুহ on October 8, 2024

    গুরুত্বপূর্ণ লেখা। প্রয়োজনীয়। একটা কথা বলা দরকার বলে মনে হয়, এই সময়ে কাজের চাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। এরফলে মানুষ কে অনেক সময়েই জীবন ধারণের জন্য অতিরিক্ত কাজও করতে বাধ্য হচ্ছেন। এরফলে তার শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অস্তিত্ব ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়ছে।

Leave a Comment