‘জাস্টিস ফর সাবির মল্লিক’ : প্রতিবাদ কলকাতায়


  • September 4, 2024
  • (0 Comments)
  • 885 Views

গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন:

 

হরিয়ানা রাজ্যে পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিক বলতে বাঙালি মুসলমানরাই বেশি। বিশেষ করে ‘কুড়া’র কাজ, মানে, আবর্জনা তোলার কাজ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য বাংলা ও আসাম থেকে আসা বহু দরিদ্র মুসলমান পরিবারই এ রাজ্যে বহু বছর ধরে বসতি বানিয়ে রয়ে গেছেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা হরিয়ানারই স্কুল-কলেজে পড়েন, বাড়ির মহিলারা অনেক সময় ওই রাজ্যেই লোকের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে সাহায্য করেন।

 

২২ বছরের সাবির মল্লিক এমনই একজন পরিযায়ী শ্রমিক, যিনি দঃ ২৪ পরগনার বাসন্তী থেকে হরিয়ানার চরখি দাদরি জেলার বধরা থানা এলাকায় গিয়ে সপরিবারে থাকতেন এবং সেখানেই জীবিকা নির্বাহের জন্য আবর্জনা তুলতেন। গত ২৭ আগস্ট, গোরুর মাংস খেয়েছেন, এমন সন্দেহের উপর ভিত্তি করে তাঁকে বেশ কিছু স্থানীয় লোকেরা মিলে লাঠি-রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। সেই হত্যার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। হরিয়ানা পুলিশ এখন অবধি গ্রেফতার করেছে ৮ জনকে – তাদের মধ্যে দু’জন নাবালকও রয়েছে।

 

 

সাবিরের মৃত্যুর বিচার চেয়ে (‘জাস্টিস ফর সাবির’) ৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে তিনটে থেকে গিরিশ পার্কে হরিয়ানা ভবনের সামনে বিক্ষোভ জানালেন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মঞ্চের (সা.বি.ম.) সদস্যরা এবং আরও কিছু মানুষ। এই অবস্থানে যোগ দিতে বাসন্তী থেকে এসেছিলেন সাবিরের মামা। পরে যোগ দেন সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশন-এর সদস্যরা এবং অন্যান্য কিছু সংগঠনের মানুষ। উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর ও হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি থেকে অপরাধীদের শাস্তি, দেশে গো-রক্ষা বাহিনীকে বেআইনি ঘোষণা করা ও হিংসার রাজনীতি বন্ধ করার দাবি।

 

 

সা.বি.ম.-এর সম্পাদক সীতাংশু শেখর বলেন – 

“সাবির মল্লিকের হত্যাকাণ্ড সংবাদ আমাদের কাছে পৌঁছলে আমরা তাঁর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করি, আর তখনই জানতে পারি পেটের ধান্দায় তিনি হরিয়ানায় গিয়েছিলেন, সেখানে স্ত্রী-সন্তান সহ থাকতেন, আর ছোটোখাটো কাজ-কারবার করে জীবন নির্বাহ করতেন। হঠাতই কিছু লোক দাবি করে যে, যেখানে সাবির থাকতেন, তার আশেপাশে গরুর মাংসের হাড় পাওয়া গেছে। সেইসব দুস্কৃতিরা দাবি করেছিল বা সন্দেহ করেছিল, সাবিররাই গরুর মাংস খেয়েছে। এরপর তারা সাবিরকে মিথ্যে বলে ডেকে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে। কে কী খাবে, কে কী পরবে – ভারতের সংবিধান অনুযায়ী কেউ ঠিক করে দিতে পারে না, কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে সারা ভারতে এধরনের হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আসছে সংঘপরিবারের গোরক্ষকবাহিনীর লোকেরা। যতই আরএসএস-বিজেপির উত্থান ঘটছে, ততই সারা দেশে এই বজরং-দের আক্রমণ বাড়ছে। শুধু মুসলিম সংখ্যালঘু নয়, খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের উপরেও আক্রমণ করা হচ্ছে, যেমন উড়িষ্যায়। আর এসব করা ভোট ব্যাঙ্ককে মাথায় রেখে।  একদিকে ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ নামিয়ে তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করা হচ্ছে, আর অন্যদিকে মেরুকরণের রাজনীতি করে, ধর্মীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে, হিন্দুত্বের বিকাশ ঘটিয়ে হিন্দু ভোট নেওয়া হচ্ছে। তাই সর্বস্তরে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ হওয়া উচিত – বিশেষ  করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমবাংলা সহ এই কলকাতা ‘জাস্টিস’-এর জন্য উত্তাল হয়ে উঠেছে। আমি আশা করব, সেইভাবে এই বাংলার মানুষ  ‘জাস্টিস ফর সাবির’-এর জন্য উত্তাল হয়ে উঠবে।”

 

 

তবে বাঙালি শ্রমিক হওয়া সত্ত্বেও ভিন রাজ্যে সাবিরের হত্যা নিয়ে পশ্চিমবাংলায় (বা অন্য রাজ্যেও) প্রতিবাদের বিশেষ নজির এখন অবধি দেখা যায়নি। আর. জি. কর হাসপাতালের ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে রাজ্যে উত্তেজনা, প্রতিবাদ, মিছিল, আলাপ-আলোচনা উত্তাল হলেও ২২ বছরের সদ্য যুবক ছেলেটির ভয়াবহ হত্যা ও তাঁর হত্যাকারীদের অধিকাংশেরই গ্রেফতার না হওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও প্রতিবাদ এখন অবধি নামমাত্র। অথচ ধর্ষণ, খুন, নারী-কুইয়ার-সংখ্যালঘু-দলিতদের প্রতি হিংসা এবং আরও বর্তমান নানা সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা কিন্তু একে অন্যের সাথে জুড়ে আছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এধরনের অবস্থা ও অপরাধের তাল মিলিয়ে বাড়বাড়ন্ত দেখলে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। দুর্ভাগ্যের কথা, যে মানুষেরা আর. জি. করের ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইছেন, তাঁদের মধ্যেও একটি বাঙালি তরুণের অমানবিক হত্যাকে প্রতিবাদের অংশ করে নেওয়ার ইচ্ছা বা উদ্যম এখনো তেমন দেখা যাচ্ছে না। 

হিন্দু বাঙালিদের এক অংশের মধ্যে প্রকাশ্যে বা লুকিয়েচুরিয়ে চাপা মুসলমান-ভীতি ও ঘৃণা (ইসলামোফোবিয়া), যাতে বিজেপি-আরএসএস-ভিএইচপি সারাক্ষণ ইন্ধন যুগিয়ে চলে। তাই, আর জি কর-এর ধর্ষণ বা হত্যায় যুক্ত ছিলেন না, এমনটা প্রমাণ হয়ে যাওয়ার পরেও ডাঃ আরশিয়ান আলমডাঃ গোলাম আজমের নামে কুৎসা ছড়িয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে। তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনীর দাপটে ক্লান্ত মানুষকে শেখানো হয়, সব সমস্যার পিছনে আছে ‘মোল্লারা’। অথচ সাবির মল্লিক গুন্ডা ছিলেন না, ছিলেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ মাত্র, যাঁকে নিজের রাজ্যে কাজ না পেয়ে অন্য রাজ্যে আবর্জনা কুড়োবার কাজ করতে যেতে হয়েছিল। যতই আজ বাংলার রাজ্য সরকার সাবিরের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও চাকরির প্রতিশ্রুতি দিক, এই দায়িত্ব তাদেরও।

 

গুন্ডা নন ৭২ বছরের হাজি আশরাফ মুনিয়ারও, যিনি কয়েকদিন আগেই মেয়ের জন্য রান্না করে নিয়ে যাওয়ার দোষে, মহারাষ্ট্রের ট্রেনে একদল হিন্দুত্ববাদী গুন্ডার হাতে চড়-থাপ্পড় খেলেন। ভাগ্যক্রমে তাঁকে পিটিয়ে মারা হয়নি, যেমন হয়েছে ২০১৪ সাল থেকে শতাধিক ভারতীয় মুসলমানকে, গোরুপাচার বা গোরুর মাংস ঘরে রাখার বা খাওয়ার সন্দেহে – বিশেষ করে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সেইসব রাজ্যে, যেখানে এখন আইন করে গোরু-মোষের মাংস খাওয়া বা মাংসের জন্য গোরু-মোষ বিক্রি করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ভারতীয় সংবিধানের বিরুদ্ধে গিয়েই।

 

হরিয়ানা রাজ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও বজরং দলের সক্রিয়তার ফলে সংখ্যালঘু মানুষদের উপর সাম্প্রদায়িক অত্যাচার হিন্দুত্ববাদী আতঙ্কবাদের চেহারা নিয়েছে এবং বছর বছর বেড়ে চলেছে। ২০২৩ সালে নূহ জেলায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধানো বা জুনাইদ ও নাসিরকে কিডন্যাপ করে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা ছাড়াও হরিয়ানার মুসলমানদের মসজিদ ভাঙচুর, তাঁদের প্রার্থনা বন্ধ করা, শহরে ও গ্রামে তাঁদের ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখা – এসব প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে বজরং দলের নেতা মনু মানেসর, বিট্টু বজরঙ্গিদের নেতৃত্বে। 

 

হরিয়ানার গো-রক্ষক দলগুলিকে নিয়ে ক্যারাভান পত্রিকায় ইশান মারভেলের রিপোর্টে দেখা যায়, কীভাবে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার (অতএব পুলিশও) হাতে হাত মিলিয়ে এই দলগুলিকে সাহায্য ও উৎসাহ দিয়ে থাকে। যেমন, সে রাজ্যে থেকেছে ‘টপ পারফর্মার’ গো-রক্ষককে কয়েক লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার নিয়ম। ইশান মূলত হরিয়ানার হিন্দুত্ববাদী আর্য সমাজের নেতা যোগেন্দ্র আজাদের গো-রক্ষক দলকে কেন্দ্র করে লেখাটি লিখেছেন, যে দলটি সাবিরের হত্যাকাণ্ডের পিছনেও রয়েছে। ইশানের লেখায় ১৯ বছর বয়সী গোলগাল গো-রক্ষক বিক্রম আর্যর কথা পড়তে পড়তে সাবির মল্লিকের নাবালক হত্যাকারীদের কথা মনে পড়ে।

 

হরিয়ানা ভবনের সামনে আজকের অবস্থানে এ কথাও উঠে আসে যে, ‘বীফ’ (গোরুর মাংস) ও ‘বাফ’ (মোষের মাংস) নিয়ে আইনি ও বেআইনি কড়াকড়ি সত্ত্বেও ভারত আন্তর্জাতিক বীফ রপ্তানিতে এখনো প্রথম পাঁচ-ছ’টি দেশের মধ্যে রয়েছে। এবছর ইলেকটোরাল বন্ড কেলেঙ্কারি ফাঁসের সময় দেখা যায় যে, ভারতের সবচেয়ে বড় ‘বাফ’ রপ্তানি কোম্পানি আল্লানাসন্স প্রাইভেট লিমিটেড ও ফ্রিগোরিফিকো আল্লানা প্রাইভেট লিমিটেড বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে ২ কোটি টাকা ও শিবসেনাকে ৫ কোটি টাকা দিয়েছে। আল্লানাসন্স কোম্পানির সাথে বিজেপির যোগাযোগ বারবার খবরে এসেছে। বিজেপি আমলে মাংস রপ্তানির ব্যবসাও সমান তালে জারি থেকেছে।

 

জুলাই মাসে লাগু হওয়া ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১০৩ (২) সেকশনে বলা হয়েছে, জাতি-গোষ্ঠী-লিঙ্গ-জন্মস্থান-ভাষা-ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা এইজাতীয় কোনো ভিত্তিতে ৫ জন বা তার বেশি সংখ্যক মানুষ মিলে যদি কাউকে হত্যা করে, তাহলে তার শাস্তি মৃত্যু বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা। কিন্তু সরকার পিছনে থাকায় গো-রক্ষকদের কোনো শাস্তি হয় না, বরং কাস্টডি থেকে বেরিয়ে এলে জোটে সংবর্ধনা আর ফুলের মালা। অনেকসময়ই, যেমন এবছর মে মাসে গুজরাতে মিশ্রিখান বালুচকে গো-রক্ষকরা হত্যা করার পর পুলিশ বলে, হত্যার কারণ সাম্প্রদায়িক নয়, পুরনো ঝগড়া মাত্র। হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, গুজরাত ছাড়াও এবছর রাজস্থান, ছত্তিসগড়, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যাতেও গো-রক্ষক বাহিনীর হাতে মুসলমানদের লাঞ্ছনা ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

 

২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট গো-রক্ষকদের হিংসামূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা রাজ্য সরকারের দায়িত্ব বলে একটি জাজমেন্ট দেয়। কিন্তু এরপরেও রাজ্যগুলিতে অবস্থার বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি। ২০২২-এ চারটি রাজ্যে অ্যান্টি-মব লিঞ্চিং বা অ্যান্টি-মব ভায়োলেন্স বিল ঠিক ভাবে পাশ না হওয়া নিয়ে একপ্রস্থ আইনি আলোচনা চলে। এবছর এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন রাজ্যকে ছ’সপ্তাহের মধ্যে গো-রক্ষকদের গণপিটুনি বিষয়ে অ্যাকশন নিতে বলা সত্ত্বেও বেশিরভাগ রাজ্য সরকার তাতে কান দেয়নি।

 

গো-রক্ষকরা সরকারের মদতপুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তারা পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে না। যেমন, এই দলগুলি শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের নয়, দলিত ও আদিবাসীদের উপরেও অত্যাচার ও তাঁদের হত্যা করে থাকে, যেমন গো-রক্ষার নামে ২০২২-এ মধ্য প্রদেশে দুই আদিবাসী পুরুষের হত্যা, বা ২০১৬-তে গুজরাতের উনায় দলিতদের বেত্রাঘাত করার ঘটনা। 

 

প্রমাণ ছাড়া সন্দেহের ভিত্তিতে অত্যাচার বা শুধুই নিজেদের ক্ষমতা দেখাবার জন্য অত্যাচারের আনন্দে এই দলগুলি এমনই উন্মত্ত যে, ২৭ আগস্ট সাবির মল্লিকের হত্যার ঘটনার পরেই ২ সেপ্টেম্বর হরিয়ানাতেই ঘটে গেল আরও একটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। মাত্র ১৯ বছর বয়সী আরিয়ান মিশ্র – ফরিদাবাদবাসী ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র – তাকে ভুল করে গোরু-পাচারকারী সন্দেহে গাড়ি নিয়ে ৩০ কিমি তাড়া করে, শেষে গুলি করে মারল গো-রক্ষকদের একটি দল। এই লাগামছাড়া ক্ষমতার রাশ এই দলগুলির হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাদের কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করার যে দাবি সা বি ম ও অন্যান্য উপস্থিত দলগুলি ৩ আগস্ট মঙ্গলবার গিরিশ পার্কের জমায়েতে রাখল, তাতে আরও বহু সংখ্যক মানুষের গলা মেলানোর প্রয়োজন।

 

Share this
Leave a Comment