ভোট চলে গেল, রয়ে গেল ঘৃণা


  • June 9, 2024
  • (0 Comments)
  • 688 Views

…ক্ষিদে, রোজগার, বাঁচার অধিকারের দাবীকে দিকভ্রান্ত করা যায় না মোষ, মঙ্গলসূত্র হারানোর ভয় দেখিয়ে, নিরন্তর ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে আর আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করে। তাই বহু মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন বিদ্বেষের সংস্কৃতি। লিখলেন শুভজিৎ সিংহ।

 

 

সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের শেষ দু’মাস প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর সভাগুলোর রাজনৈতিক ভাষণে অহিন্দুদের প্রতি ক্রমাগত ঘৃণা বর্ষিত হয়েছিল। দেশের বেহাল আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে সদুত্তর দিতে না পেরে, আশু প্রয়োজন থেকে সাধারণ মানুষের নজর ঘোরাতেই তিনি বিদ্বেষ ছড়ানোর পথ নিয়েছেন বলে মনে করা হয়েছে। ইতিহাস কিন্তু বলে তাঁদের রাজনীতির ভিত্তিই তো ঘৃণা, বিদ্বেষ, সন্ত্রাস, দাঙ্গা, খুন, গণহত্যা। বস্তুত, এদেশে ঘৃণার রাজনীতি আমদানি করেছিল বিজেপির মাতৃ সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস। স্বভাবগত ঘৃণা ভাষণের, বিদ্বেষ, হিংসার সামাজিকীকরণের, দেশময় দাঙ্গা-হানাহানি, হত্যা এবং প্রকাশ্যে অস্বীকার করবার, মিথ্যাচারের এমন এক ঘৃণ্য সংস্কৃতির উৎসমুখ রয়েছে অনেক অতীতে।

 

গত শতকে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ইতালির ফ্যাসিস্ত শাসক বেনিতো মুসোলিনির উত্থান হয়েছিল। কম্যুনিজমের আগ্রাসী বিরোধিতায় ফ্যাসিস্ত মতবাদের উদ্ভব। কয়েক বছরের মধ্যেই একই মতবাদের অনুসারী নাৎসি একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানির একছত্র ক্ষমতা অধিকার। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াইতে প্রতিপক্ষকে নির্যাতন, নিশ্চিহ্ন করার কাজে উভয়েই চালু করলেন ঘৃণার রাজনীতি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছাড়িয়ে জাতি-বিশেষ হয়ে দাঁড়াল স্বৈরাচারী একনায়ক হিটলারের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। ঐতিহ্যবাহী জার্মান আর্য রক্ত এবং সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে ‘অপরায়ন’ করা হল ইহুদিদের, সঙ্গে রোমানি, প্রতিবন্ধী, কালো জার্মান এবং ভিন্ন যৌনতার মানুষদেরও। সরকারী মদতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে সমাজে সফলভাবে প্রচার করা হল তীব্র ঘৃণা, বিদ্বেষ। মানুষকে বিশ্বাস করানো হল, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি জার্মানদের যাবতীয় দুর্দশার মূলে রয়েছে ‘ওরা’। তাই বাঁচার অধিকারটুকুও হারিয়েছে ‘ওরা’। ইহুদিদের জায়গা হল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। অবর্ণনীয় অত্যাচারে, গ্যাস চেম্বারে খতম করা হল ৬০ লক্ষ ইহুদিকে, হত্যা করা হল আরও ৪৬ লক্ষের বেশি রাজনৈতিক বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, রোমানি, এথনিক পোল, প্রতিবন্ধী, কালো জার্মান, এবং ভিন্ন যৌনতার মানুষদের। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত গণহত্যার, গৃহযুদ্ধের সলতে পাকানো হয়েছে নির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ক্ষমতাসীন দলের সরকারী ক্ষমতার মদতে ঘৃণা ভাষণ, বিদ্বেষ এবং মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে। জার্মান হলোকস্টের পরে গত শতকে ঘটে গেছে একের পর এক ভয়ঙ্কর এথনিক গণহত্যা – পূর্ব পাকিস্তানে, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার বসনিয়া-হারজেগভিনায়, রোয়াণ্ডায়, মিয়ানমারে।

 

ইয়োরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থানের সময়ে এদেশেও ঘৃণার রাজনীতির প্রবেশ ঘটল গত শতকে। ১৯২২-এ গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন আকস্মিকভাবে, কংগ্রেস-খিলাফৎ মৈত্রী ভেঙে যাওয়ার পরে ভারতের রাজনৈতিক জীবনে ব্যাপক সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটে গেল এবং দেশজুড়ে অভূতপূর্ব দাঙ্গা সঙ্ঘটিত হল। এমনই এক সময়ে ১৯২৫ সালে নাগপুরে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার পাঁচজন অগ্রণী কর্মী, ডঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের নেতৃত্বে আরও আগ্রাসী ভুমিকায়, সারভারকরের হিন্দুত্বের প্রকল্পটিকে এদেশের মাটিতে বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। সারভারকরের ব্যাখ্যায় হিন্দুত্ব বলতে ঠিক হিন্দুধর্ম নয়, একটি জীবনচর্যা বোঝায়।। তাঁর ‘হিন্দুত্ব: হু ইজ আ হিন্দু?’ বইতে জানিয়েছিলেন, “তিনিই হিন্দু, সিন্ধু থেকে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতবর্ষ যার পিতৃভূমি এবং পুণ্যভুমি।” তাই এদেশীয় মুসলমান এবং খ্রিষ্টানরা ভারতে জন্মালেও যেহেতু তাঁদের পুণ্যভুমি অর্থাৎ তাঁদের ধর্মের উৎপত্তি যথাক্রমে মক্কা এবং বেথলেহেম, তাই তারা কখনই হিন্দু নয়, তারা ভারতীয় জাতীয়তার সংজ্ঞার খোপে ঢুকলো না। কারণ, ভারতীয় জাতীয়তার সঙ্গে হিন্দু শব্দটির অর্থ একাত্মভাবেই দেখতেন তিনি। হিন্দু মহাসভার ‘হিন্দু রাজ’-এর দাবীর উল্লেখযোগ্য উত্তরণ ঘটিয়ে হেডগেওয়ার নিয়ে এলেন ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ দাবী। যে রাষ্ট্র হবে শুধুমাত্র হিন্দুদের। হেডগেওয়ার মুসলমানদের ‘যবন সর্প’ বলে উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে শুরু করলেন তীব্র ঘৃণা-বিদ্বেষের প্রচার, গড়ে তুললেন আগ্রাসী সশস্ত্র হিংস্র স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে নিজস্ব ঠ্যাঙাড়ে মিলিশিয়া। লক্ষণীয়, ভারতের জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনের অভিমুখ ছিল স্বৈরাচারী, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসন এবং ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে। অথচ, দেশ জোড়া সেই উত্তাল সময়ে, ব্রিটিশের পরিবর্তে তারা মুসলমান, খ্রিষ্টানদের এবং কম্যুনিস্টদের মূল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

 

আরএসএসের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নয়, সঙ্ঘের প্রথা অনুযায়ী, মৃত্যুর আগে হেডগেওয়ারই উত্তরসূরী হিসেবে মনোনীত (১৯৩৯) করে গিয়েছিলেন তাঁকে। তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরে গড়ে তুললেন অজস্র শাখা সংগঠন। রাজনৈতিক ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯৫১ সালে গড়ে উঠল তাঁদের রাজনৈতিক শাখা ভারতীয় জনসঙ্ঘ (১৯৮০তে যার ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি নামে পুনরাবির্ভাব ঘটল)। আরএসএসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো নির্দিষ্ট মতবাদের আকারে প্রকাশ করেছিলেন গোলওয়ালকর তাঁর দুটি বই ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ (১৯৩৮) এবং ‘বাঞ্চ অফ থটস ’ (১৯৬৬)-এর মাধ্যমে। দুটি বই-ই আরএসসের সমস্ত সদস্য/কর্মীদের কাছে ‘বেদ’ স্বরূপ। প্রথমোক্ত বইটিতে হিটলারের ভাবনাকে মহিমান্বিত করে তিনি বললেন, “জার্মানি সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে তাদের জাতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং সংস্কৃতির শুদ্ধতা রক্ষার জন্য দেশটাকে সেমিটিক জাতির, অর্থাৎ ইহুদিদের, ক্লেদ মুক্ত করে।” সেই তত্ত্বের ধারাবাহিকতায় হিন্দুদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে অহিন্দুদের ‘অপরায়ন’ করে তিনি জানালেন, “ভারতে বিদেশী জাতির (অর্থাৎ মুসলমান ও খ্রিষ্টান) মানুষদের হিন্দু সংস্কৃতি, ভাষা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে জানতে হবে এবং ভক্তি করতে হবে। তাদের পৃথক অস্তিত্ত্ব পরিহার করে হিন্দু জাতিগোষ্ঠীতে বিলীন হয়ে যেতে হবে কিংবা হিন্দু জাতির পূর্ণ বশ্যতা মেনে নিয়ে এদেশে থাকতে হবে। তাদের কোনও কিছু দাবি থাকা বা বিশেষাধিকার থাকা চলবে না, এমন কি নাগরিক অধিকারও থাকবে না তাদের” (২০০৬ সালে, আরএসএস, তাদের অস্বীকার করার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জানায়, বইটি নাকি গোলওয়ালকরের লেখা নয়। যদিও গবেষক, লেখক ধীরেন্দ্র ঝা প্রমাণ করে দিয়েছেন, এটি ছিল তাঁরই লেখা )। ‘বাঞ্চ অফ থটস ’ বইটিতে তিনি, মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং কম্যুনিস্টদের দেশের আভ্যন্তরীণ বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করে বললেন, “মুসলমান মাত্রেই পাকিস্তানের সমর্থক, তাদের একটি বৃহৎ অংশ এদেশে এখনও রয়ে গেছে, কিন্তু তারা কখনও দেশপ্রেমিক হতে পারবে না। মুসলমানরা এদেশে এসেছে আক্রমণকারী হিসেবে আর খ্রিষ্টানরা এসেছে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে”। “দেশের ভেতর বহু মুসলমান পকেট অর্থাৎ ক্ষুদ্র পাকিস্তানের সংস্করণ গড়ে উঠেছে, যেখানে কোনও মুসলমান মহল্লা বা মসজিদ আছে সেটাকে তারা নিজের দেশ মনে করে, সেখান দিয়ে গান গাইতে গাইতে বা বাজনা বাজিয়ে হিন্দুরা কোনও শোভাযাত্রা নিয়ে গেলে তারা রুষ্ট হয়।” স্বাধীনতার প্রাক মুহূর্তে ভয়াবহ দাঙ্গায় ভিটে-মাটি, আপনজন, শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বহু মানুষের জীবনে। কিন্তু, গোলওয়ালকরের মতে, “এই দাঙ্গা মুসলমানদেরই পরিকল্পিত, যা নাকি বিগত বারোশ বছরের মুসলমান আক্রমণের ধারাবাহিকতারই ফলশ্রুতি।” তিনি আরও বলেন, “খ্রিষ্টানরা মানবসেবার আড়ালে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যেই এদেশে এসেছিল।” তাঁর মতে, “কম্যুনিজম বিদেশী ধারণা, এদেশের জাতীয়তার হাজার বছরের পরম্পরা, আদর্শের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই, কম্যুনিস্টরা মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বলে, অধিকারের কথা বলে, যা বিশ্বাসকে বিনষ্ট করে, বিশ্বাস হারিয়ে গেলে কম্যুনিজম আসে’। মুসলমান, খ্রিষ্টানদের মতো কম্যুনিস্টদেরও নিকেশ করতে হবে, তাই এবারের বিজেপির ম্যানিফেস্টোতেই বলা হয়েছে, “নকশালবাদকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।” সেই সঙ্গে উল্লেখ রাখা জরুরী, উপমহাদেশের হাজার বছরের অস্পৃশ্যতাকে বিরোধিতা করে না আরএসএস, তারা মনে করে বর্ণব্যবস্থা ঈশ্বরের সৃষ্টি, পূর্বজন্মের কর্মফলে মানুষের জন্ম, তাই তার দায়িত্বও ঈশ্বর নির্দিষ্ট। সেজন্যই ব্রাহ্মণের দায়িত্ব বেদ পাঠ, পূজার্চনা; একইভাবে, তিন উচ্চ বর্ণের সেবার জন্য ঈশ্বর নির্দেশিত দায়িত্ব শূদ্রের। দলিতের প্রতি বিকারগ্রস্ত ঘৃণা আরএসরসের মজ্জায়, বিবৃত করেছেন প্রাক্তন দলিত আরএসএস কর্মী ভাঁওয়ার মেঘবংশী তাঁর স্মৃতিকথায় (‘ম্যায় এক স্বয়ংসেবক থা ’)।

 

সাভারকরের ভাবনার অনুসারী আরএসএসও বিপদে পড়লে বা রাজনৈতিক সুবিধা নিতে বার বার ক্ষমা ভিক্ষা করেছে, মুচলেকা দিয়েছে, মিথ্যা কথা বলেছে, ভুয়ো তথ্য দিয়ে সরকারকে ধোঁকা দিয়েছে। তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তারা যা বলে কখনই বাস্তবে তা করে না, আর যা বাস্তবে করে তা অবশ্যই অস্বীকার করে, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্যের সঙ্গে ঘোষিত উদ্দেশ্যের সম্পর্ক সামান্যই। শুরু থেকেই তাদের কাজকর্ম ছিল ধোঁয়াটে, আধা-গোপন। ইতিহাসে দেখা গেছে পৃথিবীর সকল জঙ্গি সংগঠনগুলো এমন গোপন কাজকর্মেই অভ্যস্ত। মহাত্মা গান্ধী তাদের বিশ্বাস করতেন না, তাদের সঙ্গে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ত এবং হিটলারের নাৎসি সংগঠনের সঙ্গে তুলনা করে তিনি তাদের একনায়কতন্ত্রী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন সাম্প্রদায়িক সংগঠন বলে মনে করতেন। গান্ধীর অহিংসার তত্ত্বকে কাপুরুষতা, ভণ্ডামি  বলে অভিহিত করেছিলেন গোলওয়ালকর। জওহরলাল নেহরু ১৯৫৮ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সভায় জানিয়েছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতার চেয়েও ভয়ঙ্কর। যখন সংখ্যালঘু সংগঠন সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে তখন আমরা তা দেখতে পাই, বুঝতে পারি, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতা সহজেই জাতীয়তাবাদ বলে চালান যায়।” পরবর্তীকালে, সরকারী উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের এক সভায় তিনি বলেছিলেন, “কম্যুনিজম নয়, দক্ষিনপন্থী হিন্দু সাম্প্রাদায়িকতাই হবে ভারতবর্ষের সংকটের কারণ।” তাঁদের দূরদৃষ্টি সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মহাত্মা এবং নেহরুর তীব্র বিরোধী আরএসএস, বিজেপি।

 

ইতিহাস বলে জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের ও দেশ ভাগের প্রস্তাবের বিরোধিতায় জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সিন্ধের আল্লা বক্স (খুন করা হয় মুসলিম লীগের মদতে), আজমগরের শিবলী নোমানী, দিল্লির হসরত মোহানি, মুখতার আহমদ আনসারী, শওকতউল্লা আনসারী প্রমুখ বহু মুসলমান রাজনৈতিক নেতা। স্বাধীনতা আন্দোলনে চিরস্থায়ী ভুমিকা রেখে গেছেন খান আব্দুল গফফর খান, শহিদ হয়েছেন আসফাকুল্লা খান, আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব দিয়েছেন শাহনওয়াজ খান, আরও অনেক মুসলমান ব্যক্তিত্ব।

 

পাশাপাশি স্মরণীয় থাকবেন, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, হরেন্দ্রকুমার মুখার্জি, কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি, ভেঙ্কল চাক্কারাই ইত্যাদি আরও ভারতীয় খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী মানুষ। বিপরীতে আরএসএসের, হিন্দুত্ববাদীদের একজনকেও দেখা যায়নি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও ভূমিকায়। বরং তাঁরা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক, সরে ছিলেন সমস্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে। স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়ে, ১৯৩৯ সালে, একদা আরএসএস কর্মী জি এম হুডারের মাধ্যমে, দুবার হেডগেওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়ে ব্যর্থ হন স্বয়ং নেতাজি। তাঁরা তখন ব্যস্ত ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দমনে, বিপ্লবীদের ধরিয়ে দিয়ে সরকারকে সাহায্য করতে। লক্ষণীয়, অন্যান্য হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক দলগুলোর মতো আরএসএস কখনও ব্রিটিশ নির্যাতনের শিকার হয়নি।

 

আরএসএসে হেডগেওয়ার মূলত নবীনদের সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করতেন। তাদের শরীরচর্চা, অস্ত্র প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বৌদ্ধিক ক্লাসও নেওয়া হত, যেখানে মুসলমানদের বর্বর, আক্রমণকারী, লুঠেরা বলে চিত্রিত করার পাশাপাশি, তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে হিন্দু রাজা রানা প্রতাপ, শিবাজির বীরত্বের গল্প শোনানো হত। তাঁদের ভাষ্যে, হাজার বছর ধরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের অবিরাম সংগ্রামই ভারতীয় ইতিহাসের ভিত্তি। চিত্রনির্মাতা ললিত ভাচানি তাঁর ‘বয়েজ ইন দ্য ব্রাঞ্চ’ তথ্যচিত্রে দেখিয়েছেন কীভাবে শিশু-কিশোরদের আরএসএসের শাখায় প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। তীব্র ঘৃণার বিষাক্ত ভাবনায় সম্পৃক্ত করানো হয় বিকশিত হতে থাকা তাদের শিশুমন। যে বিষ তারা বহন করে চলে বাকি জীবন। প্রথম থেকেই আরএসএসের অস্ত্র প্রশিক্ষিত যুবকেরা নাগপুর শহরে ছোটখাটো দাঙ্গায় হাত পাকিয়েছিল । শহরের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্বেষ এবং ভুয়ো অভিযোগ ছড়ানোর কাজ করে যেত। নমাজের সময় মসজিদগুলোর পাশ দিয়ে দল বেঁধে ঢোল, বাজনা সহযোগে গান করতে করতে মিছিল করত, একাজে হেডগেওয়ার নিজে নেতৃত্ব দিতেন। তাঁর জীবনীকার, অন্যতম প্রচারক সি পি ভিশিকর, গর্বের সঙ্গেই সে কথা লিখে গেছেন। পরবর্তীকালে, এই কুকর্মটি অন্যতম কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে আরএসএসের সমস্ত শাখা সংগঠনে। তারা পরিকল্পনামাফিকই ধর্মীয় শোভাযাত্রা (বিশেষত রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষে) নিয়ে মুসলমান বসতি, মসজিদের পাশ দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে ডিজে বাজিয়ে, হিংসাত্মক, উশকানিমূলক স্লোগান দিতে দিতে যায় এবং সামান্যতম প্রতিক্রিয়াকেই ছুতো হিসেবে ব্যবহার করে পূর্বপরিকল্পিত আক্রমণ চালাতে থাকে, কোনও সময়ে যা দাঙ্গায়ও পরিণত হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে হিটলারের জার্মানিতেও ঠিক এমনভাবে ইহুদি পাড়ার মধ্যে দিয়ে মার্চ করে যেত নাৎসি মিলিশিয়া বাহিনী, পুড়িয়ে দেওয়া হত ইহুদিদের সিনাগগ।

 

১৯৩৩-এ ব্রিটিশ ভারতের গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, “আরএসএস-এ তার যুবকদের লাঠি, ছোরা, তরোয়ালসহ বন্দুক চালানোর ট্রেনিংও দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে তারা ইতালির ফ্যাসিস্ত বা জার্মানির নাৎসির ভুমিকা নেবে।” ১৯৪২-এর দেশজোড়া আন্দোলনের ঢেউয়ে দেখা না গেলেও, ১৯৪৬-৪৭-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে আগ্রাসী হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপে দেখা গিয়েছিল তাদের। উত্তরপ্রদেশের প্রথম মুখ্যসচিব রাজেশ্বর দয়াল তাঁর আত্মজীবনী, ‘এ লাইফ অফ আওয়ার টাইমস’-এ (পৃঃ ৯৩-৯৪) জানিয়েছেন, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে গোলওয়ালকরের পরিকল্পনায় এক ভয়ঙ্কর গণহত্যার ছক, বিপুল তথ্যপ্রমাণসহ, তদন্তে ধরা পড়ার পর তিনি মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থকে জানান দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে দেরি করায় গোলওয়ালকর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। তার কিছুদিনের মধ্যেই গান্ধীকে হত্যা করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় আরএসএসকে, কয়েক মাস পড়ে তা তুলে নেওয়া হলেও, কিছুদিন প্রবল জনরোষ এবং সাংগঠনিক সমস্যায় তাদের কাজকর্মে ভাঁটা পড়ে। ১৯৬০-এর দশক থেকে দেশময় একের পর এক দাঙ্গায় তাদের সক্রিয়তা দেখা যেতে থাকে। সম্প্রতি এক আরটিআই প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, ১৯৬১ থেকে ঘটে যাওয়া বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের রিপোর্টগুলো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে বেহদিশ। এস ডি শ্রীবাস্তব কমিশন (১৯৬১), দয়াল কমিশন (১৯৬৭), রেড্ডি কমিশন (১৯৬৯), থায়াথিল কমিশন (১৯৭১), জিতেন্দ্র নারায়ন কমিশন (১৯৭৯), বেনুগোপাল কমিশন (১৯৮২), দাভে কমিশন (১৯৮৫) ইত্যাদি তেরটি কমিশনের রিপোর্টে আরএসএস এবং তার নানান শাখা সংগঠনের সহিংসতার স্পষ্ট উল্লেখ ছিল। ক্ষমতায় এসে সমস্ত পূর্ব কুকর্মের নিদর্শন লোপাট করে দেওয়াটাই অপরাধী মনস্তত্ত্বে স্বাভাবিক।

 

১৯৯০-এর দশকে রামমন্দির আন্দোলনে গতি আনতে, হাজার হাজার মানুষের রক্ত, মৃতদেহ মাড়িয়ে রথযাত্রা করেছিলেন আজকের ভারতরত্ন। বর্তমান শতকের প্রথম দশকে, শাখা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে পুণে, নাগপুর, ভোপাল, মুম্বই, পাঁচমাঢ়ী ইত্যাদি বহু স্থানে তাদের অজস্র অস্ত্র প্রশিক্ষণ, বিস্ফোরক তৈরি শেখানোর শিবিরের তথ্য প্রকাশিত হয়। আজমের শরীফ (২০০৭), মক্কা মসজিদ (২০০৭), সমঝোতা এক্সপ্রেস (২০০৭), মালেগাঁও (২০০৬ এবং ২০০৮) এবং আরও বহু জায়গায় ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে মারা যায় বহু মানুষ। বিদেশের বহু সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে তাদের গভীর যোগাযোগের তথ্য-প্রমাণ তদন্তে উঠে এসেছে। মুসলমানদের সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রের গল্প প্রচার করে বহু নিরপরাধ মানুষকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়, অবশেষে হিন্দুত্ববাদীদের মূল অপরাধীরা ধরা পড়ে। মুখ্য পরিকল্পক স্বামী অসীমানন্দ (আরএসএসের বনবাসী চেতনা আশ্রমের সংগঠক) আদালতে স্বীকারোক্তি দেন১০ আর এক গুরুত্বপূর্ণ অপরাধী সাধ্বী প্রজ্ঞা ছিলেন বিজেপির অন্যতম সংসদ সদস্য (২০১৯)। ২০০২-এর গুজরাতে মুসলমান গণহত্যায়, সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে, তাদের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার কথা বিবৃত হয়েছে গুজরাত পুলিশের তদানীন্তন উচ্চপদস্থ আধিকারিক আর বি শ্রীকুমারের বিস্তারিত বিবরণী এবং সাংবাদিক আশীষ খেতানের তথ্যানুসন্ধানী রিপোর্টে।১১ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই ২০২২-এর ডিসেম্বরে সংসদে জানিয়েছেন ২০১৭ থেকে ২০২১-এর মধ্যে সারা দেশে ২,৯০০ সাম্প্রদায়িক তথা ধর্মীয় সংঘর্ষ হয়েছে। তার কয়েকদিন বাদেই বর্তমান সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত সাক্ষাৎকারে বললেন, “হিন্দু সমাজ হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করে চলেছে, এটা স্বাভাবিক যে তারা এখন আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে।”১২ যদিও, হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও, আরএসএস-বিজেপির রাজনীতির সক্রিয় বিরোধিতা করার জন্য খুন করা হয়েছে রামমন্দিরের সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত প্রধান পুরোহিত মহন্ত লাল দাসকে, কারণ তিনি রামমন্দিরকে রাজনীতির ইস্যু হতে দিতে নারাজ ছিলেন। গুপ্তহত্যার বলি হয়েছেন বিজেপিরই প্রবীণ রাজনীতিক হরেন পাণ্ড্য (২০০৩), কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের মুখ নরেন্দ্র দাভোলকর (২০১৩), গোবিন্দ পানেসর (২০১৫), এম এম কালবুর্গী (২০১৫), সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ (২০১৭), এমন কি আরএসএস কর্মী, বিস্ফোরণগুলিতে অভিযুক্ত, সুনীল জোশী (২০০৭) – তালিকা দীর্ঘ। সাম্প্রতিককালে ইজরায়েলের মোসাদের মতো তারা বিদেশের মাটিতেও গুপ্তহত্যা করায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে।

 

এমন বহু তথ্য প্রমাণে নিশ্চিত হওয়া যায়, আরএসএসের ধারাবাহিক শিক্ষায় বেড়ে ওঠা প্রত্যেক কর্মীর চেতনায় ঘৃণা, বিদ্বেষ নিতান্তই স্বাভাবিক, সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মে কতটা পারদর্শী তারা। তাদের অজস্র শাখা সংগঠনগুলির দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় ঘৃণা-বিদ্বেষের বাতাবরণ অত্যন্ত সফলভাবে, বিশেষত, পশ্চিম এবং উত্তর ভারত এবং অন্যান্য বিস্তীর্ণ ভূমির গণচেতনায় জায়গা করে নিয়েছে। রাজস্থানের রাজসমন্দে, গত ২০১৭-এর ডিসেম্বরে পরিযায়ী শ্রমিক পশ্চিমবঙ্গের আফরাজুল সেখকে নৃশংসভাবে হত্যাকারী শম্ভুলাল রেগরের হাড়হিম করা স্বীকারোক্তি ছিল, “হিন্দু মহিলাদের লাভ-জেহাদ থেকে বাঁচাতে” সে এই নিরীহ মুসলমান মানুষটিকে হত্যা করেছে”১৩। মনে আছে, ১৯৯৯-এর ২২ জানুয়ারির রাতে খৃষ্টান মিশনারি গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনসকে তাঁর দুই শিশুপুত্র সমেত জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার মূল অপরাধী দারা সিং এক সাক্ষাৎকারে নির্দ্বিধায় জানিয়েছিল, নৃশংস শিশুহত্যার ওই ঘটনার জন্য সে একটুও দুঃখিত নয়, যা হয়েছে ঠিক হয়েছে।১৪ গডসেও গান্ধী হত্যায় একটুও অনুতপ্ত ছিল না। মহাকাব্যে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল রামের, হিন্দুত্ববাদীদের ভাষ্যে তা পরিবর্তিত হয়ে আজ সে যুদ্ধ কেমন করে যেন হয়ে উঠেছে, বাবরের সন্তানদের বিরুদ্ধে রামের সন্তানদের (বাবর কি অওলাদ কে সাথ রাম কি অওলাদ)। বিভিন্ন প্রদেশে এবং কেন্দ্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে একের পর এক সংবিধান বিরোধী আইন প্রণয়ন করে, প্রশাসনিক মদতের সঙ্গে গড়ে তোলা নিজস্ব গুন্ডাবাহিনী দিয়ে অহিন্দুদের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ আরও তীব্র হয়েছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোয় মুসলমান জনজীবন ধ্বংস করতে চালু হয়েছে বুলডোজারতন্ত্র। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে (বুলডোজার ইনজাস্টিস ইন ইন্ডিয়া, ২০২৪) উঠে এসেছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বিচার-বহির্ভূত ক্ষমতা ব্যবহার করে মুসলমান মানুষদের বাসস্থান, ব্যবসা, উপাসনাস্থল ধ্বংস করার ভয়াবহ চিত্র। আবার কখনও বজরং দল, কখনও হিন্দু গৌরব মহাসভা ইত্যাদি আরএসএস সৃষ্ট গুন্ডাবাহিনী দেশ জুড়ে খ্রিষ্টান মানুষদের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে, প্রশাসনের সক্রিয় সহযোগিতায় জেলে পুরে, একের পর এক চার্চ ধ্বংস করে (চার্চ অ্যান্ড স্টেট’, ক্যারাভ্যান, মে ২০২৪)। সাংবিধানিকভাবে এখনও পেরে না উঠলেও, প্রশাসনিকভাবে এক হিংসাশ্রয়ী হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে দ্রুত ধাবিত হয়েছে তারা।

 

নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের উদগ্র বাসনায়, মানুষের আশু প্রয়োজনীয় খাদ্য, পরিস্রুত পানীয়, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যের প্রয়োজন ভুলিয়ে দিতে, দীর্ঘ ৬৫ বছর ঘৃণার পাঠ নেওয়া আরএসএসের অন্যতম প্রচারক, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে অহিন্দুদের প্রতি গভীর ঘৃণা, বিদ্বেষ। নির্বাচন শেষ হয়েছে, বিদ্বেষ বিষ ভোলাতে পারেনি আম মানুষের পেটের ক্ষিদে। খানিক থমকেছে ঘৃণার কারবারিদের একচেটিয়া দেশ দখলের আশু পরিকল্পনা। তবে, প্রধানমন্ত্রী শপথ নেওয়ার আগেই, বিদ্বেষ আরও আগ্রাসী, হিংসা আরও তীব্র হয়েছে।  ছত্তিসগড়ে স্বঘোষিত গোরক্ষক দুর্বৃত্তদল পিটিয়ে মেরেছে মোষ বহনকারী দুই মুসলমান যুবককে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ০৬/০৬/২০২৪)। পরের দিনই (০৭/০৬/২০২৪), উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়ে খুন হয়েছেন মাদ্রাসার পরিচালক মৌলানা ফারুখ (ইটিভি ভারত, ০৮/০৬/২৪)। যা আগামীদিনের আরও ভয়ঙ্কর হানাহানি, দাঙ্গার ইঙ্গিত বহন করছে।

 

বৈচিত্রময় ভারতভূমে বহু সংস্কৃতির, বহু ধর্মের, বহু ভাষার, বহু আচারের নাগরিকদের বিশেষ মাসে আমিষ খাওয়ার বিরুদ্ধে হুমকির মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয় প্রবল কর্তৃত্ববাদী, হিংসাশ্রয়ী ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থানে’র আগামী প্রকল্পের রণহুঙ্কার। সে ভাবনার কথা আরও নিশ্চিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিবেক দেবরায়ের প্রবন্ধে১৫, বিজেপির একাধিক সংসদ সদস্যের ভাষ্যে১৬, বেনারসে হিন্দু ধর্ম সংসদের বক্তব্যে১৭। আত্মনির্ভর নতুন ভারত গড়তে “অতিরিক্ত গণতন্ত্রই বাধা”, বলেছিলেন নীতি আয়োগ প্রধান অমিতাভ কান্ত।১৮ তাই, তাঁদের প্রকল্পিত নতুন ভারতের সংবিধানের মূল লক্ষ্য থাকবে কেন্দ্রীভূত বিপুল ক্ষমতার, ব্রাহ্মণ্যবাদী, পরাক্রমশালী, সামরিকীকৃত এক হিন্দু রাষ্ট্রের, যেখানে অহিন্দু, অবর্ণ মানুষদের থাকবে না কোনও অধিকার। বস্তুত, ‘গণতন্ত্র’, ‘ব্যক্তি-স্বাধীনতা’, ‘মানবাধিকার’ এসব তত্ত্ব পশ্চিমী সংস্কৃতি বলে মনে করেন তাঁরা, তাই তাঁদের প্রকল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রের আদর্শে কোনও ঠাই নেই তার। বাঁচার অধিকার, খাদ্যের, রোজগারের, বাসস্থানের, স্বাস্থ্যের, শিক্ষার অধিকার নয়, নাগরিকদের থাকবে শুধু রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য আর রাষ্ট্র-নায়কের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য, নচেৎ তারা হবে রাষ্ট্রদ্রোহী। একই কথা মুসোলিনিও বলেছিলেন তাঁর ‘ডকট্রিন অফ ফ্যাসিজম’-এ। আর নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল তো জানিয়েই দিয়েছেন, ভিন্ন-স্বরের নাগরিক সমাজই রাষ্ট্রের নতুন যুদ্ধক্ষেত্রের শত্রুপক্ষ।১৯

 

মুশকিল হল, ক্ষুধার রাজ্যে পূর্ণিমার চাঁদকেও ঝলসানো রুটি মনে হয়। তাই, ক্ষিদে, রোজগার, বাঁচার অধিকারের দাবীকে দিকভ্রান্ত করা যায় না মোষ, মঙ্গলসূত্র হারানোর ভয় দেখিয়ে, নিরন্তর ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে আর আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করে। তাই বহু মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন বিদ্বেষের সংস্কৃতি। দেশের ৭৪ শতাংশ মানুষ কোনক্রমে এক বেলা আহার জোটাতে সক্ষম হন। বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে ‘গণতন্ত্রের মা’ পৌঁছে যান ১২৩ জনের সারিতে ১১১তম স্থানে।

 

বহুদিন আগেই তো বাবাসাহেব আম্বেদকরের সতর্কবাণী ছিল,

If Hindu Raj does become a fact, It will, no doubt, be the greatest calamity for this country…. Hindu Raj must be prevented at any cost.২০

 

সুত্র:

 

(১) হলোকস্ট এনসাইক্লোপিডিয়া

(২) খাকি প্যান্ট গেরুয়া ঝাণ্ডা – তপন বসু, প্রদীপ দত্ত, সুমিত সরকার, তনিকা সরকার, সম্বুদ্ধ সেন

(৩) উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড

(৪) গুরুজি’স লাই, ক্যারাভ্যান, আগস্ট, ২০২১

(৫) বাঞ্চ অফ থটস (বাংলা অনুবাদে ‘চিন্তাচয়ন’)

(৬) দ্য গ্রেট বিট্রেয়াল, ক্যারাভ্যান, জুলাই, ২০২৩

(৭) গডসে’স চিলড্রেন, সুভাষ ঘাটাদে

(৮) ইনকুয়ারি রিপোর্টস অন ১৩ কম্যুনাল রায়টস সিন্স ১৯৬১ ‘নট অ্যাভেলেবল’, দ্য ইকনমিক টাইমস, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

(৯) এস এম মুশরিফ, ব্রাহ্মিনিস্টস বম্বড, মুসলিমস হ্যাংড

(১০) দ্য বিলিভার, ক্যারাভ্যান,জুলাই, ২০১৪

(১১) আর বি শ্রীকুমার, গুজরাত বিহাইনড দ্য কার্টেন; আশীষ খেতান, আন্ডারকভার

(১২) হিন্দু সোসাইটি ইজ অ্যাট ওয়ার, ন্যাচারাল ফর পিপল টু বি অ্যাগ্রেসিভ: মোহন ভাগবত, দ্য ওয়্যার, ১১ জানুয়ারি, ২০২৩

(১৩) অ্যাজ ফিল্মড মার্ডার অফ মুসলিম ম্যান ইন রাজস্থান গোজ ভাইরাল, দ্য ওয়্যার, ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৭

(১৪) “আই অ্যাম প্রিপেয়ারড টু বি এ মার্টার ফর দ্য কজ অফ হিন্দুজ”: দারা সিং, ২২ মে ২০০০

(১৫) দেয়ারস এ কেস ফর উই দ্য পিপল টু এমব্রেস এ নিউ কন্সটিটিউশন, বিবেক দেবরায়, লাইভ মিনট, ১৪ আগস্ট ২০২৩

(১৬) অনন্ত হেগরে স্টার্স অ্যানাদার কনট্রোভারসি… দ্য হিন্দু, ১০ মার্চ ২০২৪; টাইমস অফ ইন্ডিয়া ১৫ এপ্রিল ২০২৪, দ্য ওয়্যার ০৮ মে ২০২৪

(১৭) হিন্দু রাষ্ট্র ড্রাফ্‌ট প্রোপোজেস বারাণসী অ্যাজ ক্যাপিটাল, হিন্দুস্থান টাইমস, ১৩ আগস্ট ২০২৩

(১৮) উই আর অফ টু মাচ অফ ডেমোক্রেসি: নীতি আয়োগ চিফ অমিতাভ কান্ত’স উইসডম, দ্য ইনডিয়ান এক্সপ্রেস, ০৯ ডিসেম্বর ২০২০

(১৯) সিভিল সোসাইটি, দ্য নিউ ফ্রন্টিয়ারস অফ ওয়ার: অজিত ডোভাল, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১২ নভেম্বর, ২০২১

(২০) B.R. Ambedkar, Pakistan or the Partition of India, 1946

 

 

Share this
Leave a Comment