ইউনুসের মডেলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারও দেওয়া হয়েছে, যা ওবামার মত যুদ্ধবাজও পেয়েছেন। দেশের যাবতীয় সম্পদ ও ক্ষমতা কিছু লোকের কাছে কুক্ষিগত থাকবে, তাঁদের কাছে বাকিদের দরবার করতে হবে একটু স্বাচ্ছল্যের জন্য, এ ব্যবস্থা ঋণ দিয়ে শোধরাবার নয়। সেখানে দরিদ্রতম অংশটির সাথে সুদের ব্যবসাকে দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রক্রিয়া বলে চালানো শুধু মিথ্যা প্রচার নয়, ঘৃণ্য অপরাধ। লিখলেন শ্যামলী জানা।
মহম্মদ ইউনুসকে কিছু লোক ‘রক্তচোষা সুদখোর’ বলে অভিহিত করেন, আবার কিছু লোক বলেন, তিনি গরিবকে টাকার জোগান দিয়েছেন। ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে সুদ দেয়, ফলত সুদ তো আমরা সবাই খাই, ‘je suis সুদখোর’, ইউনুসের কী দোষ গোছের কথাও শোনা যায়। এই লেখার উদ্দেশ্য ইউনুস গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে কত টাকা পেয়েছেন বা টাকা তছরুপ করেছেন সেসবের আলোচনা করা নয়, বরং গ্রামীণ ব্যাঙ্কের মডেলের ক্ষুদ্র-ঋণ প্রকল্পের একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা, যেটার উদ্দেশ্য এটা দেখানো যে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের মডেলকে দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ, বা সমাজসেবা বলাটা সত্যের মারাত্মক অপলাপ।
বাংলাদেশ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সুদের হার কত? উত্তরটা বেশ জটিল, এবং এই জটিলতার কারণ গ্রামীণ থেকে ঋণ নিতে হলে ঋণগ্রহীতাকে সুদ-আসলের বাইরেও গ্রামীণকে নিয়মিত টাকা দিতে হয়। এই টাকাটা গ্রামীণ ঋণের পরিমাণ থেকে কাটে না, ফলত ঘোষিত সুদের হারের তুলনায় বেশি টাকা দিতে হয় ব্যাঙ্কে। সেজন্য সুদের হার কীরকম হবে, সেটা ধারের পরিমাণের সাথে সম্পর্কিত।
কীরকম? সেটা জানতে হলে গ্রামীণের ঋণ দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে দু-চার কথা জানতে হবে। গ্রামীণে কেউ একা ঋণ নিতে পারেন না। একটি গ্রুপের অংশ হিসেবে ঋণ নিতে হয়। সাধারণত পাঁচজনকে নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি হয়। প্রত্যেক গ্রুপের একটি অ্যাকাউন্ট থাকে, যাকে বলে – গ্রুপ ফান্ড অ্যাকাউন্ট (জিএফএ)। সেই জিএফএ-তে প্রতি সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা গ্রুপের প্রতি সদস্যকে দিতে হয়। সেই টাকা গ্রুপের সদস্যরা ১০ বছর পূর্ণ না হলে এবং গ্রুপের সবার সব ধার পরিশোধ না হলে তুলতে পারেন না। এই টাকার ওপরে ঋণগ্রহীতাদের গ্রামীণ বার্ষিক ৮.৫ শতাংশ হারে সুদ দেয়। এর সাথে ঋণগ্রহীতাদের বাধ্যতামূলক ‘ট্রেনিং সেশনে’ যোগ দিতে হয় যার জন্য আলাদা করে ফি দিতে হয়। তার সাথে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্রামীণের ‘স্টক’ কিনতে হয় ঋণগ্রহীতাদের, যে ‘স্টক’ তাঁদের গ্রামীণকে ছাড়া আর কাউকে বেচার অধিকার নেই। যতদিন তাঁরা গ্রামীণের সাথে যুক্ত আছেন ততদিন তাঁরা ওই ‘স্টক’ বেচতে পারবেন না। ২০০৭ সালের আগে ওই ‘স্টক’-এর ওপরে কোনও ডিভিডেন্ট দেওয়া হত না ঋণগ্রহীতাদের। ফলত এই বত্রিশ রকম বাধ্যতামূলক লেনদেন নিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় জুড়ে গ্রামীণের থেকে কত টাকা নেওয়া হয়েছে আর গ্রামীণকে কত টাকা দিতে হচ্ছে তার হিসাব করলে সুদের হারের খতিয়ান মেলে, এবং ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়ায়।
গ্রামীণের ঘোষিত সুদের হারের থেকে বাস্তব সুদের হারের পার্থক্য করে দেয় মূলত গ্রামীণকে এই সুদ-আসলের বাইরে দেওয়া টাকা। একটা কল্পিত উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। মধু যদুর থেকে ১০০০ টাকা ধার নিয়েছে এই শর্তে যে মধু প্রতিদিন যদুকে আসলের ১/৩৬৫ ভাগ ফেরত দেবে। অর্থাৎ ১০০০/৩৬৫ টাকা দেবে, তার সাথে প্রতিদিন ১০০/৩৫৬ টাকা সুদ দেবে। তারও সাথে, বাড়তি ২০০/৩৬৫ টাকা প্রতিদিন মধুকে দিতে হবে ১০ বছরের জন্য। যার থেকে যদু মধুকে ৮.৫/৩৬৫ টাকা ফেরত দেবে। এই সিস্টেমে একবছরে মধুর গড় ধার (১০০০+০)/২=৫০০ টাকা। মধুকে আসল শোধ করা ছাড়াও দিতে হয়েছে (১০০+২০০-৮.৫) = ২৯১.৫ টাকা। অর্থাৎ, খাতায় কলমে মধুর বার্ষিক সুদ ২০ শতাংশ (১০০ টাকা) হলেও, মধুকে আসলে দিতে হয়েছে তার প্রায় তিনগুণ টাকা। এবারে, মধু যদি আগামী বছর আবার হাজার টাকা ধার নেয় যদুর থেকে, তবে সেই টাকার ১৯১.৫ টাকা মধুর নিজের ফান্ডে দেওয়া, যে টাকার ওপরেও মধু যদুকে সুদ দিচ্ছে। অর্থনীতিবিদ কার্ল বর্ডেন গ্রামীণ ব্যাঙ্কের রাজবাড়ি জেলার সেন্টারটির আট বছরের সমস্ত ঋণগ্রহীতার লেনদেনের তথ্য ঘেঁটে একটি গবেষণাপত্র লেখেন, যেটি ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি হিসেব করে দেখান, যদি কেউ ১০ বছর ধরে গ্রামীণ থেকে বার্ষিক ২০০০ টাকা ঋণ নেন এবং নিয়ম করে শোধ করেন, তবে তাঁর গড় বার্ষিক ‘সুদের’ হার হবে ৫৫৬.৪৪%। কিন্তু গ্রামীণের ঋণগ্রহীতারা সচরাচর এভাবে ঋণ নেন না। গ্রামীণের সিস্টেমে ঋণগ্রহীতাদের ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলাটাই রীতি। বর্ডেনের হিসাবে, কেউ যদি প্রথম বছরে ২০০০ টাকা ধার নেন আর প্রতিবছর তাঁর ধারের অংক আগের বছরের চেয়ে হাজার টাকা করে বাড়তে থাকে, তবে ১০ বছরের শেষে তাঁর বার্ষিক সুদের হার হবে ৪৪.১৩%। অর্থাৎ, ঋণের অংক যত বাড়বে, সুদের এফেক্টভ অ্যানুয়াল রেট তত কম হবে। গ্রামীণের লোণ অফিসাররা ঋণগ্রহীতাদের বেশি বেশি করে ধার নিতে বলেন বলে বর্ডেন লিখেছেন। এবং, ওপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট, যে গ্রামীণ থেকে অল্প পরিমাণ ঋণ নিলে তার আর্থিক বোঝা ঋণের পরিমাণের তুলনায় ভয়াবহ। গ্রামীণের জিএফএ থেকে ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ধার ইত্যাদি নিয়ে অবস্থানের কাগজে-কলমে কিছু বদল হলেও শাখাগুলিতে তার বিশেষ প্রভাব পড়েনি বলেই বিভিন্ন গবেষকের মত। বাস্তবিক, গ্রামীণ থেকে যাঁরা ঋণ নেন তাঁরা অনেকেই জানেন না, এই জটিল প্রক্রিয়াতে তাঁদের কী অধিকার আছে, কী তাঁরা পেতে পারেন। তার সাথে, জিএফএ থেকে টাকা তোলা যাবে কি যাবে না তা নিয়ে শেষ কথা বলেন গ্রামীণের অফিসাররা। ১৯৯৮ সালে এই জিএফএ-তে রাখা টাকা ছিল গ্রামীণের মোট ঋণের ৩৮%, অর্থাৎ ঋণগ্রহীতাদের দেওয়া ঋণের টাকার ৩৮% তাঁদের নিজেদেরই টাকা, যা তোলার অধিকার নেই তাঁদের। এবং, গ্রুপের কোনও একজন ঋণ শোধ দিতে না পারলে গোটা গ্রুপের জিএফএ-র টাকা আটকে দেন গ্রামীণের অফিসাররা, কিছু গবেষক এমনও দাবি করেছেন।
গ্রামীণ ব্যাঙ্কের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল, তাদের বেশীরভাগ ঋণ শোধ হয়ে যায়। ২০০১ সালে ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামীণের ‘৯৫% লোন রিপেমেন্ট রেট’- এর দাবিতে জল আছে। গ্রামীণ বেশ কিছু ঋণকে ‘ফ্লেক্সিবল লোন’-এ পরিণত করে। যেমন, এক মহিলা সাপ্তাহিক ২০০ টাকা সুদ দিতে পারছিলেন না। তাগাদা দিয়েও কিছু লাভ হয়নি। তখন গ্রামীণ তাঁকে বলে, আগামী ছয় মাস সপ্তাহে ৫০ টাকা সুদ দিতে, আর তার শেষে আগে যা শোধ দিয়েছিলেন তার দ্বিগুণ ঋণ নিতে। তিনি রাজি হয়ে যান। কিন্তু এধরণের পলিসিতে ধারের বোঝা ক্রমশ বেড়েই চলে, যে ধার ঋণগ্রহীতারা কোনোদিন পুরো শোধ দিয়ে উঠতে পারবেন না।
ওপরের আলোচনা থেকে যে জিনিসটা স্পষ্ট হওয়া উচিত, সেটা হল, গ্রামীণের ঋণগ্রহীতাদের ঋণের মাত্রা সময়ের সাথে সাথে বাড়াটাই নিয়ম। গ্রামীণের কর্মকর্তারাও সেটাই চান। কারণ সত্যি বলতে, চড়া সুদে ক্ষুদ্র-ঋণ দিয়ে দারিদ্র্য ঘোচানো যায় না। জনসাধারণের দরিদ্রতম অংশের থেকে লাভ করা যেতে পারে, স্থানীয় মহাজনদের বদলে আটঘাট বাঁধা ব্যাঙ্ক আসতে পারে, কিন্তু এতে ঋণের জালে বেশি বেশি করে জড়িয়ে পড়া ছাড়া দরিদ্রতম অংশটির বিশেষ কিছু হয় না। এবং এই কথা নতুন কিছু নয়। বরং এর উল্টোটা বলাই মিথ্যাচার। যে মিথ্যাচার বছরের পর বছর ধরে ইউনুস সাহেব এবং তাঁর ক্ষমতাশালী বন্ধুরা করে গেছেন। ইউনুসের মডেলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারও দেওয়া হয়েছে, যা ওবামার মত যুদ্ধবাজও পেয়েছেন। দেশের যাবতীয় সম্পদ ও ক্ষমতা কিছু লোকের কাছে কুক্ষিগত থাকবে, তাঁদের কাছে বাকিদের দরবার করতে হবে একটু স্বাচ্ছল্যের জন্য, এ ব্যবস্থা ঋণ দিয়ে শোধরাবার নয়। সেখানে দরিদ্রতম অংশটির সাথে সুদের ব্যবসাকে দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রক্রিয়া বলে চালানো শুধু মিথ্যা প্রচার নয়, ঘৃণ্য অপরাধ।